লক্ষণ 1: হ্যালুসিনেশন: একে বলা যায় ভুল দেখা। এ অবস্থায় মানুষটি যা দেখছে বলে ভাবছে তা আসলে ঠিক নয়। "সর, সর, আমার চোখের সামনে থেকে সর"- এ কথা রাস্তার পাগলদের বলতে আমরা দেখি। এই বলে আজো ওঝারা জি্বন-ভূত তাড়ায়। এই কথা বলেই পয়গম্বররা শয়তান তাড়াতেন। আবার অনেকেই দৃষ্টি বিভ্রমে ঘুম থেকে ওঠে ভোর বেলা আকাশের সমান লম্বা দরবেশ দেখে, ফেরেশতা দেখে, বিভ্রান্ত হয়ে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে সেই দৃশ্যবস্তুকে অনুসরণ করে হারিয়ে যায়।
লক্ষণ 2: কন্ঠস্বর শুনতে পাওয়া: সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রানত্দ মানুষ সব সময় শুনতে পায় তাদের মাথার ভেতর কে যেন কথা বলছে। আমি একজনকে চিনি যে, প্রযুক্তি-পছন্দ করতো বলেই হয়তো, আক্রান্ত হওয়ার পর বলতো স্যাটেলাইটের সব টিভি চ্যানেলের কথা সে তার মাথার ভেতর শুনতে পায়। তবে অন্য মানুষরা এসব শব্দকে বাসত্দব মানুষের, অশরীরি আত্মার, ফেরেশতার, বা ঈশ্বরের বলে মনে করে। একসাথে কয়েক ধরণের কন্ঠস্বর শোনে এরা। কোনো কণ্ঠস্বর থাকে শয়তানের, কোনোটা বা ঈশ্বরের, কোনোটা স্বগর্ীয় পিতা বা নবীর। শয়তান মাথায় দুবুর্দ্ধি দেয়, বলে অমুককে হত্যা করো, তমুককে ধর্ষণ করো, ওর কান কেটে ফেলো। আবার ঈশ্বর আশ্বাস দেন যে, তুমিই আমার প্রতিনিধি, নিশ্চয়ই সব মানুষ একদিন তোমার কথা শুনবে।
লক্ষণ 3: ডিলিউশন: ভ্রানত্দ বিশ্বাস। এরকম লোক মনে করে সে উত্তম কুমার - টালিউডের নায়ক, তার বিশাল ক্ষমতা আছে মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করার, সে ভবিষ্যতের নেতা-প্রেসিডেন্ট।
এরকম ভ্রান্ত বিশ্বাস থেকেই মানুষ ভাবে সে পয়গম্বর, ঈশ্বর তাকে বাছাই করেছেন পাপ থেকে পৃথিবীকে উদ্ধার করতে।
বিভিন্ন রকমের ডিলিউশনে মানুষ ভুগতে পারে। তবে এর মূল কথা হলো সে নিজেকে এমন একটা কিছু বলে বিশ্বাস করে যার সাথে বেশিরভাগ যুক্তি-বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ একমত হয় না।
কিছু উদাহরণ:
খ্রিস্টান ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা সেইন্ট পল বিশ্বাস করেছিলেন যে তিনি "ঈশ্বরের এক মিশনে আছেন" কারণ তিনি সেরকম এক "দৃশ্য" দেখেছেন। বিটলসের গায়ক জর্জ হ্যারিসনকে চাকু মেরেছিলো যে আব্রাম, সেও ভাবতো, যে "ঈশ্বরের এক মিশনে আছে" (অরেঞ্জ কাউন্টি রেজিস্টার, 7/5/02, পৃষ্ঠা 121)।
অস্কার পাওয়া মুভি "দি বিউটিফুল মাইন্ডে" রাসেল ক্রো অভিনয় করেছিলেন নোবেল জয়ী অধ্যাপক জন ন্যাশের ভূমিকায়। ন্যাশ সিজোফ্রেনিক ছিলেন। তিনি তার শিশুদেরকে পানিতে ডুবিয়ে মারতে চেয়েছিলেন কারণ তার ভাষায় ঈশ্বর তাকে সেটা করতে বলেছেন।
2004 এ সুইডিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনা লিন্দকে ছুরি মেরেছিল যে যুবক সেও দাবী করেছে যে ঈশ্বর তাকে এই কাজের জন্য নির্বাচিত করেছে। তার নাম ছিল মিজালো। মিজালো কে আমরা এই দাবীর জন্য সিজোফ্রেনিয়াক ভাববো কিন্তু একই রকম দাবী যখন পয়গম্বররা করছেন তখন তাদেরকে আমরা প্রেরিত পুরম্নষ জ্ঞান করেছি। কেন?
সাইকিয়াট্রিক এ্যানথ্রোপলজিস্টরা নতুন ধর্ম প্রতিষ্ঠার বিষয় নিয়ে গবেষণা করে থাকেন। তারা বলছেন, একজন ব্যক্তি মানুষের হ্যালুসিনেশন বা ডিলু্যশনের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই চালু হয়েছে নতুন নতুন ধর্ম। অর্থাৎ পয়গম্বরদের মানসিক বৈকল্যের কারণে ভুল দেখা ও ভুল শোনার উপর দাঁড়িয়ে আছে বিভিন্ন ধর্ম। তাদের এসব কথায় প্রথমেই বিশ্বাস করেছে তাদের পরিবারের সদস্যরা, বন্ধু-স্বজনরা, তারপর ধীরে ধীরে নানা অলৌকিকতার গাল-গল্পে সমর্থক-ভক্তদের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে ধর্মটি একসময় রূপ পেয়েছে বিরাট প্রতিষ্ঠানের। (তবে সবার প্রচারিত ধর্মই বড় হয় না, সবাই পয়গম্বর হিসেবে সফলও হয় না, তারা তখন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে তাদের জনপদ থেকে এবং মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত হিসেবেই মারা যায়।) (সূত্র: Littlewood, R. (1984) The imitation of madness: the influence of psychopathology upon culture. Social Science and Medicine, 19, 705 -715.)
ধর্মের প্রতিষ্ঠা ও পয়গম্বর হয়ে ওঠার এই সাইকো-এ্যানালাইটিক্যাল ব্যাখ্যা আপনাকে এক কথায় মেনে নিতে হবে তা বলছি না। তবে টেম্পোরাল লোব এপিলেপ্সি আর সিজোফ্রেনিয়ার লক্ষণগুলো পড়ুন, তারপর আপনার চেনা-জানা পয়গম্বরদের জীবনী গ্রন্থে আবার চোখ বুলান। দেখুন ভুল দেখা, ভুল শোনার কত মরতবা পৃথিবীতে।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সন্ধ্যা ৭:০০