নস্টালজিয়া
দ্বিতীয় পর্ব
ভালোবাসার বিটিভি
‘হয়নি...আরেকটু ঘুরাতে হবে!... এই...এই…এই যাহ্ আবার চলে গেল... হ্যাঁ হ্যাঁ এবার হইছে...এটাই ঠিক আছে। আর যেন না নড়ে!’
মনে পড়ে এইসব কথোপকথন? ভুলি কেমন করে তাই না? নব্বইয়ের দশকের সেই দিনগুলোতে আমাদের অস্তিত্বের সাথে মিশে যাওয়া একটা নাম ছিল বিটিভি। আজ টিভির রিমোট হাতে নিলেই এটা নয় সেটা... সেটা নয় ওটা... কত কত চ্যানেল আর কতসব বিচিত্র অনুষ্ঠান! তবু আমাদের মন ভরে না। আমাদের এখন চাই নেটফ্লিক্স, হৈচৈ কত কী! অথচ এমন একটা সময় ছিল যখন একটা মাত্র বিটিভি দিয়েই আমরা পার করে দিয়েছি আমাদের শৈশব কৈশোরের সেই সোনালি দিনগুলি!
প্রতিটা টিভি প্রোগ্রাম ছিল আমাদের পরম কাঙ্ক্ষিত। আজ লিখতে বসে ভেবেই কূলকিনারা করতে পারছি না যে কোথা থেকে শুরু করব!
তখন উঠতি তারুণ্যের সময়। বিজাতীয় সংস্কৃতির একটু আধটু হাওয়া সবে তখন দোলা দিতে শুরু করেছে আমাদের উড়ু উড়ু মনের দিকভ্রান্ত পালে। ইংরেজি থেকে বাংলায় ডাবিং করা টিভি প্রোগ্রামগুলো ছিল দারুণ জনপ্রিয়। ম্যাকগাইভারের কথা কি কখনও ভুলতে পারবে আমাদের তারুণ্য আর কৈশোর?
সঙ্গীতশিল্পী ডলি সায়ন্তণীর প্রথম গানের ক্যাসেট তখন খুব ধুম তুলেছে আমাদের মাঝে। ক্যাসেটের কাভার সঙ ছিল, ‘রংচটা জিনসের প্যান্ট পরা।’ সেই ক্যাসেটের আরেকটি শ্রোতাপ্রিয় গান ছিল, ‘টেলিফোন ধরি না... কবিতা পড়ি না... আমার দু’চোখ শুধু তাকেই খোঁজে... ম্যাকগাইভার!’ বাপরে! কী উন্মাদনা! ভাবা যায়?
আরেকটি ঘটনার কথা না বললেই নয়! আমি সেই বয়সে নিয়মিত ডায়েরি লিখতাম। এখন সেই ডায়েরি মাঝে মাঝে উল্টেপাল্টে পড়ি। একদিন একটা পাতায় আমি লিখেছি, ‘আজ বাসায় খুব একচোট হয়ে গেছে। রাফি ম্যাকগাইভার দেখতে দেখতে গলা ফাটিয়ে কাঁদতে লাগল যে, ম্যাকগাইভার মরে যাচ্ছে! বড়পা রেগেমেগে দিলো রাফিকে দু’ঘা বসিয়ে। সেই দেখে আম্মা দিলো বকা...’
রাফি আমার ভাগ্নে। ভাগ্নে এখন পি এইচ ডি করছে আমেরিকায়। আমি ডায়েরি পড়ে ওকে মেসেঞ্জারে স্ক্রিনশট সহ দেখালাম। সে আকাশ থেকে পড়ে বলল, ‘বিপু খালা এসব কি সত্যি সত্যিই হয়েছে নাকি!’
যখন ক্লাস নাইন কী টেনে পড়ি তখন আমাদের মাঝে আরও দুটো বিদেশী টিভি সিরিজ ছিল খুব জনপ্রিয়। সেগুলো হচ্ছে জাপানি সিরিজ ‘ওশিন’ আর অস্ট্রেলিয়ান একটি সিরিজ ‘গার্ল ফ্রম টুমরো’। আমার ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া বড়বোন অশিনের বেশি ভক্ত ছিল আর আমি ছিলাম পরেরটার। ভবিষ্যৎ থেকে আসা একটি কিশোরীর সাথে বর্তমানের আরেক কিশোরীর বন্ধুত্ব দেখতে দেখতে নিজেকেও ওদের একজন বলে মনে করতাম। দুজনের বিচ্ছেদে গোপনে কেঁদে বালিশ ভিজিয়ে ফেলতাম।
এছাড়া পুরো বাসার সবাই দেখত ‘আলিফ লায়লা’। আহা সেই বিখ্যাত সূচনা সঙ্গীত শুনলেই বাসার সবাই যে যেখানে থাকত এসে বসে পড়ত টিভির সামনে। অল্প কিছুসময় দেখতে না দেখতেই শুরু হয়ে যেত বিজ্ঞাপন। দেখাতো মাত্র ত্রিশ মিনিট। বিজ্ঞাপন বিরতি বাদ দিলে টেনেটুনে হয়ত কুড়ি মিনিটই হবে। তবু এটুকু দেখার জন্যই সারা সপ্তাহের সাগ্রহ প্রতীক্ষার সেই দিনগুলো... আহা...
এছাড়া আরও অনেক বিদেশী সিরিজের কথা না বললেই নয়। ডাইনাস্টি, ডালাস, দ্য এক্স ফাইলস, দ্য এটিম, দ্য রোবোকপ, ম্যানিমাল, ডার্ক জাস্টিস, নাইট রাইডার সহ আরও কত নাম! সব নাম বলতে বসলে আজ হয়ত আর শেষ করতে পারব না। প্রতিটা সিরিজ ছিল আমাদের মধ্যে তুমুল জনপ্রিয়।
সম্ভবত বিটিভির সবচেয়ে জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ছিল ‘মনের মুকুরে’ আর ধারাবাহিক নাটক। সাপ্তাহিক নাটক হতো মঙ্গলবারে, ‘মনের মুকুরে’ নামে। উপস্থাপিকা হাস্যজ্জল মুখে ঘোষণা দিতেন, ‘প্রিয় দর্শক এখন শুরু হচ্ছে সাপ্তাহিক নাটকের অনুষ্ঠান ‘মনের মুকুরে’। মনের মুকুরে আজ দেখবেন নাটক...’
একটি টিভি নাটক যে কতটা পরিশীলিত, আধুনিক, মানসম্পন্ন আর রুচিশীল হতে পারে সেটা বোধকরি নব্বইয়ের দশকের এইসব নাটক যারা দেখেনি তারা কিছুতেই অনুভব করতে পারবে না। সেই সব নাটকের কলাকুশলীরা ছিলেন বাঘা বাঘা সব অভিনেতা অভিনেত্রী। আর নাটকের নামগুলো দেখলেই হয়ত অনুভব করা সম্ভব এর ভেতরের উপাদান কতটা খাঁটি হতে পারে। এখানে নোঙর, ভাঙ্গনের শব্দ শুনি, আমি তুমি সে, দিনরাত্রির খেলা, বেলা অবেলা... আমাদের টিভি নাটকের সেই সোনালী অতীতের কথাই মনে করিয়ে দেয়।
আর ধারাবাহিক নাটকগুলো তো ছিল একেকটা রত্নের মতন। হুমায়ূন আহমেদ যখন টিভি নাটক লিখতে আরম্ভ করলেন তখন তো একেবারে সোনায়সোহাগা সময় শুরু হলো যেন। এইসব দিনরাত্রি, কোথাও কেউ নেই, সকালসন্ধ্যা, বহুব্রীহি, নক্ষত্রের রাত... এই নাটকগুলোর কথা কি আমরা আমাদের এক জীবনে ভুলতে পারব?
এখনো মনে আছে, বহুব্রীহি যেদিন প্রচারিত হতো সেদিন সকাল থেকেই মনটা ফুরফুরে থাকত। মনে হতো... হুহু আজ আছে! আজ যে আফজাল আবার কী করবে কে জানে! আগের পর্বে তো ক্যাসেট ভাঙছে! মামার কান্ডকীর্তি আর সোবহান সাহেবের আঁতলামি! কী যে এক মধুর আনন্দের রেশ নিয়ে হাজিরা দিতো দিনগুলো আজ তা আর স্মৃতিকথাতেও পুরোপুরি তুলে আনা সম্ভব নয়!
এছাড়া শহীদুল্লাহ কায়ছারের ‘সংশপ্তক’, ইমদাদুল হক মিলনের ‘কোন কাননের ফুল’, ‘বারোরকম মানুষ’, ‘রূপনগর’… প্রতিটি নাটকই ছিল দারুণ জনপ্রিয়। এইসব নাটকের সংলাপগুলো ঘুরত মানুষের মুখে মুখে। রূপনগরের খালেদ খানের মুখের ‘ছি ছি তুমি এত খারাপ’ কিংবা বহুব্রীহি নাটকের ‘তুই রাজাকার’… এই সংলাপগুলো জনপ্রিয় হয়ে ওঠে নাটকের সাথে সাথেই।
নব্বইয়ের দশকে বাবার বদলীর চাকরির সুবাদে আমরা রাজশাহীতে থাকতাম। সেইসময় বিটিভির পাশাপাশি আমাদের আরেকটা বিনোদনের মাধ্যম ছিল ‘দূরদর্শন’। রাজশাহীতে এটার সিগনাল আসত। সপ্তাহে দুইদিন দুটো সিনেমা বরাদ্দ ছিল এই দূরদর্শনের বদৌলতে। একটি কোলকাতার সিনেমা আরেকটি ওদের আঞ্চলিক ভাষার সিনেমা।
আর বিটিভির প্রতি শুক্রবারের বাংলা সিনেমা তো কখনওই মিস হতো না!
সেইসময় বিটিভিতে প্রচারিত বিজ্ঞাপনের জিঙ্গেলগুলো শুনলে এখনো দৌড় দিয়ে এক ফাঁকে ঘুরে আসি পুরনো সেই দিনগুলো থেকে।
দিন চলে গেছে কত পেছনে, তবু বিটিভি ভালোবাসার এক অনন্য নাম হয়ে রয়ে গেছে মনের গভীরে। আমাদের একটা সময় যেন বোকাবাক্সের ঐ একটি চ্যানেলের মাঝেই বন্দি হয়ে আছে!
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে আগস্ট, ২০২৩ রাত ৮:০৩