somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

এক ঝিরি ঝিরি বৃষ্টির সন্ধ্যায় (আমি আর কেয়া)

২৪ শে জুন, ২০২৫ বিকাল ৩:৫৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



দশ বছর পরে কেয়াকে সামনে দেখে আমার ভেতরটা কেমন যেন ঘোলাটে হয়ে গেল। সময় তাকে বদলেছে, কিন্তু তার চোখের ভাষা একটুও বদলায়নি। সেই গভীর, শান্ত চোখ… যেন আমার জন্যই অপেক্ষা করছিলো এতোটা বছর।
আমরা দু’জনে বসেছিলাম ঢাকার এক ছাদ-রেস্টুরেন্টে। আকাশের গা ধরা মেঘ আর মৃদু আলোয় কেয়া আরও মায়াবী লাগছিলো। হাতে ধরা কাপটায় কফির ধোঁয়া উঠছিলো, আর আমি যেন হারিয়ে যাচ্ছিলাম তার চোখে, তার নিঃশ্বাসে, তার চুপচাপ বসে থাকার অভ্যেসে। আমি তাকিয়ে ছিলাম তার নরম ত্বকে, যেটা সময়কে ছুঁয়ে আরও পরিণত হয়েছে… আর সেই চোখে, যেটায় এখনও গভীর একটা সাগরের মতো শান্তি।
কেয়া হেসে বলল, “তুমি একদম আগের মতোই দেখো।”
আমি হেসে বললাম, “তুমি একদম আগের মতোই অনুভব করাও।”
রেস্টুরেন্টের কোণের দিকে গিয়ে দাঁড়ালাম আমরা। ঝিরঝিরে বৃষ্টির মতো একটা মন কেমন করা অনুভূতি নামছিল আকাশ থেকে, আর আমাদের ভেতরেও।

কেয়া একটা সিগারেট বের করলো, আমি ওর হাতে আগুন দিলাম। দু’জনে ধোঁয়ার ভেতর হারিয়ে গেলাম—নীরব, অথচ স্পষ্ট এক ভাষায়।
আমরা হাত ধরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলাম অনেকক্ষণ। কোনো কথা নয়, কোনো প্রশ্ন নয়—শুধু কেয়া আর আমি।
কেয়া বলল, তোমার কি মনে আছে, প্রথম সিগারেট টা আমি তোমার সাথে খেয়েছিলাম সেই ইউনিভার্সিটি লাইফে।
আমি মৃদু করে হেসে বললাম হ্যাঁ মনে আছে,
কেয়া বলল, সেই থেকে আমি রেগুলার স্মোকিং করি আর প্রতিটি সিগারেটের ধোয়ায় আমি তোমাকে অনুভব করি।

তারপর আমি খুব ধীরে মাথাটা রেখে দিলাম কেয়ার কাঁধে।
সে কিছু বলল না, কিছু সরাল না।
শুধু ওর শরীরের উষ্ণতায় আমি যেন হারিয়ে গেলাম স্বর্গের কোনো বাগানে।
চারপাশে শহরের আলো, ট্রাফিকের আওয়াজ, আকাশের মেঘ, আর আমাদের নিঃশব্দে বলার হাজার গল্প—সব মিলিয়ে এক অপার্থিব সন্ধ্যা।
যেটার কোনো ব্যাখ্যা হয় না…
শুধু অনুভব করা যায়।
সেই অনুভবের নাম—কেয়া।
সেই শান্তির নাম—ভালোবাসা।

কেয়ার কাঁধে মাথা রাখার সেই মুহূর্তটা যেন সময়ের গায়ে জমাট বাঁধা নীরবতা হয়ে রইল।
সে কোনো কথা বলল না, আমি চেয়েও দেখিনি, সে কাঁদছিল কিনা।
তবে তার নিঃশ্বাসে একটা শীতলতা ছিল, যেন কোনো না বলা অভিমান... অথবা দীর্ঘ অপেক্ষার ক্লান্তি।
আস্তে আস্তে বৃষ্টি বাড়ছিল।
রেস্টুরেন্টের ছাদের এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকা দু’টো মানুষ যেন আলাদা কোনো মহাবিশ্বে ছিল, যেখানে শব্দ মানে হয় না, আর স্পর্শ হয়ে যায় একমাত্র সত্য।
"তুমি কখনো ফিরে আসতে?"
কেয়া হঠাৎ প্রশ্ন করল। গলায় কোনো অভিযোগ ছিল না, বরং এক অদ্ভুত শান্তি।
আমি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম।
"জানি না... কিন্তু তুমি আমার মাথা থেকে কখনোই গেলেও… হৃদয় থেকে সরাওনি।"
সে একবার তাকালো, তারপর চোখ সরিয়ে নিলো।
"ভেবেছিলাম, ভুলে গেছো,"
সে বলল, গলার স্বরে একফোঁটা কাঁপুনি।
"না কেয়া, আমি ভুলিনি। শুধু খুব সাহস পাইনি তোমার সামনে দাঁড়ানোর।"
আমি বললাম।
"এই শহর, এই কফি, এই ছাদ – সবকিছু যেন বারবার তোমাকে মনে করিয়ে দিত।"
সে হালকা হাসল।
“তাহলে এসেছো কেন আজ?”
আমি একটু নরম স্বরে বললাম,
"কারণ আজ আর কিছু মনে করিয়ে দিতে পারছিল না। মনে হচ্ছিল, সরাসরি তোমার চোখে না তাকালে আমি নিজেকেই হারিয়ে ফেলব।"
কেয়ার চোখে একটু জল জমে উঠেছিল, কিন্তু সে তা মুছে ফেলেনি।
"তুমি জানো?"
সে ধীরে বলল,
"এই শহরে কেউ নেই যাকে আমি 'তুমি' না বলে ডাকি। তুমি ছাড়া।"
আমাদের মাঝে দূরত্ব ছিল না, তবু যেন একটা দীর্ঘ সময় পার হচ্ছিল—একটা যুগ যেন ঠায় দাঁড়িয়ে ছিল আমাদের মাঝখানে।
আমি কেয়ার দিকে তাকিয়ে বললাম,
"তুমি কি জানো, আমি এখনো সেই রাস্তাটা এড়িয়ে চলি, যেখানে একদিন তুমি প্রথম হাত ধরেছিলে?"
আমি কেয়ার হাত শক্ত করে ধরলাম।
"এবারে আমি আর কোনো রাস্তা এড়িয়ে যাব না, কেয়া। যদি তুমি চাও—চলো হাঁটি, আবার… একসাথে।"
সে কিছু বলল না।
শুধু মাথা নিচু করে বলল,
"চলো, বৃষ্টিটা এখন মনে হচ্ছে বেশ সুন্দর।"

রাত অনেকটাই নেমে এসেছে। ছাদের কোণার সেই কাঁচের নিচে বসে আমরা দু’জন, আর বৃষ্টির টুপটাপ শব্দ যেন আমাদের নিঃশব্দ কথোপকথনের সঙ্গীত হয়ে উঠেছে।
কেয়ার চোখের কোণে তখনো একটু ভেজা ছিল, কিন্তু সেটা বৃষ্টির কিনা—সে আমি বুঝিনি, অথবা বুঝেও জানতে চাইনি।
আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম,
"এই দশ বছরে কী কী হারালে তুমি, কেয়া?"
সে কফির কাপটায় ঠোঁট ছোঁয়াল, তারপর চোখ তুলে বলল,
"নিজেকে।"
একটা হালকা হাসি দিয়ে বলল,
"তুমি তো জানোই, আমি সব কিছু ভেঙে গড়ে নিতে চেয়েছিলাম। ভালোবাসা, ক্যারিয়ার, পরিবার… সব কিছু ঠিকঠাক চলছিল।
কিন্তু তোমাকে ফেলে যাওয়া নিরবতা…
ওটা কোথাও একটা গেঁথে ছিল আমার ভিতরে। আমি অনেক কিছু পেলাম, কিন্তু শান্তি পাইনি।"
আমি চুপ করে গেলাম। আমার গলায় কোনো শব্দ ছিল না তখন।
সে জিজ্ঞেস করল,
"তোমার জীবন কেমন গেল?"
আমি একটু হেসে বললাম,
"বহু দেশ ঘুরেছি, অনেক মুখ দেখেছি, অনেক রাত একা জেগে কাটিয়েছি।
কিন্তু একটা জায়গায় আমি একটুও নড়িনি—তোমার মুখ, সেই বিকেল, সেই বিদায়।
আমার স্মৃতির ঘড়ি যেন সেদিনেই থেমে আছে।"
কেয়া তখন আমার দিকে তাকাল এমনভাবে—যেন প্রথমবার।
আমরা ছাদ থেকে নিচে নামলাম, কিন্তু কোনো গন্তব্য ছিল না। হাঁটছিলাম… শুধু হাঁটছিলাম—সেই পুরনো ঢাকা, ভেজা রাস্তা, নিঃসঙ্গ বাতি, আর দুটি পুরনো হৃদয় এক নতুন পথের খোঁজে।
হঠাৎ সে বলল,
"তুমি জানো, আমি এখন একটা ছোট স্কুলে পড়াই। ছেলেমেয়েদের মাঝে থাকতে ভালো লাগে।
তাদের নিষ্পাপ চোখে আমি কখনো তোমাকে খুঁজে পায়, কখনো নিজেকে।"
আমি হেসে বললাম,
"তুমি তো আসলে এখনো সেই কেয়াই আছো—যে বইয়ের পাতায় ফুল রাখতো, আর জানালার পাশে বসে চুপচাপ বৃষ্টি দেখতো।"
সে থেমে দাঁড়াল, আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
"তাহলে চল, আবার শুরু করি। কিন্তু এবার ভুলের জায়গাগুলো নাড়িয়ে ফেলবো আমরা।
তুমি আসবে তো?"
আমি হাতটা এগিয়ে দিলাম,
"তোমার পাশে থাকা ছাড়া এখন আর কিছুই ঠিকঠাক লাগে না কেয়া।"
সে আমার হাত ধরল।
এই প্রথম, দীর্ঘ এক যুগের পরে, আমরা হাঁটা শুরু করলাম একসাথে—
এক নতুন গল্পের শুরুতে দাঁড়িয়ে, যেখানে অতীত কাঁটার মতো নয়, বরং শেকড়ের মতো।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে জুন, ২০২৫ বিকাল ৩:৫৯
২টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×