ছয় পর্বের প্রথম পর্ব
নিজেকে সত্যিই অপ্রকৃতস্থ মনে হল।
আমার অপ্রকৃতিস্থ হওয়ার গল্প তাহলে আপনাদের শোনাই-
এক
আমি যা করছি এটাকে চরম নির্লজ্জতায় বলা যায় কিন্তু তবুও করছি, কারণ করতে হবেই, এটা তো অফিসিয়াল সুবিধা হয় তুমি গ্রহণ কর অথবা না করলে তোমার পরিবর্তে অন্য কাউকে এটা দেওয়া হবে অথবা কাউকে দেওয়া হবে না। এখানে নিয়ম মানা হয় নীতিমালা দেখে। বাংলাদেশে কোথাও না বেড়ালেও ভারতে আমাকে বেড়াতে যেতে হবে কারণ অফিস ধার্য করেছে এবার নির্বাচিত ব্যক্তিদেরকে ভারতে বেড়াতে নিয়ে যাবে। অফিসের নির্দেশ অনুযায়ী পাসপোর্ট করা হয়ে গেছে, বিরাট সৌভাগ্যবশত: আমি যে অফিস থেকে পাসপোর্ট করলাম সেখানকার অফিস কর্ণধার নাকি নতুন এসেছেন যথেষ্ট সৎ, পাসপোর্ট করতে যেয়ে তাই মনে হয়েছিল, কারণ পাসপোর্ট করতে যেয়ে কোন প্রকার সমস্যায় পড়তে হয়নি, কোন বাড়তি টাকা পয়সাও খরচ করতে হয়নি। সরকারী অফিস সম্পর্কে আমার ধারণাটাই পাল্টে গেছে। তবে আমার ভুলের কারণে পাসপোর্টে ছোট্ট একটা গণ্ডগোল আছে।
বিপত্তিটা তখনই শুরু হল, যখন আমাকে ভারতীয় ভিসা সংগ্রহ করতে হল। যেহেতু আমার কম্পিউটার ও অনলাইন এ সব সম্পর্কে কিছুটা ধারনা আছে সেহেতু চাইছিলাম নিজেই অনলাইনে ভিসার আবেদন করে ভিসা সংগ্রহ করব। আমার কলিগদের ভিসা ফর্ম দেখে দেখে মোটামুটি নির্ভুল ভাবে ফর্ম পূরণ করলাম কিন্তু ইন্ডিয়ান এমবাসিতে যাওয়ার তারিখ কোন ভাবে সংগ্রহ করতে পারলাম না, কিন্তু আমি নাছোড় বান্দা তিন মাস ধরে একাধারে চেষ্টা করতে থাকলাম। এদিকে অফিসের সকলেই ভারত থেকে ঘুরে এসেছে। আমি কখনও দেশে বা বিদেশে সেই অর্থ ঢাকা ছাড়া একা কোথাও বেড়াতে যাইনি। ঢাকা যদি একা বেড়ানো যায় বিশ্বের যে কোন জায়গা একা বেড়ানো সম্ভব এই দৃঢ় বিশ্বাস অনেক আগে থেকে আমার মনে জন্ম নিয়েছে। সবাই নানান রকম ভাবে একা যাওয়া ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করতে লাগল। অন্যের উৎসাহ অনুৎসাহ বেশ কিছু দিন খুব একটা পাত্তা দেইনা, এবারও দিলাম না। এদিকে তিন মাস ধরে ভিসা সংগ্রহ করতে না পেরে দালাল ধরে দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে সংগ্রহ করতে তা সমর্থ হলাম। টাকা প্রকৃত খরচের চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি লাগল বটে; তবে আমাকে ভারতীয় এমবাসিতে পর্যন্ত যেতে হল না।
ভিসা সংগ্রহ করার পর একজন সঙ্গী খুঁজতে লাগলাম কম বেশি Xenophobia তো কাজ করছেই। তবে একদিন খোঁজার পরে দুর্ভাগ্যবশত: অথবা সৌভাগ্যবশত যখন কাউকে খুঁজে পেলাম না খুব দ্রুতই তার পরদিন অফিস থেকে টাকা নিয়ে ভারতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। আমার বাসা থেকে চেকপোস্ট সব মিলিয়ে তিন কিলোমিটারের মত হবে। ব্যাগ এন্ড ব্যাগেজ গুছিয়ে নিলাম গুছানো মাত্রই একজন কলিগকে পেয়ে গেলাম। মোটর বাইকে করে ভদ্রলোক বাংলাদেশী ভারতে ঢোকার চেকপোস্টে সর্বোচ্চ দশ মিনিটের মধ্যে আমাকে পৌঁছে দিলেন। চেকপোস্টে ঢোকার পরপরই বেশ কয়েকজন লোক আমার পাশে এসে উপস্থিত হলেন। তারা আমাকে সহযোগিতা করতে চায়, প্রয়োজনীয় সমস্ত লেখালেখির কাজ তারাই করে দিবে। এমন সময় দেখি আমার শশুরের ফোন আসল, বললেন-
-আলমগীর তুমি তোমার কুদ্দুস আঙ্কেলের সাথে দেখা কর ও সব ঠিকঠাক করে দেবে।
আমি চেক পোস্টে একজন কে জিজ্ঞেস করলাম-
-এখানে কুদ্দুস আঙ্কেল কে?
-জামাই আমি।
বুঝলাম শশুর মশাই ওনাকে যা বলার বলে দিয়েছেন।
-তুমি এখানে বস, আমি চায়ের কথা বলে দিচ্ছি, এই জামাইকে এক কাপ স্পেশাল চা দাও। এক দোকানদারকে বললেন।
বুঝলাম অন্যদের ধরে গেলে যে টাকা খরচ হতো ইনার মাধ্যমে গেলে তারচেয়ে একটু বেশিই খরচ হবে কারণ ওনার স্নেহও অতিমাত্রা সহযোগিতার একটা মূল্য দিতে হবে। তথ্য সংগ্রহ করলাম সাধারণত: যারা সহযোগিতা করে তাদেরকে কত টাকা দিতে হয়। ধরে নিলাম শশুরের রেফারেন্স-এর কারণে খরচটা আমাকে দ্বিগুণ করতে হবে।
-বাবা তুমি কি ইন্ডিয়া যাবা? এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক আমাকে জিজ্ঞেস করলেন।
-জী, আপনিও কি যাচ্ছেন?
-হ্যাঁ বাবা কিন্তু দেখো এরা আমাকে খুব ঝামেলা করছে, সকাল সাতটা থেকে আছি এখন সাড়ে নয়টা বাজে, আড়াই ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করছি।
আমি চিন্তা করলাম আমার সবে মাত্র মিনিট দশেক হয়েছে। তার মানে এখনও ঘণ্টা দুই/তিন অপেক্ষা করতে হবে।
-জামাই বাবাজি এসো। কুদ্দুস আঙ্কেল আমাকে ডাক দিলেন।
ভদ্রলোকের পিছে পিছে গেলাম, একটি রুমে নিয়ে গেলেন, পুলিশের মত পোশাক পরে থাকা কম্পিউটারের সামনে বসা ব্যক্তিটি, আমাকে জিজ্ঞেস করলেন-
-কি করেন আপনি?
-একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করি।
-কেন ভারতে যাচ্ছেন?
-বেড়াতে যাচ্ছি, অফিস বেড়ানোর সুযোগ দিয়েছে।
-স্যার ইনি আমার জামাই। কুদ্দুস আঙ্গেল বসে থাকা ব্যক্তিকে বললেন।
অনেক লোকের মধ্যে আমার পাসপোর্ট আগে হাতে নিয়ে আমারটার কাজ আগে সেরে দিলেন। ভাবলাম এত সুবিধা যখন পাচ্ছি টাকা দু’শো অতিরিক্ত খরচ হলে সমস্যা নেই। দুইশ টাকার বিনিময়ে দুই ঘন্টা সময় পাচ্ছি মন্দ কি।
-জামাই তোমার সব কাজ শেষ।
মাত্রই পনের মিনিটই সব হল। আমি বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করলাম।
-আঙ্কেল আপনাকে কয় টাকা দিতে হবে?
-মেয়েকে ভাল করে দেখেশুনে রেখো, টাকা তোমাকে দিতে হবে না।
খুব লজ্জা পেয়ে গেলাম। কি বলব বুঝতে পারছি না।
-চল তোমাকে বিজিবিদের সাথে পরিচয় করে দিয়ে আসি। তাহলে ওরা তোমাকে কোন ঝামেলায় করবে না।
বলতে বলতে কয়েকজন বিজিবি সদস্য বসে আছেন সেখানে পৌঁছে গেলাম।
-স্যার আমার জামাই।
-আচ্ছা যান আপনি চলে যান। একজন ভারত ফেরত ব্যক্তির ব্যাগ চেক করতে থাকা বিজিবি সদস্য আমাকে বললেন।
ইশারায় জানতে চাইলাম আমার ব্যগ চেক করবে কিনা। ইশারায় উনারও ব্যাগ চেক না করার কথা জানিয়ে দিলেন।
-জামাই তুমি ভ্যানে চলে যাও; গেদে চেক পোস্ট পর্যন্ত চল্লিশ টাকা ভাড়া নেবে।
-হেঁটে গেলে কত সময় লাগবে? আমি একটু লাজুক ভঙ্গিমায় জিজ্ঞেস করলাম।
-তোমার ব্যাগতো ভারি না। তুমি হাটতে হাটতে যাও মাত্র চার পাঁচ মিনিট লাগবে।
-ভ্যানে না উঠলে আবার কোন প্রকার সমস্যা হবে নাতো।
-না তা হবে না।
-তা হলে হাঁটতে হাঁটতে যাই।
কুদ্দুস আঙ্কেল একটা কার্ড মানি ব্যাগ থেকে বের করে দিলেন। বললেন-
-তুমি এর কাছে চলে যাও ও সব কিছু ঠিক-ঠাক করে দিবে, ওখান থেকে তুমি টাকা ভাঙিয়ে নিবে। তাহলে ঠকবে না। অন্য জায়গায় গেলে ঠকতে হবে।
দুই/তিন মিনিট হাঁটার পরই ঠিক কাঁটা তারের বেড়া যেখানটাতে দেওয়া ঠিক সেই জায়গায় পৌঁছে গেলাম। তখনই ঠিক মাথার উপর দিয়ে কয়েকটি কাক ভারতীয় সীমান্তবর্তীয় গাছ থেকে উড়ে বাংলাদেশে এসে প্রবেশ করল। পাখিগুলোর পাখার শাঁ শাঁ শব্দ আমার কানে এসে লাগল। মানুষ হিসাবে জন্মানোর চরম নির্লিজ্জ্বতা উপেক্ষা করার একটা সলজ্জ হাসি হাসলাম। একটু সামনেই বিজিবি সদস্যগণ ভারত গামী ও ভারত ভ্রমণ শেষ করে ফেরত আসা বাংলাদেশীদের পাসপোর্ট চেক করছে। আমার পাসপোর্টের যেহেতু একটা সমস্যা আছে সেহেতু মনের মধ্যে একটু ভয় লাগতে শুরু করল। ওখানে তো আর শশুরের বন্ধু নেই।
আসছে পর্ব দুই…………..