somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

তারেক মাসুদ : সিনেমার ফেরিওয়ালা

০৩ রা ডিসেম্বর, ২০১৭ রাত ১০:৫৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আবদুল্লাহ আল আমিন


এক কবি-বন্ধুর অকাল মৃত্যুতে বেদনার্ত হয়ে সব্যসাচী বুদ্ধদেব বসু লিখেছিলেন, ‘যে কোনো মৃত্যু-ই শ্রদ্ধেয়, কিন্তু বীরের মৃত্যু মহান।’ রণাঙ্গনের যোদ্ধাদের মতো কবি, শিল্পী, সাহিত্যিকরাও তার কাছে বীরের মর্যাদা লাভ করেছিল। তিনি কবি, শিল্পী, বিজ্ঞানীদের বীর হিসেবে মান্য করতেন। সৃষ্টিশীল ও মননশীল মানুষের কথা বলতে গিয়ে মহাভারতের বীরদের স্মরণ করে তিনি লিখেছিলেন, ‘ দ্রোণ, কর্ণ, অভিন্যুরা আজকের দিনে ভিন্নভাবে মূর্ত হন। জ্ঞানী, শিল্পী, ¯্রষ্টা তারা; রূপ অথবা চিন্তার জনয়িতা তারা। আমরা জেনেছি সৃষ্টিশীলতা-ই শৌর্য, জেনেছি সৃষ্টিশীল মানুষ নিজেকেও সৃষ্টি করে চলেন।’ এমনই এক বলবান সৃষ্টিশীল মানুষ তারেক মাসুদ (১৯৫৯-২০১১), যিনি বাংলাদেশের সুস্থ ধারার চলচ্চিত্রকে সমৃদ্ধ করেছেন তার শ্রম ও আন্তরিকতা দিয়ে। তিনি একাধারে স্বাধীন পরিচালক, প্রযোজক, চিত্রনাট্যকার ও গীতরচয়িতা। আক্ষরিক অর্থে, তিনি সিনেমার ফেরিওয়ালা। বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যের সুতা বেয়ে নেমে আসা এক স্বাপ্নিক বায়োস্কোপঅলা। চলচ্চিত্রকার হিসেবে তারেক মাসুদের আবির্ভাব ১৯৮০’র দশকে। যখন শামসুর রাহমানের নেতৃত্বে একদল তরুণ বাংলা কবিতার কয়েক দশকের ভাষাশৈলী বদলে দিয়ে নতুন ভাষাশৈলীতে কবিতা রচনা করতে তৎপর, ঠিক সে সময়ে। নতুন সময়ের তরুণ কবিদের মনে হয়েছিল যে, পুরনো যুগের ভাষারীতিতে পরিবর্তিত সময়ের আবেগ, ভাবনা ও সংবেদনশীলতা প্রকাশ করা সম্ভব নয়। কবিতার পাশাপাশি চিত্রকলাতেও আছড়ে পড়ে পরিবর্তনের তরঙ্গ-বিভঙ্গ। ‘সময় গোষ্ঠী’র শিল্পীরা বিমূর্ত শিল্পরীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন। তাদের প্রতিবাদ কেবল বিমূর্ত শিল্পরীতির বিরুদ্ধে ছিল না, তারা নতুন ধারার শিল্প সৃজনেও তৎপর হয়ে ওঠেন। সৃষ্টিশীল উন্মাদনার ঘোরলাগা সময়ে ক্যামেরা হাতে অনেকটা নায়কের ভঙ্গিতে দৃশ্যপটে এগিয়ে আসেন তারেক মাসুদ। তিনি ছিলেন দীর্ঘদেহী, সুদর্শন ও শ্রুতি মধুর কণ্ঠের অধিকারী। আক্ষরিক অর্থে, নায়ক বলতে যা বোঝায় তিনি ছিলেন তা-ই। বুদ্ধি, মেধা, মননশীলতা, স্থিতপ্রজ্ঞা, ধীশক্তি প্রভৃতি নায়কোচিত গুণাবলি তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট হয়ে ওঠে চলচ্চিত্রকার হিসেবে আবির্ভূত হবার পরপরই। সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন,ঋত্বিক ঘটক, জহির রায়হান, আলমগীর কবির, তানভীর মোকাম্মেল যে অর্থে নায়ক, সেই একই অর্থে তারেক মাসুদও নায়ক। তিনি মূলধারার বাণিজ্যিক ও বিনোদনধর্মী ছবির মূলনীতি সচেতনভাবে প্রত্যাখ্যান করে চিন্তাশীল ও প্রথাবিরোধী ভিন্ন ধারার চলচ্চিত্র নির্মাণে ব্রতী হন।এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, বাংলাদেশের দুই গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান ও আলমগীর কবির ছিলেন ভিন্ন ধারার চলচ্চিত্রের পথিকৃৎ। ‘জীবন থেকে নেয়া’(১৯৭০), ‘স্টপ জেনোসাইড’ প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ ছবি জহির রায়হানের চিন্তাশীল মস্তিষ্কজাত। তিনি যখন বড়মাপের ছবির বানানোর জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন, তখন স্বাধীনতাবিরোধীদের চক্রান্তে মিরপুর থেকে নিখোঁজ হন।বাংলাদেশের দুর্ভাগ্যই বলতে হয় যে, তিনি তার বিখ্যাত ছবি ‘লেট দেয়ার বি লাইট’ সমাপ্ত করে যেতে পারেননি। আলমগীর কবিরও সত্তর ও আশির দশকে নির্মাণ করেছিলেন অনেকগুলো নান্দনিক ছবি এবং এসব ছবি তরুণ নির্মাতাদের বিকল্প ধারার ছবি বানাতে আগ্রহী করে তোলে। তার কাছ থেকে আমরা পেয়েছি ‘সূর্যকন্যা’, ‘ধীরে বহে মেঘনা’, ‘সীমানা পেরিয়ে’, ‘রুপালি সৈকতে’র মতো কালজয়ী ছবি। এ দুই চলচ্চিত্রকারের পর তারেক মাসুদ হয়ে উঠেছিলেন বাংলাদেশের বিকল্প ধারার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পরিচালক। তার চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র বিশ্ব চলচ্চিত্রের মহাআঙিনায় পরিচিতি ও সমাদর লাভ করে। এছাড়াও তাঁর মাধ্যমে বাংলা চলচ্চিত্রে সূচিত হয় এক নতুন যুগের এবং সেই সাথে তৈরি হয় বাংলা চলচ্চিত্রের নতুন আদল। আবহমান বাংলার লোকজসংস্কৃতি ও লোকদর্শনে ¯œাত হয়ে তিনি বাংলা চলচ্চিত্রকে স্থানিক ভাষারীতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। তিনি তার অভিজ্ঞতা দিয়েই জেনেছিলেন যে, চিত্রকলা বা শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মতো সিনেমা কোনো এলিট আর্ট বা হাই আর্ট নয়। এটা পপুলার আর্ট অবশ্যই। তাই চলচ্চিত্রকে লোকভিত্তি বা লোকগ্রাহ্যতার উপর দাঁড় করানোই ছিল তার শিল্প-দর্শনের মূল লক্ষ্য। এটা শুদ্ধতাবাদী এলিট আর্টে পরিণত হোক, তা তিনি কখনোই চাননি। আর এ দর্শন অন্তরে ধারণ করে চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানকে নিয়ে নির্মিত ‘আদম সুরত’ দিয়ে চলচ্চিত্রের রূপালিখাতায় নাম লেখান। যে শুভ কর্মপথে তিনি যাত্রা করেন, সেখানে সখা হয়েছিলেন মিশুক মুনীর। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে তারেক মাসুদের আবির্ভাব অনেকটা লোকশিক্ষক হিসেবে। মঞ্চ সারথি গিরীশ ঘোষ, শিশির ভাদুড়ী যে অর্থে লোকশিক্ষক, শম্ভু মিত্র যে অর্থে লোকশিক্ষার ধারক-বাহক, ওই এক-ই অর্থে তারেক মাসুদও লোকশিক্ষক। ‘আদম সুরত’ থেকে ‘নরসুন্দর’, অন্তর্যাত্রা’ থেকে ‘রানওয়ে’, ‘মাটির ময়না’,‘ মুক্তির গান’ সব ছবিতেই তিনি লোকশিক্ষকের ভূমিকা পালন করেছেন। লোকশিক্ষার বাহন হিসেবে সিনেমাকে তিনি সাধারণ মানুষের কাছে নিয়ে যেতে চেয়েছেন আমৃত্যু। বাংলাদেশের মঞ্চনাটক বেইলি রোডের মহিলা সমিতির মঞ্চ আর শিল্পকলা একাডেমির পরীক্ষণ থিয়েটার হল ও নন্দনমঞ্চে আটকে আছে, তার চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রেও তেমনটি হোক তিনি তা চাননি। শিল্প-সাহিত্য, সিনেমার জনসম্পৃক্ততা নিয়ে সব সময় তিনি সরব থাকতে চেয়েছেন সৃজনকুশলতা দিয়ে, হোক তা আর্টফিল্ম কিংবা ইন্ডাস্ট্রি ফিল্ম। তবে আর্ট কিংবা ক্রিয়েটিভিটির প্রশ্নে আপস করেননি। ভায়োলেন্সকেও তিনি নান্দনিকভাবে উপস্থাপন করতে চেয়েছেন সব সময়। তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন :
“আমরা যারা সৃজনশীল ছবি বানাতে চেষ্টা করি, তাদের ফিল্মে যে ভায়োলেন্স আসে না তা নয়। কিন্তু তার ট্রিটমেন্ট হয় ভিন্ন। যেমন যদি আমি আমার ‘মাটির ময়না’র কথা বলি, পুরো ছবিটা বেসিক্যালি ভায়োলেন্স নিয়ে। ছবির বিষয়বস্তু-ই যদি দেখি, নানাভাবে ভায়োলেন্স আছে, ওয়ার ইজ দ্যা ব্যাকড্রপ। ছবির মধ্যে ব্রুটালিটি আছে।একটা ব্যাপার আছে নন্দনতাত্ত্বিক.. যে গ্রাফিকওয়েতে ভায়োলেন্স দেখাবো না, কিন্তু ক্রিয়েট এ সেন্স অব ভায়োলেন্স।” ( প্রথম আলো, ১৯ আগস্ট ২০১১)।
তিনি আরো বলেছেন, ‘মাটির ময়না’ ছবিতে ভায়োলেন্স এসেছে মোর অ্যাসথেটিক্যালি। তারেক মাসুদ ব্যক্তিগতভাবে ভায়োলেন্সকে পছন্দ করতেন না, ভায়োলেন্স তার জীবন-দর্শনের বিরোধী। আর তাই ‘মাটির ময়না’তে সরাসরি ভায়োলেন্স-দৃশ্য গ্রহণ করেননি। কোরবানির মতো ভায়োলেন্সকেও ছবিতে গ্রহণ করতে পারেননি। তাই ভায়োলেন্স-দৃশ্য পরিহারের জন্য স্লটারিং না প্রদর্শন করে ‘ পোস্ট স্লটারিং রক্তভেজা’ মাটি দেখানো হয়েছে। চড়কের বড়শি ভায়োলেন্ট বিষয় হওয়ায় ‘মাটির ময়না’য় তা দেখানো হয়নি।
তারেক মাসুদ ছিলেন সত্যিকারের সৃষ্টিশীল ও জীবনঘনিষ্ঠ মানুষ। তাই যুদ্ধ ও যৌনতাকেও জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে মনে করতেন। তিনি গভীরভাবেই বিশ্বাস করতেন, মৃত্যুকে বাদ দিয়ে যেমন জীবন কল্পনা করা যায় না, তেমন-ই যৌনতাকেও মনুষ্য জীবন থেকে আলাদা ভাবা যায় না। কিন্তু যৌনতা যখন ‘ মেয়ার গ্রাফিক রিপ্রেজেন্টেশন হয়ে যায়, তখন তা পর্নোগ্রাফি, আর যখন তা পার্ট অব লাইফ হিসেবে আসতে পারে তখন সেটা আর্ট’। জীবনকে তিনি গভীর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে দেখেছেন। তাই দ্বিধাহীনভাবে বলতে পেরেছে,‘ জীবনের একটা বিশাল এবং গুরুত্বপূর্ণ অংশ যৌনতা। সেটা আমার ছবিতে প্রায় অনুপস্থিত। এটা এক ধরনের অসম্ভব সীমাবদ্ধতা, অসম্পূর্ণতা এবং অক্ষমতা- নির্মাতা হিসেবে মনে করি।.. যৌনতা শুধু ব্যক্তিগত নয়; পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনেও খুব গুরুত্বপূর্ণ।.. যুদ্ধের মধ্যে যেমন রাজনীতি আছে, তেমন-ই যৌনতাও রাজনীতির বিরাট অংশ।’ ফ্রয়েডের মনোসমীক্ষাতত্ত্ব দ্বারা প্রভাবিত এই মহান চলচ্চিত্রকার বলেছেন, ‘ সিনেমার জন্য যৌনতা খুব জরুরি।’
তারেক ইতিহাসের ছাত্র, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ইতিহাসে ¯œাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। তাই তার ছবিতে থাকে ইতিহাস ও রাজনীতির ছাপ। অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে অবিচল তারেকের ছবিতে বারবার ফিরে এসেছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। মানবমুক্তির সার্বিক দ্যোতক হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ ছিল তার শিল্পভাবনার কেন্দ্রবিন্দুতে। মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাথা তুলে ধরতে নির্মাণ করেন ‘মুক্তির গান’, ‘মুক্তির কথা’। ‘মাটির ময়না’তেও মুক্তিযুদ্ধের কথা এসেছে। সেই সাথে এসেছে, বাঙালি জাতীয়তাবাদের কিছু মৌলিক সংকটের প্রসঙ্গ। মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাথা তুলে ধরতে গিয়ে তিনি কোনো মহামানবের স্তবগাথা রচনা করেননি। বিশ্বের সব যুদ্ধের ইতিহাস এক অর্থে মহামানবদের গৌরবগাথায় আকীর্ণ। সেখানে সাধারণের ঠাঁই নেই বললেই চলে। মুক্তিযুদ্ধের মরণপণ লড়াইয়ে প্রান্তজনের যে বিশাল অবদান রয়েছে তা আমরা মনে করতেই চাই না । কিন্তু তারেক সেই গতানুগতিক পথে পা বাড়াননি, তিনি তার প্রজ্ঞার দীপ্তিতে নতুন পথের সন্ধান করেছেন। তাঁর ‘মুক্তির গান’, ‘মুক্তির কথা’, ‘নরস্ন্দুর’, ‘মাটির ময়না’য় সাধারণ মানুষের সাহস-সংগ্রাম, আনন্দ- বেদনা ব্যাখ্যাত হয়েছে ভিন্নমাত্রিক কায়দায়। ছবি বানাতে গিয়ে কেবল মুনাফা অর্জনের বিষয়টি চিন্তা করেননি, সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধতার কথাও চিন্তা করেছেন গভীরভাবে। বলতে দ্বিধা নেই, আমাদের দেশে যারা মূলধারার বাণিজ্যিক ছবি বানায়, তারা কোনোদিনই সিনেমাকে আর্ট হিসেবে গ্রহণ করেন না। তারা এটাকে গ্রহণ করেছেন বাণিজ্যিক পণ্য হিসেবে। তারা চলচ্চিত্রে বিনিয়োগ করেন সামাজিক দায়বোধের তাগিদ থেকে নয়, কেবল মুনাফা অর্জনের প্রত্যাশায়। তাদের কাছে পালতোলা নৌকা, ঢেউ খেলানো ধানক্ষেত, ভোরের শিশির, অস্তাচলগামী সূর্যের রক্তিম আভা, ভাটিয়ালি গান, বাউলের একতারা সব-ই পণ্য। তারা নারীর সৌন্দর্য, মায়ের অশ্রু, শিশুর হাসি বিক্রি করে কেবল টাকা কামায় করতে চায়। গীতাঞ্জলির চেয়ে একজোড়া চটিজুতাকে তারা অধিক মূল্যবান মনে করেন। ফলে মূলধারার চলচ্চিত্রকাররা বছরে একটিও শিল্পগুণসম্পন্ন ছবি বানাতে পারেন না। অথচ তারেক মাসুদ ও তার সমসাময়িক তরুণ নির্মাতারা তাদের বলিষ্ঠ শিল্পচেতনা দিয়ে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে একটি বিশেষ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন। তাঁদের মাধ্যমেই নির্মিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক অনেকগুলি স্বল্পদৈর্ঘ্যরে ছবি। মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক যে সব ছবি নির্মিত হয়েছে , সেগুলোর মধ্যে মোরশেদুল ইসলামের আগামী, সূচনা ও খেলাঘর; নাসিরউদ্দিন ইউসুফের একাত্তরের যীশু ও গেরিলা; আবু সায়ীদের ধূসর যাত্রা; দিলদার হোসেনের একজন মুক্তিযোদ্ধা; খান আখতার হোসেনের দুরন্ত; তারভীর মোকাম্মেলের স্মৃতি ৭১, নদীর নাম মধুমতি, হুলিয়া; মোস্তফা কামালের প্রত্যাবর্তন এবং তারেক মাসুদ ও ক্যাথেরিন মাসুদের মুক্তির গান ও মুক্তির কথা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। নাসিরউদ্দীন ইফসুফ কিংবা তারেক মাসুদরা মুক্তিযুদ্ধকে সংকীর্ণ পরিসরে বিবেচনা করেননি। তাদের শিল্পভাবনায় মুক্তিযুদ্ধ এসেছে বিশ্ব মানবতার মুক্তিসংগ্রামের অংশ হিসেবে। এ কারণে তারেক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আর্কাইভাল ফুটেজ খুঁজতে গেছেন আমেরিকায় এবং তা ক্যাথেরিনের সহায়তায় খুঁজে বের করেছেন। সম্ভবত সেখান থেকেই দুজনের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে ওঠে এবং প্রগাঢ় প্রেমপর্বের পর দুজনে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। ক্যাথেরিন ছিলেন মাসুদের সকল শুভকর্ম ও চিন্তার প্রেরণাদাত্রী। এই ঋদ্ধিমতী নারীর অনিঃশেষ প্রেরণা-ই তাঁকে দিয়েছিল ¯্রােতের বিপরীতে দাঁড় বাইবার প্রবল প্রাণশক্তি। ক্যাথেরিন তার ঋজুতা দিয়ে তারেকের শিরদাঁড়া টানটান করে রেখেছিলেন। অন্তিম মুহূর্তেও তিনি তারেকের পাশেই ছিলেন।
তারেকের স্বপ্ন ছিল মুক্তিযুদ্ধের মহাকাব্যিক আখ্যান নিয়ে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্যরে ছবি বানানোর। এই কর্মযজ্ঞে হাত দেয়ার জন্য তিনি নিজেকে প্রস্তুত করছিলেন। মেজর কামরুলকে তিনি বলেছিলেন, ‘ কামরুল ভাই, আপনার লেখা মুক্তিযুদ্ধের সত্য কাহিনীগুলো নিয়ে একটি পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি বানাবো। আয়োজনটা সম্পন্ন করে নিই।’[ মেজর কামরুল হসান ভূঁইয়া (অব.) : ‘ ভালো মানুষ বেশিদিন বাঁচে না’। প্রথম আলো, ১৬ আগস্ট ২০১১]
ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা উপজেলার নুরপুর গ্রামে জন্ম নেয়া তারেক মাসুদ বড় হয়েছেন প্রসারিত জীবনভাবনার মধ্য দিয়ে। শিল্পের বিভিন্ন মাধ্যমের রূপরস নিতে নিতে তার মধ্যে জেগে ওঠে সেক্যুলার, মানবিক ও উদার দৃষ্টিভঙ্গি। এই দৃষ্টিভঙ্গিই তাকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও বাঙালিত্বের কাছাকাছি নিয়ে আসে। বাঙালিত্বের মহিমা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্ভাসিত মানুষ হিসেবে তার অবস্থান ছিল ধর্মান্ধতা, গোঁড়ামি, ভিত্তিহীন- অযৌক্তিক বিশ্বাসের বিরুদ্ধে। ‘মাটির ময়না’তে তিনি আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে প্রতিবাদ করেছেন ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার ও জঙ্গিবাদের। আর এই প্রতিবাদ-সংগ্রামে তাকে সাহস যুগিয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার আগ্রহ ও কৌতূহলের খামতি হয়ি কখনোই। তার কাছে মনে হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাথাকে কেবল মহাকাব্যের সাথেই তুলনা করা যেতে পারে। এ যুদ্ধের একদিকে রয়েছে বর্বরতা, অমানবিকতা, নিষ্ঠুরতা, অগ্নিসংযোগ, হত্যাযজ্ঞ-লুণ্ঠন, আর অন্যদিকে রয়েছে আত্মত্যাগ, বীরোচিত লড়াই, মানবিকতা ও মনুষ্যত্বের মহিমা। মহাকাব্যে থাকে বীররস, করুণরস ও আনন্দরসের মতো বিপরীতধর্মী নানা রসের সমাহার, তেমনটিই আমরা প্রত্যক্ষ করি, ১৯৭১-এর রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে। তাই মুক্তিযুদ্ধের আখ্যান নিয়ে ছবি বানাতে তিনি সব সময় স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। কথাসাহিত্যিক হরিপদ দত্তের মতো তিনিও মেনে নিয়েছিলেন যে, ‘সাহিত্যের বাইরে বাঙালির একমাত্র মহাকাব্য হচ্ছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ।’ ‘মুক্তির গান’ থেকে ‘মাটির ময়না’ পর্যন্ত সবখানে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাথা অথবা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বরতা, অমানবিকতা ও নিষ্ঠুরতার বয়ান। তবে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চলচ্চিত্রায়ন করতে গিয়ে তারেক কখনোই শিল্পের সৌন্দর্যে আঘাত করেননি কিংবা স্থূলভাবে মতাদর্শ প্রচারের কাজেও তিনি তার সিনেমাকে ব্যবহার করতে চাননি। তিনি যে জীবন যাপন করেছেন এবং যে জীবন-দর্শন বিশ্বাস করতেন তা-ই তিনি ক্যামেরার মাধ্যমে রূপালি পর্দায় আনতে চেয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে এ ভূখ-ের জনমানুষের মননে যে স্বপ্ন, আকাঙ্খা ও চেতনা সঞ্চারিত হয়, সেটাই তিনি রূপায়িত করতে চেয়েছিলেন সিনেমায়।
তিনি ভালো করেই জানতেন, কোনো মহৎ শিল্প-ই উদ্দেশ্যহীন হতে পারে না, তা সাহিত্য হোক আর সিনেমা হোক। মিনা কাউটস্কিকে লেখা এক চিঠিতে ( ২৬ নভেম্বর, ১৮৮৫) এঙ্গেলস নাট্যকার এসকাইলাস, দান্তে সম্পর্কে বলেন,‘ তারা সবাই উদ্দেশ্য-প্রবণতা নিয়ে লিখেছেন’। লিও টলস্টয় সম্পর্কে একই কথা বলেন মহামতি লেনিন। সময়লগ্নতা ও সামাজিক দায়বদ্ধতা না থাকলে কোনো শিল্প-ই মহৎ শিল্প হয়ে উঠতে পারে না। আবার ‘পোস্টার ও স্লোগানের স্তরে নামিয়ে আনা হলেও কোনো শিল্প উঁচুমানের শিল্প হয় না।’ আমার বিশ্বাস , তারেক মাসুদের ছবি কালের দাবি পূরণ করেও কালোত্তীর্ণ হবে।
কবিতা, কথাশিল্প, সঙ্গীত, চিত্রকলা, সিনেমা যে শিল্পমাধ্যমই হোক না কেন, প্রতিটির রয়েছে স্বতন্ত্র প্রকাশভঙ্গি। চিত্রকলার কথা যদি বলা হয়, তখন বলা যায় সব চিত্রশিল্পী একই আঙ্গিকে নিজেকে প্রকাশ করেন না। জয়নুল আবেদিনের শিল্পভাষা আর কামরুল হাসানের শিল্পভাষা এক রকম না। কবিতার ক্ষেত্রেও তাই, শামসুর রাহমার আর আল মাহমুদের ভাষারীতি, উপমা, প্রকরণ এক রকম না। অনুরূপভাবে সিনেমার ক্ষেত্রে, ঋত্বিক ঘটক ও গৌতম ঘোষের শিল্পভাবনার মধ্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে। তারেক মাসুদের শিল্পভাবনাও ছিল স্বাতন্ত্র্যম-িত। তার এই ভাবনা আরোপিত কোনো ভাবনা নয়, তার জীবনবোধের সঙ্গে এই ভাবনার সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত নিবিড়। তিনি যেমন করে ভাবতেন, আলাপ করতেন; ঠিক সেভাবেই সবকিছু ফুটিয়ে তুলতে চাইতেন ছবিতে। তিনি চলচ্চিত্রকে গ্রামের ছবি, শহরের ছবি, ইনটেলেকচুয়ালদের ছবিÑ এভাবে ভাগ করতে চাননি। আবার স্ক্রিন প্রেজেন্স, স্টারডম, গ্ল্যামারÑ এ সবও তিনি তেমন গুরুত্ব দিতেন না। বাংলা চলচ্চিত্রকে তিনি অন্ধগলি থেকে আলোকোজ্জ্বল রাজপথে আনতে চেয়েছিলেন সারাজীবন। চেয়েছিলেন তার সব ছবি সর্বশ্রেণির দর্শকের কাছে নন্দিত হয়ে মেইনস্ট্রিমের ছবি হয়ে উঠুক, ইনটেলেকচুয়ালের তকমা নিয়ে টিকে থাকুক তা তিনি চাননি। ‘আই উইল গো টু টপ, দ্যা টপ. টপ..’ সত্যজিৎ রায়ের ‘নায়ক’ এর মর্ম দর্শনটিও তিনি গ্রহণ করেননি।
শূন্য থেকে আসে বিন্দু এবং বিন্দু দিয়ে তৈরি হয় বৃত্ত, তেমনই শূন্য খাতার উপর অক্ষরের পর অক্ষর সাজিয়ে রচনা করতে হয় উপন্যাস, মহাকাব্য কিংবা কবিতার বই। সুখ-দুঃখ, আনন্দ- বেদনা মথিত জীবনকে খাতার পৃষ্ঠা হতে সেলুলয়েডে গতিময় করার নাম- সিনেমা। নির্মাতা যখন ক্যামেরা হাতে নেন, তখন সেলুলয়েডের ফ্রেম থাকে শূন্য। সেই শূন্য থেকে তারেক মাসুদ নির্মাণ করেছেন একের পর এক শিল্পের রস মাখানো জীবনের জলছবি। আর এভাবেই তিনি হয়ে ওঠেন চলচ্চিত্র নামক শিল্পের মহান কারিগর ও শিল্পী।

আবদুল্লাহ আল আমিন : গবেষক ও প্রাবন্ধিক। সহযোগী অধ্যাপক, মেহেরপুর সরকারি কলেজ, মেহেরপুর। ফোন : ০১৮১৬- ০৫৬৯৩৪
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা ডিসেম্বর, ২০১৭ রাত ১০:৫৮
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মামুনুলের মুক্তির খবরে কাল বৃষ্টি নেমেছিল

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৪৯


হেফাজত নেতা মামুনুল হক কারামুক্ত হওয়ায় তার অনুসারীদের মধ্যে খুশির জোয়ার বয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ তো বলল, তার মুক্তির খবরে কাল রাতে বৃষ্টি নেমেছিল। কিন্তু পিছিয়ে যাওয়ায় আজ গাজীপুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ অপেক্ষা

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২৩



গরমের সময় ক্লাশ গুলো বেশ লম্বা মনে হয়, তার উপর সানোয়ার স্যারের ক্লাশ এমনিতেই লম্বা হয় । তার একটা মুদ্রা দোষ আছে প্যারা প্রতি একটা শব্দ তিনি করেন, ব্যাস... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদে মসজিদে মোল্লা,ও কমিটি নতুন আইনে চালাচ্ছে সমাজ.

লিখেছেন এম ডি মুসা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৩

গত সপ্তাহে ভোলার জাহানপুর ইউনিয়নের চরফ্যাশন ওমরাবাজ গ্রামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। লোকটি নিয়মিত মসজিদে যেত না, মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েনি, জানা গেল সে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী ছিল, স্বীকারোক্তিতে সে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×