আমি এহসান হাবীব বানিয়ে বানিয়ে কবিতা লিখি না। বানিয়ে লেখায় বিশ্বাসও করি না। ‘কবিতা স্বতঃস্ফূর্ততার’- বলে একদা যে কথা রটেছিল আজ তা নিজ আস্তিনে মুখ লুকাচ্ছে। কারণ স্বতঃস্ফূর্ততা এমন একটি মাধ্যম যা চেষ্টা করে আয়ত্ব করা যায়। আয়ত্ব করা জিনিস যদি আপনি কবিতায় বমি করেন তবে সেটাকে আর কতটুকু স্বত:স্ফূর্ত বলা যাবে? যেহেতু আজকে - যেভাবেই হউকÑস্বতঃস্ফূর্ততাও মানুষের বশ হতে বাধ্য হয়েছে সে কারণে স্বত:স্ফূর্ততার নাম করে আজকের কবিতায় ঢুকে পড়েছে আদর্শের বৈপরীত্ব্য, আদর্শহীনতা, কবি আর কবিতার দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্ব থেকে একজন কবির কবিতাকে মুক্তি দেওয়া উচিৎ।
আমি বিশ্বাস করি মহৎ কবি মাত্রই সৎ। অথচ সততা সমাজের অন্যান্য সেক্টরের মতো কবি সমাজ থেকেও উঠে যাচ্ছে। কবির ধর্মই হচ্ছে বলা। কবি যা বিশ্বাস করে না, যা ধারণ করে না, অনুধাবন করে না সেইসব চমকিত অনুভব, আদর্শ যদি কবি তার কবিতায় প্রকাশ করেন তবে তিনি পাঠককে, পরিচিত পরিবেশকে ধোকা দেন আর এই ধোকা দেওয়ার নামই হচ্ছে অসততা। কবি পজেটিভ বা নেগেটিভ যাই তিনি ধারণ করুন না কেন তা অকপটে প্রকাশ করাই হলো কবির সততা। এজরা পাউন্ডকে আমি এজন্যই কবি বলি। অসৎ কাউকে আমার কবি বলে মানতে কষ্ট হয়।
স্বতঃস্ফূর্তার নাম করে কবি তার অসততাকে ঢেকে রাখেন। অনেক কবিকেই আমাদের খুব কাছ থেকে দেখা হয় না। ফলে তার স্বতঃস্ফূর্ততা আমাদের বিভ্রান্ত করে। আমি দেখেছি চরম সুবিধাবাদী, মধ্যস্বত্তভোগী লোকটি স্বত:স্ফূর্ততার জোরে নিজেকে কী ভয়ানক প্রগতিশীল প্রমাণ করে ফেলেন। অথচ এমনটি মোটেই কাম্য নয়। এতে করে কবিতা একসময় নির্বাসিত হতে পারে। একটি নির্দিষ্ট কালখণ্ডের কবিদেরকে মানুষ ধোকাবাজ হিসেবে চিহ্নিত করতে পারে। আপনি কোন লাইলির জন্য মজনু হবেন না অথচ লিখে ফেলবেন ‘লাইলী মজনু’ এও কি হয় কখনো? না কি তা কেউ পেরেছে? আজ তো-পূর্ণিমা কেমন? তা না দেখেই অনেকে আমাদেরকে জোৎøারাতের গল্প শোনায়। আমার বড্ড হাসি পায়। এ না হয় কবিতা, না হয় ভাঁড়ামী। মনে পড়েছে আর্তুর র্যাঁবোর কথা। লিখতে চেয়েছিলেন অনুশাসনহীন কবিতা। তার জন্য তিনি তার ব্যক্তিজীবনকে কী অনুশাসনহীনই না করে তুলেছিলেন। পাগলামীর শেষপ্রান্তে পৌঁছে নিজের জীবনকে জ্বালিয়ে জ্বালিয়ে কবিতার প্রতিটি পঙক্তিকে, শব্দকে মুক্তি দিয়েছিলেন অনুশাসন থেকে। র্যাঁবোকে অভিবাদন।
গায়ত্রী চলে গেলে আপনি তার বদনাম করে বেড়াবেন আর তারপরও আপনি লিখবেন ‘ফিরে এসো চাকা’ এও কি হয়? অথচ রাখি চলে গেলে তার রেখে যাওয়া চিঠিগুলো বুক পকেটে জমিয়ে জমিয়েই লিখতে হয়-‘আমার বুক পকেট পৃথিবীর ুদ্্রতম জাদুঘর’। লিপি তার স্বামীর সাথে লেপের ওমে ঘুমিয়ে থাকলে পৃথিবীর সব শীত যদি আমি নিজের বুকে ধারণ না করি তবে আমি কি সাহসে লিখব-
অথচ কাল সকালে তোমার গোসল হবে ভেবে
আজ রাতে ভয়ানক কেঁপে উঠেছি বেদনার শীতে।
স্বতঃস্ফূর্তার নাম করে সাকুরায় বসে মদের পেয়ালায় ভর করে এই শীত কি টের পাওয়া যাবে?
যেদিন অনুভূতির শুদ্ধতম প্রকাশ ঘটাবার জন্য ঠাণ্ডায় হিমে জমে না যাব সেদিন শীতের কবিতা আমি লিখব না। যেদিন জীবনের প্রতি অস্থি থেকে নিংড়ে রস বের করে কবিতা লিখতে পারব না সেদিন আমি কবিতাই লিখব না। পথে পথে ঘুরে পাগল হয়ে যাব তবু ঘরে বসে বসে বানিয়ে বানিয়ে কবিতা লিখব না নিজের অনুভূতির সাথে বেঈমানী করব না। এটুকু আস্থা আপনি আমার প্রতি রাখতে পারেন।