বাপ-মরা মেয়ে মহুয়া , বাহ্যিক সৌন্দর্য
যদি বুদ্ধি দিয়ে ঢাকা যেত, তাহলে মহুয়া বেশ
সুন্দরি । ওর বাবা মারা যাওয়ার
পরে ঢাকাতে মামাদের কাছে মানুষ ও। পালিত
বা আস্রিত নয়, মহুয়ার মা তাঁর ভাইদের কাছ
থেকে বাবার দেয়া একটা ফ্ল্যাট পেয়েছেন।
পাঁচতালার বাড়িটিতে দো' তলায় থাকে ওরা। নিচ
তলাতে মামাদের দোকান আছে । মহুয়ার মায়ের ও
একটা ষ্টেশনারী শপ আছে ওখানে,
একটা উড়নচণ্ডী গোছের মামাত ভাই
ওখানে বসেছে আজ দু বছর হল। মহুয়াদের সংসারের
খরচা সেখান থেকেই বেশ মিটে যায় । মরিয়ম
বেগম,মহুয়ার মা মেয়েকে নিয়ে বেশ আছেন।
মেয়ে তাঁর খুব লক্ষ্মী । ছোট শহরের স্কুল
থেকে এসে ঢাকাতে সে বেশ ভাল
স্কুলে ভরতি হয়ে যেতে পেরেছিল, এইটে বৃত্তি,
মাধ্যমিকে স্ট্যান্ড, উচ্চমাধ্যমিকে ও স্ট্যান্ড
করেছিল। এখন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেমিস্ট্রি নিয়ে পড়ছে। এমন
কি মেয়েটা নিজের পড়া লেখার খরছ নিজেই
চালিয়েছে আজ এম.এস.সি পর্যন্ত। এদিক অদিকের
বৃত্তির টাকায় আর টিউশনি করে ।
মন খারাপ থাকলে মহুয়া বেহালা বাজায় । এইটের
বৃত্তির টাকায় কিনেছিল শখ করে।
বাজানো শিখে ছিল আটঘাট বেধে। পেরছে ও। পড়ার
চাপে এখন আর সব সময়
বাজানো হয়ে ওঠে না ওটা।
আজ ভার্সিটিতে এ একটা ছেলের
মুখে ওকে নিয়ে খুব বাজে একটা কথা শুনেছে ও।
বাসায় এসে দরজা লাগিয়ে, অনেকটা সময় আয়নার
দিকে চেয়ে থেকেছে। খুব কাল ? মায়াবি চোখ
দুটো থেকে পানি পড়েছে অবিরাম।
মায়ের ধাক্কা-ধাক্কিতে দ্রুত দরজা খুলে ও ।
মরিয়ম সব বুঝে ফেলেন নিমেষে । মেয়ে তার
লক্ষ্মী ,কিন্তু "কিন্তু" একটাই। ওদের
বান্ধবিদের অনেকের বিয়ে হয়ে গেছে। অনেকের
বা হাতে এংগেজমেন্টের আংটি আছে। কিন্তু মহুয়ার
ক্ষেত্র আলাদা । মামা মামি রা অনেক
চেষ্টা করছেন। মহুয়ার জন্য একটা পাত্র খুজতে।
পাত্র তো অহরহ আছে। তাই বলে স্ট্যান্ড
করা মেয়ের জন্যে তো আর যেন তেন পাত্র
হলে চলবে না । যাদের বাইরের টা উপযুক্ত
বলে মনে হয়, তাদের ভেতরের টা উপযুক্ত না।
তারা মেয়ের গায়ের রঙ নিয়ে কটাক্ষ করে ।
বারান্দায় বসে বেহালা বাজাচ্ছে মহুয়া। বেহালার
সাথে দুঃখের কোন সম্পর্ক আছে কি না কে জানে ?
বেহালার সুরের স্রোতে ওর চোখের জলের স্রোত ও
জাগে । তাঁর অশ্বেত গণ্ড দিয়ে মুক্তা বিন্দুর মত
পানি পড়ে যায়।
কৌশিকরা এ পাড়ায় নতুন। সপ্তাহ তিনেক
এসেছে ওরা। কৌশিক বাবার ছোট ছেলে।
ব্যাঙ্কে চাকরি করে ও । বাপ বেটা মিলে এই
পাড়ায় একটা বাড়ি কিনে ফেলেছে। বড় ভাইয়ের মত
স্বার্থ খুজে নি কৌশিক।
বাবা মা কে আগলে রেখেছে এতকাল। অফিস ছুটির
পর মা বাবাকে নিয়ে ছাদে চা খেতে যায় কৌশিক।
একথা অকথা হতে হতে ওর মা স্বভাব-সুলভ
কৌশিকের বিয়ের কথা তুলেন।এ পাড়া তে এসেই
মহুয়রা মায়ের সাথে আলাপ হয় ওর।
বাড়ি তো মুখোমুখি। এ তিন সপ্তাহে তাদের দুজনার
আলাপ ই হয়নি শখ্যতা গড়ে উঠেছে । কথাই কথাই
মহুয়ার কথা তুলেছে মরিয়ম বেগম।
কৌশিকের মা, বাসায় এসে দেখেছেও মহুয়াকে। কাল
হলে কি হবে! মেয়ের মুখ তো মায়া কাড়া,
লেখা পড়াতেও দুরদান্ত। কথাও বলছে তার মহুয়ার
সাথে। মেয়েটা খারাপ কিসে ? চামড়াতে? আমার
মহুয়ার মনটাকে চাই, চামড়া তাকে না।
ভেবেছে কৌশিকের মা
বারান্দাতেই ছিল মহুয়া... বেহালা বাজাচ্ছিল ও।
প্রনয় কি, কেমন তা কৌশিক জানে না।
বেহালা শুনে বাদক কে দেখার ইচ্ছা হচ্ছিল ওর।
কোন তরঙ্গে তরঙ্গে মহুয়ার বেদনা, কৌশিক
পর্যন্ত পৌঁছচ্ছে কি না কে জানে । হাহাকার
করা এই সুরের মাঝে হা হু করতে করতেই । মায়ের
ধাক্কাতে সম্বিত ফিরে কৌশিকের । কৌশিকের
মা বলল, মেয়েটাই বাজাচ্ছে। কাল তোরা দেখা কর,
মায়ের উরযুপুরি নির্দেশে কৌশিক
কি করবে বুঝতে পারে না।
দেড় ঘণ্টা ধরে টিএসসি তে বসে আছে মহুয়া। ভর
দুপুর বেলা এদিকে মানুষ কম। মাএর উপর খুব রাগ
হচ্ছে তাঁর। এরকম করে অনেক বার
তাকে আসতে হয়েছে, লাভের খাতা শুন্য। এই
পোড়া চামড়া নিয়ে যে দুহাজার তের সালে আঠাশের
যুবতীকে কে বিয়ে করবে কে জানে? স্কুল
কলেজে যখন তার বান্ধবীরা লুকিয়ে প্রেমপত্র
পেত তখন থেকেই তার আমূল ধারনা কাল মেয়েদের
জিবনে প্রেম বলে কিছু নাই। এখন বিয়ের
বয়েসে এসে তার ধারনা আর কঠিন হয়েছে।
আপনিই মহুয়া? হটাত প্রশ্নে পিছনে তাকাই মহুয়া।
- জী, আপনিই কৌশিক সাহেব?
নীল শার্ট পরা যুবকের উত্তর... জী, আমিই।
অকৃত্রিম হাসি দিয়ে বলল, রাস্তায় প্রচুর জ্যাম।
তাই আপনাকে একটু ওয়েট করতে হল আরকি...
জবাব কৌশিকের।
না। ঠিক আছে... স্মিত হাসে মহুয়া।
কিছুটা সময় নীরবে কেটে যায় দুজনের।
গলা খাকারি দিয়ে কথা শুরু করে কৌশিক।
পড়ালেখা, ব্ন্ধু। পছন্দ অপছন্দের
পাল্টাপাল্টি প্রশ্নে এগিয়ে যায় কথোপকথন।
কৌশিকের কথা আর আচার ব্যবহার
শুনে ওকে আলাদা মনে হল মহুয়ার। আজকাল এরকম
খুব পাওয়া যায় না। কৃত্রিমতা নেই তার
হাসি তে বেশ বোঝা যায়। ব্যাংকের চাকরি, উচু
লম্বা।খারাপ কি? এই সব ভাবে অন্তরালে মহুয়া।
কিন্তু মহুয়াও তো পছন্দের হতে হবে। এরকম
অনেক ছেলেই দেখে গেছে তাকে।
আপনি খুব ভাল বাজান।
-কি?
বেহালা
-ও, ওটা বাজাই মন খারাপ হলে
মন ভাল থাকলে বাজান না, কেন?
-ওটা বোধ হয় দুঃখেই ভাল বাজে।
বাদক ভাল হলে সবসময় ভাল বাজবে।
এটা সেটা কথা। ফুচকা আইস্ক্রিমে
বিকেল গড়িয়ে আসে। দু জনে বিদায়
নিয়ে ফিরে আসে বাসায়। মরিয়ম বেশ
আশা নিয়ে বসে থাকেন। তিনি মানত করেছেন,
মেয়ের বিয়ের পাকা কথা হলে তিনি মসজিদে হাজার
টাকার নোট পাঠাবেন। মহুয়া ফিরে আসে। মায়ের
সামনে পড়ে বিব্রত হয় মহুয়া। দেখো ওরা কি বলে?
আমি আর কি বলব?
এশার নামাজে থেকে উঠছেন মাত্র। কৌশিকের
মায়ের ফোন বাজছে। মরিয়ম ফোন তুললেন । এ ঘর
থেকে শুনছে মহুয়া। কথা নিচু গলাই হচ্ছে। নিচু
গলাতেই কথা হয়। প্রত্যখানের খবর
মা নীরবে শুনেন। কথা চলতে থাকে ।
হটাত মরিয়ম নিচ থেকে মহুয়ার মামাত
ভাইটিকে ডাকে। মহুয়া দেখল পর্দার
আড়ালে মা তাকে লাল রঙের এ হাজার টাকার নোট
দিয়ে মসজিদে পাঠালেন। মহুয়া বুঝতে পারে......
বেহালা নিয়ে বারান্দায় চলে যায় মহুয়া...
আকাশে পূর্ণ চাঁদ... চারিদিকে আলো...
মহুয়া বেহালাতে সুর তুলেছে...... সুখের সুর...
বাতাসে ভেসে ভেসে সেই সুর... উদগ্রীব
হয়ে থাকা যুবকের মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলে। চাঁদের
আলোতে, বেহালার সুরে অবৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায়
সুখ ছড়িয়ে যাচ্ছে... প্রচণ্ড সুখ