নিজেকে আজকাল সময় একেবারেই দেয়া হয় না।
শুধু মাত্র নিজেকে ব্যস্ততায় সঁপে দিয়ে যেন বোঝাতে চাচ্ছি অনেক ভাল আছি। হয়ত বা আশেপাশের সবার জন্য ভাল থাকতে হচ্ছে। কিন্তু আমার মন কি ভাল আছে?
মন কি আমার পরিতৃপ্ত এই জীবনে? মনেহয় সবার জীবনেই কিছু না কিছু অতৃপ্তি থেকে যায়। আমারো নাহয় থেকে যাক।বিধাতা এই বোধহয় লিখেছিল আমার জীবনে।
থাক, বিধাতার নির্ধারিত নিয়তিতে নাহয় সময় চলুক। আমারতো নিজেকে সময় দেয়া উচিত। আজ হতেই দেবো, এখুনি দেবো। আজকের এই বিকেলটা হবে শুধুই আমার নিজের জন্য। আর চিন্তা না করে গাড়ি থেকে নেমে গেলাম। হাঁটবো আজ মনটা ভরে। হেঁটে হেঁটে যতদূর পারি যাবো। ভাববোনা কারো জন্য, আজ সময় যে শুধুই আমার।
প্রবল ব্যস্ততায় সবাই কি রকম ঘরে ফিরছে। দিনের শেষে ঘরে ফিরে পরিবারের সবার সাথে মিলিত হবার মাঝেই তো আছে প্রশান্তি। শত ক্লান্তির মাঝেও সবার মুখে একটা অন্যরকম প্রশান্তির ছোঁয়া আছে যেন। রাস্তা দিয়ে হাঁটছি, আর লক্ষ্য করছি চলন্ত সবার দিকে। ভাল লাগছে, অনেক ভাল লাগছে। যেতে যেতে বনানীর "কফি ওয়ার্ল্ড"-এ পৌঁছে গেলাম। একটু কফি মনে হয় পান করা যেতে পারে। আমার খুব পছন্দের জায়গা এটি।
আমেরিকানো কফির মগে চুমুক দিতে পাশের টেবিলে হঠাৎ নজর গেলো। ২১ কি ২২ বছর বয়সী দু'জন ছেলে মেয়ে বসে আছে। এই বয়সটাই অন্যরকম। একসময় আমিও ছিলাম, ছিল অন্যরকম একটি জগৎ। সে জগতেও তুমি ছিলে। মনে আছে কি আমি আর তুমি মাঝে মাঝে সেই ধানমন্ডির "কফি ওয়ার্ল্ড"-এ যেতাম। কত কথাই যে আমি শুধু বলতাম আর তুমি শুধু শুনে যেতে। কেনো যে এত শান্ত ছিলে তুমি তা আজো আমার কাছে রহস্য রয়ে গেল। তোমার ব্যবহার দেখে মনে হত আমি একটা বাচ্চা ছেলে , যে কিনা সারাদিন স্কুলে কি করেছে তা এসে তোমার কাছে বলছে। ওহ! আমি তোমার কথা কেনো ভাবছি এখন? আজ তো সময়গুলো শুধুই আমার। আমি শুধু আমাকে নিয়েই ভাববো।
কফি শেষ না করেই বের হয়ে গেলাম। সন্ধ্যা প্রায় কাছাকাছি।
আবার পা দু'টোকে চলন্ত করলাম।শার্টের হাতা দু'টোও ভাঁজ করে নিলাম। আচ্ছা, এয়ারপোর্টের ওদিকে গেলে কেমন হয়?
কতক্ষণ লাগলো জানিনা, সেই কখন থেকেই হাঁটছি। প্রায় কাছাকাছি পৌঁছে গেলাম এয়ারপোর্টের। মানুষ আসছে আবার যাচ্ছে।
কেউ আসছে প্রিয়জনকে বিদায় দিতে, কেউবা প্রিয়জনকে স্বাগত জানাতে। আমাদের জীবনের জন্ম-মৃত্যর সাথে কতইনা মিল।
জন্মের শুভ লগ্নে আপনজন পাশে থাকে নবজাতককে স্বাগত জানাবার জন্য। আর মৃত্যুর পর কবরে বা শশ্মানেও আমরা বিদায় দিয়ে আসি। আমি তোমাকে কতবার বিদায় দিয়েছি?
মনে পড়ে কি তোমার, যেদিন আমি এয়ারপোর্টে এসেছিলাম তোমাকে বিদায় দিতে। তুমি সেদিন হুইল চেয়ারে বসেছিলে। তোমার মা-বাবা একটু দূরে সরে যান যেনো আমরা ভালমত কথা বলতে পারি। সেদিন তোমার হাত দু'টো ছিল খালি। আমি তোমার হাত দু'টো ধরে কাঁদছিলাম। তুমি আমাকে কপট রাগ করে বলেছিল কেনো আমি এমন করছি। কোনো জানো? আমি তো তোমাকে এভাবে দেখিনি আগে। তোমার হাত দু'টোতে থাকতো কাঁচের চুঁড়ি।আর সবসময় মুখে থাকতো স্নিগ্ধ হাসি। সেই তুমি কি এই তুমি? তাও আমিতো কথা দিয়েছিলাম, আমি তোমার অপেক্ষায় থাকবো।
মনে আছে আমাদের কি কথা হয়েছিল?
তুমি বলেছিলে তুমি সুস্থ হয়ে আবার আমার কাছে ফিরে আসবে।
আমি তোমার জন্য যেনো হালকা সবুজ আর গাড় হলুদ রঙের কাঁচের চুঁড়ি নিয়ে অপেক্ষা করি এয়ারপোর্টে। আর সাথে যেনো থাকে দোলনচাঁপা ফুল। তুমি কি জানো, যখনি আমি দোলনচাঁপা ফুল পাই, আমার রুমে এনে তা সাজিয়ে রাখি। দোলনচাঁপার সুবাসে মনে হয় তুমি আমার আশেপাশেই আছো।
মনে আছে তুমি বিদায়বেলায় আমাকে কি বলেছিলে?
বলেছিলে আমি যেনো কখনো তোমাকে ভুলে না যাই। মনে হয় ভুলে গেলে কতইনা ভাল হতো। শেষ বিদায়টা কি মনে আছে?
তুমি ঘাড় বাঁকিয়ে বারবার আমাকে দেখছিলে, আর চোখ কি ভেজা ছিলনা?
আমার ছিল। আমি নিজেকে আটকাতে পারিনি। হয়ত বা সেটাই শেষ দেখা ছিল বলে। তুমি জানো, তুমি চলে যাবার পরও ২ ঘন্টা আমি সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম।চোখের পানি থেমে গিয়েছিল সেই কখন কিন্তু মনের অশ্রু কি থেমেছিল?
আজ নিজেকে সময় দিতে গিয়েও এয়ারপোর্টের সামনে এসে তোমার কথা মনে পড়ে গেল আবারো। নিজেকে আর সময় দেয়া হলনা। মনে হচ্ছে তুমি আমার পাশে দাঁড়িয়ে বেশ মজা পাচ্ছো। কারণ তুমিই তো জয়ী হলে। কেঁড়ে নিলে আমার সমস্ত সময়।
দোলনচাঁপার কিছু তোড়া নিয়ে ঘরে আসলাম। চাবি দিয়ে খুললাম লকার, আর বের করে আনলাম তোমার জন্য রাখা হালকা সবুজ আর গাড় হলুদের কাঁচের চুঁড়ি। সব আছে রাখা আজ তোমার জন্য। দোলনচাঁপা ফুল আর কাঁচের চুঁড়ি। শুধু আজ তুমিই নেই।
মনকে সময় দিতে চেয়েছিলাম আজ। কিন্তু মন তো শুধু চায় তোমাকেই সময় দিতে। থাকুক না হয় মন তার অতীত স্মৃতিগুলো নিয়ে। তবুও যদি সে ভাল থাকে.....................
[ আমার লেখা জীবন কাহিনীগুলো বেশ বিরক্তিকর, এটা আমি জানি। তাই আগেই সবার নিকট হতে ক্ষমা প্রার্থনা করে নিচ্ছি।]