আমাদের দেশের মিডিয়া নিয়ে জাকারিয়া সপনের লেখা নিবন্ধের কপি এটি। সচেতন পাঠক দর্শকের মনের কথাগুলো এভাবে বলার মতো লোক খুব বেশি নেই। আসুন একটু সময় করে লেখাটি পড়ি।
আমাদের মিডিয়া এবং কয়েকটি সহজ প্রশ্ন
অনেক দিন ধরেই প্রশ্নটি আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু কখনই বিষয়টি নিয়ে লেখার জন্য শক্তি সঞ্চয় করতে পারিনি। কারন আমি জানি, কোনও পত্রিকা এই লেখা প্রকাশ করতে পারবে না। আসলে কোন পত্রিকাটিকে যে লেখাটি পাঠাবো, সেটাই খুজে পাচ্ছিলাম না। তাই আর লেখা হয়ে ওঠেনি। আজকে কিভাবে যেন লিখতে বসে গেলাম। তবে লেখাটি কোনও খবরের কাগজে পাঠাবো না; কারন তাদেরকে বিব্রত করে লাভ কি? কেউ এই লেখাটি ছাপতে পারবে না। কারো সেই যোগ্যতা নেই। কারনটা একটু পরেই বলছি।
গেল বছর দেশে একটি ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া প্রতিষ্ঠার জন্য অনেক দৌড়-ঝাপ করেছিলাম। সচিবালয়ের দরজা দরজায় ঢু মারাও হলো। কিন্তু একটি বিষয় খুবই স্পষ্ট যে, আপনার কোনও খুটির জোর না থাকলে বাংলাদেশে নিয়মমাফিক কিছু করা সম্ভব নয়। যা কিছু করতে হবে, সেটা অনিয়মমাফিকই হতে হবে। আপনার যদি যথেষ্ঠ টাকা থাকে, তাহলে সচিব মহোদয় পর্যন্ত তার চেয়ার থেকে উঠে দাড়িয়ে আপনার সাথে হাত মেলাবেন। আমার টাকা নেই, কিন্তু ইচ্ছেটা আছে। তাই একদিন সচিবালয়ের একজন বন্ধুকে নিয়ে তথ্য মন্ত্রনালয়ে গেলাম। শুধু খোঁজ নেয়ার জন্য, ঠিক কিভাবে আবেদন করতে হবে; আর নিয়মকানুনগুলো কি কি। ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থেকেও দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার সেই তথ্য দিলেন না। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের একটি কথা আছে। সঠিক কথাটি মনে নেই। তবে মর্মার্থ হলো, একটি দরজা বন্ধ থাকলে আমি আরেকটি দরজা দিয়ে চেষ্টা করবো; আর কোনও দরজা না থাকলে, নিজেই একটি দরজা বানিয়ে নিবো। আমিও তাই করলাম। দেখলাম, এভাবে সারা জীবনেও তথ্যমন্ত্রনালয় থেকে সামান্য তথ্য টুকু পাবো না। তাই পরের সপ্তাহে আমি একাই গেলাম। তবে সেই চুনোপুটি অফিসারের কাছে নয়। মূল সচিবের কাছে। যাওয়ার আগে ফোন করে দিলেন তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একজন উপদেষ্টার কাছের মানুষ। সচিব মহোদয়ের ব্যবহার দেখে মনে হলো, আমার সাথে সাক্ষ্যাৎ করার সুযোগ পেয়ে তার জীবন ধন্য হয়ে গেছে। তারপর তিনি সেই চুনোপুটি অফিসারটিকে ডেকে আমাকে প্রয়োজনীয় তথ্য বুঝিয়ে দিতে বললেন। সেই ভদ্রলোক কাচুমাচু হয়ে আমাকে বিস্তারিত জানালেন। এই হলো বঙ্গদেশ। একজন সাধারন মানুষ এখানে কিভাবে যে কী করতে পারে, আমি মোটেও কিছু বুঝে উঠতে পারি না।
যে কথা বলতে গিয়ে এই ভূমিকা দিয়ে ফেললাম, সেটা হলো, বাংলাদেশে কোনও মিডিয়া করা সহজ কোনও কাজ নয়। ক্ষমতার কাছাকাছি ছাড়া কোনও মিডিয়া হতে পারে না। কিংবা কোনও ধনাঢ্য লোকের মালিকানা ছাড়া বাংলাদেশে কোনও মিডিয়া হতে পারে না। প্রথমত লাইসেন্স পাবে না। আবার খবরের কাগজের লাইসেন্স পাওয়া কিছুটা সহজতর হলেও, সেটা পরিচালনার জন্য খুব ধনী কোনও ব্যক্তির মালিকানা লাগবেই। বাংলাদেশের যতগুলো টেলিভিশন চ্যানেল আছে, সবগুলোর মালিক অযাচিতভাবে ধনী। এবং তাদের সেই সম্পদের বৈধতা নেই বললেই সত্যি কথা বলা হবে। একইভাবে সবগুলো বৃহr পত্রিকার মালিকের টাকা অবৈধ। নামগুলো না হয় আর নাই বললাম। আপনারা জানেন, কোন টেলিভিশন চ্যানেলের মালিকানা কার, আর কোন পত্রিকার মালিক কে। তারা এগুলোকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার জন্য অঢেল টাকা বিনিয়োগ করেছেন। এটা দিনের আলোর মতো সত্যি। এখন আমার প্রশ্ন হলো, এই অবৈধ সম্পদের মালিকের টাকায় মিডিয়া তৈরী করে, সেই মিডিয়াতে বসে একজন সাংবাদিকের কাজ করতে কেমন লাগে? তাদের পক্ষে কি নৈতিকতা রক্ষা করে কাজ করা সম্ভব? তারা তো জানেন, তাদের বেতনের টাকা কোথা থেকে আসে। তখন কি তারা নিজেদেরকে সৎ রাখতে পারেন? তাদের চিন্তা কি সr হয়? নিজেদের ঘরটি যখন স্বচ্ছ নয়, তখন তারা কিভাবে অন্যক্ষেত্রে স্বচ্ছতার কথা বলেন!
একদিন প্রশ্নটি আমি একজন সমাজকর্মীকে জিজ্ঞেস করলাম। দূর্নীতির বিরুদ্ধে খুবই সোচ্চার সেই ভদ্রলোক মোসাদ্দেক আলী ফালুর টেলিভিশন এনটিভি-তে নিয়মিত অনুষ্ঠান করেন। তাকে বললাম, আপনি এনটিভিতে অনুষ্ঠান করেন কেন? তিনি আমার কথার ইঙ্গিতটি ধরতে পারেননি। খুব উrসাহ নিয়ে বললেন, ওহ, এনটিভির ট্রান্সমিশন তো খুব ভালো; আপনি কালার দেখেছেন? ঝকঝকে।
আমি আরেকটু কথা ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ফালু সাহেবের টেলিভিশনে বসে ভোট চুরি নিয়ে কথা বলতে কেমন লাগে?
এবারে তিনি বুঝতে পারলেন। মুখটা শুকনা করে বললেন, এছাড়া আর উপায় কি বলুন? আমাদের কথাগুলো তো মানুষকে কোনওভাবে জানাতে হবে। আর তো কোনও মাধ্যম নেই।
একইভাবে একদিন একটি পত্রিকার সাংবাদিক বন্ধুকে বললাম, তোরা যে সারাদিন বিভিন্ন অনিয়ম আর দূর্নীতির বিরুদ্ধে রিপোর্ট করছিস, তোরা তোদের মালিককে নিয়ে রিপোর্ট করতে পারবি? তোর চাকরী থাকবে?
মাথা নাড়িয়ে বন্ধুটি বললো, নাহ পারবো না। চাকরী থাকবে না|
আমি পাল্টা প্রশ্ন করলাম, তাহলে নীতির প্রশ্নে তোদের শক্তিটা কোথায়? কিসের জোরে তোরা আরেকটি লোককে দূর্নীতিবাজ বলিস? সেই অধিকার কি তোদের আছে?
তার সাদামাটা উত্তর হলো, যাবো কোথায়? সবগুলো পত্রিকার মালিকই তো এক। তারা কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। তারা তো মাফিয়া|
আমি আর কথা বাড়ালাম না। বন্ধুটিকে বেশ লজ্জিত মনে হলো। তার আর লজ্জা বাড়াতে ইচ্ছে করলো না।
কিন্তু সেই থেকে আমি উত্তরটি খুজে বেড়াচ্ছি। বাংলাদেশে কি কোনও সr মিডিয়া হতে পারে, যেখানে তাদের মালিকই সৎ নন। আর মিডিয়া যদি সr না হয়, তাহলে কিসের এতো বড় বড় কথা? সব কিছুই কি এক ধরনের ভন্ডামী? আমাদের হাতে মিডিয়ার হাতিয়ার আছে বলে, কেউ আমাদের সেই ক্রেডিবিলিটি নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে না!
আমাদের যত সমাজ সচেতন মানুষ আছেন, যারা লেখালেখি করেন, তারা যখন কোনও পত্রিকায় লেখেন, সেটা কি অনেকটা বিপরীতমূখী নয়? প্রদীপের নীচেই কি অন্ধকার নয়? তাহলে আমরা সেই সব পত্রিকায় লিখি কেন? সেই টেলিভিশনে অনুষ্ঠান করি কিভাবে? নাকি এছাড়া আমাদের আর কোনও উপায়ও নেই? সেই পত্রিকার সম্পাদক সাহেবের কেমন অনুভূতি হয়? মাসের শেষে যখন বেতন নেন, আর প্রতিদিন তার মালিকের অপকর্মের কথাগুলো চেপে যান, তার মনের ভেতর কী ঘটতে থাকে? কিভাবে তারা এটাকে হজম করেন, সেটা আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে।
বাংলাদেশে কি কোনও পত্রিকা সৎ মালিকায় চলতে পারবে? যদি না পারে, তাহলে এর দোষটি কার? মিডিয়া হলো একটি সমাজের আয়না। যে আয়নায় নিজের মুখ দেখা যায় না, সেখানে অন্যের মুখ দেখাই কিভাবে? সভ্য সমাজের কি এটা একটি দায়িত্ব নয় যে, একটি পত্রিকা বা টেলিভিশন সৎভাবে চলতে পারবে? পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও কি তাই?
উত্তরগুলো আমার জানা নাই। কেউ জানালে কৃতজ্ঞ থাকবো।