somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

ফকির ইলিয়াস
আলোর আয়না এই ব্লগের সকল মৌলিক লেখার স্বত্ত্ব লেখকের।এখান থেকে কোনো লেখা লেখকের অনুমতি ছাড়া অন্য কোথাও প্রকাশ, ছাপা, অনুলিপি করা গ্রহনযোগ্য নয়।লেখা অন্য কোথাও প্রকাশ, ছাপা করতে চাইলে লেখকের সম্মতি নিতে হবে। লেখকের ইমেল - [email protected]

আধুনিক কবিতার দ্বন্দ্বযাত্রা ও পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনা / আহমেদ ফিরোজ

২১ শে জুন, ২০০৮ সকাল ৮:৪৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আহমেদ ফিরোজ শূণ্য দশকের কবি। তার এই লেখাটি ২০ জুন ২০০৮
শুক্রবার দৈনিক ভোরের কাগজে ছাপা হয়েছে। কবিতা বিষয়ে তার ভাবনা
সবার সাথে শেয়ার করার জন্য এখানে তুলে দিলাম। বেশ গুরুত্বপূর্ণ কিছু
কথা আছে এ লেখায়।

---------------------------------------------------------------------------------
আধুনিক কবিতার দ্বন্দ্বযাত্রা ও পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনা
আহমেদ ফিরোজ
=========================================
কবিতায় আধুনিকতা প্রসঙ্গটিকে পুনর্মূল্যায়ন করবার সময় এসেছে। বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে আধুনিকতা শব্দটি উচ্চারণের সাথে সাথে দীক্ষিত পাঠকের চেতনায় যে অনুষঙ্গগুলি ফুটে ওঠে, সেগুলোকে তিনটি পর্বে ভাগ করা যেতে পারে। প্রথমত, আধুনিক কবিতা রবীন্দ্রোত্তর বা রবীন্দ্র-রচনার প্রাতিষ্ঠানিকতা, দাপট ও সর্বব্যাপ্তির প্রতিক্রিয়ায় একধরনের পাল্টা কাব্যভাষা। ভাষাকেই বদলানো বা ভাষার স্বাস্থ্যোদ্ধার সেখানে খুব বড় একটা জায়গা নিয়ে আছে। ভাষাকে পাল্টানো : আঙ্গিকের দিক থেকে , কবিতার ভাষাকে মুখের ভাষার কাছাকাছি নিয়ে আসা। দ্বিতীয়ত, আধুনিক কবিতা বলতে বাঙালি পাঠক যা বোঝেন, তা মোটামুটি সজনীকান্ত দাস-এর শ্লেষার্থে ব্যবহৃত আধুনিক। অর্থাৎ রবীন্দ্রানুসারীদের প্রচারিত ত্রিশের নব্য, রবীন্দ্র-বিরোধী কবিদের ক্যাম্পের সম্বন্ধে এক নঞর্থক ধারণাÑ যা চলে এসেছে সাম্প্রতিক কাল-পর্যায়ে ষাট বা সত্তর পর্যন্ত। এখানে, আধুনিক কবিতা মানে দুর্বোধ্য, ধোঁয়াটে, কখনো কখনো বেপরোয়া অশ্লীলও। আধুনিক কবিতার তৃতীয় ব্যাখ্যা হলো সেই কবিতাÑ যা বিশের দশকের পর থেকে অর্থাৎ প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়ে মূলত ইংরেজি এবং সাথে সাথে ফরাসি কবিতা ইত্যাদির প্রভাবে নিজেকে পাল্টে নেয়। অর্থাৎ এই ধারণায় আধুনিকতার সাথে পাশ্চাত্য প্রভাবের একটি সংযোগ আছে। পাশ্চাত্য-অর্থ মূলত ইউরোপ। বোদলেয়ার, ইয়েটস, পাউন্ড, এলিয়ট প্রমুখ কবিদের আধুনিক ধারণাকে দ্রুত আত্তীকরণ করা ও বাংলা কবিতায় তার অনুপ্রবেশ ঘটানোই আধুনিক কবিতার প্রগতির সূচক, আধুনিকতার দ্যোতকÑ এই ধারণা বা উপপাদ্যটি মূলত কলকাতাকেন্দ্রিক বিবেচনা থেকে এসেছে। এটার সত্যতা অনেকটাই নিরূপিত হয় আর্থ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের অন্যান্য ঘটনার যথার্থতা থেকেÑ সমাজের অবক্ষয়, প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর সংকটÑ ইত্যাদির প্রতিফলনে।
রবীন্দ্রোত্তর কবিতায় বাংলা ভাষার স্বাস্থ্যোদ্ধারের যে উল্লেখ আছে, তার ভেতরে আরো একটু প্রবেশ করলে আমরা এই প্রশ্নগুলির মুখামুখি হবো : ভাষার স্বাস্থ্যসম্বন্ধে একটা বিশেষ ধারণার বশবর্তী হয়ে ভাষার স্বাস্থ্যোদ্ধারে এগোনোর কোনো বিশেষ লগ্ন কীভাবে নির্ধারিত হবে, সেই লগ্নটি কি সত্যি নির্ধারিত হয় কবিতার ভাষার দ্বারা, নাকি ভাষা-বহির্ভূত, অন্য কোনো আর্থ-সামাজিক/রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ফলশ্র“তি তা? এই সিদ্ধান্তের কথাটিও কি একধরনের ভাষাবিশ্ব বা চিন্তাপ্রক্রিয়ার ফসল? নাকি বাস্তবতাকে আমি যেভাবে দেখতে চাইছিÑ তারই প্রতিফলন? অর্থাৎ আমি যেভাবে বাস্তবতাকে আমার ভাষাবিশ্বের প্রিজমের ভেতর দিয়ে প্রসারিত ও প্রতিফলিত এবং পরিবর্তিত অবস্থায় পাচ্ছি, সেটাই আমার আর্থ-সামাজিক বাস্তবতা হয়ে দাঁড়াচ্ছে; অর্থাৎ প্রকৃতপক্ষে আমারই সিদ্ধান্ত বলে আমি আমার বাস্তবতাকে নির্মাণ করছি এবং আমার কবিতা সেই নির্মাণেরই অন্তর্গত হয়ে যাচ্ছে।
দুই
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম ও আমাদের সমালোচনাসাহিত্য-সমর্থিত ত্রিশের আলোচিত পাঁচ কবি এবং জসীমউদ্দীন-এর পরে বাংলা কবিতার যে কালযাত্রা, এ-যেন ধারাবাহিক উত্তরাধিকারেরই নামান্তর; অর্থাৎ বিশেষ কোনো দিক পরিবর্তন, চেতনা ও ভাষায় অথবা উপস্থাপনাগত উল্লেখযোগ্য কোনো কাজ চোখে পড়ে নাÑ যা হয়েছে তা কোনো-না-কোনো ভাবে রবীন্দ্রনাথ থেকে জীবনানন্দ কিংবা নজরুল-এর দ্রোহ থেকে জসীমউদ্দীন-এর পল্লীগানের প্রভাব মুক্ত নয়। লালন-এর সর্বরাগ সর্বসুরের অন্তর্যাত্রা, প্রেমবার্তা, ভক্তিমাত্রাÑ নশ্বর, অবিনশ্বর, অধিনশ্বরে শতরঙে বিচ্ছুরিত ও সমর্পিত। আর রবীন্দ্রনাথ-এ জল-বারি-বরিষণ এনে দিলো ষড়ঋতু আবাহনঃ। তাঁদের দেখানো পথেই ঘুরে-ফিরে পথচলাÑ যা নতুন পথের সন্ধান দিতে না-পারলেও এবং ধারাক্রম ভেঙে অন্যদিনের আলোয় আলোকিত করতে এগিয়ে না-আসলেও কুয়াশাচ্ছন্ন পথকে রুদ্ধ করেছে। তারপরেও আশাহীন পথচলা, ভিন্নতা চারদিকে।
এই পরিপ্রেক্ষিত গতি-অন্বেষার কালে বাংলাদেশে মধ্যাশির কিছু আগে ও পরে একটি নতুন সুর বাজতে চাইল লিটল ম্যাগাজিনের আন্দোলনের সূত্র ধরে। আবার দেখা যায়, এ-সময়েই তারুণ্যদীপ্ত মুখগুলো জ্বলে উঠতে শুরু করল একটা পৃথকাবস্থান নির্দেশনায় স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য নিয়ে। এবং এ-কালে এসেই আগের ধারাবাহিকতা ভেঙে দেবার প্রত্যয় দেখা গেল। কিš' দুর্ভাগ্যজনকভাবে ঊষালোকিত ভোরকে স্বাগত জানাতে বারবার ব্যর্থ হলো।
উদগ্র নেশা, নীতিহীন প্রেম, ধর্মের জেল্লাই এবং রাজনীতির খড়্গ চেপে বসল শিল্পের ওপর। যখন অবৈজ্ঞানিক নেশার কড়চায় অন্ধপ্রেম মোহমুগ্ধ হয়ে উঠল ধর্মের জিল্লতি পসারে, তখন স্বৈরশাসন কিংবা বিক্রি হয়ে যাওয়া আশ্রয় খুঁজে ফিরল আশির মেধা ও মনন। এভাবে মিথ্যে হয়ে গেল সাংস্কৃতিক মোল্লাদের নানাপ্রকার ফতোয়া বয়ান, পাশাপাশি ধর্মীয় মৌলবাদচক্র নানা ভাব-বেশে দানা বাঁধতে শুরু করলÑ রাষ্ট্রীয় কাঠামোতেও। নব্বইয়ে এসে আর-এক ঝাঁক নতুন যাত্রীর দেখা মিললেওÑ তারাও মোহভঙ্গের মতোই হতাশ করেছে। কোনো সামষ্টিক উদ্যোগ (লেখা ও কর্মে) চোখে পড়েনি, ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও স্বাহঙ্কার ভেঙে দিয়েছে শিল্পগুণ কাঠামোকেও। এবার মিডিয়া কিনে ফেলল মাথা, সবাই দল বেঁধে ছুটল মধ্যবর্তী কাল থেকে প্রিন্টিং মিডিয়ার ভাগাড়েজ্জদালালিতে কিংবা অন্নপ্রাসনে; কেননা প্রতিটি পত্রিকা ও চ্যানেল কোনো-না-কোনো মুখপত্রÑ ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠানের। পুঁজি হাভাতেÑ গিলছে ছোট-বড় সব স্বপ্ন কিংবা সম্ভাবনাকে। পরবর্তী পাঁচ বছরে জেঁকে বসল ইলেকট্রনিক মিডিয়া, ফলে পণ্য হলো ধন্য দেশের সাংস্কৃতিক পরিচয়, আর আটকে গেল অথবা বাক্যশূন্য হয়ে পড়ল এইসব উত্থিত তরুণদল। এই সময়ে দু’একটি লিটল ম্যাগাজিন, সাহিত্য পত্রিকা বেঁচে থাকলেও এবং নতুন নতুন সংকলন-পত্রিকার জন্ম হলেওÑ এসব ঘিরে গড়ে উঠেছে নীতিহীন দল, গোষ্ঠী; মূর্খতা ও গোপন আঁতাত।
সুসংবাদ এখনো নেই, দূরের ইশারা ভাঙছে প্রতি পলে পলে : সামুদ্রিক চোখ আঁষ্টে গন্ধে দিক-নির্দেশনা খুঁজে ফেরে যান্ত্রিক নগরে। আমরা ধর্মীয় মৌলবাদকে গালাগাল দিয়ে পরিত্যাগ করে বুর্জোয়াকে বুকে জড়িয়ে ধরেছি। মৌলবাদ একচোখে পতিত, বুর্জোয়া দশচোখে জারজাত। দু’য়ের পার্থক্য কম, মিল অনেক। ফলে সর্বত্রই সত্য মিলল পশ্চাৎপদতায়, কমিটমেন্ট হলো স্বার্থনত। আর, এমন-এক সময় আমরা পার করছিÑ যখন নিজের গা থেকে রক্ত না-ঝরলে বুঝতেই পারি না যে কতটা পতিত আছি!
তাছাড়া এই দুই দশকে, যখন লিটলম্যাগের আন্দোলনসূত্রে এন্টি-এস্টাবলিশমেন্টের কথা জোরেসোরে বলা হচ্ছে, তখন ব্যক্তিগত পর্যায়ে এস্টাবলিশমেন্টের পিছনে ঘোড়দৌড়ে অংশগ্রহণ করেছে সেইসব বয়ানকারী কবি-সম্পাদক ও লেখকেরা। পাশাপাশি বিদেশে পাড়ি দেওয়ার ঘটনাও বেড়েছে। কখনো ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে, কখনো অর্থোপার্জনের মাধ্যম-নির্বাচনে; আবার কখনো-বা দুর্নীতির বেড়াজাল টপকে নিজের কবি-স্বভাবকে রক্ষা করতে। এক্ষেত্রে আশির একজন কবির বিদেশযাত্রা বিশেষভাবে সমালোচিত। এর সঙ্গে বেড়েছে আমলা ও অধ্যাপকদের কচলানি, লিটলম্যাগের নাম ভাঙিয়ে নানা আইটেম ও সাইজে সাহিত্যপত্রিকা, অধিকাংশ ক্ষেত্রে সংকলন প্রকাশ এবং ইতিহাসে নাম লেখানোর প্রেরণায় নানামুখী চটকদার ও চাটুকারী আয়োজন ও উৎসব উৎযাপনে। আয়ের বাড়তিতে মেধা বিকিয়ে এরাই কৈশোরোত্তীর্ণ তরুণ-প্রজন্মকে নানাভাবে বিভ্রান্ত ও ভোজং-আড়ংয়ে নিজ কিংবা অন্যের দলমুখী করার চেষ্টায় লিপ্তÑ যা কখনো কখনো রহস্যজনক ও আক্রমণাত্মক। এদের রুখতে না-পারলে ভেড়ার পালে বাছুর প্রামাণিক সাহিত্যযাত্রা ও অবদমিত জীবনযাপন কখনোই মেরুদণ্ড সোজা করে উঠে দাঁড়াতে পারবে নাÑ এ-আশঙ্কা আজ আর রূপকথারূপ গল্প নয়, ধর্মের বেসাতি নিয়ে দাঁড়িয়েছে; সে-কারণে সময়ের করণীয় প্রজন্মকেই গ্রহণ করতে হবেÑ আমাদের ঘুরে দাঁড়ানোর প্রত্যয়ে। এই ঘুরে দাঁড়ানোর নামই দ্রোহ, অহংকার, ব্যক্তিগত কমিটমেন্ট। এখন সিদ্ধান্ত শর্তযুক্ত : ডান নাকি বাম, সামনে নাকি পশ্চাতে, ঊর্ধ্বে নাকি অধেঃ, নাকি আরো চারদিকে; নাকি দিক-পথ একটিইÑ কবির পক্ষে, স্রষ্টার পক্ষে, লালনের পক্ষে, ইচ্ছা-শ্রম ও সাধনার শৌর্যে সর্বমঙ্গলের দিকেÑ সর্বশূন্যতাবাদের পথ। যে পথে নির্বাণ ও নির্মিতি।
জাতীয় ও ভারতবর্ষীয় অলস ও কর্মবিমুখ মন-মানসিকতা তিলে তিলে গিলতে শুরু করেছে আমাদের স্বতন্ত্র সত্তা ও উদ্ভাসকে। ‘শ্রম’ ও ‘সাধনা’ শব্দ দুটি আমরা যেন ভুলতে বসেছি, সৎ ‘ইচ্ছা’র জায়গাও কম। উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত আলস্যতা আর জাতীয়ভাবে প্রাপ্ত কর্মবিমুখতা ক্রমে অতল-অন্ধকার-গহ্বরে তলিয়ে নিয়ে যাচ্ছেজ্জস্বাহঙ্কার ও আপসের চরম উৎকর্ষতায়। স্ববিরোধিতা প্রাতিষ্ঠানিকতা পেয়েছে লিটল ম্যাগাজিন কর্মীদের হাতেই। কেউ ফতোয়া দিয়ে বড় কাগজে গিয়েছে, কেউ বড় কাগজ থেকে ছোট কাগজে, কেউ-বা প্রকাশনা দিয়ে ফাঁদ পেতেছেন ‘মহান কারিগর’। অনাগ্রহ, উদাসীনতা, ভণ্ডামি ও আঁতলামি যেন এদের স্বভাবে জেঁকে বসেছে দিনে দিনে। কবিতা এখন তো আর গীত নয়, মূর্খ সভায় পাঠান্তরও নয়, কবিতা এখন শিক্ষিত মানুষের আরাধ্য ও সাধনায় পরিণত হয়েছে, পাঠকও এ-শ্রেণিভুক্ত। পাঠককে মূর্খ, গেয়ো, অসচেতন, বোকা ভাববার কোনো কারণ নাই। বিজ্ঞানের উন্নয়ন বা বিকাশের পাশাপাশি তার বিস্তারও ঘটে গেছে সমাজে নানাভাবেÑ নানা পর্যায়েÑ নানা দিক দিয়ে। সেক্ষেত্রে আঁতলামি বা ছেঁচড়ামি করবার কোনো সুযোগ নাই। এই সবুজাভ যাত্রায় লেখক-পাঠক উভয়কেই সৎ (মননশীল) হয়ে উঠতে হয়। ব্যক্তিগত কমিটমেন্টই আজ সমাজে ও কবিতায় সবচেয়ে জরুরি হয়ে পড়েছে, এবং তার ব্যবহার আবশ্যকতাও সমানভাবে প্রযোজ্য। আর, একজন প্রতিশ্র“তিশীল কবি বা সাহিত্যিক সে-সাধনাই করেন দ্বন্দ্বচর্চার প্রক্ষেপণে।
তিন
‘সহজ কথা যায় না বলা সহজে’Ñ সেই রবীন্দ্রনাথ-এ এসেই কবিতা খুঁজে পেল সহজ ভাষা এবং এই ধারা অব্যাহত রইল ত্রিশের দশক পর্যন্ত। কিš' চল্লিশের দশকের পর থেকে সহজ ভাষা আরো সহসা রূপ পেল মুখের ভাষায় এবং উত্তরাধিকার বয়ে চলল পঞ্চাশ ও ষাটের দশকেও। এরপর সত্তর দশকে এসে রাজনৈতিক ভাষা শ্লোগান প্রধান করে কথা ক’য়ে উঠলেও কোথাও কোথাও সহজতা হয়ে পড়ল তরলতা যোগ গদ্য-পদ্য প্রধান। যেখানে ভাবের সন্ধান মিললেও শিল্পের গান ব্যাহত হলো। আর এ-প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো এ-দশকার্থে শুধুমাত্র সেই দশকের যাত্রা শুরুর লেখকেরাই শুধু নন, পাশাপাশি ঐ দশকে ধারাবাহিক চর্চায় অংশগ্রহণকারী তরুণ-প্রবীণ কবির অনতিক্রম্য যাত্রাও বিবেচ্য।
আশি এবং নব্বই দশকে সেই যাত্রার ধ্বনিই হয়ে পড়ল জটিল-কুটিল, কখনো কখনো অতি তরলীকরণ, হাস্যকর ও গা-ছাড়া। ব্যতিক্রম ব্যতিক্রমই এবং ব্যতিক্রম কখনোই উদাহরণ হতে পারে না। জটিল-কুটিল অর্থে দুর্বোধ্যতার প্রচারণা মুখ্য। কেননা চর্যাপদ থেকে মধ্যযুগের উজ্জ্বলতর সৃষ্টি বৈষ্ণব পদাবলী, শেষের দিকে গদ্য ও উপন্যাসমুখর যাত্রাÑ সবই ছিল একালের বিবেচনায় ভাষার বুঝে না-ওঠার ব্যর্থতা বা প্রচলিত ভাষার সঙ্গে এগুতে না-পারা। কিš' আশি ও নব্বইয়ে শব্দের বাড়াবাড়িরকম ব্যবহার চোখে পড়বার মতোÑ যা দুর্বোধ্যতায় পরিগণিত। সবাই রান্নার কাঠ-খড় নিয়েই মেতেছেন বেশি, খাবারের স্বাদ নিয়ে চিন্তা করেননি। ভেবেছেন খাবেন পাড়া-প্রতিবেশী, তার জন্য তো ফ্রিজে রবীন্দ্রনাথ, বোদলেয়ার, চেকভ, শেক্সপিয়র, ওমর খৈয়াম তোলা আছে। এভাবে একদল কাঠ-খড় সংগ্রহ ও সাইজ কাঠামো তৈরিতে ব্যস্ত রইলেন; অন্যদল আগে তেল না পানি, পিয়াজ না মরিচÑ এই করে সারা দুপুর; তৃতীয় দল কি রান্না হবে তার কোনো খোঁজ-খবর না-জেনেই স্বাদ-আলোচনায় উত্তরাধুনিক হয়ে উঠলেন; কিš' বিষয়, ভাব ও হাতযশ নিয়ে ভাবলোই না এবং খাবার যারা গ্রহণ করলেন, তাদের জিহ্বা ও দাঁতের খোঁজ না নিয়েই লেগে পড়লেন পাতিল-খুন্তি চর্চায়। যা অশোভন, অমানবিক ও উচ্ছৃঙ্খলতার শামিল। আবার এরাই দলবেঁধে ন্যাংটো উৎসব করে, মেয়ে-বউয়ের শরীরী মাপ-জোক শ্লীল শব্দে বস্তাবন্দি করে। কারণ শ্লীল-অশ্লীল শব্দের দ্বন্দ্বে এদের হাত-পা কাঁপে, সঠিক জায়গায় সঠিক উচ্চারণটি করতে দ্বিধান্বিত ও মূক হয়ে পড়ে, আবার সময়ে সময়ে তথাকথিত বিদ্রোহীর মুখে পান চিবোয়, চুন-সুপারি-খয়েরএরও যে একটা মূল্য আছে তা তাদের চর্মজীবনে কে বিশ্বাস করাবে?
এ-পর্যায়ে আঞ্চলিক শব্দ ও ধ্বনি ব্যবহার এবং লোকজ ও ঐতিহ্যের দোহায় দিয়ে কবিতায় ঢুকে পড়ল অশুদ্ধ, অপ্রচলিত ও পুরনো সব শব্দÑ যা আধুনিকতার নামে কলঙ্ক ছড়াল। কোথাও কোথাও অশিক্ষিত গোবেচারা ভাব ফুটে উঠল। যা কারো কারো হাতে অতি তরলিকরণ রূপ পেল। এবং এই সময়েই সমাজ ও পারিবারিক জীবনে ব্যর্থ, হতাশাগস্ত ও কোথাও ঠাঁয় না-পাওয়া দুর্বৃত্তেরা এসে জুটল সাংস্কৃতিক বলয়ে : কবি, সাংবাদিক, নাট্যকর্মী, শিল্পী, সমালোচকের ভূমিকায়Ñ এরা পথ আগলে দখল করল প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া এবং ছড়িয়ে পড়ল ঢাকাসহ দেশজুড়ে; নিজের ও অন্যের অঞ্চল এক করে ফেলল। তোষামোদকারী, আপসকামী কিংবা সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজ বলা যায় এসব সংস্কৃতিকর্মীদের। যাদের লোভ ও মোহের লোল ঠোঁট গড়িয়ে বুকের সরুপথ বেয়ে নাভিমূল হয়ে নিম্নদেশমুখী। ফলে কোনোকিছুই আর কমিটমেন্টের আওতায় থাকল না, চলে গেল অতি-গণতন্ত্রায়নের ফিল্মি নায়িকার স্থূল গতরে। সংস্কৃতিসেবীর মুখোশ পরিচয়ে বেড়ে গেল আমলা, অধ্যাপক ও সাংবাদিক। যা গড়চর্চারও নিচে গিয়ে দাঁড়াল। এর উদাহরণ প্রতিবছর একুশে বইমেলা ও অন্য সময়ে প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে কতগুলো পাঠযোগ্যজ্জসে বিবেচনা থেকে চিহ্নিত ও পরিষ্কার। ফলে হাস্যকর ও গা-ছাড়া হয়ে পড়ল সাহিত্যচর্চা ও সংস্কৃতিকর্মীর আসন।
মানুষের কথাজ্জদেশপ্রেম যেন চিরকালের জন্য দেশান্তরিত হলো অতি-আধুনিকতা বা উত্তরাধুনিকতার নামে। চোর, ছেচ্চড়, বদমাশে পরিণত হলো অধিকাংশ সংস্কৃতিকর্মী। ফলে নিম্নবৃত্তের মানুষের কথা স্থান পেল না, মধ্যবিত্তের কচকচানি থাকল, পাশাপাশি উচ্চবিত্তের জৌলুস ও বেহায়াপনা স্থান পেল সাহিত্য ও মিডিয়ায়। পজেটিভ ধ্যান-ধারণা জলাঞ্জলি দিয়ে নেগেটিভ আক্রোশ ফুটে উঠল সর্বত্র। কবিদের স্থান এর থেকে খুব দূরে হলো না। ভূমি দখলের মতো পাতা দখল ও পতিতচরিত্র ফুটে উঠল জীবনযাপনে। সংস্কৃতিকর্মীর একটা বড় অংশ মিথ্যাবাদী, কমিটমেন্টহীনতায় পতিত হয়ে পড়ল ধর্মে-কর্মে ও শরমে। দ্রোহ লুকাল ইঁদুরের গর্তে, আর জীবনের সবচেয়ে ব্যর্থ মানুষগুলো হয়ে উঠল সাহিত্য-সংস্কৃতির কেশরবিহীন সেবক-সিংহতে। এ আমাদের একধরনের জাতিগত দুর্ভাগ্য এবং নীতিহীন বেড়ে ওঠা শরীর ও মনের দীর্ঘকালের ভীরুতার ফলাফল; দাসনীতি তাই এখনো প্রকট সমাজে ও রাষ্ট্রে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে স্বপ্ন-সম্ভব সম্ভাবনার সাহসী বাস্তবায়ন ও কার্যকরণ যেমন জরুরি, তেমনি ব্যাপক শুদ্ধি অভিযান প্রয়োজন সাংস্কৃতিক ধ্বনি-যাত্রার অন্দরে-বাইরে। তবেই উত্তরণের গান আলোর মুখ দেখবে। ভালো মানুষ, সৎ মানুষ এখনো আছে। তাদের একত্রিত হতে হবেÑ ঘরে-বাইরে, ধর্ম, রাষ্ট্র ও সমাজে। এগিয়ে আসতে হবে বিপ্লবের অগ্রনায়কদের শ্রেণি-বৈষম্য ভুলে সত্যিকার সাহিত্যসেবায়, সংস্কৃতিচর্চায়। সেইদিন পরাভূত নয় নিশ্চয়?
তাছাড়া আঠারো ও উনিশ শতকের শিক্ষা আমরা ভুলতে বসলাম বিশ শতকের শেষ ত্রিশ বছরে। আমাদের ভূখণ্ডগত স্বাধীনতা ও মুক্তিসংগ্রামÑ অহংকার ও আনন্দের একই সঙ্গে, আবার আমাদের পরাজয়Ñ ধর্মীয় মৌলবাদ, দেশদ্রোহ ও একান্ত একার ব্যক্তিগত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বার্থের কাছে জিম্মি। সাহিত্যেও এর প্রভাব পড়েছে। শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন হয়নি, সাথে সাথে বিকাশ লাভ করেনি দেহ, মন ও আত্মার বেড়ে ওঠা ও প্রকাশ। কি রীতিতে, কি ইঙ্গিতে? ধর্ম, রাজনীতি, নেশা ও শরীর ভোগগত প্রেম অন্ধকারে ঢেকে ফেলল সম্ভাবনা-উত্তর স্বপ্নযাত্রা ও শিকড়ের রূপ-রস-গন্ধের অস্থি ত্বকে। ব্যর্থতার কাল একুশ শতকের শুরুর দশকেও প্রযোজ্য, তবে আশার কথা : গত শতাব্দির ক্লেদ দূর হচ্ছেÑ নতুনের জয়গানে, দেশপ্রেম ও কমিটমেন্টের ডকুমেন্টারি থেকে মাটিতে, বাতাসে, প্রচ্ছন্ন ব্যক্তিত্বে। ‘অহংকার’ ব্যক্তিত্বের মূল হয়ে উঠছে ব্রিটিশ ভাব-সম্প্রসারণ ভুলে। এসব সৃষ্টিপর্বের আনন্দ-বেদনার জয়ধ্বনিই।
আমার বিশ্বাস মানুষ শুধুই টিকে থাকবে না, সে সফলতা পাবে। সে অমর, কিš' সেটা এই কারণে নয়Ñ প্রাণীদের মধ্যে শুধু তারই এক অফুরান কণ্ঠস্বর আছে; বরং এই কারণে যে, তার আত্মা আছে, সেটা এমন-এক সত্তাÑ যেটা মায়া-মমতা, আত্মত্যাগ ও ধৈর্যসহিষ্ণুতায় ভরপুর। কোনো কবির, কোনো লেখকের কর্তব্য শুধু এই নিয়েই লেখা। তার যে বিশেষ অধিকার আছে, মানুষের হৃদয়কে উন্নীত করে তিনি যে ধৈর্যসহিষ্ণুতায় বাঁচতে সাহায্য করতে পারেন, তাকে তিনিই মনে করিয়ে দিতে পারেন স্পর্ধা আর সাহস আর সম্মান আর আশা আর অহমিকা আর মায়া-মমতা আর আত্মত্যাগÑ যা ছিল তার অতীত মহিমা। নিছক মানবস্বরের প্রতিলিপি হয়ে থাকার তো দরকার নেই কবির স্বরের, সেটা নানা কৃৎকৌশলের একটা হতে পারে, বরং আসল খুঁটিকৌশল একাই হতে পারেÑ যা অসীম সহিষ্ণুতায় টিকিয়ে রেখে সাফল্য অর্জন করতে তাকে সাহায্য করবে।



















সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জুন, ২০০৮ সকাল ৮:৪৮
৫টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্মৃতিপুড়া ঘরে

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৩০



বাড়ির সামনে লম্বা বাঁধ
তবু চোখের কান্না থামেনি
বালিশ ভেজা নীরব রাত;
ওরা বুঝতেই পারেনি-
মা গো তোমার কথা, মনে পরেছে
এই কাঠফাটা বৈশাখে।

দাবদাহে পুড়ে যাচ্ছে
মা গো এই সময়ের ঘরে
তালপাতার পাখাটাও আজ ভিন্নসুর
খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×