somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আবেগ...

০৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১০ রাত ৩:৪০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

একটু আগে আমার ব্রিটিশ শিক্ষক এবং তাঁর একমাত্র ১২ বছরের মেয়ে লিরা আমাদের বাসায় এলেন। স্যারের অধিনে ছিল আমার মাষ্টার্সের প্রজেক্ট। মাত্র ৩ সপ্তাহ আগে অনলাইনে চ্যাটে স্যারকে কথাচ্ছলে বলেছিলাম আমাদের দেশে এসে একবার ঘুরে যেতে।স্যার যে তা কবুল করবেন তাতে আমি বেশ অবাক এবং খুশি।আজ সকালেই তাঁরা এলেন বাংলাদেশে।

লিরা দেখতে ঠিক বার্বিডলের মতোন।একবিন্দু স্থির থাকতে পারেনা।বাসার সবাইকে ১ঘন্টার ভেতর আপন বানিয়ে ফেলল।আর বিশেষ করে বেশি ভক্ত হয়ে গেল আমার ছোট খালার।আমার ছোট খালা আমার মা-বাবা চলে যাবার পর আমাদের সংসারের সবকিছুর হাল ধরে আছেন। রাতের খাবার পর দেখা গেলো লিরা স্যারের সাথে হোটেলে যাবেনা, সে এখানেই থাকবে।তো ঠিক হলো স্যার আগামী ক'দিন ভাইয়ার সাথে আমাদের বিভিন্ন প্রজেক্ট দেখবেন, আর আমার কাজ হলো লিরাকে এখানে সেখানে ঘুরিয়ে বেড়িয়ে দেখাতে হবে।

২ দিন চলে গেল। এর মাঝে লিরাকে ঘুরিয়ে আনলাম শ্রীমংগল চা বাগান, কুমিল্লার ময়নামতি ইত্যাদি। সে নেট ঘেটে ঘেটে জায়গা ঠিক করছে কোথায় কোথায় যাওয়া যায়। আর সারাক্ষণ মুখে খই ফুটছে তো ফুটছেই।রাজনৈতিক ব্যক্তি ছাড়া একটা মানুষ কিভাবে যে ঘন্টার পর ঘন্টা শুধু কথা বলে যেতে পারে এটা তাকে না দেখলে আমি কখনো বিশ্বাস করতামনা।

রাতে তাকে নিয়ে গেলাম বনানীর শর্মা হাউজে।শর্মা সে বেশ পছন্দ করে ফেলল।
"আচ্ছা দাইফ, তুমি নাকি দেশে চলে এসেছো পি,এইচ.ডি. শেষ না করে?"- লিরার প্রশ্ন (তার কথপোকথন বাংলাতেই তুলে দিলাম)
"হ্যাঁ" - আমি
" কিন্তু কেনো?"
"আর পড়াশুনা ভাল লাগেনা তাই"- আমার সোজাসাপ্টা উত্তর
"ও আচ্ছা। ওই পোষাকটাকে না তোমরা কি বলো?"
আমি তার হাতের ইশারা নিশানা করে দেখলাম সে এক মহিলার শাড়িকে ইংগিত করছে।
"আবারো ভুলে গেছো? ওটা হচ্ছে শাড়ি" - আমি
"হ্যাঁ হ্যা মনে পড়েছে। এই, আমি আজকে শাড়ি কিনবো"- লিরা
"তুমি পরতে জানো?"-আমি
"আরে নাহ, খালা পরিয়ে দেবে"- লিরা

বনানীর বেশকিছু দোকান ঘুরে তার পছন্দমত কয়েকটি শাড়ি কিনে দিলাম।গাড়িতে আসতেই আমাকে আচমকা এক প্রশ্ন
" তুমি নাকি এক মেয়েকে ভালবাসতে"-লিরা
"কে বলেছে?"- আমি
"বাবা" - লিরা
"তো?" -আমি
"আমাকে একবার তাদের বাড়িতে নিয়ে যাবে?"
"কেনো?"
"এমনি, একটু তার ছবি দেখতাম। তার ঘরে যেতাম,এই আর কি"
"তার ছবি আমার কাছে আছে,এখন বাসায় চলো"-আমি
"শুধু কিছুক্ষণের জন্য"-লিরা
"না" বলে হঠাৎ আমি বেশ ধমকে উঠলাম। আর সাথে সাথেই বুঝলাম এটা করা ঠিক হলো না। কিন্তু লিরা একদম চুপ মেরে গেলো।
" আমি দু:খিত লিরা, এমন করা ঠিক হলো না আমার"
"ইটস ওকে" বলে একদম চুপ মেরে গেলো।
সারা রাস্তা একটি কথাও বললো না।

পরদিন সকালে নাস্তার টেবিলে তাকে জানালাম আজ বিকেলে তাকে এক জায়গাতে নিয়ে যাবো।শুনে কিছু বললো না।
দুপুরে খালা তাকে শাড়ি পরিয়ে দিতেই সারা বাড়ি সে ঘুরে বেড়িয়ে সবাইকে দেখাতে লাগলো আর নিজেকে পরিচয় করাতে লাগলো "ব্যাংগালী ন্যারি(নারী)" বলে।সারা বিল্ডিং নিয়েই আমাদের যৌথ পরিবার। এ ক'দিনেই মেয়েটিকে সবাই ভালবেসে ফেলেছে।পিচ্চি কাজিনগুলো লিরাকে ডাকে "লিরাপু" বলে।ছোট খালা মনে হয় একটু বেশিই আদর করে তাকে। ছোট খালাকে সে ডাকে "চোটো খ্যালা"। খালা এতেই আরো বেশি আপ্লুত।দুপুর বা রাতে ইদানিং নিজ হাতে খাইয়ে দেয় লিরাকে।
বিকেলে সাদাফের বাসায় নিয়ে গেলাম। হ্যাঁ, আমার সাদাফ, যে আজ নেই।তার মাকে আগে থেকেই জানিয়ে ছিলাম।
ঘরে ঢুকতেই আন্টি লিরাকে জড়িয়ে ধরে বেশ আদর করলেন।
তারপর সে আন্টিকে জানালো সাদাফের ঘরে একটু যাবে।

আজ অনেকদিনপর সাদাফের রুমে ঢুকলাম।একদম গোছানো, মনে হচ্ছে মাত্রই সে এসে যাবে।লিরা ঘুরে ফিরে রুমটা দেখছে।দেয়ালে টানানো ছবিগুলো হাত বুলিয়ে দেখছে। আমি শুধু চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম।এই ছোট্ট মেয়েটির এমন আবেগ দেখে আসলেই আমি বেশ অবাক হচ্ছি।মনে মনে দোয়া করলাম যে এই আবেগের জন্য মেয়েটিকে না আবার ভবিষ্যতে কষ্ট পোহাতে হয়।

একটা ড্রয়ার দেখিয়ে বললো, "আমি কি একটু খুলে দেখতে পারি"?
"হুমম"- আমি, জানি সেখানে সাদাফ ডায়রী আর কাগজ কলম রাখতো।
একটা ডায়রী বের করলো, সব তো বাংলাতে লেখা, কি আর বুঝবে সে।পাতা উল্টাতে উল্টাতে যেখানে শেষ সেখানটা দেখিয়ে আমাকে বললো কি লেখা এখানে।
সেখানে লেখা ছিল,

"যেদিন আমি ভালবেসেছিলাম
সেদিন থেকেই তুমি আমার
যেদিন আমি থাকবোনা
সেদিনও তুমি আমার,
একসময় এই পৃথিবী,মহাকাশ কিছুই রবেনা,
তখনো আমি শুধুই তোমার।
যখন ঠান্ডা বাতাস বইবে,
আকাশেতে চাঁদ খেলা করবে,
ভাববে, আমি তোমারই আছি,
কাছেই আছি, ভালবেসেই আছি।"

আমি লিরাকে অনুবাদ করে বললাম কি লেখা আছে সেখানে।
লিরা চুপচাপ ডায়রীটা রেখে দিল ড্রয়ারে। আমি রুম থেকে বের হলাম, কিন্তু জানি লিরার চোখ দুটো অশ্রুতে ভরা।

মধ্যরাত। এয়ারপোর্টে আমরা সবাই এসেছি স্যার আর লিরাকে বিদায় দিতে।ছোট খালাকে লিরা জড়িয়ে ধরে চোখের পানি ফেলে দিল।স্যার একটু বিব্রত হয়ে গেল।বললো, "লিরা আপনাদের এত ভালবেসে ফেলেছে যে কি আর বলবো।"
লিরা আমার সামনে এসে আমাকে একটা খাম দিয়ে বললো সে যাবার পর যেনো আমি সেটা খুলে পড়ি।আর আমাকে ডাকলো "দাইফ ভাইয়া"।
আমরা সবাই অবাক। আসলে খালার কাছ থেকে সে শিখেছে।সে জানাল সে আবার আসবে এই দেশে। এখানে নাকি ভালবাসার কোনো কমতি নেই।

বাসায় ফিরছি।ছোট খালা পাশে বসে নিরবে অশ্রু বিসর্জন করছে। লিরার দেয়া খামটা হাতে নিয়ে গাড়ির লাইট জ্বালালাম।খুব সুন্দর তার হাতের লেখা।চিঠিটা পড়া শুরু করলাম,

"প্রিয় দাইফ ,

আমি কখনো কাউকে কোনো চিঠি লিখিনি।এমনকি আমার মা'কেও না।আমার মা'র কথা তুমি জানোনা কারণ বাবা এটা নিয়ে কারো সাথে শেয়ার করেনা।আমার মা আমার বয়স একবছর থাকতেই এক লোককে বিয়ে করে চলে যান।আমার বাবা শত কষ্টের মাঝেও আমাকে নিজে একা একা বড় করে তোলে।তুমি জানো যে বাবা সারাক্ষণ তাঁর গবেষণা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন।তবুও আমাকে যতটুকু দরকার সময় দিয়েছেন।আমাদের তেমন কাছের কোনো আত্মীয় নেই।আমি ছোট থাকতেই একা একা বড় হয়েছি আর এখনো হচ্ছি।ছোট্ট থাকতে স্কুলে যখন মাদার্স ডে হতো, আমি সেদিন স্কুলে যেতাম না।
বাসায় সারাক্ষণ একা একা বসে কাঁদতাম।ভালবাসা কি জিনিস তেমন ভাবে বুঝতাম না। আজ আমি জানি পরিবার কি জিনিস।
তোমাদের মাঝে এই কয়েকটি দিন থেকে আমার যে কি পরিমান ভাল লেগেছে তা আমি কোনোদিন ভুলতে পারবোনা।

আমি আবার আসবো তোমাদের মাঝে।তোমাদের ভালবাসার কথা আমি আমার বন্ধুদের জানাবো।তোমরা কতসুন্দর করেই না পারো মানুষকে আপন করে নিতে।খালা যতবার আমাকে আদর করতো মনে হতো আমার মা বুঝি আমাকে আদর করছেন।তুমি একবার বলেছিলে ইউরোপের মানুষদের আবেগ কম।এটা ভুল, আবেগ ভালবাসা না থাকলে কি পৃথিবী এখনো টিকে থাকতো?আমি পৃথিবীর বেশ কিছু সমৃদ্ধশালী দেশে ভ্রমণ করেছি।সেখানেও ছিল বাবার অনেক ছাত্র এবং তাদের পরিবার।তারাও আমাকে বেশ আদর যত্ন করেছিল। কিন্তু তারা তোমাদের মতো করে পারেনি আমাকে আপন করে নিতে।তোমাদের ভালবাসায় কোনো মেকিত্ব ছিলনা। আমার একথাগুলো তোমার কাছে হাস্যকর মনে হবে,কিন্তু আমার জায়গাতে তুমি থাকলে তুমিও তাই মনে হয় লিখতে।

ভাল থেকো, আর সবসময় হাসিখুশি থাকবে।মুখ গোমড়া করে রাখবেনা।আমাকে দেখো, মনে এত কষ্ট থাকাতেও মুখে সবসময় হাসি থাকে।তোমাদের অনেক ভালবাসি আমি।

লিরা "

চিঠিটা ভাঁজ করে রাখলাম। বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এল। ছোট্ট মেয়েটার জন্য মমতায় মনটা ভরে গেল।
ভাল থেকো আমার ছোট্ট বোন লিরা। তোমাকেও আমরা কখনো ভুলবোনা।আমরা অপেক্ষায় রইলাম তোমার জন্য। তোমার দেশ হতে বহুদূর এই বাংলাদেশে একটি পরিবার আছে তোমার জন্য এবং থাকবে আজীবন।





(এবছরের শুরুর দিকের ঘটনা নিয়ে লেখা।আর লিরার অনুমতি নিয়েই লেখা)





সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে জানুয়ারি, ২০১১ রাত ৮:৪৫
৮৯টি মন্তব্য ৮৯টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ

লিখেছেন রাজীব নুর, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:৪০



'অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ'।
হাহাকার ভরা কথাটা আমার নয়, একজন পথচারীর। পথচারীর দুই হাত ভরতি বাজার। কিন্ত সে ফুটপাত দিয়ে হাটতে পারছে না। মানুষের... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্য অরিজিনস অফ পলিটিক্যাল জোকস

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১১:১৯


রাজনৈতিক আলোচনা - এমন কিছু যা অনেকেই আন্তরিকভাবে ঘৃণা করেন বা এবং কিছু মানুষ এই ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। ধর্ম, যৌন, পড়াশুনা, যুদ্ধ, রোগ বালাই, বাজার দর থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×