somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ফিরে দেখা শৈশব (পর্ব-১: ফুল চুরি) :) :)

১৫ ই আগস্ট, ২০১২ রাত ১০:২৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

উৎসর্গপত্রঃ
অ-আ-ক-খ-গ-ঘ-সহ বাংলায় আর আর যতসব বর্ণমালা আছে সবগুলোকে। এই বর্ণমালার শক্তি ও দাবি যেকোন কিছুর চেয়ে বেশি, অনেক বেশি। শৈশবের গল্পগুলোকে বেশ আয়োজন করেই এই বর্ণমালায় বন্দি করলাম। বর্ণমালাগুলো না থাকলে আমাদের শৈশবের হাসি-কান্না মেশানো অনুভূতিশীল অদ্ভুত মজার গল্পগুলো হয়ত হারিয়ে যেত কোন এক গহীণে………



মুখবন্ধঃ অনেকদিন পর কিছু লিখলাম। এবারের বিষয়বস্তু আমার মেয়েবেলা, শৈশবের সেই দুরন্ত দিনগুলো। ক্ষেত্রবিশেষে কৈশোর এবং তারুণ্যও স্থান পেতে পারে। আর এই পুরো কাজটাই করতে হবে স্মৃতি হাতড়ে হাতড়ে। আমার মত শর্ট-টার্ম মেমরির পক্ষে সেই কাজ অবশ্যই কঠিন, খুব কঠিন। যথারীতি পোস্ট সাইজে বড় হয়েছে। সাইজ দেখে যারা পড়বেন না ঠিক করেছেন পোস্টের শুরুতেই সময়ের গুরুত্ব অনুধাবনের জন্য তাদের আন্তরিক ধন্যবাদ। বাকিদের হাওয়াই মিঠাইয়ের গন্ধে ভরা শৈশবের স্মৃতিময় অধ্যায়ে আমন্ত্রণ।


চোখে আমার লাল-নীল-বেগুনি (মিশনঃ“ফুল চুরি”):

ঘটনার সময়-কাল ১৯৯৮। আমি তখন ক্লাস ফাইভে পড়ি। বয়স নয় কি দশ। ভরা যৌবন বলে একটা কথা আছে কিন্তু ভরা শৈশব নেই। আমার তখন ভরা শৈশব চলে। একেবারে যাকে বলে টইটুম্বুর অবস্থা।B-)B-)

আটানব্বইয়ের রোজার দিনের কথা বলছি। আমরা তখন থাকতাম কবি জসিম উদ্দিন রোডের একতলা একটা টিনশেডে। এক রুমে থাকি আমরা। অন্য দুই রুমে থাকেন আমার বাবার দুঃসম্পর্কের এক ভাইঝি। আপার পাঁচ সন্তান। পেঁপে গাছের চারার মত পিঠাপিঠি ৫ ছেলেমেয়ে। এরা সবাই আমার খালা-মামা হয়। এদের মধ্যে রিয়াজ মামা আমার সমবয়সী। রিয়াজকে আমি মামা ডাকি না। মামা ডাকার কোন কারন নেই। সে আমার বন্ধুর মত। যাবতীয় খেলাধূলা ও দুষ্টুমির সার্বক্ষণিক সঙ্গী। সেই সময়ে আবার আমার সেজ ফুফু-ফুফাজী তাদের ছোট ছেলেকে নিয়ে প্রথম বারের মত আমাদের ঢাকার বাসায় বেড়াতে এসেছেন। তাই ঘরে শাসনের কোন বালাই নেই। আমার স্বভাব মত ধেই-ধেই করে রাত দুপুরে ঘুরে বেড়ালেও বাবা-মা কেউ কিছু বলেন না। বলাই বাহুল্য, আটানব্বইয়ের রোজা কাটছে প্রচন্ড আনন্দে। আহা কি আনন্দ রোজার দিনের আকাশে বাতাসে! B-)B-)

তো আমার ছোটভাই, আমার ফুফাতো ভাই জনি, এবং দুঃসম্পর্কের চার মামারা সবাই মিলে দল বেঁধে ইফতার শেষে তারাবীহের নামাজ পড়তে যায়। নামাজের স্থান কমলাপুর রেল-স্টেশন মসজিদ। ফিরে আসার পর তাদের পাঞ্জাবির দুই পকেট ভর্তি থাকে বাহারি ফুলে। :-B :-B

বেশিরভাগই বিভিন্ন জাতের গোলাপ, গন্ধরাজ, রক্তজবা আর গাঁদাফুল। আমি আবার ছিলাম অতি মাত্রায় পুষ্পানুরাগী।
এতই অনুরাগ যে এলাকায় কোন বিয়ে হবে। অনেক বড় করে গেট সাজানো হল কাঁচাফুল দিয়ে। আমরা বাচ্চা ভয়ংকরের দল জানতে পারলাম আর গিয়ে ওৎ পেতে বসে রইলাম। দারোয়ান সরলেই নতুন বানানো ফুলের গেট ছিড়ে ফুল নিয়ে দৌড়। দারোয়ান ঘটনার আকস্মিকতায় স্তব্ধ। কি হচ্ছে কি এসব? এরা কারা? গেট ছিড়ে তো সর্বনাশ করল! এই ভয়ংকরের দলকে ধরার জন্য পেছনে পেছনে দৌড়াচ্ছে। আমরাও দৌড়াচ্ছি। ধরতে পারলেই নির্ঘাত আছাড় মারবে। কি সাংঘাতিক! আমি আবার গল্পের খেই হারিয়ে ফেলছি। এই গল্প আরেকদিন করব। :):)

তো তারাবীহের নামাজ থেকে ফিরে আসার পর ওদের পকেটে এত এত কাঁচাফুল দেখে আমার আর মুন্নি খালার (শিরীন আপার একমাত্র বড় মেয়ে। ক্লাস সেভেনে পড়তেন) তো বিস্ময়ের সীমা নেই। আমরা প্রতিদিনই ওদের কাছে এত কাঁচা ফুল কোথা থেকে আনছে তার উৎস জানতে চাই। আমার মায়ের পেটের আপন ভাই তো দূরে থাক কোনটাই মুখ খোলে না। X(X(

একদিন দলের সর্ব কনিষ্ঠ মুসুল্লি রাকিবকে (বয়স ছয়/সাত) ধরে আনলাম। বহু জিজ্ঞাসাবাদের পর জানলাম কমলাপুর রেল-স্টেশন মসজিদের পাশে নাকি অনেক বড় একটা নার্সারি আছে। ওরা প্রতিদিন নামাজ পড়ে ফেরার পথে সবাই মিলে ওখান থেকে ফুল চুরি করে আনে। শুধু ওরা না। জসিম উদ্দিন রোডের ওদের সমবয়সী আরো অনেক ছেলেই এই কাজ করে। চারিদিকে এত সুন্দর কাঁচাফুল ফুটে থাকে, চুরি না করে উপায় কি? তাই নামাজ শেষে সবাই মিলে দল বেঁধে ফুল চুরি করতে যায়! :-/:-/

যাই হোক, ঘটনা শুনে ভাবলাম, ওরা তাহলে প্রতিদিন এত এত ফুল চুরি করে আনে? তাহলে আমরা যাই না কেন? এবার নিজেরাই নিজেদের জন্য ফুল চুরি করতে যাব।X(X(

আমি আর মুন্নি খালা চুরির প্ল্যান করতে বসলাম। প্ল্যান এজন্য বলছি কারন ওটা কোন সাধারণ জায়গা ছিল না। কমলাপুর রেলস্টেশনের একটা নার্সারি, সেই সাথে মসজিদ। মুসিল্লিদের কেউ সন্দেহের চোখে না দেখলেও দুইটা মেয়েকে মসজিদের আশেপাশে ঘুরঘুর করতে দেখলে সন্দেহ হতেই পারে। আমাদের পক্ষে খুব বেশিদিন অপেক্ষা করা সম্ভব ছিল না। তাই ঠিক করলাম চুরি করতে যাব পরদিন বাদ ইফতার তারাবীহের সময়। B-)B-)

তবে মুন্নি খালা ছিলেন ভীরু প্রকৃতির মেয়ে। মেয়েরা চুরি করতে যাবে শুনে ছেলেরা বলতে লাগল তোরা দুইটা পারবি না,হারিয়ে যাবি, এই হবে, সেই হবে ইত্যাদি বলে নানাভাবে আমাদের দুজন কে ভয় দেখাতে লাগল। সেইসব প্ররোচণা আমাকে খুব একটা বিচলিত না করলেও মুন্নি খালাকে করল। শেষ মুহুর্তে তিনি যাবেন না বলে বেঁকে বসলেন। ফুল-চুরির মত পালটে ভাল মানুষটি সেজে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। অবস্থা দেখে আমার তো আক্কেল গুড়ুম!:-/:-/

খালা এইসব কি বলছেন? ওদের কথা শুনে না যাওয়ার চিন্তা? এটাতো একেবারে তীরে এসে তরী ডোবানো হবে! সাধারণ কাঠের তরী নয়, একেবারে ইস্টিমার। আমি আবার এত ভালো মানুষ না। আমার জেদ চেপে গেল।X(X(

মুন্নি খালা যেই স্টীমার ডোবালেন আমি সেটা নিজ উদ্যোগে ভাসানোর চেষ্টা করলাম। আমি গ্রাম থেকে আসা ফুফাতো ভাই জনিকে দলে টানলাম। সে আমার চেয়ে দুই তিন বছরের বড়। গ্রামের ছেলে বলে চুরির ব্যপারে সে ওস্তাদ শ্রেণীয়। তাই তাকে দলে টানা। সেইসাথে আছে রিয়াজ। আমরা তিনজন মিলে মিশনে যাব। মিশনঃ “ফুল চুরি”, স্থানঃ কমলাপুর রেল স্টেশন নার্সারি। B-)B-)

কবি জসীম উদ্দীন রোডের সাথে পরিচিত ব্যক্তি মাত্রেই জানেন কমলাপুর রেল স্টেশন আর কবি জসীম উদ্দিন রোড হল কমলাপুর রোডের এপাশ ওপাশ। আমরা যে গলিতে থাকতাম সে গলির শেষেই একটা দেয়াল আছে। সেই একটি দেয়ালের ব্যবধান মাত্র। এপাশ থেকে চিপা দেয়াল টপকালেই ওপাশে স্টেশন।:-*:-*

গল্প পাঠকদের চোখ কপালে তোলার কোন কারন নেই। ভদ্র শ্রেনীর জন্য এ ব্যবস্থা না। তারা রিকশা ভাড়া করবে। তারপর জসীম উদ্দীন রোড, উত্তর অথবা দক্ষিণ কমলাপুর ইত্যাদি ইত্যাদি ঘুরে ফিরে স্টেশানে উপস্থিত হবে। ভাড়া দিবে দশ থেকে পনেরো টাকা। আমরা যাব চুরি করতে। এত আয়োজন করে ঘুরে ফিরে যাবার কি দরকার? ভাত মুখের সামনে দিয়ে খাবার সিস্টেম আছে। সামনে দিয়েই খাব। মাথার পেছন দিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে খাওয়ার কোন মানে হয়?:|:|

তাই যথা সময়ে তিনজন মিলে ইসলাম কটেজের পেছনের গলির সেই বিখ্যাত দেয়ালটা টপকালাম। দেয়ালের অপর পাশে দেখা যায় কাংখিত স্থান, কমলাপুর রেল স্টেশন নার্সারি। নার্সারির ভেতরের পথ দিয়েই মসজিদে যেতে হয়। এই সুযোগে সর্বসাধারণ নার্সারিতে প্রবেশ করে। অন্যদের দেখাদেখি আমরাও ভালো মানুষটি সেজে গুটিগুটি পায়ে ভেতরে ঢুকে পড়লাম। মন কাঁপছে দুরু দুরু। :|| :||

দুই একজন মুসুল্লি আমাদের দিকে বিরক্তি নিয়ে তাকাচ্ছে। কারন আমাদের সবার গায়ে প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় উদ্ভট শীতের পোশাক। উদ্ভট কেন বলছি? আমার গায়ে কি ছিল তার একটা বর্ণনা দিলেই কারন টা পরিষ্কার হবে। প্রথমে একটা টপ-স্কার্ট পরেছি। তার ওপর মোটা মত সোয়েটার। তার ওপর চার পকেট বিশিষ্ট বস্তা সদৃশ একটা নীল জ্যকেট(বস্তুটা আমার ছোট ভাইয়ের। ধার হিসেবে পরেছিলাম। ওটা পরার কারনে আমাকে ছোটখাট একটা নীলহাতি মনে হচ্ছিল)।:-B :-B

এগুলোর সাথে আবার জিন্সের প্যান্ট পরেছি। প্যান্ট ও যেমন তেমন না। একেবারে ডিজুস কোয়ালিটির। তাতে ছয় পকেট। সামনে চার যোগ পেছনে দুই সমান ছয় পকেট। আবার সাথে নিয়েছি একটা লম্বামত ওড়না। এত অদ্ভুত পরিচ্ছদের কারন কি? উদ্দেশ্য ছিল সব পকেট, ওড়না আর স্কার্ট ভর্তি করে অনেক অনেক ফুল নিয়ে আসব। অনেক অনেক ফুল। আনন্দে পেটের ভেতর গুড় গুড় করছিল। যেন তেন আনন্দ নয়! এই ইট কাঠের শহরে ফুল চুরির আনন্দ! B-)B-)

তো আমরা তিন জন হাটতে হাটতে নার্সারির মাঝখানে অন্ধকার মত একটা জায়গায় থামলাম। তারপর এদিক ওদিক তাকিয়ে ভালমত কিছু চারাগাছ বেছে আলাদা আলাদা জায়গায় বসে পড়লাম। বসেই কর্ম শুরু। মনের সুখে ফুল ছিড়ে ছিড়ে পকেটে পুরছি। !:#P !:#P

অন্ধকারে বোঝা যাচ্ছিল না কি ফুল। ঘ্রাণ শুনে বুঝলাম সম্ভবত গাঁদা। অবশ্য এত কিছু দেখার কোন প্রয়োজনও বোধ করছিলাম না। পুষ্পানুরাগীদের কাছে কি পুষ্প পাচ্ছি এইটা কোন বড় কথা না, পাওয়া যাচ্ছে এইটাই বড় কথা। /:) /:)

হঠাত চারপাশে কি যেন একটা পরিবর্তন হল। আমার ফুফাত ভাই জনি স্বভাবে অতি ধূর্ত। গ্রামের ছেলেরা যেমন হয়! প্রাথমিক গন্ডগোলের আভাস পাওয়া মাত্রই সে তার কাছের একটা গেইট ধরে এক দৌড়ে পালিয়ে গেল। সে কেন পালিয়ে গেল এটা বোধগম্য হবার আগেই ধর ধর রব তুলে কেউ তাকে পিছু করল। আবারো আমার আক্কেল গুড়ুম হল। একেবারে গুড়ুম শব্দে গুড়ুম।:-/:-/

এর মধ্যেই পুরো নার্সারির জায়গায় জায়গায় তিন চারজন লোক হা-রে-রে-রে ডাক ছেড়ে ধর ধর চোর চোর রবে দৌড়াদোড়ি করতে লাগল। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি দৌড়াতে ভুলে গেলাম। কিংবা বলা যায় এতবড় নার্সারির ঠিক কোন দিকে দৌড়াব এতশত বুঝে উঠলাম না। চোখে তো কিছুই দেখি না। খালি দেখি লাল, নীল, বেগুনী। তাই যথাস্থানে দাঁড়িয়ে থাকাই কর্তব্য মনে করলাম। অতএব কেউ একজন এসে আমাকে হ্যাচকা টানে এক হাতে শূণ্যে তুলে নিয়ে চেঁচাতে লাগল, “পাইছি এক্টারে”! :-/:-/ B:-) B:-)

রিয়াজ ফুল তুলতে তুলতে অনেক দূরে সরে গিয়েছিল। ঘটনা বেগতিক দেখে সেও জনির মত ভোঁ দৌড় দিল।:-*:-*
বলাই বাহুল্য, সে চাইলেই পালিয়ে যেতে পারত। কিন্তু কি যেন ভেবে সে নিজের গতি কমিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। এখানে চুরি করতে আসার টার্মস এন্ড কন্ডিশন্সে একটা বিষয়ে স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা ছিল। বিষয়টা হল যাই ঘটুক না কেন সকলকে একসাথে মোকাবেলা করতে হবে। কোন মতেই একা একা পালিয়ে যাওয়া যাবে না। একেবারে নিষিদ্ধ। জনি নিষিদ্ধ কাজটাই আগে করেছে। নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে প্রাথমিক সুযোগেই পালিয়ে গিয়েছে।:|:|

সে পালিয়েছে কারন তার নীতিবোধ অতি ঠুনকো। সুযোগ পেয়েও রিয়াজ পালাতে পারে নাই। কারন তার নীতিবোধ সুকঠিন। তো যাই হোক, রিয়াজ দাঁড়িয়ে পড়তেই কেউ একজন ওকেও টানতে টানতে আমার সাথেই নিয়ে চলল। গন্তব্য নার্সারির সন্নিকটে মালিদের ঘর। :((:((

সেখানে উজ্জ্বল আলোতে আমাকে দেখেই দুইজন হার্টফেলের মত করল।
“পোলার সাথে একটা মাইয়া চোর??” :-/:-/

আসলে অনেকদিন থেকেই নার্সারির সব গাছ নষ্ট করে ফুল চুরি করায় মালিদের ওপর খুব প্রেশার ছিল। কখন আর কিভাবে চুরি হয় এটা বুঝতে তাদের সময় লেগেছিল। তারপর ইফতার করেই সেদিন অন্ধকারে তিন-চারজন মিলে চোর ধরতে নার্সারির জায়গায় জায়গায় গা ঢাকা দিয়ে বসে ছিল। আর আমরাও লক্ষীটির মত ওদের ট্রাপে পা দিয়েছিলাম। যাকে বলে একেবারে হাতে-নাতে ধরা! কট রেড হ্যান্ডেড। :|:|

তারপরের ঘটনা কি আর বলব! অনেক করুন সেই ইতিহাস। আমাকে আর রিয়াজকে তল্লাসি করা হল। তল্লাসি থেকে যেই পরিমাণ ফুল বের হল তা দেখে এরা বলে, “দেখসুনি কারবারটা?” শাস্তিসরূপ প্রাথমিকভাবে কিছু চড়-থাপ্পড় দিয়ে একটা ছাগলের সাথে দড়ি দিয়ে আমাদের দুজনকে বেঁধে রাখা হল। ছাগল পাতা খায়। আমরা আসন্ন ভবিষ্যতের কথা ভাবতে ভাবতে ওর পাতা খাওয়া দেখি। ছাগলের গায়ের রঙ কালো, সাইজে মাঝারি। আমাদের সাথে ছাগলের সাথে কোন বিশেষ পার্থক্যই রইল না। কারন আমরাও ভয়ে কিংবা ধরা পড়ার বিস্ময়ে ছাগল হয়ে গেছি। কিছুই চোখে দেখিনা। দেখি শুধু লাল-নীল-বেগুনী। :-*:-*

কিছুক্ষণ এইভাবে কাটার পর মোটা মত এক মহিলা আর পুরুষ আসল।
সম্ভবত মহিলা হেড মালির বৌ আর পুরুষ হল মালিক বা প্রধান কেউ। অন্য মালিরা চিৎকার করে বলতে লাগল, “আইজকা চুর ধরছি!”
মহিলাও রিয়াজের সাথে আমাকে দেখে মনে হয় একটু হার্টফেলের মত করলেন। মুখে ক্রমাগত অ-অ টাইপ শব্দ করে যাচ্ছেন আর বলছেন মাইয়া চুর? B:-) :|| :-&

আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “এই ছেম্রি তোর কি নাম?” X(X(

আমি ভয়ে ভয়ে উত্তর দিলাম, “বিউটি” (অবশ্যই ছদ্মনাম। নামটা ইংলিশ সেকেন্ড পেপার বই থেকে কিছুক্ষণের জন্য ধার নিয়েছিলাম। দুইদিন আগে একটা লেটার পড়েছিলাম। বিউটি নামের এক কিশোরি তার বাবাকে পরীক্ষার প্রস্তুতি জানিয়ে পত্র লিখেছে, ডিয়ার ফাদার, ব্লা ব্লা ব্লা......) :P:P

আমার দেখাদেখি রিয়াজও কোন একটা ছদ্মনাম বলেছিল। আমার মনে পড়ছেনা।

মহিলা বললেন, “বাসা কই?”
আমি বললাম দক্ষিণ কমলাপুর (মিথ্যা কথা। জসীম উদ্দীন রোড উত্তর কমলাপুরে।)

“তোরা দুইটা ভাইবোন?”X(X(

আমি বিনীত কন্ঠে বললাম, জ্বী, আমরা দুইজন ভাইবোন! (অবশ্যই নির্ভেজাল মিথ্যা কথা। কখন সত্য বলতে হবে, কখন মিথ্যা বলতে হবে এটা কেউ কাউকে শিখিয়ে দিতে হয় না। প্রকৃতি নিজ প্রয়োজনে শিখিয়ে নেয়। ওইটুকু বয়েসেই বুঝে গিয়েছিলাম কোনভাবেই এই মহিলাকে সত্য বলা যাবে না। বললেই মহা বিপদ! চোখে দেখি লাল-নীল-বেগুনী।) :|| :||

তারপর মহিলা বললেন ফুল চুরি করিস কেন? তোদের আইজকে ধরছি। এমন রাম ধোলাই দিব না! তোরা প্রতিদিন ফুল চুরি কইরা লসে ফালাইছিস। বাপ কি করে? বাসার ঠিকানা বল। তোদের বাপ-মারে ডাইকা আনি। নাইলে ছাড়া যাবে না। এক কাজ কর। এই দড়ি খুইলা দাও। এদের শাস্তি হওয়া দরকার। এরা দুইটায় কান ধইরা উঠ-বস করুক।
দড়ি খুলে দেয়া হল। :|:|

আমরা অমাবস্যার মত মুখ মলিন করে সবার সামনেই কান ধরে উঠবস করতে লাগলাম। সব মালিরা আমাদের শাস্তি দেখে দাঁত কেলিয়ে হাসতে লাগল। ছি ছি! কি লজ্জা! কি কুক্ষণে ফুল চুরি করতে আসছিলাম। লজ্জায় মাথা কাটা যায় যায় অবস্থা। মনে মনে আল্লাহকে ডাকি। মাবুদ গো, এই অবস্থা থেকে উদ্ধার কর! :((:((

মাবুদ মালিদের মত এত কঠিন না। তিনি এই দুই দেবশিশুর(!?) লজ্জা বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারলেন না। সাথে সাথে উদ্ধারকারী পাঠিয়ে দিলেন।B-)B-)

মহিলাকে চুপ করতে বলে সাথের সৌম্য দর্শণ পু্রুষ লোকটা বলে উঠলেন, “এই তোমরা থাম তো। আর উঠবস করতে হবে না। এদের দেখে তো রাস্তার ফুল চোর মনে হচ্ছে না। ভদ্র ঘরের সন্তান মনে হচ্ছে। বাবুরা তোমরা কেন ফুল চুরি কর?”

এত কিছুর পরও আমার স্নায়ু খুব স্বাভাবিক। বারবার শুধু বাবার কথা মনে হচ্ছে। উনি জানতে পারলে কি শাস্তির বিধান করবেন সেটাই মনে মনে ভাবছিলাম। এই পর্যায়েও চোখে কিছুই দেখি না। খালি দেখি লাল, নীল, বেগুনী।
সৌম্য দর্শণ লোকটির কথার পিঠে আমি আমি কথা বললাম, “আমরা আজই প্রথম এসেছি। আগে তো কখনো চুরি করিনি।”:-*:-*

তারপর লোকটি আমাদের বোঝালেন, বাচ্চারা তোমরা কি বুঝতে পারছ এভাবে ফুল চুরি করলে ঐ গাছগুলো আর বিক্রি হয় না? ফুল চুরি হয়ে যাওয়ায় ফুল বিক্রিও কমে গেছে। ফুল চুরি করা অবশ্যই আনন্দের। কিন্তু মনে রাখবে এটা একটা ব্যবসায়। এভাবে চুরি হতে থাকলে আমাদের লস হয়। তাই বাবুরা তোমরা আর কখনো চুরি করবে না। তোমাদের বন্ধুদের ও নিষেধ করবে, কেমন? এই এদের ছেড়ে দাও। এরা বাড়ি চলে যাক। এই বলে তিনি বের হয়ে গেলেন। আমাদের বুকের ওপর থেকেও যেন একটা মস্ত বড় পাথর নেমে গেল।:-/:-/

ফুল চোরদের শাস্তি দেয়ার মজা থেকে মালিরা বঞ্চিত হল। তাদের বদন হল মলিন।:P:P

ছাগলের দড়ি থেকে সম্পূর্ণরূপে ছাড়া পেয়ে উজ্জ্বল বদনে লেজ গুটিয়ে আমরা দুজন দেয়াল টপকে বাসায় চলে এলাম। চোখে লাল-নীল-বেগুনী আর দেখছি না। সবকিছু স্বাভাবিক। ঘটনার এই পর্যায়ে রিয়াজ এবং আমি বেমালুম অন্যদের কাছে এ খবর চেপে যাবার প্রতিজ্ঞা করলাম। জীবন-মরন প্রতিজ্ঞা। মাঝখান দিয়ে কাল হয়ে দাঁড়ালো জনি। হারামজাদা এমনিতেই চুরির টার্মস এন্ড কন্ডিশান্স ব্রেক করেছে। তার উপর দিয়ে অম্লান বদনে সবাইকে বলে দিয়েছে যে সে দেখেছে মালিরা আমাদের দুজনকে ধরে ফেলেছে। পরের কাহিনী কি হতে পারে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। সবাই মনে মনে যে যেভাবে খুশি কল্পনা করে নিল। তবে যত যাই কল্পনা করুক, ছাগলের দড়ি দিয়ে ছাগলের সাথে বেঁধে রাখার মত একটা ব্যপার যে ঘটতে পারে এটা ওদের জন্য অবশ্যই অকল্পনীয়। আমি আর রিয়াজ ওইটুকু ভেবে বাকি সব অপমান মুখ বুজে সহ্য করে নিলাম। এই হল আমার ফুল-চুরির কাহিনী। /:) /:)

এখন কেউ কেউ প্রশ্ন করতে পারেন এই ঘটনার পর কি পুষ্পের প্রতি আমার কোন বীতরাগ জন্মেছে?
উত্তরঃ না।
যদিও বাকি জীবনে পুষ্পের প্রতি আমার অবশ্য অন্য রকম একটা অনুরাগ জন্মেছে। আমি পুষ্পকে গাছ থেকে ছিড়ে হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পুষ্প বিলাস করার চেয়ে গাছে দেখতেই বেশি স্বস্তি বোধ করি।


হাওয়াই মিঠাইয়ের গন্ধে ভরা শৈশব নিয়ে আজকের গল্প এই পর্যন্তই। :):)



(চলবে?)


লেখাটি পোস্টের সময়ে যাদের বিশেষভাবে স্মরণ করেছিঃ
ব্লগার “কথক পলাশ” ভাইয়া, “অন্তত আইস্ক্রিমকালের লেখা দাও” বলে যে উৎসাহ তিনি দিয়েছেন তাতেই এত বড় একটা লেখা প্রসব করে ফেলেছি! এই পোস্ট চোখে পড়লে ভয়ে ও বিস্ময়ে ভাইয়ার কি অবস্থা হবে খুব দেখতে ইচ্ছা করছে! ব্লগার “রাষ্ট্রপ্রধান” ভাইয়া যিনি লেখা দাও লেখা দাও বলে আমাকে বিরক্ত করে ফেলার এক পর্যায়ে কোন লেখা না পেয়ে নিজেই বিরক্ত হয়ে গিয়েছেন বলে আমার ধারণা! /:) /:)

সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে আগস্ট, ২০১২ রাত ৯:০৪
৩৯টি মন্তব্য ৩৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

খুলনায় বসবাসরত কোন ব্লগার আছেন?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:৩২

খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় তথা কুয়েট-এ অধ্যয়নরত কিংবা ঐ এলাকায় বসবাসরত কোন ব্লগার কি সামুতে আছেন? একটি দরিদ্র পরিবারকে সহযোগীতার জন্য মূলত কিছু তথ্য প্রয়োজন।

পরিবারটির কর্তা ব্যক্তি পেশায় একজন ভ্যান চালক... ...বাকিটুকু পড়ুন

একমাত্র আল্লাহর ইবাদত হবে আল্লাহ, রাসূল (সা.) ও আমিরের ইতায়াতে ওলামা তরিকায়

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৬:১০



সূরাঃ ১ ফাতিহা, ৪ নং আয়াতের অনুবাদ-
৪। আমরা আপনার ইবাদত করি এবং আপনার কাছে সাহায্য চাই।

সূরাঃ ৪ নিসার ৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ-
৫৯। হে মুমিনগণ! যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×