somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নবান্ন উৎসব : ‘অঘ্রান এসেছে আজ পৃথিবীর বনে’

১৬ ই নভেম্বর, ২০১৭ বিকাল ৪:২৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আবদুল্লাহ আল আমিন

রবীন্দ্রনাথ হেমন্তের লাল- গেরুয়া রঙটি দেখতে পেতেন না। তাই তার গানে-কবিতায় হেমন্তকাল তেমন আসেনি। কিন্তু জীবনানন্দের কবিতায় হেমন্ত ঘুরে ফিরে এসেছে। বাংলার গাছপালা, লতাগুল্ম , মেঠোচাঁদ, নদী-নিসর্গের অপরূপে মুগ্ধ কবির কাছে হেমন্ত মানে অঘ্রাণ- তাঁর কাছে কার্তিকের চেয়ে অগ্রহায়ণ ঢেরবেশি উজ্জ্বলতর। তিনি লিখেছেন : ‘ অশ্বত্থ পড়ে আছে ঘাসের ভিতরে/ শুকনো মিয়ানো ছেঁড়া,অঘ্রান এসেছে আজ পৃথিবীর বনে;/ সে সবের ঢের আগে আমাদের দুজনের মনে/ হেমন্ত এসেছে তবু;’ ( অঘ্রান প্রান্তর, বনলতা সেন) অগ্রহায়ণ মানেই ‘আমন’ ধান কাটার মাস। ‘ বাংলার শস্যহীন প্রান্তরে’ যখন ‘গভীর অঘ্রান’ এসে দাঁড়ায়, তখন উৎসবের রঙ ছড়িয়ে পড়ে বাংলার আকাশ-অন্তরীক্ষে। অগ্রহায়ণ বয়ে আনে ধানকাটার রোমাঞ্চকর দিন, বয়ে আনে সমৃদ্ধি। কিষাণ-কিষাণীর প্রাণমন ভরে ওঠে এক অলৌকিক আনন্দে। বর্ষায় রোয়া ‘আমন’ ধান অগ্রহায়ণ মাসে কাটা হয়। আর ধান কাটার পরপরই গ্রামের ঘরে ঘরে আয়োজন করা ‘নবান্ন উৎসব’। মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া অঞ্চলে অগ্রহায়ণের শুরু থেকে পৌষ মাসের প্রারম্ভ পর্যন্ত চলে নবান্নের আনুষ্ঠানিকতা।
কলকাতা থেকে প্রকাশিত রমেশচন্দ্র দত্তের ‘বাংলার কৃষক’ (১৮৭৪) গ্রন্থে বলা হয়েছে, আমন ধান ভরা বর্ষায় রোপণ করা হয় নিচু জমিতে। ধান কাটা হয় বাংলা সনের অগ্রহায়ণ ও পৌষ মাসে। অগ্রহায়ণের নবান্ন উৎসবকে ‘আমন পার্বণ’ হিসেবে উল্লে¬খ করে তিনি বলেন, ‘আমন কাটা শেষে আনন্দ-উল্লাসের সাথে বিভিন্ন ধরনের আচার-অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় এবং বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান হলো ডিসেম্বরের শীতের মতো উষ্ণ ও হৃদ্যতাপূর্ণ ভোজন এবং বিভিন্ন উপায়ে তৈরি উষ্ণ ও সুস্বাদু পিঠা বিতরণ।’
নবান্ন মূলত একটি উদার, অসাম্প্রদায়িক লোকজ উৎসব, ধর্মের সাথে এর কোনো বিরোধও নেই, সম্পর্কও নেই। এর ষোলআনাই বাঙালিত্বের মহিমা কীর্তনে ভরা। এ উপলক্ষে ঘরে ঘরে উপাদেয় খানাপিনার আয়োজন করা হয়। পল্লীতীর্থের পথিক লেখক দীনেন্দ্রকুমার রায় তাঁর ‘পল্লী বৈচিত্র্য’ (২০০৪) বইয়ে লিখেছেন, ‘বঙ্গের অধিকাংশ পল্ল¬ীতেই নবান্ন অগ্রহায়ণ মাসের একটি আনন্দপূর্ণ প্রয়োজনীয় গার্হস্থ্য উৎসব। পল্ল¬ীবাসীগণের মধ্যে হিন্দু মাত্রেই পিতৃপুরুষ ও দেবগণের উদ্দেশ্যে নূতন চাউল উৎসর্গ না করিয়া স¦য়ং তাহা গ্রহণ করেন না।’
মেহেরপুর নিবাসী লেখক দীনেন্দ্রকুমার রায়ের কথার প্রতিধ্বনি শোনা গেল মেহেরপুর সদর উপজেলার শ্যামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক গৌরী সাহার কণ্ঠে। তিনি জানান, মেহেরপুর অঞ্চলে আমন ধানের চিকন চাল হয় প্রচুর পরিমানে। আগের রাতে জলে ভিজিয়ে রাখা চিকন-আতপ চাল পরদিন ভোরে স্নান সেরে গৃহবধূরাা পাটানোড়া দিয়ে বেঁটে গুড়ো প্রস্তুত করে। সেই গুড়োর সাথে নতুন গুড়, আদা, মসলা, দুধ মিশিয়ে নবান্ন বানানো হয়। ন’ রকমের ফলও এতে মেশাতে হয়। নতুন চালের পায়েস ছাড়াও থাকে চিড়া ও মুড়ি-মুড়কি। এসব খাবার সর্বপ্রথমে গৃহদেবতার উদ্দেশ্যে নিবেদন করা হয় এবং পরে আত্মীয়স¦জন ও প্রতিবেশীদের মধ্যে বিতরণ করা হয়।
শুধু খাওয়া-দাওয়াই নয়, নবান্ন উৎসবকে প্রাণবন্ত করে তোলার জন্য যাত্রাপালা, জারিগান, কীর্তন গান, বাউল গানের আয়োজন করা হয়। ধানকাটা শেষ হয়ে গেলে মেহেরপুরের চরগোয়ালগ্রাম, দীঘিরপাড়া, আমঝুেিপত লাঠিখেলা হয়। গ্রামের পথে পথে মানিকপীরের নামে গান গেয়ে বেড়ায় গ্রামের গায়েন-বয়াতিরা। এক সময় মেহেরপুরের পিরোজপুর, সাহারবাটী, দারিয়াপুর, আমদহ; চুয়াডাঙ্গার হাটবোয়ালিয়া, আসমানখালি গ্র্রামে আমন কাটার পরপরই যাত্রাগানের আসর বসতো। মেহেরপুর শহরে ঢপগান ও কবির লড়াই। সাহারবাটী,পিরোজপুর, আসমানখালি,হাটবোয়ালিয়া গ্রামে অনুষ্ঠিত এসব আসরের স্থিতিকাল ছিল পাঁচ থেকে সাত রাত পর্যন্ত। মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা জেলায় যাত্রার আসর আর তেমন হয় না। তবে মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া জেলার অজ-পাড়াগাঁয়ের আখড়াগুলিতে বাউলগানের আসর বসে। আর সারারাত জেগে আসরের গান উপভোগ করে গ্রামের মানুষ।
সরেজমিনে মেহেরপুর জেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, দিগন্ত জোড়া মাঠ ভরে উঠেছে এখন পাকা ধানের সুঘ্রাণে । ইতোমধ্যেই কারো কারো ধান গোলায় উঠে গেছে। মেহেরপুর সদর উপজেলার গোপালপুর গ্রামের কৃষক মোস্তফা কামাল জানান, ‘ আশা করি, এবার আমন ধানের বাম্পার ফলন হবে। ভালো লাগছে, খুব ভালো লাগছে।’ এই ভালোলাগার হাসি-রঙ চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। তাই গ্রামে গ্রামে চলছে নবান্ন উৎসব। অধিকাংশ বাড়িতে চলছে ক্ষীর-পিঠা-পুলি আর হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িতে পায়েস এর ধুম। বলা বাহুল্য যে, প্রতি বাড়িতে প্রতিদিনই চলছে নবান্নের প্রচুর আয়োজন। যে সব বাড়িতে নবান্নের আয়োজন হয়নি, তারাও হয়তো অন্য বাড়ি থেকে আসা নবান্নের উপাদেয় খাবার সপরিবারে উপভোগ করছে।
দীনেন্দ্রকুমার রায় ‘নবান্ন’ সম্পর্কে ‘পল্লী বৈচিত্র্য’ গ্রন্থের এক জায়গায় লিখেছেন, ‘নবান্নের দিন অপরাহ্নে পল্লীপ্রান্ত এক সময় হর্ষকলরবে মুখরিত হত। নদী তীরবর্তী সুবৃহৎ ষষ্ঠী গাছের ছায়ায় গ্রামের রাখাল-কৃষাণ-মজুরেরা সমবেত হয়ে বিশ্রাম নিত। আজ তাহাদের বর্ষব্যাপী কঠোর পরিশ্রমের পর বিশ্রামের দিন, আজ তাহারা কেউ কাজে যাইবে না।’ ‘পল্লী রমনীগণ নদী জলে গা ধুইয়ে কলসি ভরিয়া জল লইয়া গৃহে ফিরতো।’ তিনি আরও লিখেছেন, “ছেলেরা সমস্ত দুপুর বাড়ির বারান্দায়, চিলেকোঠার ছাতে, অন্দরের বাগানে, গোয়াল ঘরের অন্তরালে’ লুকোচুরি খেলতো। প্রত্যেক বাড়িতেই আয়োজন করা হতো ডাল, ভাল মাছ, গুড়-অ¤¦ল, দৈ, পায়েস প্রভৃতি সুস্বাদু আহার। শিব মন্দিরের বারান্দায় বসে নেশাখোর বাউলের দল ডুগডুগি বাজিয়ে গাইত,
বাঁশের দোলাতে উঠে, কে হে বটে
শ্মশান ঘাটে যাচ্ছে চলে।”
দীনেন্দ্রকুমার রায় (১৮৬৯-১৯৪৩) এর সময়ের সেই রঙিন দিনগুলি আর নেই- বদলে গেছে বাংলাদেশ, বদলে গেছে মেহেরপুর। তারপরও অগ্রহায়ণ আসতে না আসতেই, বাজার ভরে যায় সীম,শশা, শাক, আলু, ‘সাকারকু-’ আলু, ফুলকপি, বাঁধাকপি, পালংসহ নানারকম শাক-সবজিতে। এসব দিয়েই ঐতিহ্যবাহী এ জেলার গ্রামে গ্রামে চলছে নবান্নের আয়োজন। মেহেরপুর শহরের শহীদ শামসুজ্জোহা নগর-উদ্যানে বসেছে নবান্নের মেলা।
আবদুল্লাহ আল আমিন : লেখক ও প্রাবন্ধিক। সহযোগী অধ্যাপক, মেহেরপুর সরকারি কলেজ, মেহেরপুর।


সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই নভেম্বর, ২০১৭ বিকাল ৪:৩০
৪টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মামুনুলের মুক্তির খবরে কাল বৃষ্টি নেমেছিল

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৪৯


হেফাজত নেতা মামুনুল হক কারামুক্ত হওয়ায় তার অনুসারীদের মধ্যে খুশির জোয়ার বয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ তো বলল, তার মুক্তির খবরে কাল রাতে বৃষ্টি নেমেছিল। কিন্তু পিছিয়ে যাওয়ায় আজ গাজীপুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ অপেক্ষা

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২৩



গরমের সময় ক্লাশ গুলো বেশ লম্বা মনে হয়, তার উপর সানোয়ার স্যারের ক্লাশ এমনিতেই লম্বা হয় । তার একটা মুদ্রা দোষ আছে প্যারা প্রতি একটা শব্দ তিনি করেন, ব্যাস... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদে মসজিদে মোল্লা,ও কমিটি নতুন আইনে চালাচ্ছে সমাজ.

লিখেছেন এম ডি মুসা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৩

গত সপ্তাহে ভোলার জাহানপুর ইউনিয়নের চরফ্যাশন ওমরাবাজ গ্রামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। লোকটি নিয়মিত মসজিদে যেত না, মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েনি, জানা গেল সে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী ছিল, স্বীকারোক্তিতে সে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×