somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

নস্টালজিয়া (তৃতীয় পর্ব)

২৯ শে আগস্ট, ২০২৩ সকাল ১১:০৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

নস্টালজিয়া
তৃতীয় পর্ব
অন্ধকারটাই আলোকিত ছিল যখন



আজকের লেখাটা শুরু করার আগে আমি বেশ কিছুটা সময় নিয়ে ভাবতে বসলাম, নস্টালজিয়া মানে কী। আমি তো নস্টালজিয়ার গল্পগুলো বলতে বসেছি। কাজেই আমাকে নস্টালজিয়া শব্দটার অর্থ তো আগে ভালোভাবে জানতে হবে।

আশ্রয় নিলাম সবজান্তা গুগল মামার। তিনি জানালেন, নস্টালজিয়া মানে হচ্ছে অতীত বিধুরতা। বাহ! কী চমৎকার একটা বাংলা অর্থ খুঁজে দিয়েছেন গুগল মামা! সত্যিই তাই! আমি আমার অতীত বিধুরতার গল্পগুলোই তো বলতে বসেছি! আর তাই আঁচড়ে আঁচড়ে রক্তাক্ত করছি বুকের অলিন্দটাকে, যেখানে গুঁজে রাখা আছে কিছু চাপা দীর্ঘশ্বাস... অদ্ভুত কিছু মোচড় দিয়ে যেটা প্রায়ই আমাকে জানান দেয় জীবনটা একদিন ওরকম ছিল!

বেশ অনেকদিন আগেই একবার ইন্টারনেটে একটি ছবি খুঁজে পেয়েছিলাম। হাতে আঁকা ছবি। ছবিতে দেখানো হয়েছে একটি পাড়া। সেই পাড়ায় রাতের বেলায় লোডশেডিং হয়েছে। খুব সুন্দর ভাবে সেই অন্ধকারের সময়টাকে তুলে আনা হয়েছে পুরো ছবিতে। বোঝা যাচ্ছে, আশেপাশে একটা অকারণেই ‘হঠাৎ পেয়ে যাওয়া চাঞ্চল্য’। ছুটোছুটি শুরু হয়ে গেছে শিশু কিশোরদের মাঝে। পাড়ার মেয়েরা এবাড়ি ওবাড়ির ছাদ থেকে মুখ বাড়িয়ে গল্প করছে পাশের বাড়ির ছাদে উঠে আসা প্রতিবেশিনীদের সঙ্গে। যুবক বয়সীরা পাড়ার মোড়ে ঘাড়ে হাত দিয়ে গল্প করছে বন্ধুদের সঙ্গে আর ঠারে ঠারে চোখ রাখছে কলকাকলিতে মেতে থাকা তরুণীদের দিকে। ছবির ক্যাপশনে লেখা, ‘অন্ধকারটাই আলোকিত ছিল তখন!’

আমি সীমাহীন বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলাম ছবিটার দিকে! জানি না কে এমন নিপুণ নিখুঁত দক্ষতায় তুলে এনেছেন আমাদের সেই দিনগুলোকে! তিনিও নিশ্চয়ই আমাদেরই কেউ ছিলেন! যে প্রজন্মের আমরা প্রতিনিধিত্ব করি, তিনিও নিশ্চয়ই সেই প্রজন্মেরই একজন হবেন। তাই তো প্রতিটি ঘটনাকে এত চমৎকারভাবে তুলে ধরতে পেরেছেন।

আমরা যারা ছোটখাট মফঃস্বল শহরে বেড়ে উঠেছি, আমাদের শৈশব কৈশোরের কিছু নিত্য অনুষঙ্গ ছিল। এই নিত্য অনুষঙ্গগুলোর মধ্যে খুবই গৌরবের সঙ্গে যার কথা বলতে হয়, সেটি হচ্ছে প্রতিবেশীদের মধ্যে হৃদ্যতা। পাড়াতো হৃদ্যতাও বুঝি বলা যায় এটাকে। আমরা একই পাড়াতে পাশাপাশি বাসায় বাস করতাম, দিনমান ছুটাছুটি দৌড়াদৌড়ি কাড়াকাড়ি করতাম। একসঙ্গে খেলতাম, আবার না বনলে মুখ ভেংচি কেটে দিন দুই কাটিয়ে দিতাম। তারপর যখন কথা না বলতে পাড়ার যাতনায় নাভিশ্বাস উঠে যেত, তখন নিজেই গিয়ে আবার পায়ে পাড়া দিয়ে আগ বাড়িয়ে বলতাম, ‘এ্যাই চোখে দেখিস না?’
আমরা সাধারণত সবাই এক স্কুলেই পড়তাম। কেউ কেউ মাঝেমধ্যে দলছুট হতাম। একই ক্লাসের হলে আমাদের মধ্যে অথবা আমাদের মায়েদের মধ্যে একটা গোপন রেষারেষি কাজ করত। সেই রেষারেষি কেউই ওপরে বুঝতে দিত না। কেউ পিছিয়ে পড়লে মায়েরা শুধু বাসার মধ্যে কানের কাছে মধুবর্ষণ করে বলত, ‘দিনমান তো একই সঙ্গে ঘুরো, কিন্তু ও তোমার চেয়ে এত বেশী নাম্বার পেল কী করে?’

বিশেষ দিনগুলোতে আমরা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করতাম। আমাদের মধ্যে যারা বয়সে একটু বড় ছিল, তারা ছিল এসব অনুষ্ঠানের আয়োজক। আমরা পিচ্চিরা থাকতাম অনেকটা কামলা পর্যায়ের। বড় ভাইবোনেরা আমাদের দয়া করে নাটক বা দলীয় কোনো পরিবেশনাতে একটা ছোটখাট পার্ট দিলে আমরা রীতিমত ধন্য হয়ে যেতাম।

মনে পড়ে, শিবগঞ্জে (চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ) থাকতে আমরা একবার ‘কাবুলিওয়ালা’ নাটকটা করেছিলাম। আমাকে বিশেষ দাক্ষিণ্য দেখিয়ে ‘মিনি’র চরিত্রে কাস্ট করা হয়েছিল। আমার মায়ের চরিত্রে অভিনয় করেছিল আমার নিজেরই বড়বোন, নাটকে যার মূল কাজ ছিল শুধুই আমাকে বকাবকি আর শাসন করা। আমার বড়বোন তো সুযোগ পেয়ে সেদিন একটা বকাও মাটিতে পড়তে দেয়নি!

একুশে ফেব্রুয়ারিতে আমরা পাড়ার সবাই মিলে প্রভাতফেরির আয়োজন করতাম। খালি পায়ে হাতে একটি কিংবা দুটি ফুল নিয়ে ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গাইতে গাইতে রওয়ানা দিতাম জেলা শহরের ছোটখাট একমাত্র শহীদ মিনারটির উদ্দেশ্যে। ঘটা করে কালোসাদা জামা পরার ধুম ছিল না আমাদের। বছরে দুটো ঈদে বরাদ্দ ছিল দুই জামা। প্রতি দিবসে নিত্য নতুন রঙের জামাকাপড় কিনে দেওয়ার বিলাসিতা করা আমাদের স্বল্প আয়ের বাবার পক্ষে ছিল দুঃসাধ্য। তাই একেকজন একেক রঙের জামা পরে বুকভরা আবেগ আর ভালোবাসা নিয়ে গাইতে গাইতে যেতাম।

আরেকটা কাজ আমরা করতাম মনে আছে। আসলে একটা পাড়ায় তো শিল্পমনা কিশোর কিশোরী তরুণ তরুণী কম ছিল না! তাই এসব আইডিয়া কারও না কারও মাথা থেকে এসেই যেত। আমরা একবার পাড়া থেকে একটা দেওয়াল পত্রিকা বের করেছিলাম। সেটাই ছিল দেওয়াল পত্রিকার সাথে আমার প্রথম পরিচয়। শিশুতোষ কিছু একটা ছড়া টড়া দেওয়ার জন্য খুব তক্কে তক্কে ছিলাম। কিন্তু বড়দের কাছে থেকে পারমিশন মেলেনি।

বিকেল বেলায় আড্ডা খেলাধুলা ছিল রোজকার রুটিনে। কেউ খেলতাম ব্যাডমিন্টন, কেউ বা গোল্লাছুট, বউচি, দাড়িয়াবান্ধা, আরও কত সব নাম না মনে করতে পারা খেলা। এর মাঝেই কেউ কেউ হয়ে উঠেছিলাম প্রকৃতিপ্রেমী। শিবগঞ্জে ছিলাম বলেই প্রচুর আম খেয়েছি সেই সময়। আর কত যে বিচিত্র সব আমের সঙ্গে পরিচিত হয়েছি, সেগুলোর নাম বলে ফুরানো যাবে না। আমি যে স্কুলে পড়তাম, সেই স্কুলের দুটি স্থানীয় মেয়ে আমাকে আমের পাতার গন্ধ শুঁকে নাম বলতে পারা শিখিয়েছিল। আমি সেই কৌশল বাসায় এসে দেখিয়ে রীতিমত তাক লাগিয়ে দিয়েছিলাম সবাইকে।


সন্ধ্যে নেমে এলেই যার যার ঘরে ঢুকে দোর বন্ধ করে শুরু হতো পড়াশুনা। আস্তে আস্তে পড়লে চলবে না। যে যত ভালো ছাত্র, তার পড়ার আওয়াজ থাকবে তত উঁচুতে। তাই প্রতিটা বাসা থেকেই ভেসে আসত সমস্বরের কলরব।

গ্রীষ্মের দিনগুলোতে লোডশেডিং ছিল অবশ্যম্ভাবী একটা ব্যাপার। অবশ্য আমরা তখন লোডশেডিং শব্দটার সঙ্গে সেভাবে পরিচিত ছিলাম না। আমরা বলতাম, ‘কারেন্ট চলে গেছে!’ আর কারেন্ট চলে গেলেই হলো! আমাদের আনন্দ আর দেখে কে! কারণ যতই জোরপূর্বক ধরেবেঁধে রেখে পড়ানো হোক না কেন, কারেন্ট চলে গেলে আর কারও জোর খাটানোর কিছু নেই। তখন ঘরে ঘরে ছিল হ্যারিকেন। সেই হ্যারিকেনও ছিল সীমিত সংখ্যক। হয়ত বড়জোর একটা কী দুটো। আর ভাইবোন তো ছিল কম করে হলেও এক গণ্ডা। কাজেই গণ্ডাখানেক হ্যারিকেনের তো আর জোগান দেওয়া সম্ভব নয়। কাজেই একদিক দিয়ে কারেন্ট চলে যেত, আরেকদিক দিয়ে আমাদের বইয়ের পাতা ধপ করে বন্ধ হয়ে যেত।

আমার এখনো একটা দৃশ্য পরিষ্কার মনে আছে। চোখ বন্ধ করলে আমি যেন হুবহু সবকিছু পরিষ্কার দেখতে পাই।

গলা ফাটায়ে চিৎকার করে পড়ছি। হঠাৎ দুপ করে কারেন্ট চলে গেল। ব্যস, বইয়ের পাতা সটান করে বন্ধ করে এক দৌড়ে লাফাতে লাফাতে বাসার বাহির! ঝকঝকে আকাশে তখন তারাদের কনফারেন্স চলছে!
বাইরে ইতিমধ্যেই সবাই দলেবলে এসে জড়ো হতে শুরু করেছে। কেউ বা মোড়া পাটি বিছিয়ে একেবারে জমিয়ে বসে পড়েছে। তীব্র গরমে বাইরে হয়ত একটা গাছের পাতাও নড়ছে না অথবা একটু একটু শীতল হাওয়ায় গা জুড়াচ্ছে। বড়দের কারও কারও হাতে তালের পাখা। সেটাকে ঘুরাতে ঘুরাতে আম্মা খালাম্মারা পান খেতে খেতে খোশমেজাজে গল্পের আসর বসিয়েছেন।

আমরা কয়েকজন জুটে যেতেই ‘এ্যাই আই কানামাছি খেলি’ বলে অন্ধকারেই শুরু করে দিয়েছি দৌড়াদৌড়ি। মা খালারা গল্পের আসর থেকেই মাঝেমাঝে উঁচুস্বরে বলছে, ‘এ্যাই আস্তে দৌড়া তোরা! অন্ধকারে হোঁচট খেয়ে পড়বি! একটা কেলেঙ্কারি বেঁধে যাবে!’

সেই আলো আঁধারিতে কোনোই যে কেলেঙ্কারি বাঁধত না, সেটাই বা কী করে বলি! কচি বয়সের তরুণ তরুণীর দল তখন লাজুক হেসে এ ওর সাথে হেলে হেলে গল্প করছে... এই দৃশ্যও তো কতই দেখেছি! প্রেমের গল্প কি রচিত হতো না কখনোই? হতো নিশ্চয়ই! কিন্তু সেই খবরে আজ এতদিন পরে আর কীই বা এসে যায়!

ফুরিয়ে গেছে সকল লেনাদেনা...

শুধু অন্ধকারে হাতড়ে খুঁজে ফেরা হৃদয়ের একেকটি মোচড় মনে করিয়ে দেয়, অন্ধকারটাই তখন কত আলোকিত ছিল! সাদাকালো সেই জগতটা তখন কতই না রঙ্গিন ছিল!

সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে আগস্ট, ২০২৩ দুপুর ১:৩৬
৯টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্মৃতিপুড়া ঘরে

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৩০



বাড়ির সামনে লম্বা বাঁধ
তবু চোখের কান্না থামেনি
বালিশ ভেজা নীরব রাত;
ওরা বুঝতেই পারেনি-
মা গো তোমার কথা, মনে পরেছে
এই কাঠফাটা বৈশাখে।

দাবদাহে পুড়ে যাচ্ছে
মা গো এই সময়ের ঘরে
তালপাতার পাখাটাও আজ ভিন্নসুর
খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×