
ধরুন, কেউ এসে আমার বাবাকে খুন করলো। ঠান্ডা মাথায়, নির্মমভাবে। এরপর মামলা হলো, বিচার হলো, সাক্ষী-প্রমাণে প্রমাণিত হলো যে সেই মানুষটাই খুনি। বিচারক রায় দিলেন—যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।
আমি থমকে যাই। একটা মানুষের জীবন নিয়ে নিলো, আর বিনিময়ে সে কয়টা বছর জেলে থাকবে? আমার বাবা কি ফিরে আসবে?
বিচার শেষ। খুনি এখন জেলখানায়।
জেলখানায় সে খাচ্ছে, ঘুমাচ্ছে, চিকিৎসা পাচ্ছে—সবকিছু সরকারি খরচে। আর এই "সরকারি খরচ" আসে কোথা থেকে? আমাদের কাছ থেকে। আমার কাছ থেকে।
আমি প্রতিদিন বাজার করি, ভ্যাট দিই। বিদ্যুৎ বিল দিই, কর দিই। প্রতিটি লেনদেনে আমি টাকা দিচ্ছি সরকারকে, সেই টাকা দিয়ে সরকার চলছে—আর তার একটা অংশ খরচ হচ্ছে জেলখানায় থাকা কয়েদিদের পেছনে।
মানে দাঁড়ায়, আমার টাকায়—আমার বাবার খুনিকে খাওয়ানো হচ্ছে?
এই চিন্তা মাথায় এলে আমার গলা শুকিয়ে আসে। বুকের ভিতর একটা অসম্ভব যন্ত্রণা কাজ করে। এটা তো শুধু একটা দণ্ড নয়, এটা একটা তামাশা।
বাবা হারানোর পর আমি এখনো সেই কষ্ট বয়ে বেড়াচ্ছি, অথচ খুনি মানুষটা হয়তো এখন দুপুরে গরম ভাত আর ডাল খাচ্ছে—আমারই টাকায়।
হ্যাঁ, আমি জানি রাষ্ট্র একটা নিয়মে চলে।
রাষ্ট্র বলে, আইন সবার জন্য সমান। এমনকি খুনিরও কিছু মৌলিক অধিকার আছে।
রাষ্ট্র বলে, আমরা প্রতিশোধের সমাজে বাস করি না।
রাষ্ট্র বলে, সঠিক বিচার মানে প্রতিশোধ নয়, বরং শাস্তির মাধ্যমে সংশোধন।
আমি সব জানি।
কিন্তু আমার কষ্টগুলো কি রাষ্ট্র বোঝে?
আমার মনে হয়, এই সমাজে খুনির অধিকার আছে, কিন্তু খুন হওয়া মানুষের পরিবারের আবেগের কোনো জায়গা নেই। আমি কাঁদি, ভেঙে পড়ি, বাবার ছবি জড়িয়ে রাত কাটাই—এতেও কারো কিছু যায় আসে না।
রাষ্ট্র শুধুই বলে, “আপনার বাবা ন্যায়বিচার পেয়েছেন।”
তবে কি এটা ন্যায়?
একজন খুনিকে বাঁচিয়ে রাখা, আর খুন হওয়া মানুষের পরিবারকে ধুকে ধুকে বাঁচতে বাধ্য করা—এটাই কি সভ্যতা?
আমি চাই না কাউকে মেরে ফেলা হোক। আমি চাই না রাষ্ট্র অমানবিক হোক।
কিন্তু আমি প্রশ্ন করি, অন্তত এইটুকু কি রাষ্ট্র স্বীকার করতে পারে না যে, আমার কাছ থেকে কর নিয়ে, আমার বাবার খুনিকে খাওয়ানোটা একটা চরম মানসিক অবমাননা?
রাষ্ট্র হয়তো বলবে—এটা আবেগের কথা, বাস্তবতা না।
কিন্তু আমি বলি, এটাই তো বাস্তবতা।
কারণ প্রতিদিন আমি টাকাটা দিচ্ছি, আর প্রতিদিনই মনে পড়ছে—সেই টাকায় কেউ একজন খাচ্ছে, যে আমার বাবাকে মেরে ফেলেছে। এভাবে আমি প্রতিদিন একটু একটু মরে যাই।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জুলাই, ২০২৫ বিকাল ৪:২৪

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



