somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জন্ম নিবন্ধন এবং ওয়ান স্টপ সার্ভিস

০৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ রাত ৮:২৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



শিশুর জন্ম নিবন্ধিত না হলে পাওয়া যাবে না এমন সেবার সংখ্যা উনিশটি। এর মাঝে পাসপোর্ট তৈরির প্রয়োজন না হলে শিশুর বয়স ছয় হবার আগে জন্ম নিবন্ধন নম্বরের প্রয়োজন পড়ে না। এ কারণে আমার ছোট মেয়ের জন্মের বছরখানেক পার হলেও জন্মনিবন্ধনের উদ্যোগ নেয়া হয়নি। উদ্যোগ নেয়ার পরে নিবন্ধন নম্বর পেতে লাগলো দেড় বছর। কেন সেই গল্পটাই বলছি।

মেয়ের বয়স একদিনও কমানোর কোন ইচ্ছা ছিল না, তাই জন্ম সংক্রান্ত সকল কাগজপত্র শুরু থেকেই যত্নের সাথে সংরক্ষণ করেছি। বড় মেয়ের জন্মনিবন্ধন আবেদন করেছিলাম অনলাইনে, দিন পনেরো পরে সিটি কর্পোরেশন অফিসে গিয়ে সনদ নিয়ে এসেছি। এবারও এতটা সহজ হবে ধারণা করেছিলাম। এবারও সেই একই উপায় অনুসরণ করতে চাই।

অনলাইনে আবেদন করতে গিয়ে দেখি মেয়ের জন্ম নিবন্ধন করতে আমার ও স্ত্রীর জন্ম নিবন্ধন নম্বর প্রয়োজন। দুজনেরই সতেরো অংকের জন্ম নিবন্ধন নম্বর ও সনদ আছে কিন্তু অনলাইনে আবেদন করতে গেলে আমার জন্ম নিবন্ধন নম্বর অকার্যকর দেখায়। ওয়েবসাইটেই জন্ম নিবন্ধন নম্বর যাচাইয়ের সুযোগ আছে। সেখানে দেখা গেল আমার জন্ম নিবন্ধন সংক্রান্ত কোন তথ্য ডেটাবেজে সংরক্ষিত নেই।

ওয়েবসাইটেই জানা গেল, যেখানে কাগজে কলমে জন্ম নিবন্ধিত হয়েছিল সেখানকার রেজিস্টার থেকে তথ্য পাওয়া গেলে ডেটাবেজে যুক্ত করার আবেদন করা যাবে। সমস্যা হলো, আমার তৎকালীন বর্তমান ঠিকানা ছিল চট্টগ্রাম আর আমি চট্টগ্রাম ত্যাগ করেছি দেড় যুগ আগে। ছোট ভাইকে দায়িত্ব দিয়ে পাঠালাম কাউন্সিলরের অফিসে। সেখানকার কর্মকর্তারা একবাক্যে জানিয়ে দিলেন জন্ম নিবন্ধনের কোন রেজিস্টার সংরক্ষিত নেই, নতুন করে আবেদন করতে হবে। তথ্যটা আমাকে হতবুদ্ধি করে দিল। এত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংরক্ষিত নেই নাকি কর্মকর্তাগণ পুরাতন রেজিস্টার খুঁজে বের করতে অনাগ্রহী – সেটা নিশ্চিত হওয়া গেলো না।

নতুন করে জন্ম নিবন্ধন করার কোন আগ্রহ পাচ্ছিলাম না। জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্সের মত ডকুমেন্ট থাকা সত্ত্বেও পুনরায় জন্ম নিবন্ধন নম্বর কেন প্রয়োজন তা ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না। বিভিন্নজনের সাথে কথা বলে একই রকম ভুক্তভোগী আরও অনেককে পাওয়া গেল। সরকার প্রায় দশ কোটি লোকের জন্মনিবন্ধন সংক্রান্ত তথ্য হারিয়েছে – এমনটাও শুনলাম একজনের কাছে। শুনতে অবিশ্বাস্য লাগলেও উড়িয়ে দিতে পারলাম না, আমার সহ কিছু লোকের তথ্য যে হারিয়েছে সেটা তো নিশ্চিত। একটি লোকের তথ্য হলেও সেটা হারিয়ে যাবে কেন?

এর মধ্যে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় জন্ম নিবন্ধনের সমস্যা নিয়ে বেশ কিছু প্রতিবেদন প্রকাশিত হলো। সারা দেশেই বহু লোক একই সমস্যায় পড়েছে এমন সংবাদ সেখানেও পাওয়া গেল। আমিও অসীম ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করতে লাগলাম। মেয়ের বয়স ছয় হতে আরও কয়েক বছর বাকী, ততদিন পর্যন্ত নাহয় অপেক্ষা করবো।

কয়েক মাস পরে কাঙ্ক্ষিত সংবাদ পাওয়া গেল। আবেদন প্রক্রিয়ায় কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। এখন বাবা-মায়ের জন্ম নিবন্ধন নম্বর না হলেও আবেদন করা যাবে। এবার নতুন উদ্যমে আবেদন করতে গিয়ে নতুন এক সমস্যার সম্মুখীন হতে হলো। আবেদন প্রক্রিয়ায় কয়েকটি ধাপ রয়েছে। তৃতীয় ধাপে হাসপাতালের সনদ ও স্থায়ী ঠিকানার প্রমাণক আপলোড করতে হয়। যতবারই আপলোড করি না কেন, ডকুমেন্ট প্রিভিউ হয় না। আর ডকুমেন্ট প্রিভিউ না হলে পরের ধাপে যাওয়া সম্ভব হয় না। আমি প্রতিদিন কয়েকবার করে চেষ্টা করে ব্যর্থ হই। দিনে চেষ্টা করি, রাতেও করি – সার্ভার ব্যস্ত থাকতে পারে এই চিন্তা থেকে গভীর রাতেও চেষ্টা করি কিন্তু সফল হই না।

সমাধানের জন্য ইমেইল করলাম। সেই মেইলের কোন উত্তর এলো না। অবশ্য আমাদের এই ডিজিটাল বাংলাদেশের সরকারী প্রতিষ্ঠানে ইমেইলের রিপ্লাই পাওয়া সৌভাগ্যের ব্যাপার। বহু ইমেইলের কোন রিপ্লাই না পাওয়ার পর থেকে আমি এখন আর ইমেইলের উত্তর আশাও করি না।

আমার অসীম ধৈর্যের কারণেই সম্ভবত মহান রাব্বুল আলামীন সদয় হলেন, একদিন হঠাৎ ডকুমেন্ট প্রিভিউ হলো এবং সফলভাবে আবেদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা গেলো। আবেদনের প্রিন্টেড কপি এবং আপলোডকৃত ডকুমেন্টের কপি নিয়ে পরদিন খিলগাঁও-এ ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের আঞ্চলিক কার্যালয়ে হাজির হলাম।

জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন, ট্রেড লাইসেন্স ইত্যাদি সেবা প্রদানের জন্য সেখানে ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে দেখে বেশ ভালো লাগলো। দীর্ঘ লাইনে আধাঘন্টা দাঁড়িয়ে বুথে উপস্থিত হলে কর্মচারী ভদ্রলোক বর্তমান ঠিকানার প্রমাণক হিসেবে পানি, গ্যাস বা বিদ্যুৎ বিলের কপি চেয়ে বসলেন। বললাম, ওয়েবসাইটে এর ডকুমেন্টের কথা উল্লেখ ছিল না। ভদ্রলোক দেয়ালে সাঁটা কাগজ দেখিয়ে দিলেন – সেখানে লেখা রয়েছে। বললাম, গ্যাস ব্যবহার করি সিলিন্ডার, বিদ্যুৎ প্রিপেইড মিটারে, পানির বিল বাড়িওয়ালার কাছে। কর্মচারী নির্বিকার – নিবন্ধনের ঠেকা তার নয়, আমার।

বাড়িওয়ালার কাছ থেকে পানির বিলের কপি নিয়ে সেকেন্ড টাইম ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেন্টারে হাজির হলাম। ভদ্রলোক এবার বাচ্চার টিকা সনদ চেয়ে বসলেন। দেয়ালে সাঁটানো কাগজ দেখে নিলাম, সেখানে টিকা সনদের উল্লেখ নেই। বুদ্ধি করে সাথে বাচ্চার সকল ধরণের কাগজপত্র নিয়ে এসেছিলাম, সেখান থেকেই দেখানো গেলো। এবার তিনি পঞ্চাশ টাকা চাইলেন – জন্ম নিবন্ধন ফি। ওয়েবসাইটে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুর জন্ম নিবন্ধন ফি বিশ টাকা উল্লেখ থাকলেও বাড়তি ত্রিশ টাকা দিতে আপত্তি করলাম না। এক আবেদন জমা দিতে দুদিন অফিস থেকে দুই ঘন্টা করে ছুটি নিয়েছি, কোন অযুহাতে নিবন্ধনের আবেদন বাতিল করে দিলে ফেঁসে যাওয়ার ভয় আছে।

আবেদন জমা দিয়ে দেয়ালে সাঁটানো যত নোটিশ আছে পড়ে ফেললাম। ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেন্টারের নিয়মকানুন অদ্ভুত – আবেদন জমা নেয়া হয় সকালে, সনদ বিতরণ হয় বিকেলে। নতুন সরকারি মোতাবেক অফিসের সময়সূচী পাল্টেছে, তাই সনদ নিতে দুপুর একটা থেকে তিনটার মধ্যে বিতরণ হবে, অথচ আমার অফিস শেষ হয় পাঁচটায়। নোটিশে আরও বলা আছে, সাত দিনের মধ্যে এমএসএস এর মাধ্যমে নিবন্ধনের সংবাদ না পেলে অফিসে যোগাযোগের অনুরোধ জানানো হয়েছে।

সাত দিন নয়, দশ দিন পরে এসএমএস এলো -Birth registration application status: Registered. অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে অফিস থেকে এক বেলা ছুটি নিয়ে চলে এলাম জন্ম নিবন্ধন সনদ নিতে। এখানেও ভীড় ঠেলে আধাঘন্টা পর বুথে উপস্থিত হলে ভদ্রলোক বিরস মুখে জানালেন, সনদ প্রিন্ট হয় নাই, আগামী সপ্তাহে আসেন।

দুঃখে-আফসোসে পরের সপ্তাহে নয়, পরের মাসে উপস্থিত হয়ে এক কক্ষ থেকে সনদ কোন তারিখে প্রিন্ট হয়েছে তা জেনে নিয়ে বুথ থেকে সনদ সংগ্রহ করলেও ওয়ান স্টপ সার্ভিস বলতে আসলে কি বোঝায় তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই গেলো।

উত্তর পেলাম পাশের টেবিলের দুই কলিগের কাছ থেকে। দুজনেরই জন্ম নিবন্ধন করানো প্রয়োজন কিন্তু আনুষঙ্গিক কাগজপত্র সংগ্রহের জন্য স্থায়ী ঠিকানায় যাতায়াতের সময় ও সুযোগ নেই। তারা গেলেন মধ্য বাসাবোতে আউয়াল বিরিয়ানীর পাশে অবস্থিত সালাম কম্পিউটার্সে। চৌকস ছেলে সালাম কম্পিউটারে আবেদন করে দিলেন, প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের দরকার হবে না বলেও নিশ্চয়তা দিলেন। সন্ধ্যায় তার কাছ থেকে সিটি কর্পোরেশনের লোক এসে আবেদনপত্র নিয়ে গেল৷ পরদিন সকালে কলিগদের মোবাইলে মেসেজ এলো, সন্ধ্যায় সনদের ডেলিভারি পেলেন উনারা। সব সেই সালামের দোকানেই। বিনিময়ে অবশ্য নগদ বারোশ টাকা দিতে হলো সালামকে, কারণ, সালামের ভাষ্যমতে, স্যারদের ‘রেট এখন একটু বেশী’।

ওয়ান স্টপ সার্ভিস তো একেই বলে, নাকি?

দারাশিকো'র ব্লগ
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ রাত ৮:২৭
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দাদার দাদা।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৫৫

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী।

আমার দাদার জন্মসাল আনুমানিক ১৯৫৮ সাল। যদি তার জন্মতারিখ ০১-০১-১৯৫৮ সাল হয় তাহলে আজ তার বয়স... ...বাকিটুকু পড়ুন

জেনে নিন আপনি স্বাভাবিক মানুষ নাকি সাইকো?

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১৮


আপনার কি কারো ভালো সহ্য হয়না? আপনার পোস্ট কেউ পড়েনা কিন্তু আরিফ আর হুসাইন এর পোস্ট সবাই পড়ে তাই বলে আরিফ ভাইকে হিংসা হয়?কেউ একজন মানুষকে হাসাতে পারে, মানুষ তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×