বিভেদের রাজনীতির শেষ কোথায়?
মুহাম্মদ রেজাউল করিম
আওয়ামী লীগের প্রতি বিএনপি মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের ঐক্য প্রস্তাব ও আওয়ামী লীগের তা প্রত্যাখানের বিষয়টি সম্প্রতি দেশে বিদেশে আলোচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত হয়েছে। খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন সাংবাদিক সম্মেলনে আওয়ামী লীগকে লক্ষ করে বলেন, আল্লাহর ওয়াস্তে ঐক্যের প্রশ্নে না করবেন না, আসুন এই পরিস্থিতিতে আমরা জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলি। কিন্তু আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব আশরাফুল ইসলাম ঐক্যের প্রস্তাব সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেন। প্রশ্ন দাঁড়িয়েছে, বিএনপির মহাসচিব যে ঐক্যের আহ্বান জানিয়েছেন তা কি দলীয় চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার মতামত, নাকি খন্দকার দেলোয়ার হোসেনের নিজস্ব। একটু গভীর ভাবে দেখলে বোঝা যায় এই ঐক্যের আহবান দলীয় চেয়ারপারসনের ইঙ্গিতেই তিনি দিয়েছেন। এর কয়েকটি কারণ রয়েছে। এক. জাতীয় ঐক্যের আহবানের দু-একদিন আগেই আদালতে বিএনপি চেযারর্পাসন বেগম খালেদা জিয়ার সাথে মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের সাক্ষাৎ হয়েছিল। দুই. বেগম খালেদা জিয়া ঐ দিন আদালতের কাঠগড়ায় যে বক্তব্য রেখেছেন তাতে তার দলীয় নেত্রীর পরিচয়কে ছাপিয়ে জাতির অবিসংবাদিত ও অপোষহীন নেত্রীর পরিচয়ই বেশি ফুটে উঠেছে। দেশের মানুষ তার এই বক্তব্যে অনুপ্রাণিত হয়েছেন। এখান থেকে ধারণা করা যায় তার গ্রিন সিগন্যালেই বিএনপি মহাসচিব এই জাতীয় ঐক্যের আহবান জানিয়েছেন। দেশের মানুষের মনে থাকার কথা বিএনপি চেয়ারপারসন ক্ষমতায় থাকা কালেও শেখ হাসিনাকে বিভিন্ন সময় শুভেচ্ছা জানিয়ে উদারতার পরিচয় দিয়েছেন এবং জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন।
জাতীয় ঐক্যের প্রশ্নে আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল ইসলামের বক্তব্যকেও তাদের দলীয় মতামত হিসেবে ধরে নেয়া যায়। কারণ এক. আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মতামতটি দিয়েছেন ভারপ্রাপ্ত সভাপতি জিল্লুর রহমানের বাসায় সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে। দুই. শুরু থেকেই বিএনপি ও জামায়াত বেগম খালেদা জিয়া ও মাওলানা নিজামীর সাথে শেখ হাসিনারও মুক্তি দাবি করে আসলেও আওয়ামী লীগ এখন পর্যন্ত খালেদা জিয়া বা নিজামীর মুক্তির কথা মুখেও আনেনি। এতে প্রমাণিত হয় ঐক্যের ব্যাপারে আওয়ামী লীগ দলীয়ভাবেই তাদের অবস্থান তুলে ধরেছে। আওয়ামী লীগ জাতির এই দুর্যোগ মুহূর্তে বিএনপি মহাসচিবের ঐক্য প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে জাতির সামনে জ্বলে ওঠা আলোকে নিভিয়ে দিয়েছে। সচেতন দেশবাসির মনে প্রশ্ন জেগেছে তাহলে কি আওয়ামী লীগ এই বিপর্যয়ের মুহূর্তেও জাতীয় ঐক্যের মাধ্যমে দেশে গণতন্ত্রের পূন:প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে শর্টকাট ওয়েতে ক্ষমতায় যাওয়াকেই বেশি পছন্দ করছে? তাদের সরকারবিরোধী বক্তব্য, বিবৃতি, কর্মসুচি সবই কি মেকি? অবশ্য আওয়ামী লীগ যদি চোরাপথে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখে তাহলে সেটা হবে মহা ভুল। আওয়ামী লীগ ৮৬ তেও এরশাদের পাতানো নির্বাচনে অংশ নিয়ে একই ভুল করেছিল। কিন্তু পরিণাম তাদের জন্য সুখকর হয়নি।
ইতিহাসের নির্মম সাক্ষ্য এই যে, আওয়ামী লীগ গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যুতে বরাবরই ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং ঠকেছে। আওয়ামী লীগের দুর্ভাগ্য হলো অতীত ভুল থেকে আওয়ামী লীগ শিক্ষা গ্রহণ করতে মোটেই প্রস্তুত নয়। তাদের সাম্প্রতিক কয়েকটি ভুল সিদ্ধান্তের কথা এই ছোট্ট নিবন্ধে উল্লেখ করার লোভ সামলানো গেল না। এক. ড. ফখরুদ্দিন এর শপথ অনুষ্ঠানে উল্লসিত ভাবে অংশ গ্রহণ করলেও পরবর্তী পরিণতি আওয়ামী লীগের জন্য মোটেই আনন্দের হয়নি। দুই. এই সরকারের সকল কর্মকান্ডকে বৈধতা দেয়া হবে বলে শেখ হাসিনা বলেছিলেন। শেখ হাসিনা কি আজ তাঁর নিজের গ্রেফতারকেও বৈধ বলতে রাজি হবেন? তিন. গত নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে আওয়ামী লীগ খেলাফত মজলিসের সাথে চুক্তি করে সর্বমহলে সমালোচিত হয়েছিল। পরে আওয়ামী বুদ্ধিজীবি মহলের চাপে ঐ চুক্তি বাতিল করতে তারা বাধ্য হয়। চার. আওয়ামী লীগ সুযোগ পেলেই বলে থাকে যে, এই সরকার তাদের আন্দোলনের ফসল। যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে বর্তমানে জনগণের এই দুর্ভোগ, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে জনগনের নাভিশ্বাস অবস্থা এবং স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব আজ যে হুমকির মুখে তার দায় দায়িত্ব কি আওয়ামী লীগ নিতে রাজি হবে?
এবারও জাতীয় ঐক্যকে পায়ে ঠেলে আওয়ামী লীগ একই ভুলের পুনরাবৃত্তি করতে যাচ্ছে। এবারের ভুল সিদ্ধান্ত আওয়ামী লীগের জন্য যে দুর্ভোগ বয়ে আনবে সেগুলো এরকম। এক. জাতীয় দুর্যোগের এই দু:সময়ে বিএনপির মতো একটি বড় দলের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান দেশের ইতিহাসে একটি নজির হয়ে থাকল। বিএনপি যদি আওয়ামী লীগের দু:সময়ে এই অপমানের প্রতিশোধ নিতে চায়, তাহলে বিএনপিকে খুব দোষ দেয়া যাবে কি? দুই. আগামী দিনে জাতীয় ঐক্যের সকল পথ বন্ধ করে আওয়ামী লীগ নিজেদেরকে একঘরে, নিসঙ্গ ও মিত্রশূন্য (মিত্রশূন্যতার ব্যাপারটি একটু পরে ব্যাখ্যা করছি) করে ফেলেছে। তিন. ড. কামাল এবং এরশাদের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার বক্তব্য ১৪ দলের ঐক্যে চিঁড় ধরিয়েছে। চার. যুদ্ধাপরাধী ইস্যুতে আওয়ামী লীগের বাড়াবাড়ি জামায়াতের সাথে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনেরও পথ রুদ্ধ করে দিয়েছে।
দুর্মুখেরা বলে, আওয়ামী লীগের সংষ্কারবাদী অংশটিই শেখ হাসিনাকে বিদেশে পাঠিয়ে দলের শীর্ষ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে চায়। র্যাটস খ্যাত ঐ গ্রুপটিই নাকি ঐক্যের সামনে সবচেয়ে বড় বাধা। এই লেখাটি যখন তৈরি হয়, তখন জানা গেল যে শেখ হাসিনার দেশের বাইরে যাওয়ার প্রক্রিয়া একবারে চূড়ান্ত। আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম ও র্যাটস নামক ঐ গ্রুপটি নাকি এতে খুবই খুশি। এদের কেউ কেউ নাকি চান যে শেখ হাসিনা যদি কনভিক্টেড হয়ে দেশ থেকে বিদায় নেয় তাহলে আরো ভালো। শেখ হাসিনাবিহীন আওয়ামী লীগে তারা বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে রাজনীতি করতে পারেন। কেউ কেউ আবার বলেন, আশরাফুল ইসলাম জাতীয় ঐক্যের প্রস্তাব প্রত্যাখান করে সরকারের এজেন্ডাই বাস্তবায়ন করেছেন। অনেকেই মনে করেন আশরাফ সাহেবকে এক অদৃশ্য শক্তি বিদেশ থেকে নিয়ে এসে আওয়ামী লীগের মত একটি বড় রাজনৈতিক দলের মহাসচিব বানিয়েছে, আওয়ামী লীগকে দিয়ে সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্যই। এখন আওয়ামী লীগের সংষ্কারপন্থী সুবিধাভোগীদের সিদ্ধান্ত দলীয় নেতা কর্মীরা কতদিন মেনে চলবে তাই দেখার বিষয়।
বিএনপির আপাত অনৈক্য ও নেতাদের জেলে যাওয়ার দৃশ্য আওয়ামী লীগকে দারুণ উল্লসিত করে তুলেছে। তারা ধরে নিয়েছে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হলে তারাই ক্ষমতায় যাবে। কারণ ১৪ দলে ভাঙ্গনের ঢেউ লাগেনি। আর আওয়ামী লীগতো স্বয়ং অখন্ডিত। সুতরাং ভয় কি? এজন্য আওয়ামী লীগের নেতারা প্রকাশ্যেই মাঝে মাঝে বলতেন যে প্রয়োজনে শেখ হাসিনাকে ছাড়াই তারা নির্বাচনে যেতে প্রস্তুত। আর যদি চোরা পথে ক্ষমতায় যাওয়ার কোন সুড়ঙ্গ পাওয়া যায়, তাহলে তো পোয়া বারো। অতএব আওয়ামী লীগ আত্মবিশ্বাসী। বোকার মতো বিএনপির সাথে ঐক্য করে লাভ কী? আওয়ামী লীগ বিএনপির সাথে ঐক্য না করে বোকামী করেছে নাকি চালাকি করেছে তার সঠিক মূল্যায়ন একমাত্র ভবিষ্যতই করতে পারে। আমরা এখানে দুটি দিক নিয়ে সামান্য আলোচনা করবো।
প্রথমত আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট অক্ষত আছে কথাটি মোটেই ঠিক নয়। মহাজোটের দ্বিতীয় বৃহত্তম দলের নেতা এরশাদ সাহেব এখন তো অনেকটাই ক্ষমতার বারান্দায় ঘোরাফেরা করছেন। তিনি শেষ বয়সে কারা বরণের ভয়ে সরকারে সব কাজের সমর্থন জুগিয়ে চলেছেন। তিনি বলেছেন, আমার সময়ের অসমাপ্ত কাজ এ সরকার করছে। তিনি মহাজোটের জনসভায় গিয়ে বলেছিলেন, আমি মুক্ত বিহঙ্গ। মহাজোট ত্যাগ করে এখন তিনি কোন বিহঙ্গ? ড. কামাল সাহেব তো বর্তমান সরকারের মহা উপদেষ্টা। এই সরকারের প্রধান পৃষ্ঠপোষক। সম্প্রতি তিনি বলেছেন, দেশ গোল্লায় যাক, তাও আমি দুই নেত্রীকে পূজা করতে পারবো না। তিনি দুই নেত্রী সম্পর্কে আরও বলেছেন, যারা দুর্নীতিবাজ নেতা-নেত্রীর পক্ষে অবস্থান নেবে দেশের জনগণ তাদেরকে প্রতিহত করবে। অবশ্য জনগণ বলতে কাদেরকে বুঝিয়েছেন তা তিনি ব্যাখ্যা করে বলেননি। নির্বাচনে যার জামানত বাজেয়াপ্ত হয়, তিনি জনগণ বলতে বিদেশের কাউকে বুঝাচ্ছেন কিনা সে ব্যাপারে সংশয় থেকেই যায়। মহাজোটের অন্যান্য শরীক বাম নেতারা তো জাতীয় সরকারের জন্য মায়াকান্না শুরু করে দিয়েছেন। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, আওয়ামী লীগ যাদের ভরসায় সোনালি স্বপ্নের প্রহর গুনছে তারাও আখেরে কতদিন বন্ধু হিসেবে থাকবে তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে। অন্যদিকে চারদলীয় জোট আগের মতোই ঐক্যবদ্ধ আছে। খোন্দকার দেলোয়ার, আলী আহসান মুজাহিদ ও অন্যান্য শীর্ষ নেতাদের নিয়ে চার দলীয় জোটের সিটিংও হয়েছে। রাজপথের সবচেয়ে বড় শক্তি সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যের সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল এবং ইসলামী ছাত্রশিবির বাংলাদেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মজবুতভাবে অবস্থান করছে। ৪ দল খান খান হয়ে গেছে আর ১৪ দল অক্ষত আছে এরকম মিসকনসেপশনে আওয়ামী লীগের মতো একটি বড় দল বিভ্রান্ত হবে না বলেই জাতি বিশ্বাস করতে চায়।
দ্বিতীয়ত, ঐক্যের আহবানে সাড়া না দিয়ে আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় যে ক্ষতি হয়েছে তা হলো, দেশের জনগণ আওয়ামী লীগের এই সংকীর্ণতাকে মোটেই ভালো চোখে দেখেনি। আওয়ামী লীগ একটি বড়, পুরাতন ও অভিজ্ঞ রাজনৈতিক দল হিসেবে সবার আগে ঐক্যের ডাক দিলে তাদের মর্যাদা আরো বৃদ্ধি পেত। জাতির দুর্যোগ মুহূর্তে দলীয় সঙ্কীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে জনগণের অভিভাবকত্ব গ্রহণ করলে জনগণ তাদের যথাযথ মূল্যায়ন করতো। দলীয় সঙ্কীর্ণতার উর্ধ্বে উঠতে না পারার কারণেই ওয়ান ইলেভেনের বিপর্যয় এটি অস্বীকার করার উপায় নেই। তাই দলীয় সঙ্কীর্ণতার ঊর্ধ্বে যারা উত্তীর্ণ হতে পারবে না দেশের জনগণ এবং দলের নেতা কর্মীরা তাদের প্রত্যাখ্যান করবে। এ কথা মনে রাখতে হবে যে আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো সিদ্ধান্ত নিয়ে বাস্তবায়ন করতে পারে না, যদি দলীয় নেতাকর্মীদের সমর্থন না থাকে। এর প্রমাণ বর্তমান সরকার সকল শক্তি দিয়েও সংস্কার নামক জীবকে মৃত্যুর হাত থেকে কোরামিন দিয়েও বাঁচাতে পারেনি। তাই ঐক্যের আহবান প্রত্যাখ্যানকারীদের জন্য জনগণ ও নেতাকর্মীদের ধিক্কার ও ঘৃণাই শুধু বরাদ্দ থাকবে।
মহাকালের ইতিহাসে কোন কোন মুহূর্ত আসে যখন দেশকে রক্ষার স্বার্থে, জাতির সামগ্রিক কল্যানের জন্য দল মত নির্বিশেষে সবাইকে এক সারিতে এসে দাঁড়াতে হয়। কোন জাতির নেতৃবৃন্দ সেই মাহেন্দ্রক্ষণকে মূল্যায়ন করতে না পারলে জনগণকে চড়া মূল্য দিয়ে সেই ভুলের খেসারত দিতে হয়। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, আমাদের জাতীয় নেতৃবৃন্দ অতীতের মতোই সেই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলোকে অবজ্ঞা করে চলেছেন। বিদ্বেষ ও হিংসার ক্ষুদ্রত্ব থেকে আমাদের জাতীয় নেতৃবৃন্দ বেরিয়ে এসেছেন, সব বিভেদ ভুলে দেশের স্বার্থে এক হয়েছেন এ দৃশ্য দেখতে আমাদের আর কত দিন অপেক্ষা করতে হবে কে জানে!
লেখক- পিএইচডি গবেষক
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে জুন, ২০০৮ বিকাল ৪:২৯