এক:
৭ দশমিক ৫ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্পে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে ৩৭৫ জনের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন দু্ই হাজারেরও বেশি মানুষ।ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে শত শত স্থাপনা,বাড়িঘর।অনেক মানুষই এগুলোর নিচে চাপা পড়েছেন বলে মনে করা হচ্ছে। ফলে ওই এলাকাগুলোয় আতঙ্ক ও উদ্বেগের পাশাপাশি শোকাবহ পরিবেশ বিরাজ করছে। হতাহতদের উদ্ধারের পাশাপাশি স্বজনদের খোঁজ নিতে মরিয়া হয়ে ছুটছেন মানুষজন। এর মধ্যে বিভিন্ন স্থানে সড়ক ও মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় বিশেষ করে পার্বত্য এলাকার যোগাযোগ মাধ্যমগুলো ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আরও প্রবল হয়েছে।ক্ষয়ক্ষতি এবং হতাহতের সংখ্যাও বাড়তে পারে বলে মনে হচ্ছে।এ ঘটনায় সারা বিশ্বের মানুষ যখন উদ্বিগ্ন তখন বাংলাদেশের একদল মানুষ পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে বিশেষ করে পাকিস্তানে ভূমিকম্প হওয়ায় তা নিয়ে ফান,সেল্ফি, রম্যগল্প, ট্রল,স্যাটায়ার কত কিছু যে করছেন !! এদের কাছে ৭১, পাকিস্তান এইসব একটা পন্য। যে পণ্য দিয়ে তারা চেতনার ব্যবসা করে যাচ্ছেন। তাই তারা অন্য কিছু চোখে দেখেন না। এত আজব আজব টাইমে আর বিষয়ে এরা দেশপ্রেমের বস্তা নিয়ে হাজির হন,যে সাধারন মানুষ কনফিউজড হয়ে যায়! অথচ দেশের ক্রান্তিকালে ,সমস্যায় বা কোন প্রয়োজনে এই দেশপ্রেমের আধার দেশপ্রেমিকদের আমরা কোথাও খুজে পাইনা। তিক্ত হলেও সত্য আমাদের অনেকের মধ্যে স্বদেশ প্রেম যতটা না বেশি তার চেয়ে বেশি বিদেশ বিদ্বেষ! দেশপ্রেম দেখাতে আমরা বাইরের কতিপয় দেশের প্রতি অবিরত ঘৃনা পোষন করে যাচ্ছি আর ক্রমেই মুক্তিযুদ্বের মুল চেতনা সাম্য,মানবিক মর্যাদা,ন্যায় বিচার বা ইনসাফ থেকে দুরে সরে গিয়ে নিত্য নতুন চেতনার আমদানী করছি !!
কেউ কেউ লিখেছেন,ভূমিকম্পে পাকিস্তান ধ্বংস হয়ে যাক।পাকিস্তানীরা ৭১‘এ আমাদের দেশের মানুষকে হত্যা করেছে তাই ওদের প্রতি বিন্দুমাত্র সহানুভূতি নেই । আবার কেউ কেউ লিখেছেন পাকিস্তানিদের প্রতি এই “ঘৃণা” যৌক্তিক। কারণ তারা ৭১ এ কৃত অপরাধের জন্য ক্ষমা চায়নি। ভাইয়েরা, ৭১‘এর জঘন্য অপরাধের বিচার আমরা সবাই চাই । রাষ্ট্রীয় পর্যায়েই চাওয়া উচিত । দায়ী পাকিস্তানীদের শাস্তি হওয়া উচিত । এবং এই কাজ করতে হবে আন্তর্জাতিক মবিলাইজেশনের মাধ্যমে, কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে। পাকিস্তানকে ক্ষমা চাওয়াতে বাধ্য করার দায়িত্ব সরকারের। কেউ চাপে না পড়লে নিজের অপরাধ স্বীকার করে ক্ষমা চায়না। সেই চাপ সৃষ্টির দায় এবং দায়িত্ব সরকারের। কিন্তু তা না করে তার জন্যে সকল পাকিস্তানীর প্রতি প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে আমরা ঘৃণা বরাদ্দ রাখবো? এমনকি ভূমিকম্পে ধ্বসে যাওয়া দালানের নীচে আটকা পড়া লাশের জন্যেও বরাদ্দ থাকবে সেই ঘৃণা ? পাকিস্তানে কি এমন মানুষ নাই যারা সেসময় আমাদেরকে সমর্থন করেছিল, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে দাঁড়িয়েছিল, নির্যাতিত হয়েছিল, গ্রেফতার হয়েছিল কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিল, কলম ধরেছিল, রাজপথে বিক্ষোভ করেছিল??
১৯৭০ সালের নির্বাচনে জয় লাভের পর বাঙ্গালীদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের পক্ষে অবস্থান নিয়ে চাকুরীচ্যুত হয়েছিলেন পাকিস্তান বিমানবাহিনীর পাইলট ও কবি আনোয়ার পীরজাদা। এজন্য সামরিক আদালতে তাকে সাত বছরের কারাদণ্ডও দেয়া হয়েছিল। বাংলাদেশের মানুষের ওপর গণহত্যা, নির্যাতন ও নিপীড়নের প্রতিবাদে কবিতা লিখে সামরিক আদালতে কারাদণ্ডের পাশাপাশি বেত্রাঘাত সহ্য করেছিলেন মানবাধিকার কর্মী আহমদ সালিম। লে.জেনারেল আযম খান , বেগম তাহিরা মাজহার আলী, বেগম নাসিম আখতার, মালিক গোলাম জিলানী, অধ্যাপক ও সাংবাদিক ওয়ারিস মীর,সাংবাদিক ও কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ, , কবি হাবিব জালিব, দার্শনিক ইকবাল আহমেদ,ভারতে ব্রিটিশ শাসনবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নেতা পাকিস্তান এবং উপমহাদেশের অন্যতম আধুনিক,প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতা খান আবদুল গাফফার খান, পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সাধারণ সম্পাদক মীর গাউস বকস বিজেঞ্জো, কাজী ফয়েজ মোহাম্মদ,নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি শামীম আশরাফ মালিক প্রমূখ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। ১৩ জন পাকিস্তানী মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সন্মাননাও পেয়েছেন।।
জনগণ আর শাসক এক নয় ,পাকিস্তানীদের অনেকেই তাদের ৭১‘র শাসকদের ঘৃণা করে ,বাংলাদেশে তারা যে গণহত্যা করেছিল,এই জন্য । এবং তাদের সংখ্যাটাই বেশি । অনেকে আবার তাদের সাপোর্ট ও করে ,কিন্তু তাদের সংখাটা অনেক কম। আমি দীর্ঘদিন বিদেশে থাকার সুবাদে ,অনেক পাকিস্তানীর সাথে চলাফেরা করেছি। তাদের সাথে এই বিষয়ে আলোচনা করেছি ,তারা বলেছে ,আমরা আমাদের সে সময়ের শাসকদের ঘৃনা করি ,আমরা পৃথিবীর সকল ক্ষমতা অপব্যাবহারকারী এবং নিপীড়নকারী শাসকদের ঘৃণা করি। তাদের অনেকেই আবার ৭১ এর গণহত্যার ব্যাপারে তেমন অবগতও নয়। তাদের বইগুলো ঐভাবে রচনা করা হয়েছে । আমাদের দেশে যেমন চেতনাধারী আছে ,তেমনি তাদের দেশেও তেমন কিছু চেতনাধারী আছে। আর সেসব চেতনাধারীরাই শুধু তাদের নিপীড়নকারী শাসকদের পক্ষ নিচ্ছে !!
রাজনের হত্যাকারীরা বাংলাদেশের মানুষ হলেও বাংলাদেশের সব মানুষ রাজনের হত্যাকারীদের মত নয়।বরং বাইরের দেশের মানুষ যদি বাংলাদেশের সব মানুষকে রাজনের হত্যাকারীদের মত পিচাশ মনে করে তবে ভাবতে হবে তার মাথায় সমস্যা আছে। বাংলাদেশের সব মানুষকে রাজনের হত্যাকারীদের মত ভাবাটা কতটুকু যৌক্তিক ? ফেলানী হত্যার অপরাধে আমরা সকল ভারতীয়কে ঘৃণা করবো? তেমনি ৭১‘এ পাকিস্তানে যেমন কিছু কসাই ছিল তেমনি ছিল উপরোল্লিখিত মানুষগুলোর মত কিছু মানুষ। এখনও আছে। তাই পাকিস্তানী ক্ষুদ্র শাসকদের অপরাধের দায় পুরো জাতির উপর চাপিয়ে দেয়া , জাতিগত ঘৃণায় পর্যবসিত করা যৌক্তিক নয়।একজনের অপরাধে অন্যকে দণ্ডদেয়া যায় না।পিতার অপরাধের জন্য পুত্রকে এবং পুত্রের অপরাধের জন্য পিতাকে দায়ী করা চলে না। মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বিজয় অসাম্যের বিপক্ষে সাম্যের বিজয়,অমানবিকতার বিপক্ষে মানবিকতার বিজয়,বে-ইনসাফের বিপক্ষে ইনসাফের বিজয়,হিংসার বিপক্ষে অহিংসার বিজয়, জাতিগত অহং বোধের বিপক্ষে বিশ্বের সকল জাতির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের বিজয়, কোন জাতির প্রতি হিংসা বিদ্বেষ অসম্মান প্রদর্শনের বিজয় নয়। পাকিস্তানের এক প্রজন্মের কিছু লোকের/গোষ্ঠির কুপমন্ডুকতা আর পাষবিকতার দায় সবার উপর চাপিয়ে, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে টেনে নিয়ে কিছু লোকের/গোষ্ঠির নানা রকম ফায়দা আদায়ের সুযোগ হতে পারে কিন্তু কোন জাতির জন্যই তা সম্মানের হতে পারেনা।।
প্রত্যেক মানুষের মৃত্যুই আমাকে সংকুচিত ক্ষুদ্র করে ফেলে, কারণ আমি এই মানবতার অংশ। তোমরা জিজ্ঞাস করোনা ওই দুঃখের ঘন্টা ধ্বনি কার মৃত্যুর বার্তা ঘোষণা করছে? এই ঘণ্টাধ্বনি তোমার জন্যই। জন ডানের কথা ধার করে বলি, 'প্রতিটি অস্বাভাবিক মৃত্যুই আমাকে সংকুচিত করে, ক্ষুদ্র করে ফেলে, কারণ আমি সেই মানুষদেরই একজন' ।
দুই:
বাংলাদেশে আরেকদল মানুষ আছেন যাদের কাজ দেখলে মনে হয়, না বুঝে কাজ করায় বোধহয় আমরা বাংলাদেশীরাই চ্যাম্পিয়ান। পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের ভুমিকম্প উপদ্রুত এলাকায় যারা আছেন, তাদের জন্য "Pakistan Earthquake Safety check" এবং "Afghanistan Earthquake Safety check" নামে দু‘টি অপশন ওপেন করেছে ফেইসবুক, যেন তারা তাদের পরিবারকে জানাতে পারে, তারা সেইফ আছে কি নাই। আর অমনি আমাদের অতি উৎসাহী পোলাপাইন না বুঝেই ঝাপিয়ে পড়ছে, প্রায় মিনিটে মিনিটে নোটিফিকেশনস। 'Mofiz, Abul & 420 others were marked safe during Pakistan/Afghanistan Earthquake'. আমার ফ্রেন্ড লিস্টের অনেক বিজ্ঞ মানুষও নিজেদের সেইফ মার্কড করছেন। আর আমি প্রায় মিনিটে মিনিটে নোটিফিকেশনের যন্ত্রনায় বিরক্ত হয়ে এক পর্যায়ে এই পোস্ট দিতে বাধ্য হয়েছি। ভাইরে "Pakistan/Afghanistan Earthquake Safety check" নামটা একটু ভালোভাবে পড়েন। দেশের মান ইজ্জত ডুবাইয়েন না প্লিজ। পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের অপশনে আপনারা বাংলাদেশে থেকে সেইফ ক্লিক দিচ্ছেন এটা খুবই দৃষ্টিকটু এবং হাস্যকর !! ভূমিকম্প হয়েছে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে। অপশনটাও পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের জন্য। আর আপনি বাংলাদেশে সেইফ আছেন! আপনার বন্ধুও সেইফ আছে !! আপনারা কবে আপনাদের কমনসেন্সটা সঠিকভাবে সঠিক সময়ে ব্যবহার করবেন !! নেপালে ভূমিকম্পের সময়েও দেখেছি আপনারা কেউ কেউ এই হাস্যকর কাজটা করেছিলেন!!
ভাইরে,ফেইসবুকের এই সার্ভিসটা দুর্যোগ উপদ্রুত এলাকার জন্য চালু করা হয়েছে.....আর ওখানে তো স্পস্ট লেখাই আছে, " Pakistan/Afghanistan Earthquake“। তো,শুধু শুধু বাংলাদেশ থেকে আপনার চেকইন দেওয়ার কি দরকার !! তবে হ্যা,আপনার কোন বন্ধু পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে থাকলে আর আপনি বাংলাদেশ থেকে তার অবস্থান ক্লিয়ার হলে সেফটি চেক দিতে পারেন।অন্যথায় দেশে সেফ জায়গায় বসে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের জন্য খোলা সেফটি চেকে শুধু শুধু চেক ইন সিকিওর মারা বন্ধ করেন প্লিজ !! আপনাদের অনেকের কাছে যেইটা ফান, সেইটা পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সার্ভাইবারদের খুজে বের করার জন্য বানানো অথেন্টিক ডাটাবেইজের মৃত্যু।
বুধবার,২৮ অক্টোবর ২০১৫
লণ্ডন, ইংল্যাণ্ড ।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে অক্টোবর, ২০১৫ ভোর ৫:০৭