টুকরো স্মৃতিগুলো
শৈশবের কত স্মৃতি আজও ভাবায়, কিছু সুখ আর কিছু দুঃখ স্মৃতি সবই হারালো সময়ের থাবায়। শৈশবের কিছু কথা কিছু গানে ছিল ভুলভাল উচ্চারণ, যৌবনে এসে শুদ্ধ করে করে করি স্মৃতিচারণ। এই যে সময়ের ঘুর্ণিপাকে ঘুরে ঘুরে আজ এখানে, এখানে কী মন চায় থাকি, ইচ্ছে চলে যাই শৈশবের টানে।
০১। তখন আমি ক্লাস টু অথবা থ্রিতে পড়ি। আমাদের ছিল তখন হারিকেন সন্ধ্যা। শীতল পাটি বিছিয়ে পড়াশোনার আসর বসতো। আধো ঘুম চোখে বইয়ের অক্ষর ঝাপসা, ইশার আযানের অপেক্ষায় বসে থাকতে হতো হারিকেনের আলোয়। সেদিনও আমরা ভাই বোনের হারিকেন নিয়ে পাটিতে বসে পড়াশোনা করার জন্য সবে বসেছিলাম। সন্ধ্যা তাইতো দরজাটা ছিল খোলা। আম্মা আর দাদী বিছানায় বসে পান খাচ্ছিলেন।
আমার আব্বা সেনাবাহিনীতে জব করতেন। তখন আব্বা ঢাকায়। আমরা ভাইবোন আর দাদী আর আম্মাই থাকতাম বাড়ীতে। আব্বা যেহেতু সেই যুগে চাকুরীজীবী । মানুষের ধারণা আমাদের সম্পর্কে একটু অন্যরকম ছিল মানে টাকা পয়সার অভাব নেই মনে করত।
সেদিন আমরা পড়তেছি জোরে জোরে। ঠিক সেই মুহূর্তে আট দশজন ব্যাটা লোক হইহই করে রাম দা হাতে ঘরে ঢুকে পড়লো। এখনো স্পষ্ট মনে আছে এক ডাকাত আম্মার ঘাড়ে রামদা ধরে বলে কেউ চিল্লাইবা না, চিল্লাইলে গলা কাইট্টা ফেলমু। আরেকজন ছিল দাদীর কাছে ইয়া লম্বা দাও হাতে। তখন বাকী ডাকাত'রা সব জিনিস তছনছ করা শুরু করলো। আম্মার গলার চেইনটা নিল। আম্মা একটা ডাইরীর ভিতর ১৫০০ টাকা রাখছিল বেটারা সেই টাকাটা নিয়ে নিল। আমরা হা করে তাকিয়ে আছি, ভয়ে গলা দিয়ে শব্দও বেরোয় না। ধারণাই ছিল না আমরা বাঁচবো কিনা, রাম দা দেখে গলা শুকিয়ে গেছে । (বড় দা কে কী বলে জানি না, আমরা রাম দা বলতাম)
আমরা যে ঘরে থাকতাম, সে ঘরটা আমার চাচাদের ঘরের থেকে একটু দূরে, একটু সুনসান জায়গা। তো যখন ডাকাতরা রুমে রুমে জিনিসপত্র উল্টা পাল্টা করতেছে ঠিক তখনই আমার এক ফুফাতো বোন দরজা খোলা পেয়ে ঢুকেই মামী বলে ডাক দিল। এক ডাকাত তাৎক্ষণিক ফুফাতো বোনের গলায় রাম দা ধরে বলে এই চুপ, তখন তার কানের দুল টেনে খুলে নিয়ে নিল। অবশ্য বোনের কানের দুলটা ছিল ইমিটেশনের। হাতে নিয়ে দেখলো এটা স্বর্ণের না। এ নিয়ে ডাকাতদের কথাবার্তার ফাঁকে ফুফাতো বোন এমন দৌঁড় দিল , ডাকাতরা তাকে ধরতে পারেনি। সে বের হয়েই চিৎকার অই মামুরে নিতাছে গা, মামুরে নিতাছেগা। এই চিৎকার শুনে বাড়ীর চাচা, চাচাতো ভাইয়েরা আমাদের ঘরে না এসে গ্রামের দিকে দৌঁড়ানি শুরু করলো আর ডাকাতরা গেল ভেগে। সবাই ভাবছে আব্বার উপরে বিপদ আসছে। কারণ আব্বার বাড়িতে আসার কথা ছিল সেদিন বৃহস্পতিবার। আব্বাকে কোথাও না পেয়ে তখন সবাই আমাদের ঘরে আসলো তখন দেখলো আসল কাহিনী কী। সবাই ফুফাতো বোন ধমক দিতে থাকলো, কারণ সে ডাকাতি হইতাছে না বলে বলেছিল মামুরে নিতাছে গা।
মধ্যরাতে আব্বা আসেন বাড়ীতে । পরের দিন থানায় কেস করা হলে পুলিশ এসেছিল। মাইগ্গো পুলিশ দেইখা আরও ভয় পাইছিলাম। ডাকাতদের হদিস পাওয়া গেছিল শেষে। গ্রামের পরিচিতজনই ছিল। কিন্তু মালামাল উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ । সেদিনের ভয়ের মুহূর্তটি মনে হলে গায়ে আজও কাঁটা দিয়ে উঠে।
০২। অতীতে মানে আমার শৈশব কৈশোর বেলায় গ্রামে কেবল চুরিই হইতো। বাহিরে কিছুই রাখা যেত না। তাছাড়া মাটির ঘর কেটে ঘরে ঢুকে পড়তো চুরেরা। আমাদের ঘরে অসংখ্য বার চোরেরা হানা দিয়েছে। অনেক জিনিসপত্র চুরি হইছে। এত কাহিনী বললে আপনারা বিরক্ত হই যাইবেন।
একদিন আম্মা নানা বাড়ী গেলেন আমাদেরকে রেখে। ঘরে চাচাতো ভাইকে বলেছিলেন রাতে ঘুমাতে। তো মধ্যরাতে হঠাৎ আমাদের পালা কুকুরের হাউকাউ শুনে ঘুম ভেঙ্গে যায়। লাইট জ্বালিয়ে দরজার সামনে গেলাম, শুনলাম কুকুরটা সেখানেই ডাকছে। পূর্বের দরজা ছেড়ে পশ্চিমে আসছি ওমা কুকুর দেখি সেই দরজার কাছে ডাকছে । তার মানে চোর বুঝতে পেরেছে আমরা জেগেছি। তাই দরজা খুললেই তারা ঢুকে পড়বে। এমতাবস্থায় আরেক দরজার সামনে গিয়ে দেখি চাঁদনি রাতের আলো দেখা যাচ্ছে, ব্যাপার কী কেন আলো আসতেছে বাহির থেকে। কাছে গিয়ে দেখি দরজাটাকে ড্রিল মেশিন দিয়া ছিদ্র কইরা ঝাঁঝরা কইরা ফালাইছে। ঘর হতেই আমরা চিৎকার শুরু করলে চাচারা আর ভাইয়েরা ছুটে আসে আর চোরেরা ভেগে যায়। সেদিন বড় অঘটন ঘটে নাই আলহামদুলিল্লাহ। সেদিনও কেইস করেছিলাম আমরা পুলিশও আসে। তখন আর পুলিশরে ডরাই না। তাদেরকে ড্রয়িং রুমে বসাইয়া চাও খাওয়াছি। তখন হয়তো টেনে পড়ি। কিন্তু চোর কে, বের করতে পারেনি।
০৩। তখনকার দিনে ধান কাটার মৌসুমে ভাটি থেকে অনেক মহিলা পুরুষ স্বপরিবারে আমাদের এখানে চলে আসতো । আমাদের বাড়ীর প্রত্যেকেই পরিবারই এদেরকে রাখতেন ধান কাটার সাহায্যের জন্য। সেজন্য বাড়ির অপর পাশে তাদের জন্য ঘর বাঁধাই থাকতো।
একদিন মধ্যরাতে পাশের ঘরের হইচই শুনে আমরা দরজা খুলে বাহির হইছি। গিয়ে দেখি মাটির ঘরের দুয়ারের চৌকাটের নিচে ইয়া বড় গর্ত। সেই ঘরে ভাটির কাজের লোকেরা থাকতো। তাদের মধ্যে এক ষোড়শিও ছিল। উঠোনে দাঁড়িয়ে কাহিনী শুনছিলাম কী না কী হচ্ছিল সে সময়। শুনি কী ঘরে গর্ত করে জোয়ান মেয়েটাকে বের করার জন্য পায়ে ধরে চোর বেটারা টানাটানি করতেছিল। পরিবারের সদস্যসহ মেয়েটা প্রাণপণ নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করতেছিল আর চেঁচামেছি করতেছিল। বাড়ীর মানুষ জেগে যাওয়ায় অঘটনটা ঘটেনি। এসব শুনে আমি গভীর চিন্তা করতেছিলাম, যদি মেয়েটারে নিয়ে যেত ধরে মুখ বেঁধে. কী হতো, কী হতো ........ কী সর্বনাশই না হতো এই ভেবে ভেবে শেষে নিজেকে আবিষ্কার করি আম্মার কোলে মাথা, মাথায় পানি ঢালা হচ্ছে। কই থেকে আর সবাই চোক খুঁজে আমাকে নিয়ে সবার চিন্তুা কী না কী হলো আবার। আমি তখন নাকি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। আল্লাহ মেয়েটার ইজ্জত বাঁচাইছিল সেদি আলহামদুলিল্লাহ।
০৪। তখন আমি ইন্টারে পড়ি। আর আব্বা তখন কুয়েতে থাকতেন। আমাদের ঘর ভেঙ্গে নতুন করে বানানোর কাজ চলতেছে। উঠোনে বাঁশের বেড়ার ঘর বানিয়ে আমরা থাকতাম। একদিন তিন বোন এক বিছানায় ঘুমিয়ে আছি। হঠাৎ দেখি কালো হাত আমাদের মাথার উপর হাতড়াচ্ছে খালি, সেখানেই ছিল দেয়াল ঘড়িটা। এমন চিল্লানি দিছি , চোর নাই হয়ে গেছে। নিতে পারে নাই।
০৫। একদিন ঠিকই চুরি হইছে স্বর্ণের জিনিসগুলো। এক রাতে আমরা গভীর ঘুমে। আগে থেকেই চোর ঘরে ঢুকে বসেছিল আমাদের ধারণা। সেদিন চোর এসেছিল আমরা টেরই পাইনি। ফযরে উঠে দরজা খোলা দেখে সবাই সবাইরে জিগাই দরজা খোলা কেন। তখন ভাবতেই পারিনি খাটের কাছে রাখা কাঠের বক্সটা উঠিয়ে নিয়ে গেছে। চুরি হইছে তখনো জানি না। দুপুর বেলা আমাদের ক্ষেতে গিয়ে দেখি কাঠের বক্সটা, যার দুয়ারটা ভাঙ্গা। ভিতরে স্বর্ণ ছিল। আব্বা তিন বোনের জন্য স্বর্ণের চেইন এনেছিলেন কুয়েত থেকে। কী আর করার নিলো তো নিলোই।
আমাদের ছোটবেলা কেটেছে মহা আতঙ্কে। একেতো আব্বা ছিলেন না কাছে। সেনাবাহিনী থেকেই আবার কুয়েত গেলেন শান্তি বাহিনীর সদস্য হয়ে। তারপর দেশে এসে চলে গেলেন কাতারে। আম্মাই একা আমাদের পাঁচ ভাই বোনদের সামলিয়েছেন। আমাদের সহজ সরল পেয়ে আমাদের আত্মীয় স্বজনরাই চোর সেজে ঘরে ঢুকে নানান সময় কত জিনিস যে নিয়ে গেছে চুরি করে। কত মানুষ যে বাজার করার নামে কত কত টাকা খেয়েছে। বাড়ী করার সময়ও অসংখ্য টাকা মেরে দিয়েছে আমাদের আপনজনেরা। এখন বুঝতে পারি তখনকার দিনের ঘটনাগুলো। চোখের সামনে ভেসে উঠে সেই দিনের স্মৃতিগুলো।
ঘর বানানোর সময় বারো সেট দরজা জানালা তৈরী করা ছিল কাঠের। একদিন সকালে গিয়ে দেখি সবই চুরি হয়ে গেছে। নিয়েছে আমাদের আপনজনেরাই, বিক্রি করেছে কোথায় তাও জানতে পারি। তখন আমরা কিছুই করতে পারিনি। আব্বা নাই বলে। এই যে তোরা টাকা মেরে খেয়েছিস, আজও তো সেই ধান্ধাতেই থাকিস । অথচ দেখ আল্লাহ কত মেহেরবান আমরা ভাইবোনেরা ঠিকই উঁচু পর্যায়ে আছি, চাকুরী করছি, সম্মান নিয়ে বেঁচে আছি আলহামদুলিল্লাহ। আর বাড়ীর মধ্যে আমাদের ঘরটাই এখনো জমজমাট। আত্মীয় স্বজন অসহায় সবাই এক দুই বেলা আমাদের এখানেই খান। সকালে এখনো চায়ের আসর বসে। গ্রামের কত কত মুরুব্বি এক কাপ চায়ের জন্য আমাদের ঘরে আসেন। আব্বা কাউকে কখনো ফেরত যেতে দেননি এখনো দেন না। আমরা নাই বাড়িটা অনেকটাই জৌলুস হারিয়েছে। স্মৃতিগুলো অম্নান থাকবে বুকের মাঝে।
আমাদের গ্রামে চোরের বেশ উপদ্রব ছিল। বড় হওয়া পর্যন্ত বেশ আতঙ্কে কেটেছে। ডিগ্রি পড়ার সময় পাড়ার ছেলেরা ঠিক করলো পালা বদল করে রাত্রে পাহারা দেবে। তাই হল, ফিকল (বাঁশের আগায় ধারালো চৌকা লোহার অস্ত্র), দা, শাবল এসব উপকরণ রাতে ব্যবহার হত। তখন থেকে চোরের উপদ্রব কমেছে। তারপর একদিন বাড়ীর সামনে পিছনে পিচ ঢালা রাস্তা হল। মানুষ রুজি রোজগারের পথ খুঁজে পেল। আলহামদুলিল্লাহ এখন গ্রামে সিঁদ কাটা চোর, বড় চোর নাই বললেই চলে।
চোরের অজস্র কাহিনী আছে আরেকদিন বলবো নে।
ছোটবেলা স্মৃতিগুলো লিখলে মনে হয় যেন লিখে শেষ করতে পারবো না। আরও কিছু স্মৃতি নিয়ে আসবো ইংশাআল্লাহ। আল্লাহ হাফেজ।
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই মে, ২০২৩ রাত ৯:২১