somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বদরুদ্দীন উমরের নজরুল-ভাবনা

২৫ শে মে, ২০১৭ বিকাল ৪:২৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


আবদুল্লাহ আল আমিন

শোষণ-নিপীড়ন-বঞ্চনা ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামের দুই পুরোধা-পুরুষ কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও লেখক বদরুদ্দীন উমরের জন্ম অবিভক্ত বাংলার রাঢ় অঞ্চলের বর্ধমান জেলায়। প্রথমজন সাহিত্যিক, মূলত কবি, আর দ্বিতীয়জন তাত্ত্বিক, গবেষক ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার। দুজন-ই চেয়েছেন বাঙালি সংস্কৃতির প্রগতিশীল বিকাশ ও রূপান্তর। নজরুল অখ- মানবিকতায় বিশ্বাসী ভাবুক-কবি, অন্যদিকে বদরুদ্দীন উমর সর্বতোভাবে মার্কসবাদী তাত্ত্বিক। নজরুলের জন্ম বর্ধমানের চুরুলিয়া গ্রামের এক ক্ষয়িষ্ণু মুসলিম পরিবারে। মাত্র ন’ বছর বয়সে তিনি তার পিতা ফকির আহমেদকে হারান। পিতার মৃত্যুতে নজরুলের জীবনে ঘটে মারাত্মক ছন্দ পতন । বৈরী পরিবেশ ও পারিবারিক প্রতিকূলতার কারণে এন্ট্রান্স পাসের আগেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় ছেদ পড়ে, জীবিকা হিসেবে বেছে নেন মোল্লাগিরি, মসজিদে এমামতি, কখনোও রুটির দোকানের কাজ। অপরজনের জন্ম ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে বর্ধমান শহরের শিক্ষিত সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে। বদরুদ্দীন উমরের পিতা আবুল হাশিম ছিলেন ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামের অন্যতম পুরোধা পুরুষ, অখ- বাংলার অন্যতম চিন্তানায়ক ও স্বপ্নপুরুষ, মুসলিম লীগের প্রগতিশীল অংশের প্রধান-সংগঠক। সাম্প্রদায়িকতার কারণে ১৯৫০ সালে তারা সপরিবারে ঢাকায় চলে আসেন। ১৯৫২’র ভাষা আন্দোলনে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। বদরুদ্দীন উমর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম এ পাস করেন। ১৯৫৭ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন, ইতোপূর্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে খ-কালীন শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৬১ সালে অক্সফোর্ড থেকে দর্শন, রাজনীতি ও অর্থনীতি তিন বিষয়ে অনার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। ষাটের দশকে প্রকাশিত তার সাম্প্রদায়িকতা (১৯৬৬). সংস্কৃতির সংকট (১৯৬৭) ও সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা (১৯৬৯) গ্রন্থত্রয় বাঙালি জাতীয়তাবাদের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে অনন্য ভূমিকা পালন করে। এসব লেখা ‘বাঙালি মুসলমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে’ পথ দেখিয়েছে, মুসলমান বাঙালিকে রূপান্তরিত করে মৃত্তিকালগ্ন বাঙালি মুসলমানে। নজরুল ও উমরের জীবনচর্যা, সংস্কৃতিবোধ ও লেখনীর পদ্ধতি ও ফর্মের মধ্যে যেমন পৃথকতা আছে, তেমনই অমিলও খুঁজে পাওয়া যায় ভুরি ভুরি। দুজন-ই সাম্প্রদায়িকতা, সা¤্রাজ্যবাদ, শোষক নিপীড়ক, জুলুমবাজদের দুশমন। নজরুল তার গান-কবিতা-উপন্যাসকে পরিণত করেছিলেন সাম্প্রদায়িকতা ও সাম্্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামের শাণিত হাতিয়ারে আর উমর কেবল লেখালেখির মধ্যে সীমিত থাকেননি, সমাজের বিপ্লবী রূপান্তর ও মানবমুক্তির সংগ্রাম ত্বরান্বিত করার জন্য নিজেকে বিস্তৃত করেন, যুক্ত হন সাংগাঠনিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে। কৃষক আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য বাংলাদেশ কৃষক ফেডারেশন ও প্রগতিশীল সংস্কৃতিচর্চা ও বিকাশের জন্য বাংলাদেশ লেখক শিবির প্রতিষ্ঠা করেন। নজরুল কবিতা রচনা এবং সাহিত্যচর্চার জন্য কারারুদ্ধ হয়েছেন, ব্রিটিশ রাজশক্তির রোষানলে পড়েছেন। ষাটের দশকে বাঙালি সংস্কৃতির প্রগতিশীল বিকাশের জন্যে ‘সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা’ নিয়ে লিখতে গিয়ে বদরুদ্দীন উমর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর রোষানলে পড়েন, বাধ্য হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার কাজে ইস্তফা দেন এবং যুক্ত হন সক্রিয় রাজনীতিতে । তিনি বেছে নিয়েছেন সার্বক্ষণিক লেখক-জীবন, রাজনীতির প্রয়োজনে নিয়মিত প্রবন্ধ-নিবন্ধ রচনা করছেন। তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৬০-এর অধিক । প্রকাশিত, কিন্তু অগ্রন্থিত প্রবন্ধের সংখ্যাও অজ¯্র।
এই মার্কসবাদী তাত্ত্বিকের স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ ‘আমাদের সময়কার জীবন’ এর পাঠ শেষ করলাম কদিন আগে । এ গ্রন্থে তিনি শেরে বাংলা ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাহানারা ইমাম, গোবিন্দ্রচন্দ্র দেব, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, আহমদ শরীফ, আরজ আলী মাতুব্বর, কলকাতার প্রখ্যাত লেখক- বুদ্ধিজীবী হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, বিপ্লবী সুখেন্দু দস্তিদার প্রমুখ সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করেছেন। এঁদের সঙ্গে তার ব্যক্তিগত সম্পর্কের কথাও উল্লেখ করেছেন। কবি বিষ্ণু দে, সমর সেন, নাট্যকার ও অভিনেতা উৎপল দত্ত প্রমুখের প্রসঙ্গ এসেছে, কিন্তু নজরুলকে পেলাম না। তবে বইয়ের এক জায়গায় তিনি লিখেছেন, ‘ নজরুল ইসলামের কবিতা পাঠ করে ও গান শুনে লক্ষ লক্ষ মানুষ মনে করতো নজরুল ইসলাম তাদের কথাই লিখেছেন। ( আমাদের সময়কার জীবন, পৃষ্ঠা :১৪)। সত্যিই তাই, এ কারণে রাজনৈতিক উত্থান-পতনের মধ্যেও বাঙালি নজরুলকে বিস্মৃত হয়নি। মৃত্যুর এত বছর পার হয়েছে, তারপরও তিনি বাঙালির জীবন থেকে, সশ্রদ্ধ দূরত্বের ফ্রেমে বন্দি হয়ে যাননি। বাঙালি তাকে গভীরভাবে মনে রেখেছে, প্রদান করেছে জাতীয় কবির স্বীকৃতি। তবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির অভিধা ছাপিয়ে জেগে আছে তাঁর প্রতি কবিতানুরাগী, দেশপ্রেমী, সঙ্গীতপিপাসু বাঙালির গভীর ভালবাসা, অকুণ্ঠ অনুরাগ। তার সৃজনস্পর্শে সমকাল যেমন মথিত ও উদ্বেলিত হয়েছে, একইভাবে চার দশকের নির্বাকপর্ব এবং প্রয়াণের ৪২ বছর পেরিয়েছে, তারপরও তাকে জানার আগ্রহ ফুরোয়নি। নজরুলের জীবন ও সাহিত্য নিয়ে মূল্যানধর্মী প্রবন্ধ-নিবন্ধ, গ্রন্থ নেহাত কম রচিত হয়নি। ঘনিষ্ঠজনদের স্মৃতিচারণার সূত্রেও উঠে এসেছে অনেককিছু। ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মধ্যে কমরেড মুজাফফর আহমদ রচনা করেন ‘কাজী নজরুল ইসলাম : স্মৃতিকথা’ নামের এক মহামূল্যবান আকরগ্রন্থ। বদরুদ্দীন উমরও তার বিভিন্ন প্রবন্ধে নজরুল সাহিত্য সম্পর্কে ইতিবাচক ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। উমর স্যারকে মুঠোফোনে জিজ্ঞাসা করলাম, নজরুল ও আপনি বর্ধমানের মানুষ। নজরুল মূলত বিশ শতকের প্রথমার্ধের কবি, আর আপনার জন্ম বিশ শতকের ত্রিশের দশকে। আপনার কী নজরুলের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে ? তিনি বললেন, না। বয়োস্বল্পতার কারণে সম্ভব হয়নি, আরোও স্বীকার করলেন, তার বাবা আবুল হাশিমের সঙ্গেও নজরুলের তেমন কোনো যোগাযোগ ছিল ন। তারপরও নজরুল-সাহিত্যের প্রতি তার প্রবল আগ্রহ রয়েছে ।
দুই.
বুদ্ধদেব বসুকে দোহাই দিয়ে বলা যায় যে, রবীন্দ্রনাথ হলেন বাংলা সাহিত্যের বটবৃক্ষ। বটবৃক্ষের ছায়ার নীচে যেমন অন্য কোনো বৃক্ষ জন্মায় না, তেমনই রবীন্দ্রনাথের দোর্দ- প্রতাপে কয়েক দশক বাংলা সাহিত্যে কোনো প্রতিভাবানের জন্ম হয়নি। তারপরও বটবৃক্ষের ছায়ার নিচে বিপুল শক্তি ও সম্ভাবনা নিয়ে বাংলা সাহিত্যের রঙ্গমঞ্চে নজরুলের মতো বিস্ময়কর প্রতিভার অভ্যুদয় হয় । তার জনপ্রিয়তা ছিল আকাশচুম্বি। জনমানুষের মনের ভাষা বুঝতেন তিনি এবং সেই ভাষায় দু হাত উজাড় করে লিখতে পারতেন। শোষণ, নিপীড়ন, অত্যাচারের বিরুদ্ধে তার কলম সব সময় সরব ও সক্রিয় ছিল। উমর মার্কসবাদী তাত্ত্বিক, তারপরও নজরুল ইসলামকে প্রগতিশীল ধারার সাহিত্যিক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘ নজরুল ইসলাম সাহিত্যিক হিসেবে প্রগতিশীল হলেও কোনো নির্দিষ্ট জীবনদর্শনের মধ্যে তিনি ধরা দেননি। অর্থাৎ তিনি তাঁর চিন্তার মধ্যে তেমন কোনো শৃঙ্খলা কোনদিন আনতে পারেননি অথবা তার চেষ্টাও করেননি।’ (নজরুল ইসলাম অহিফেন, সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা)। উমরের মনে হয়েছে, নজরুল প্রগতিশীল হলেও মার্কসীয় সাম্যবাদের অনুগামী ছিলেন না, তার সাম্যবাদী ধারণার মধ্যে ভ্রান্তি ছিল। তারপরও বলা চলে, তিনি মানুষের কবি ছিলেন, সারাজীবন তিনি বৃহত্তর জনমানুষের কথা বলেছেন হৃদয় দিয়ে। শ্রেণিগত বিবেচনায় তিনি বাংলা তথা ভারতবর্ষের বিশাল জনগোষ্ঠীর সাথে একাত্মতা অনুভব করেছেন। আর এ অনুভব থেকেই তার মানবিকতা,প্রগতিশীলতা ও স্বাদেশিকতার উৎপত্তি। তার জীবনচর্যা, সাহিত্য-ভাবনা, কর্মপ্রয়াস সবকিছুই মানুষের প্রতি একাত্মতা বোধ থেকে উৎসারিত। নজরুলের সৃজনকর্মের দিকে তাকিয়ে উমর বলেছেন, নজরুল যে ধর্ম-সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন, সেখানে হিন্দু- মুসলমান ফারাক নেই। এ সাহিত্যে হিন্দুর যতখানি অধিকার, মুসলমানের অধিকারও ঠিক ততখানি।‘ এদিক দিয়ে বিবেচনা করলে বলা চলে যে নজরুল ইসলামই একমাত্র সাহিত্যিক যিনি বাঙালি সংস্কৃতিকে আত্মসাৎ করেছিলেন সম্পূর্ণরূপে।’(নজরুল ইসলাম অহিফেন, সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা)। বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্রের সঙ্গে নজরুলের পৃথকতা থাকলেও বাঙালিত্ব, মানবিকতা ও অসাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে নজরুল ছিলেন অতুলনীয় এবং অপ্রতিদ্বন্দ্বী। নজরুলের সাহিত্য ও জীবনচর্যার পূর্বাপর বিশ্লেষণ করে উমর এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, বাঙালি হিসেবে অনন্যসাধারণ ছিলেন তিনি, তাই তার নিজস্ব ধর্মও ছিল না, তা থাকলে তিনি পুরোপুরি বাঙালি হতে পারতেন না। তিনি ছিলেন সমন্বয়বাদী, হিন্দু-মুসলমান উভয় ধর্মের অনুসারী।
তিন.
নজরুল সাহিত্যের সঙ্গে যারা পরিচিত, তারা ভালভাবেই জানেন যে, তিনি হিন্দু পুরাণ ও ঐতিহ্য গান-কবিতা রচনা করেছেন, ইসলামি ঐতিহ্যের আলোকেও সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন। তাই হিন্দু মুসলমানকে এক সূত্রে গাঁথার অভিপ্রায়ে তিনি গানে গানে উচ্চারণ করেছেন মিলন ও মানবিক সম্প্রীতির বাণী:
‘ মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু মুসলমান/ মুসলিম তার নয়ন মনি হিন্দু তাহার প্রাণ।’
নজরুলের জীবনচর্যা ও সৃষ্টিবিশ্বের সবখানে রয়েছে কেবল সমন্বয় ও সম্প্রীতি ভাবনার উজ্জ্বল উপস্থিতি। তিনি তাবৎ ধর্মের অন্তর্নিহিত নির্যাস গভীরভাবে আত্মস্থ করতে পেরেছিলেন বলেই তিনি বাঙালির প্রাণের কবি হতে পেরেছিলেন। ধর্মান্ধতা ও প্রতিক্রিয়াশীলতার মধ্যে বাস করেও তিনি লড়াই করেছেন সাম্প্রদায়িকতা, সংকীর্ণতা এবং অমানবিকতার গাঢ় অন্ধকারের বিরূদ্ধে। ‘ বিদ্রোহী’ তে নজরুল যে অভেদ সুন্দর, সাম্য প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন তা থেকে তিনি বিচ্যুত হননি আমৃত্যু। ১৯২৯ সালে ১৪ এপ্রিল ডিসেম্বর কলকাতার আলবার্ট হলে প্রদত্ত অভিভাষণে তিনি বলেন, ‘ আমি এই দেশে, এই সমাজে জন্মেছি বলেই আমি এই দেশের এই সমাজের নই। আমি সকল দেশের, সকল মানুষের, সুন্দরের স্তবগান আমার উপাসনা। যে কুলে, যে সমাজে, যে ধর্মে, যে দেশেই জন্মগ্রহণ করি সে আমার দৈব।’ উমর বলেছেন, নজরুলের ধর্মবোধ হিন্দুত্ব বা মুসলমানিত্বে পাওয়া যাবে না। তার ধর্মচেতনার সন্ধান মিলবে তার রাজনীতি-ভাবনা ও জনমানুষের সঙ্গে তার একাত্মতার মধ্যে। তিনি যে ধর্মসাহিত্য রচনা করেন তা মূলত শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে জনসাধারণকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্যে। তার প্রতিভার মূল প্রবণতা ছিল গণসাহিত্যের দিকে, ধর্মসাহিত্যের দিকে নয়।
চার.
নতুন ধাঁচের সঙ্গীত ও তাতে সুরারোপের ক্ষেত্রে নজরুল অসামান্য প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। নজরুলের সঙ্গীত সাধনা সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কাজী মোতাহার হোসেন বলেন, “ ১৯২৭ সালে সাহিত্য-সম্মেলনে আমি যখন ‘ সঙ্গীতচর্চায় মুসলমান’ শীর্ষক প্রবন্ধ পাঠ করছিলাম, তখন আমার প্রবন্ধ শুনে মোল্লা সম্প্রদায়ের মুখ থেকে যে উক্তি বেরিয়েছিল সে হলো- ‘ ও বাব্বাহ ! দাড়ির মধ্যেও কুফরি ?” আর নজরুলের গান শুনে যে উক্তি বেরিয়েছিল তা হল, “ বা! বা! কী সুন্দর ইসলামি গান- ঠিক যেন গজল!...শাহি দরবারের সানাই, রূপ-ওয়ালির নূপুর-ঝঙ্কার, শিরি-ফরহাদ ও লায়লি-মজনুর মজলিসে, শরাব-সাকির উৎসবের উল্লাসে, পলাশ-অশোক থেকে উপচে-পড়া ‘ফুল-ডালি’ তে হিন্দুয়ানির সামান্য গন্ধটুকু মালুম হয়নি।” এ সব উদাহরণ টেনে কেউ কেউ নজরুলকে মুসলিম সাহিত্যের প্রতিনিধি বানাতে চেয়েছেন। সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের এ ধরনের প্রয়াস কোনো কোনো ক্ষেত্রে সফলও হয়েছে। অনেকের মনে প্রশ্ন জেগেছে, তাহলে নজরুল কী মুসলমানদের কবি ? সাম্প্রদায়িক সাহিত্যের প্রতিনিধি । আবার উত্তর এসেছে,‘ না, কখনোই না’। ইসলামি গান শুনে নজরুলকে নিষ্ঠাবান মুসলমান ভাবার কোনো সুযোগ নেই, ভাবলে সত্যের-ই অপলাপ হবে। বদরুদ্দীন উমর বলেছেন, নজরুল হিজ মাস্টার্স ভয়েস কোম্পানির ফরমায়েসে কিংবা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ইসলামি গান রচনা করেছেন, কিন্তু তার ব্যক্তিগত জীবনে ধর্মচর্চা ছিল না। তিনি ইসলামি গান রচনা করেছেন, তারপরও মুসলমান সমাজ তাকে ইসলামের খাদেম বলে মনে করেনি বরং হিন্দু-প্রীতি ও স্বাদেশিকতার জন্য ধিক্কৃত হয়েছেন। শ্যামাসঙ্গীত রচনা করেছেন অজ¯্র, কিন্তু তাকে কালী-সাধক ভাবার কোনো অবকাশ নেই। উমর আরও বলেছেন, বৈষ্ণব সাহিত্যকে কোনভাবেই হিন্দুর সাহিত্য বলা যায় না, এ সাহিত্যে হিন্দুধর্ম ও ইসলামি চিন্তার যে সমন্বয় সাধন হয়েছে, সেটা কোনোভাবেই সম্ভব হতো না, যদি আমাদের সংস্কৃতি ক্ষেত্রে সেই সমন্বয় না থাকতো। বৈষ্ণব সাহিত্য যেমন বাঙলা সাহিত্যের অবিভাজ্য অংশ, তেমনই নজরুলের ইসলামি গানকেও বাঙালি সংস্কৃতির মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখার সুযোগ নেই। এ প্রসঙ্গে ‘ তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে’ গানটি উল্লেখ করা যেতে পারে। গানটিতে নবি করিম (সা.)- এর আবির্ভাবের মহিমা বর্ণনা করা হলেও, এতে বৈষ্ণব কবিতার প্রভাব সুস্পষ্ট। বৈষ্ণব কবিরা যেমন যশোদার কোলে শ্রীকৃষ্ণকে কল্পনা করেছেন এবং তার আবির্ভাবের মহিমা কীর্তন করেছেন, নজরুলও একই কাজ করেছেন উল্লিখিত গানে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মহিমা কীর্তন করে। এ জন্য কোনোভাবেই গানটিকে ইসলামি গান বলা যায় না। কারণ মাতৃরূপের বন্দনা বা মহিমা কীর্তন ইসলামি তত্ত্বে নেই। উমর বলেছেন, ‘ গানটিতে হযরত মহম্মদ ও হযরত আমেনার কথা আছে বলেই এটি যে মুসলিম সংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী সেটা বলা যাবে না। এ গানটি যে ঐতিহ্য বহন করে তার নাম বাঙালি সংস্কৃতি।’ ( সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা।)
বদরুদ্দীন উমর মূলত মার্কসবাদী তাত্ত্বিক, মার্কসীয় দর্শনের আলোকে তিনি রাজনীতি, সমাজ, সাহিত্য ও সংস্কৃতির ব্যাখ্যা প্রদান করেন। মার্কসীয় তত্ত্বেও ভিত্তিতে তিনি নজরুলকে সাম্যবাদের কবি বলতে চান না। তার মতে, নজরুল-সাহিত্যে শ্রেণি সংগ্রামের মর্মচেতনা প্রতিফলিত হয়নি। সুকান্ত ভট্টাচার্যকে তিনি শ্রেণি সংগ্রামের কবি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। আর অসাম্প্রদায়িকতা ও সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতা যে অর্থে জাতীয়তাদের ভিত্তি সেই অর্থে তিনি নজরুলকে মহান জাতীয়তাবাদী কবি বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন। হুমায়ূন আজাদের মতো উন্নাসিক পনডতরা নাক উঁচু করে যখন নজরুলকে ‘ বাংলা ভাষায় বিভ্রান্ত কুসংস্কার উদ্দীপ্ত লেখকদের প্রধান’ বলে মনে করেছেন, তখন উমর নজরুলকে মহৎ চিন্তার কবি বলে মান্য করেছেন। প্রফেসর আজাদ তাকে বিদ্রোহী কবি হিসেবেও মানতে নারাজ। এক্ষেত্রে বদরুদ্দীন উমর সম্পূর্ণরূপে ব্যতিক্রমী। আমাদের দেশের রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প-িতরা যখন সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতি তেমন আগ্রহ দেখান না, তখন ‘ হার না-মানা’ বদরুদ্দীন উমরের নজরুল-ভাবনা ও মূল্যায়ন আমাদের অনুপ্রাণিত করে ।
Image may contain: 1 person, eyeglasses, closeup and outdoor
Image may contain: 1 person, sunglasses and closeup
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মে, ২০১৭ বিকাল ৪:২৪
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মামুনুলের মুক্তির খবরে কাল বৃষ্টি নেমেছিল

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৪৯


হেফাজত নেতা মামুনুল হক কারামুক্ত হওয়ায় তার অনুসারীদের মধ্যে খুশির জোয়ার বয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ তো বলল, তার মুক্তির খবরে কাল রাতে বৃষ্টি নেমেছিল। কিন্তু পিছিয়ে যাওয়ায় আজ গাজীপুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ অপেক্ষা

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২৩



গরমের সময় ক্লাশ গুলো বেশ লম্বা মনে হয়, তার উপর সানোয়ার স্যারের ক্লাশ এমনিতেই লম্বা হয় । তার একটা মুদ্রা দোষ আছে প্যারা প্রতি একটা শব্দ তিনি করেন, ব্যাস... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদে মসজিদে মোল্লা,ও কমিটি নতুন আইনে চালাচ্ছে সমাজ.

লিখেছেন এম ডি মুসা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৩

গত সপ্তাহে ভোলার জাহানপুর ইউনিয়নের চরফ্যাশন ওমরাবাজ গ্রামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। লোকটি নিয়মিত মসজিদে যেত না, মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েনি, জানা গেল সে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী ছিল, স্বীকারোক্তিতে সে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×