ছাত্র অবস্থা থেকেই ছিলেন শিল্প-সাহিত্যের প্রতি অনুরাগী।শিল্প-সাহিত্যে অসাধারণ অনুরাগ আর সৃষ্টিশীলতার অন্তর্গত অনুপ্রেরণার ফলে বিজ্ঞান ছেড়ে দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা অনার্সে ভর্তি হন।তার জীবন ও কর্মে ছিল বৈচিত্র্য ও বিশালতার এক বিস্ময়কর সমন্বয়।নিপীড়িত মানুষের প্রতি তাঁর ভালোবাসা ছিল প্রগাঢ়।১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন এবং গ্রেপ্তার হন।১৯৬৯ সালের গণ অভ্যুত্থানেও তিনি অংশ নেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি আগরতলা এবং পরে কলকাতায় চলে যান এবং সেখানে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে প্রচারাভিযান ও তথ্যচিত্র নির্মাণ শুরু করেন।
শুধু ক্যামেরা নয়, কলমও ছিল তাঁর যুদ্ধাস্ত্র।একজন খ্যাতনামা কথাসাহিত্যিক হিসেবেও তিনি প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন।তিনি ছিলেন শিল্পী ও যোদ্ধা যুগপৎ।ছিলেন বাংলাদেশ লিবারেশন কাউন্সিল অব ইন্টেলিজেন্সিয়ার সাধারণ সম্পাদক। তথাকথিত বিলাসী বুদ্ধিজীবীদের মতো শিল্প অথবা শিল্পতত্ত্ব নিয়ে ঘরে বসে থাকার লোক ছিলেন না। কারণ, তিনি ভালোবাসতেন মানুষকে। মানুষের জীবনের ক্লেশ-ক্লেদ দেখার এবং তা বিভিন্ন শিল্পমাধ্যমে মুক্তির হাতিয়াররূপে রূপান্তরিত করার মতো প্রতিভাবান ছিলেন তিনি। অন্যায়, অমানবিকতা, দুঃশাসন, সামাজিক আধিপত্য ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সংগ্রামী চেতনার স্বাক্ষর রেখে গেছেন তাঁর কর্মক্ষেত্রের পরতে পরতে।
স্বাধীনতার পরপরই কলকাতা থেকে ঢাকায় চলে এসেছিলেন।বুদ্ধিজীবীদের নির্মম হত্যাকাণ্ড এবং তার বড় ভাইয়ের নিখোঁজ হবার সংবাদ শুনে,ভাইকে খুঁজতে বের হয়েছিলেন তিনি,কিন্তু আর ফিরে আসেননি।বড় ভাইকে খুঁজতে বের হয়ে নিজেই নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিলেন। তার এই নিখোঁজ হওয়া নিয়ে পত্র-পত্রিকায় বেশ লেখালেখি হয়েছিল। একদিন তার বড়বোনকে ডেকে নিয়ে ততকালীন রাসট্রপ্রধান বলেছিলেন – ‘ভাইয়ের নিখোঁজ হওয়া নিয়ে এরকম চিৎকার করলে তুমিও নিখোঁজ হয়ে যাবে'। পরে তার বড় বোন আর কিছু বলেননি। তার বড় ভাই মিরপুরে আছে বলে টেলিফোন করে যে লোক তাকে নিয়ে গিয়েছিল তার খোজে যখন পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি শুরু হলো তখন সেই লোককে সরকার নাগরিকত্ব দিয়ে পুরো পরিবারসহ আমেরিকায় পাঠিয়ে দিয়েছিল । তাঁর অন্তর্ধান নিয়ে আর কোন তদন্ত হয় নি।
বিভিন্ন মহল থেকে বারবার বলা হয়েছে,পাকিস্তানি হানাদার বা অবাঙালিরা নয়,বাঙালিদেরই একটি বাহিনী যা ভারতের সামরিক বাহিনীর জেনারেল ওবান-এর নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিলো, যারা তাজ উদ্দিন আহমেদকে পর্যন্ত হত্যা করতে চেয়েছিল তারাই তাকে তার ভাইয়ের কথা বলে ডেকে নিয়ে খুন করেছিল।দেশে এই বাহিনীর অনেক নেতাই এখনো জীবিত আছেন।কিন্তু তারা এ বক্তব্যের প্রতিবাদ বা এর কোন ব্যাপারেই উচ্চবাচ্চ্য করছেন না। তাদের নীরবতা তাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত বক্তব্যকেই দিন দিন প্রতিষ্ঠিত করছে !!
শোনা যায় ,বুদ্ধিজীবিদের হত্যার তদন্ত করতে গিয়ে তিনি এমন কিছু তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন যা অনেক রথী-মহারথীর জন্যই বিপজ্জনক ছিল, সেজন্য তাকে তারা সরিয়ে ফেলেছিল॥ বুদ্ধিজীবিদের হত্যার জন্য তিনি সরাসরি আওয়ামী নেতৃত্বকে দায়ী করে শ্বেতপত্র প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন এবং যুদ্ধকালীন আওয়ামী লীগ নেতারা কলকাতায় কে কি করেছিলেন তা ফাঁস করে দেবেন বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। এটাই তার জন্য কাল হয়েছিলো।
তিনি নেই ,তবুও মনে হয় তিনি আছেন, মাত্র ৩৭ বছর বয়সে নিখোঁজ হয়ে গেলেও তিনি থাকবেন হাজার বছর ধরে। শুভ জন্মদিন _জহির রায়হান !! যেখানেই থাকুন,ভালো থাকুন!!