আনমনে হেঁটে চলেছি আমি, অন্ত বিহীন একটা পথে। এই পথের যে কোথায় অন্ত, আমার জানা নেই, আপাতত আমার কাছে অন্ত বিহীন ই মনে হয়। চলেছি আমি, অদৃশ্যমান একজন সঙ্গী নিয়ে "আমার আমি", এবং দৃশ্যমান একজন সঙ্গী নিয়ে "আমার ছায়া" এই পথ চলতে চলতে আমার একা মনে হয়নাই কখন ও, কারণ দুজন সঙ্গী আছে আমার সাথে। হাটতে হাটতে অনেক দূর হাঁটলাম। পা যেন আর চলতে চাইছে না। ভীষণ ক্লান্ত আমি, অবসাদে ঘিরে আসছে পুরো শরীর টা। তাই হেলান দিয়ে বসে পড়লাম পথের পাশের একটা গাছের নিচে। প্রখর রোদ, চারদিক মরুভূমির মত খাঁ খাঁ করছে। ভীষণ তৃষ্ণা ও লাগছে । কেউ একজন বলেছিল, তৃষ্ণা নাকি মানুষের জৈবিক তাড়ান, আমার এই তৃষ্ণা কিসের আমি বুঝতে পারছিনা। ছেয়ে আছি উদাস ভরা দৃষ্টি দিয়ে দিগন্তের মিলিয়ে যাওয়া রেখার দিকে, জনমানব শূন্য এই বিশাল পথে। হঠাৎ করে আমি লক্ষ্য করলাম, দিগন্তের মিলিয়ে যাওয়া রেখা থেকে কিছু একটা আমার দিকে যেন উড়ে আসছে । উৎসুক দৃষ্টিতে ছেয়ে আছি, আর ভাবছি কি হতে পারে! ক্রমে স্পষ্ট হয়ে উঠছে কিছু একটা, দেখতে পেলাম যে একটা প্রজাপতি উড়ে আসছে, উড়ে এসে ঠিক আমার সামনে পাথরের পাশে একটা ঘাস ফুলের উপর বসে পড়ল। আমি অ-ভাক হয়ে দেখলাম কি সুন্দর একটা ঘাস ফুল ফুটে আছে এখানে, অথচ এতক্ষণ আমি খেয়ালই করিনি। আপন মহিমায় সে তার সব সৌন্দর্য কে উজাড় করে দিয়ে মৃদু বাতাসে দোল খাচ্ছে। আমি অ-ভাক চোখে তাকিয়ে দেখছি, কি সুন্দর, অপরূপ লাগছে ঘাস-ফুলটা কে। আমার এই দীর্ঘ চলার পথে, কত হাজার হাজার নাম না জানা ঘাস-ফুল আমি দেখেছি, কিন্তু এ রকম গভীর ভাবে কখনও কোন ঘাস-ফুল কে দেখা হয়নি। আমি, মুগ্ধ, বিমোহিত এই ঘাস-ফুলটা কে দেখে। এত সুন্দর কি করে হয় ঘাস-ফুল! প্রজাপতিটা যেন আমার কানে কানে বলছে, এই বোকা ছেলে ঘাস-ফুল সন্দর ঠিক ই, তুমি কখনো সুন্দর করে দেখতে চাও নি ঘাস-ফুল কে। ঠিক তখন ই ঘাস-ফুলটি যেন বলে উঠল, এই ছেলে ওর কথায় তুমি কান দিও না, আমি ঘাস-ফুল নই, আমি মডার্ন টেকনোলজি দিয়ে তৈরি করা একটা প্রোগ্রাম মাত্র। আমার পাপড়ি মেলায় কোন আগ্রহ নেই, আমার পাপড়ি থেকে কোণ সু-গন্ধ বের হয়না, আমি অন্ত সার শূন্য ঠাই দাঁড়িয়ে থেকে শুধু এই পথের পথিকদের আসা-যাওয়া দেখছি। আমার কোন বাসনা নেই, কোন চাওয়া নেই, কোন জিজ্ঞাসা নেই, কোন অনুভূতি নেই, আমি এক আলট্রা মডার্ন ঘাস-ফুল মাত্র। আমি হঠাৎ সম্বিৎ ফিরে পেলাম, এবং ভাবলাম এই সব কি হচ্ছে! আমি কি সব আবোল-তাবোল শুনছি! একটু নড়ে-চড়ে বসে লক্ষ করলাম, প্রজা-পতিটা ঠিক ই আমার বাম কাঁধের পাশে কান বরাবর বসে আছে, এই অবস্থায় সাধারণত প্রজাপতিটার উড়ে চলে যাওয়ার কথা, কিন্তু সে বসে এ আছে। আমি এবার চোখ বুজে ভাবতে লাগলাম কি হচ্ছে এ সব! ভাবছি যে এটা হয়ত আমার ক্লান্ত আর অবসাদ মনের অতীন্দ্রিয় কোন ব্যাপার। আসলে ব্যাপারটা তাই, এবার দেখি এখানে কোন প্রজাপতি ই নেই, তবে একটা ঘাস-ফুল ঠিক ই আছে, আমি ঘাস-ফুলটার প্রতিটা পাপড়ি স্পষ্ট করে দেখতে পারছি, তার প্রতিটা পাপড়িতে আপন মহিমায় সৌন্দর্য ছড়িয়ে দেওয়ার বাসনা, তার প্রতিটা পাপড়ির পরতে পরতে মৃদু হাসির রেখা, আমি যেন দেখতে পারছি তার ভেতরের ভালবাসা পাবার বাসনা, হৃদয় উজাড় করে ভালবাসার তীব্র আকাঙ্ক্ষা। আমি হাত বাড়িয়ে পাপড়িটাকে একটু স্পর্শ করতে ছেয়েছিলাম, আমার ক্লান্ত আর অবসাদ জড়ানো হাতে তাকে একটু খানি আলতো আবেশে ছুঁইয়ে দিতে ছেয়েছিলাম। পারলাম না আমি। কারণ ঘাস-ফুল টার অনেক বড় অভিমান আর দীর্ঘশ্বাসের নিচে আমার আগ্রহ টা চাপা পড়ে গেছে। আমি উঠে আবার দিগন্তের দিকে হাটতে লাগলাম। পেছনে ফিরে তাকাতে পারিনি আমি আর, ইচ্ছে করছে পেছনে ফিরে একবার দেখি প্রিয় ঘাস-ফুলটি কে, দেখা হয়নি আমার পেছন ফিরে, অনুভব করছি আমার মনের গভীরে কোন এক কোনায় পিন পতন রক্ত ক্ষরণ, কেবল ই অনুভব করছি অনেক দূর থেকে আসা সেই ঘাস-ফুলের অন্তর চোখের দৃষ্টি টা আমার পীঠে প্রতিবিম্বিত হয়ে পীরে যাচ্ছে,তার দিকে। আমি চলেছি আমার অন্তহীন পথে। ঘাস-ফুলটার অভিমান আর তীব্র আর্তনাদ আমার মনে একটা দাগ কেটে দিয়েছে। এখন ও গেঁথে আছে সেই দাগটা। ভুলতে চাইনা তোমাকে প্রিয় ঘাসফুল। যতদিন আমি এই অন্তহীন পথে চলতে থাকব, ততদিন থাকবে আমার অন্তরে তোমার কেটে দেওয়া সেই দাগ।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই সেপ্টেম্বর, ২০১২ ভোর ৬:০৭