somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাংলা সিনেমা রিভিউ: ইভটিজিং - ইতিবাচক পৃথিবীর নেতিবাচক কর্ম

২১ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৩ রাত ৮:০৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সিনেমাহলের একটি বিশেষ ক্ষমতা আছে। অনেকগুলো মানুষকে পেটের মধ্যে নিয়ে অন্ধকার একটি ঘরে ত্রিশ ফুট চওড়া সাদা পর্দায় যখন ছবি চালতে শুরু করে, তখন পেটের ভেতরে থাকা দর্শকরা এক অন্য জগতে স্থানান্তরিত হয়। সেই জগতে সরব থাকে শুধু পর্দার লোকজন, ঘটনা ঘটে শুধু তাদের জীবনে, এপাশে বসে থাকা মানুষগুলো নীরবে সেই ঘটনার সাক্ষী হয়, তাদের আনন্দে হাসে, দুঃখে কাঁদে। সিনেমাহলের এই ক্ষমতাকে ব্যবহার করার জন্য গল্প তৈরী করে ছবি নির্মান করে সাদা পর্দায় প্রক্ষেপন করতে পারাটাই পরিচালকের যোগ্যতা, সিনেমার স্বার্থকতা। ছবি বিচারের এই যদি হয় মাপকাঠি, তবে কাজী হায়াৎ পরিচালিত সিনেমা 'ইভটিজিং' একটি সার্থক চলচ্চিত্র। কিন্তু সিনেমাহলের বাহিরের চিন্তাভাবনা-বিশ্লেষণ যদি মাপকাঠির অন্তর্ভূক্ত হয়, তবে বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজনও বাড়ে।

ইভটিজিং চলচ্চিত্রের প্রধান চরিত্র কাশেম। তার পেশা রিকশা ভ্যানে করে অপঘাতে মৃত লাশ নিয়ে লাশকাটা ঘরে পৌছে দেয়া এবং কাটা লাশ আবার ফেরত নিয়ে আসা। কাশেম পিতৃহীন ও দরিদ্র, পরিবারে তার মা এবং ক্লাস নাইনে পড়ুয়া আদরের ছোট বোন হোসনে আরা। কাশেমের স্বপ্ন ছোটবোনকে 'ম্যাট্রিক' পাশ করাবে কিন্তু ইভটিজিং নামক সামাজিক ব্যাধির শিকারে পরিনত হওয়া হোসনে আরার ঘটনাকে কেন্দ্র করে তার জীবন যে পরিণতির দিকে এগিয়ে যায় সে গল্প নিয়েই ইভটিজিং চলচ্চিত্র।

ছবির নাম ইভটিজিং হলেও ইভটিজিং ছবির একাধিক উপকরণের একটি। চলচ্চিত্রের সম্পূর্ণ গল্পই আবর্তিত হয়েছে প্রধান চরিত্র কাশেমকে কেন্দ্র করে। কাশেম সৎ, সরল, পরিশ্রমী, দায়িত্বশীল, স্নেহপ্রবণ, অনুগত, বন্ধুবৎসল - এই সকল গুণ তুলে ধরার ক্ষেত্রে ইভটিজিং এর ঘটনা অন্যতম সহায়ক উপকরণ। সামগ্রিক দিক বিবেচনা করে চলচ্চিত্রের নাম যদি ইভটিজিং না হয়ে 'কাশেম' অথবা 'মরা টানা কাশেম' হয় - তবে নামকরণ তুলনামূলকভাবে বেশী স্বার্থক হয়। কাশেমের চরিত্র অতি সরলতার দোষেও দুষ্ট হতে পারে। বিশেষ করে, হোসনে আরা যখন নির্যাতনের শিকার হয় তখন কাশেমের আচরণ একে নির্বুদ্ধিতা হিসেবে উপস্থাপন করে।

ইভটিজিং ছবির প্রেক্ষাপট গ্রাম এবং সময় বর্তমান। কাহিনীকার কাজী হায়াৎ অত্যন্ত চমৎকার বুননে যৌক্তিকভাবে নানা ঘটনাবলীর সাথে তুলে ধরেছেন গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী লাঠিখেলা এবং তলোয়ার খেলা। এই দুই খেলার সাথে যাদের ধারনা নেই তারা লাঠি ও তলোয়ার যুদ্ধ বলে ধারনা করতে পারে, কিন্তু এর পোশাক, নৃত্য, বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার ইত্যাদি সম্পর্কে ধারনা করা সম্ভব না। বিলুপ্তপ্রায় এই ঐতিহ্যবাহী খেলাকে বেশ দারুণভাবে তুলে ধরার জন্য কাহিনীকারকে ধন্যবাদ।

ইভটিজিং এর ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। তবে, তার আগে কাজী হায়াৎ এর দৃষ্টিভঙ্গী সম্পর্কে ধারনা থাকা প্রয়োজন। কাজী হায়াৎ এর দৃষ্টিতে পৃথিবী ভালোয় পরিপূর্ণ, প্রায় সবকিছুই ইতিবাচক কিন্তু অল্প কিছু মানুষ এবং তাদের কর্মকাণ্ড পৃথিবীকে কলুষিত করে তুলছে। এই দৃষ্টিভঙ্গীর পরিচয় পাওয়া যায় এমন কিছু ছবির তালিকায় আম্মাজান, ইতিহাস, ওরা আমাকে ভালো হতে দিল না ইত্যাদির পাশাপাশি ইভটিজিং-ও যুক্ত হবে। বরং, অন্যান্যগুলোর তুলনায় ইভটিজিং এ এই দৃষ্টিভঙ্গীর ছাপ তুলনামূলকভাবে বেশী স্পষ্ট। পরিচালকের এই দৃষ্টিভঙ্গী যদি দর্শকের কাছে গ্রহনযোগ্য হয়, তবে 'ইভটিজিং ' ও গ্রহণযোগ্য হবে, অন্যথায় নয়। কাজী হায়াতের ছবিতে ভালো কথা আর পরামর্শ থাকবেই - তার ছবিকে শিক্ষামূলক ছবি বলবেন না নাকি বিনোদনমূলক - সে বিচার দর্শকের।

ছবিতে মোট গান আটটি। একটি আধ্যাত্মিক বাউল গান, একটি লাঠি খেলার গান। বাকী পাঁচটির একটি হিন্দী, চারটি ফোক। প্রত্যেকটা গানই এত চমৎকার হয়েছে যে শুধু গান শোনার জন্য আরেকবার সিনেমাহলে যাওয়া যায়। সুর এবং সংগীত পরিচালনা করেছেন সাগীর আহমেদ - তাকে ধন্যবাদ।

কাশেম চরিত্রে কাজী মারুফ অভিনয় করেছেন। হাতে গোনা কয়েকটা দৃশ্য বাদে তিনি ভালো অভিনয় করেছেন। নাচের দৃশ্যে তাকে আগেও ভালো লাগে নি, এবারও লাগল না - বেশ জড়তাপূর্ণ নৃত্য। কাশেমের প্রতি অনুরক্ত চাচাতো বোন কুলসুমের চরিত্রে তমা মির্জা আকর্ষণীয় এবং চমৎকার অভিনয় করেছেন। এ দুয়ের দৃশ্যগুলো উপভোগ্য। পরিচালক, কাহিনীকার কাজী হায়াৎ অভিনেতা হিসেবে মোটেও চমৎকার নন - আরও একবার এই অনুভূতি হল। মনি ডাক্তার চরিত্রে তাকে শিক্ষক বলে মনে হচ্ছিল। আরও একটু প্রাণবন্ত অভিনয় খুব প্রয়োজন ছিল এই চরিত্রে। কানাই ডোম চরিত্রে কাবিলা যথারীতি ভালো অভিনয় করেছেন।

আলাদা আলাদা ভাবে ছবিতে দুর্বলতা অনেক। পরিচালক রাত-দিনের পার্থক্যকে দর্শকের চোখকে ফাঁকি দেয়ার চেষ্টা করেছেন। কন্টিনিউটি ব্রেক আছে বেশ কিছু। লাঠি খেলা, তলোয়ার খেলার জন্য হাজার লোককে একত্রিত করেছেন, কিন্তু খেলাকে আরও জমিয়ে তুলতে সক্ষম হন নি। সম্পাদনায় জোড়াতালি দেয়ার চেষ্টা হয়েছে। বাণিজ্যিক কারণে নায়িকার শরীরে অহেতুক ক্যামেরা ঘুরে বেড়িয়েছে। কাজী মারুফের কস্টিউম আকর্ষণীয়, কিন্তু বর্তমান সময়ের বিচারে এই কস্টিউম বাতিল। শেষ দৃশ্যে তমা মির্জা র রূপসজ্জাবিহীন মুখ অনেক বেশী পছন্দনীয়।

সামগ্রিক বিচারের মাপকাঠিতে ইভটিজিং সম্পূর্ণ সফল নয়, তবে এফডিসি নির্ভর ছবির তুলনায় ইভটিজিং বেশ ভালো একটি ছবি। ত্রুটি বিচ্যুতি ছাড়িয়ে ছবি যদি দর্শককে তৃপ্ত করতে পারে তবেই পয়সা উসুল - ইভটিজিং দর্শককে তৃপ্তি দিয়েছে।

ছবি মুক্তির আগে থেকেই শোনা যাচ্ছে ইভটিজিং কাজী হায়াৎ এর শেষ ছবি। প্রায় চল্লিশটি চলচ্চিত্রের নির্মাতা এখানেই দাড়ি টানলে দর্শক বঞ্চিত থেকে যাবে। শেষ ছবি হিসেবে ইভটিজিং একটি ভালো সমাপ্তি। ভালো থাকুন কাজী হায়াৎ।

রেটিং: ৪/৫

ছবি কৃতজ্ঞতা: বাংলা মুভি ডেটাবেজ
১৮টি মন্তব্য ১৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×