somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আজ ১০ নভেম্বর জুম্ম জনগণের ইতিহাসের এক কালো অধ্যায়

১০ ই নভেম্বর, ২০১৬ সকাল ৮:১৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আজ ১০ নভেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক, সাবেক সাংসদ মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার ৩৩তম মৃত্যুবার্ষিকী। পার্বত্য চট্টগ্রামের অবিসংবাদিত এই নেতা আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় ১৯৮৩ সালের ১০ নভেম্বর দলীয় অন্তর্দ্বন্দ্বে অপর আট সহকর্মীসহ নিহত হন। পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীরা এই দিনটিকে জুম্ম জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালন করে আসছে।



মানুষের জন্ম হলে মৃত্যু অনিবার্য। তবে এমন কিছু মানুষের জন্ম-মৃত্যু আসে, যা সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তেমনই একজন অগ্রপথিক, স্বপ্নদ্রষ্টা, বুদ্ধিদীপ্ত দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মহান নেতা মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা, যিনি এম এন লারমা নামেই বেশি পরিচিত। এম এন লারমার জন্ম ও কর্মময় জীবন পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের চিরনিপীড়িত নির্যাতিত আদিবাসী মানুষকে জাগিয়ে তুলে শিক্ষা ও রাজনৈতিক অধিকার বিষয়ে সচেতন করেছিলেন। আর তাঁর মৃত্যুর যে ক্ষত, তা কোনো দিনই পূরণ হওয়ার নয়।


১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পার্বত্য চট্টগ্রাম উত্তরাঞ্চল আসন থেকে মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এর আগে ১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনেও পার্বত্য চট্টগ্রাম আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জয়লাভ করেছিলেন।

এম এন লারমা কর্মজীবনের শুরুতে শিক্ষিত ছাত্র-যুবকদের সংগঠিত করে ‘গ্রামে চলো’ স্লোগান সামনে রেখে পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত এলাকায় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও আদিবাসীদের শিক্ষায় মনোনিবেশ করার উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানান। তিনি নিজেও ১৯৬৬ সালে খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালা উচ্চবিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন।

তবে ১৯৬৯ সালে এলএলবি পাস করার পর চট্টগ্রাম বার কাউন্সিলে যোগদান করেন। প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি আইন পেশায় যুক্ত ছিলেন। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে সংবিধান প্রণয়নকালে এম এন লারমা পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগণের সাংবিধানিক স্বীকৃতি, পার্বত্য চট্টগ্রামকে বিশেষ অঞ্চলের মর্যাদা দেওয়ার দাবি এবং পাহাড়িদের বাঙালি হিসেবে জাতীয় পরিচয় নির্ধারণ করার প্রতিবাদ করেন।



এই ১০ই নভেম্বর মহান নেতাকে মৃত্য দিয়েছে সঠিক, কিন্তু এই দিনটিতে তাঁর স্বপ্ন গেঁথে গেছে প্রতিটি জুম্ম জনগনের রক্তে। এই সেই মহান নেতা যিনি নিয়মতান্ত্রিক ভাবে দাবি আদায় করতে চেয়েছিলেন, চেয়েছিলেন সামাজিক অনাচার, অত্যাচার, নির্যাতন, শোষন, লুন্ঠন ও জাতিগত নিপীড়নের হাত থেকে জুম্ম জনগনকে বাঁচাতে।

এই সেই মহান নেতা যিনি ১৯৭২ সালের সংবিধানে জুম্ম জনগনের স্বকীয়তাকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি বলে প্রতিবাদ করেছিলেন। প্রতিবাদ করেছিলেন সংবিধানের মাধ্যমে চাকমা, মার্মা, ত্রিপুরা, তনচংগ্যা, মুরং, বম, ওরাও, সাঁওতাল, কোচ, গারো সহ অন্যান্য আদিবাসী গোষ্ঠীসমূহকে তাঁদের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, জাতি পরিচয় থাকা সত্বেও স্বরসঙ্ঘাত করে বাংগালি বানানো হয়েছিলো বলে। জোর করা হয়েছিলো সবাইকে নিজস্ব জাতীয় পরিচয় ভুলে বাংগালি হয়ে যেতে।

কিন্তু সংসদে মানবেন্দ্র নারায়ন লারমা তাগড়াই উত্তেজনায় প্রতিবাদ করেছিলেন যে,“আমি বাঙালি নই” “আমি যে অঞ্চল থেকে এসেছি , সেই পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীরা যুগ যুগ ধরে বাংলাদেশে বাস করে আসছে । “বাংলাদেশের কোটি কোটি জনগণের সাথে আমরা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সব দিক দিয়েই আমরা একসঙ্গে একযোগে বসবাস করে আসছি। কিন্তু আমি একজন চাকমা। আমার বাপ, দাদা, চৌদ্দ পুরুষ – কেউ বলে নাই আমি বাঙালি”



কিন্তু সংবিধান প্রণয়ন কমিটি তাঁর দাবি ও প্রতিবাদ অগ্রাহ্য করে। এসব দাবি আদায়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তুলতে ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি গঠন করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি। তিনি হন সমিতির সাধারণ সম্পাদক। পরে ১৯৭৩ সালে জনসংহতি সমিতির সভাপতির দায়িত্ব নেন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন ঘটলে এম এন লারমা পাহাড়ি ছাত্র-যুবকদের নিয়ে আত্মগোপনে যান।

একদিকে জুম্ম জনগনের অশ্রুতে নির্মিত পাকিস্তান আমলের কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের বাঁধ, অন্যদিকে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতিগত বৈষম্য। সবকিছুই কেবল কাঁদিয়েছিলো এই জুম্ম জনগনকে। শোষণমুক্ত সুন্দর স্বাধীন বাংলাদেশকে রূপ দিয়েছেন এই বাংলার দামাল ছেলেরা এক সাগর রক্তের বিনিময়ে শুধুমাত্র শোষন, নির্যাতন ও বঞ্চনাকে চিরতরে দ্বীপান্তর করার জন্য।

যার আচ্ছাদন থেকে মুক্তি মিলেনি পার্বত্য জুম্ম জনগনের। যার নৈতিক প্রতিবাদ জানিয়েছেন মহান নেতা এমএন লারমা। কিন্তু জুম্ম জনগনের এই নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পথ রুদ্ধ করে দেওয়া হয় কয়েকটিমাত্র ভ্রান্ত অজুহাতে।

তারপরেও মহান নেতা নিয়মতান্ত্রিকভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তিপূর্ন সমাধানের পথ খোলা রেখেছিলেন। কিন্তু জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডের পর সেই খোলা পথটিও বন্ধ করে দেওয়া হয়। বাড়তে থাকে জুম্ম জনগনের উপর অত্যাচার, নিপীড়ন, ভূমি দখল। আর এইসব কারনে বাড়তে থাকে জুম্ম জনগনের প্রতিরোধ। এই প্রতিরোধে সুদক্ষ নেতা ভালোভাবে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু এই প্রতিরোধে ভাটা পড়ে শান্তিবাহিনীর বিভাজনের কারনে।

আত্মগোপন অবস্থায় নিজ দলের বিভেদপন্থী একটি অংশের হাতে এম এন লারমা নিহত হন। দাবি আদায়ে সশস্ত্র আন্দোলন গড়ে তুললেও এম এন লারমা সব সময় চেষ্টা করেছিলেন আলোচনার মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের। সেই পথ ধরে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর সরকার ও জনসংহতি সমিতির মধ্যে সই হয় পার্বত্য চুক্তি, যা পরে পার্বত্য শান্তি চুক্তি নামে পরিচিতি পায়। পার্বত্য চুক্তির মাধ্যমে এম এন লারমার স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথের দেখা পেলেও শাসকগোষ্ঠীর নানা ছলচাতুরীতে তা হচ্ছে না। সে কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনপদ আবার অশান্ত হয়ে ওঠার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এম এন লারমা পারিবারিক গণ্ডি থেকে গণতান্ত্রিক ভাবধারার অধিকারী। ছাত্রজীবন থেকে সমাজ, সংস্কৃতি ও ইতিহাস বিষয়ে সচেতন ছিলেন।

একটি জাতিকে সচেতন করে তুলতে যে বিষয়টি সবচেয়ে বেশি জরুরি, তা হলো শিক্ষা। সেটিই প্রথম করেছিলেন এম এন লারমা। সে কারণে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ-পরবর্তী সময়ে ছাত্র-যুবকদের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা এবং শিক্ষক হিসেবে আত্মনিয়োগ করার নির্দেশনা দিয়েছিলেন। তিনি নিজেও বেছে নিয়েছিলেন শিক্ষকতা পেশা। মূলত সেই সময় থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের শিক্ষার বিস্তার শুরু হয়েছিল।

কারণ তিনি নিজের জাতিসত্ত্বাকে শোষন, নিপীরণ, লুন্ঠন থেকে বাঁচাতে চেয়েছিলেন, রক্ষা করতে চেয়েছিলেন নিজের জাতিকে। বৈশিষ্ট্যসমূহকে। মৃত্যু বরন করেছেন পার্বত্য চট্টগ্রামকে বাংলাদেশের সাথে রাখতে চেয়েছিলেন বলে। বাংলাদেশ জুম্ম জনগনকে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেয়নি সত্যি, কিন্তু তিনি মহান নেতা এমএন লারমা বাংলাদেশকে আপন দেশ মনে করেছেন। ভালোবেসেছেন বাংলাদেশকে, ভালোবেসেছেন বিভিন্ন আদিবাসী জাতিসত্ত্বাক্বে।

এম এন লারমা ছিলেন মহান মনের মানুষ। তিনি সবাইকে বিশ্বাস করতেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতিতে যখন অন্তঃকোন্দল শুরু হয়, তখনো তিনি কুচক্রী ও বিভেদপন্থীদের বিশ্বাস করেছিলেন। সে কারণে তিনি দলের মধ্যে ‘ক্ষমা করো ও ভুলে যাও’ নীতি প্রচার করেছিলেন। তবে মানুষের প্রতি তাঁর সেই বিশ্বাস পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসে নিয়ে এসেছে কলঙ্কময় অধ্যায়। তাঁরই কিছু বিপথগামী সহকর্মী এই মহান নেতার মহানুভবতার সুযোগ নিয়ে তাঁকে হত্যা করেছিলেন।

সর্বশেষ এডিট : ১০ ই মার্চ, ২০১৮ রাত ১০:২৩
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কম্বলটা যেনো উষ্ণ হায়

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৮ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৩:৫৭


এখন কবিতার সময় কঠিন মুহূর্ত-
এতো কবিতা এসে ছুঁয়ে যায় যায় ভাব
তবু কবির অনুরাগ বড়- কঠিন চোখ;
কলম খাতাতে আলিঙ্গন শোকাহত-
জল শূন্য উঠন বরাবর স্মৃতির রাস্তায়
বাঁধ ভেঙ্গে হেসে ওঠে, আলোকিত সূর্য;
অথচ শীতের... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইউনুস সাহেবকে আরো পা্ঁচ বছর ক্ষমতায় দেখতে চাই।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১:৪৪


আইনশৃংখলা পরিস্থিতির অবনতি পুরো ১৫ মাস ধরেই ছিলো। মব করে মানুষ হত্যা, গুলি করে হত্যা, পিটিয়ে মারা, লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার করতে না পারা, পুলিশকে দূর্বল করে রাখা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদির যাত্রা কবরে, খুনি হাসছে ভারতে...

লিখেছেন নতুন নকিব, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৬

হাদির যাত্রা কবরে, খুনি হাসছে ভারতে...

শহীদ ওসমান বিন হাদি, ছবি অন্তর্জাল থেকে নেওয়া।

হ্যাঁ, সত্যিই, হাদির চিরবিদায় নিয়ে চলে যাওয়ার এই মুহূর্তটিতেই তার খুনি কিন্তু হেসে যাচ্ছে ভারতে। ক্রমাগত হাসি।... ...বাকিটুকু পড়ুন

'জুলাই যোদ্ধারা' কার বিপক্ষে যুদ্ধ করলো, হ্তাহতের পরিমাণ কত?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৫১



সর্বশেষ আমেরিকান ক্যু'কে অনেক ব্লগার "জুলাই বিপ্লব" ও তাতে যারা যুদ্ধ করেছে, তাদেরকে "জুলাই যোদ্ধা" ডাকছে; জুলাই যোদ্ধাদের প্রতিপক্ষ ছিলো পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি, ছাত্রলীগ; জুলাই বিপ্লবে টোটেল হতাহতের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাদিকে মারল কারা এবং ক্রোধের আক্রশের শিকার কারা ?

লিখেছেন এ আর ১৫, ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:০৩

হাদিকে মারল কারা এবং ক্রোধের আক্রশের শিকার কারা ?


হাদিকে মারল জামাত/শিবির, খুনি নাকি ছাত্রলীগের লুংগির নীচে থাকা শিবির ক্যাডার, ডাকাতি করছিল ছেড়ে আনলো জামাতি আইনজীবি , কয়েকদিন হাদির সাথে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×