somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

দূরদেশের দু'জন : দূরদেশের চিঠি

০১ লা মে, ২০১১ রাত ১২:২২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



নায়লা, সেই বসনিয়ান মেয়েটি যে মাহতাব নামের এক দূরদেশের একজনকে ভালবেসেছে। মুখ ফুটে সে মাহতাবকে বলতে পারেনি কতটা সে ভালবাসে মাহতাবকে। তার ভালবাসা সে প্রকাশ করেছিল একটি চিঠির মাধ্যমে। দীর্ঘ সময় পর সেই চিঠিটি অবশেষে পৌঁছালো মাহতাবের কাছে। তাদের জীবনের গল্প শোনা যাক তাহলে।

অনলাইনে বসলেই নায়লার এখন প্রধান কাজ, প্রথমেই মেইল চেক করা। মাহতাব কোনো মেইল করলো কিনা সেটা সে দেখে ঘুম থেকে উঠেই। বেশিরভাগ সময়ই মেইল বক্সে কোনো নতুন মেইল আসেনা। কিন্তু সে আশায় থাকে, এমন এক সময় আসবে যখন মাহতাব প্রতিটি দিন একটি করে মেইল পাঠাবে। যেখানে শুধুই ভালবাসার কথা লেখা থাকবে। তার দিনটি যেন শুরু হবে তার প্রিয় মানুষটির কথা দিয়ে। তবুও শান্তি যে মাহতাবের সাথে তার প্রতিদিনই কথা হয় ফোনে কিংবা অনলাইনে। আগের মত মাহতাব আর এড়িয়ে চলেনা তাকে। তবুও কেন যেন একটু বেশিরকম গম্ভীর মাহতাব। মনে হয় কিছু একটা বলতে চায় কিন্তু পারেনা বলতে।

নায়লার মা-বাবা একটা ব্যাপার বেশ লক্ষ করছে ক'দিন ধরে। তাদের মেয়েটা আগের মতো খুব বেশি চুপচাপ থাকে না, একা একা থাকেনা। মেয়েটার মুখের হাসি দেখেলেই প্রাণটা জুড়িয়ে যায় তাদের। ইদানিং ভিনদেশি এক ছেলের ছবি দেখিয়েছে তাদের। কম্পিউটারে ছবিটা দেখানোর সময় কেমন যেন একটা আবেগ তারা দেখতে পেয়েছিল নায়লা দু'চোখে। ছেলেটাকে চেনে তারা, জার্মানীতে বেড়াবার সময় দেখা হয়েছিল তাদের সাথে।

দেশে আসবার পর মাহতাব ব্যস্ত হয়ে পড়ে তাদের পরিবারের ব্যবসা নিয়ে। নিজেকে খুব বেশি ব্যস্ততার মাঝে রেখেই যেন তার শান্তি। নিজের মন থেকে নিজেকেই সড়িয়ে রাখতে চায় সে। কেন যেন আজকাল নায়লা মেয়েটি আস্তে আস্তে তার জীবনে জড়িয়ে পড়ছে। খুব বেশি খেয়াল রাখতে চায় মেয়েটি। কিন্তু এটা কি করে সম্ভব, দূর হতে কি এত ভালবাসা যায় কাউকে? আর কেনই বা মাহতাব ভালবাসতে যাবে নায়লাকে? ভাবনায় পড়ে যায় মাহতাব। কিছু অতীতের স্মৃতি যেন বারবার ব্যথা দিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। ভাবনার মাঝে এসে যায় ছেদ। নায়লার একটি চিঠি হাতে আসে তার। পড়া হয়না সেটা, রেখে দেয় নিজের ড্রয়ারে। আর কিছু না ভেবেই একটি চিঠি লিখতে বসে যায় মাহতাব, পাঠাবে সেই দূর এক দেশের একজনের কাছে। অনেক কথা আছে যা মুখ ফুটে বলা যায় না, কিন্তু চিঠিতে বলা যায়। মেইল করতে পারে সে, কিন্তু হাতের লেখার মর্ম কি বুঝবে যন্ত্র?

নায়লা খুব আগ্রহ নিয়ে বাংলা ভাষা শিখছে। ইন্টারনেট ঘেঁটে, মাঝে মাঝে মাহতাবকে জিজ্ঞেস করে। মাহতাবদের দেশের ভাষা বাংলা। এই ভাষার প্রতি অনেক শ্রদ্ধা নায়লার। রক্ত দিয়ে পাওয়া সেই ভাষার প্রতি মনে শ্রদ্ধা না এসে কি পারা যায়? তার মেসেন্জারের স্ট্যাটাসে লিখে রাখে Ridoye Bangla. মাহতাব জিজ্ঞেস করে,
- তুমি কি জানো এটার মানে?
- জানি।
- কিভাবে?
- আমি অনলাইনে সময় পেলেই বাংলা ভাষা এবং তোমার ভালবাসার দেশকে নিয়ে পড়াশুনা করি। আস্তে আস্তে শিখবার চেষ্টা করছি।
- কেন?
- কারণটা বলতে পারি। তবে ভাল হয়, আমার চিঠিটা পড়লে। কেন এখনও পড়নি চিঠিটা।
- পড়বো, সময় হলেই পড়বো। আর কথা বাড়ায় না মাহতাব।

আজকাল বাংলা গান শোনাও শুরু করেছে নায়লা। কিছুটা বিপদই বলা যায় মাহতাবের জন্য। গানের অনুবাদ করে দিতে হয়। অর্থ বুঝিয়ে দিতে হয়। মাহতাব একটু একটু অনুভব করে, তার ভেতরের নিষ্প্রাণ ভাবটা কেমন যেন কমে আসছে। কিন্তু তবুও সে আবেগকে পাত্তা দিতে চায় না। জড়াতে চায় না কারও বন্ধনে। কিন্তু এই ভিনদেশি মেয়েটা কিভাবে যেন তার সবকিছুতে ভাগ বসাচ্ছে আজকাল। হুট করে ফোন দেবে, কথা বলবে। মাঝে মাঝে অফিসে থাকলে বেশ বিরক্ত হয় মাহতাব। মাঝে মাঝে একটু রাগও করে। কিন্তু মেয়েটি যেন কোনো কিছুই মনে করেনা।

সাগর পাড়ের এক শহরে মাহতাব। মাঝে মাঝে একাই ছুটে আসে মনের ক্লান্তি দূর করবার জন্য। ল্যাপটপের ব্যাগে সে দেখতে পায় নায়লার চিঠিটি, যা এখনো খুলে পড়া হয়নি।

নায়লার মন-প্রাণ এখন ক্যানভাসটির দিকে। একটি ছবি একে যাচ্ছে সে। ঝড়ের রাতে পাশাপাশি একটি ছেলে এবং মেয়ে হাত পরস্পরের হাত ধরে হেঁটে চলেছে নির্জন রাস্তায়। ছবির জন্য রং যেমন লাগে তেমনি সেটি রাঙাতে লাগে মনের আবেশ। সেটা দিয়েই হয়ত সে এঁকে চলেছে। বাঁধা পায় তার ছোট্ট বোন আমিনার ডাকে, চিঠি হাতে আমিনা দাঁড়িয়ে। হাতে নিয়ে দেখে মাহতাবের চিঠি। সে কি করবে ঠিক বুঝতে পারছেনা। খুশি আর বিস্ময়ে হতবার হয়ে পড়ে। ছেলেটা একবারও বলেনি তাকে যে চিঠি পাঠিয়েছে তাকে। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নেয় সে, এই চিঠি সে পড়বে তার প্রিয় একটি স্থানে। তার বাড়ি হতে কিছুটা দূরে সেই লেক, মন ভাল থাকলে নায়লা আসে এই লেকের পাড়ে। বসে থাকে অনেকক্ষণ। তার মাহতাবের চিঠি সে পড়বে তার সেই লেকটির পাড়ে বসে।




সাগর হতে একটু দূরে, বালির উপর বসে মাহতাব পড়ে যাচ্ছে নায়লার সেই চিঠিটি। পাতার পর পাতায় লেখা শুধু তার প্রতি মেয়েটির ভালবাসার কথা। যা আঁচ করে ছিল মাহতাব তাই হলো। মেয়েটি অনেক ভালবাসে তাকে। স্বপ্ন তৈরি করেছে তাকে নিয়ে। কিন্তু এ যে হবার নয়। কেন বিধাতা এভাবে খেলা করেন? বারবার কিছু লেখা শুধু ভেসে উঠছে তার চোখে,

আমি তোমাকে এত ভালবাসা দেবো মাহতাব যে সব ব্যথা ভুলে যাবে তুমি। আমি তোমাকে এত ভালবাসবো যে ঝড়ের মাঝে আমি তোমাকে যখন আঁকড়ে ধরবো, ঝড়ও হার মানবে আমার ভালবাসার শক্তি দেখে। সাগর অবাক হবে দেখে যে তার স্রোতধারা নি:শেষ হয়ে যাবে, কিন্তু আমার ভালবাসা শেষ হবে না। আসবে একবার মাহতাব, আসবে একটিবার শুধু আমার কাছে? শুধু একটিবার দেখা দেবে আমাকে, আমি শুধু তোমার হাত দু'টি ধরে বলতে চাই, আমি তোমাকে ভালবাসি মাহতাব। এসো না একবার এই মেয়েটিকে দয়া করে?

লেকটির চারপাশ আস্তে আস্তে আলো হারাচ্ছে এই ভর বিকেলেও। মেঘ জমছে গাঁঢ় আকারে। এর থেকেও গাঁঢ় মেঘ যে পাড়ে বসা নায়লার মনে। অশ্রুর ক'ফোঁটা গড়ালো গাল থেকে। এক অজানা বেদনার কাহিনী সমাপ্ত করলো সে চিঠি হতে। আজ সে অনুভব করছে, কেন মাহতাবের মনে এতটা দু:খ ছিল। ছেলেটির জন্য হৃদয়টা ছিঁড়ে যাচ্ছে তার। চিঠির ক'টি লাইন যেন বারবার ব্যথা দিয়ে যাচ্ছে। যেখানে ছিল লেখা,

এমন একজন ছিল, যাকে অনেক ভালবাসতাম। এমন একজন ছিল, যে আমাকে দিয়েছিল এক সুন্দর ভুবন। ভালবাসার চাদরে সে দূর করে দেয় সব ব্যথা। আমি শুধু তাকেই ভালবাসতাম। চিরদিনের জন্য সে দূরে চলে গিয়েছে। তবু সে আমার অনেক কাছে। আমি শুধু তাকেই ভালবাসি, ভালবেসে যাব আজীবন। মৃত্যু মানেই ভালবাসার শেষ নয়, ভালবাসার শেষ কখনও হয় না।

চিঠির পাতাগুলো নায়লার হাত থেকে পড়ে গেল। দু'হাত দিয়ে মুখটা ঢেকে ফোঁপাচ্ছে মেয়েটি। গাঢ় সাগর নীল দু'নয়নে জলের ধারা বয়ে চলেছে।

বালির উপর চিঠির পাতাগুলো রেখে উঠে দাঁড়াল মাহতাব। চলে আসছিল সে ফিরতি পথে। হঠাৎ পিছু ফিরে দেখে চিঠির পাতাগুলো বাতাসে গড়াগড়ি ঠিক তার কাছেই এলোমেলো হয়ে ফিরে আসছে। একটি পাতা শুধু রয়ে গেছে দূরে। সব ক'টা পাতা হাতে নিয়ে সেই একটি পাতা নিতেই ছুটে চলে যায় সে.......................

দু'চোখ মুছে দাঁড়ায় নায়লা, মনকে বোঝায় সে, নায়লার খুব প্রয়োজন মাহতাবের। তার বিশ্বাস, তার ভালবাসাই পারবে মাহতাবের সকল বেদনা দূর করে দিতে। মাহতাবকে সে এত ভালবাসে, এই ভালবাসার কি কোনো মূল্যই নেই? সে দেবে মাহতাবকে নতুন এক জগৎ, ভালবাসার জগৎ। হঠাৎ খেয়াল করে, মাহতাবের চিঠির পাতাগুলো ঝড়ো বাতাসে উড়ে যাচ্ছে। চিঠির পাতাগুলো পিছু ছুটে চলে মেয়েটি, পাতাগুলোর প্রতিটি অক্ষরে যে তার মাহতাবের ছোঁয়া। অদৃশ্য যে দেয়াল গড়ে তুলেছে মাহতাব নিজের ভেতর, সেই দেয়ালটিকে ভেঙ্গে ফেলার জন্যই যেন ছুটে চলেছে নায়লা।

ছুটে চলেছে দু'জনই, দু'টি ভিন্ন প্রান্তে। শুধু জানেনা কখন শেষ হবে নিয়তির সাথে ছুটে চলা এই দূরদেশের দু'জন।


[ শুধুই গল্প ]
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা মে, ২০১১ রাত ১২:২২
১০২টি মন্তব্য ১০২টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×