#নস্টালজিয়া
#চতুর্থ পর্ব
#বিনা তারের কাব্য
অফিসে যেতে যেতে অথবা ঢাকার মধ্যেই একটু বাইরের দিকে কোথাও লং ড্রাইভে গেলে গাড়ির সিডি প্লেয়ারটা নিশ্চয়ই অন করে দিতে ভোলেন না। প্রিয় শিল্পীর গান শুনতে শুনতে যাত্রা হয়ে ওঠে আনন্দময়।
পাশ থেকে হয়ত আপনার টিনএজ ছেলেটি আবদার জুড়ে দেয়, ‘টি টোয়েন্টি ম্যাচ হচ্ছে বাবা। স্কোর কত হলো জানতে হবে। এফ এম রেডিওটা অন করে দাও প্লিজ!’
ছেলের পাশ থেকে মেয়েটি হয়ত আবদার করে, ‘না বাবা প্লিজ! এখন কিছুতেই ঐ বিরক্তিকর কমেন্টি শুনতে পারব না। ৯২.৮ এফ এমে ‘এক কাপ গান শুনুন রঞ্জনের সাথে’ হচ্ছে। ওটা দাও।’
এই সময় শুরু হয়ে যায় ভাইবোনের ঝগড়া। ‘উঁহু বাবা... আমার স্কোরটা জানতেই হবে!’
স্ত্রী হয়ত নির্বিকার মুখে ভাবছে, তার একটা কিছু হলেই হলো! গান হোক অথবা ক্রিকেট কমেন্টি। আপত্তি নাই কোনোটাতেই!
আজকের দিনের প্রেক্ষাপটে এটাই হয়ত বাস্তবতা। কত কত এফ এম রেডিও চ্যানেল! ইচ্ছেমত একটাতে টিউন করলেই হলো! চলবে পছন্দের গান, ভূতের গল্প অথবা জীবনের গল্প। এই তো মাত্র কিছুদিন আগে পর্যন্ত আমিও ছিলাম আরজে কিবরিয়ার ‘যাহা বলিব সত্য বলিব’ অনুষ্ঠানের একনিষ্ঠ একজন শ্রোতা। প্রথম দিকে খুব মন দিয়ে প্রতিটা পর্ব শুনতাম। ধীরে ধীরে আগ্রহ হারিয়ে ফেললাম। হয়ত তখন অন্য কোনো অনুষ্ঠান আমাকে বেশি আকর্ষণ করতে শুরু করে দিয়েছিল।
আসলে নতুনত্বের এই জামানায় দিনের পর দিন কিছু একটাতে আকৃষ্ট থাকতে পারা বেশ কঠিন ব্যাপারই বটে! একটা কিছুতে মন লাগতে না লাগতেই বেজে যায় চলে যাওয়ার ঘণ্টা। পাশ থেকে হয়ত হাতছানি দিয়ে ডাকতে থাকে নতুন কিছু!
অথচ এমন একটা সময় ছিল, যখন আমাদের কাছে ছিল একটি মাত্র বিটিভি, একটি মাত্র ক্যাসেট প্লেয়ার আর একটিমাত্র বেতার বাংলাদেশ। অবশ্য পরে বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে বেতার বাংলাদেশের শাখা গড়ে ওঠে। শুরু হয় অঞ্চলভেদে রেডিওর অনুষ্ঠান প্রচার।
শুরু করি একটু পেছনের কথা দিয়ে। সেটা আশির দশকের কথা। আমার দাদা তখন বেঁচে ছিলেন। আমরা যখন বার্ষিক পরীক্ষা দিয়ে দাদাবাড়িতে যেতাম, তখন প্রিয় কয়েকটা দৃশ্যের মধ্যে একটি ছিল... ছোট্ট রেডিওখানি কানের কাছে নিয়ে দাদার বসে থাকা। কী যে শুনতেন ওভাবে, আজ এতদিন পরে সব কি আর মনে আছে ছাই! তবু মাঝে মাঝে সেই মাথা ঝাঁকুনি আর হেলেদুলে করা অঙ্গভঙ্গির কথা মনে করে ধারণা করতে পারি, দাদা হয়ত দাদিকে ফেলে মজা করে সিনেমার গান শুনতেন!
সেই সময় থেকে আরেকটা দশক সামনে এসে সময় বদলে গেল অনেকখানি। প্রযুক্তির তখনও বুঝি এখনকার মতন এমন দ্রুতগতির উর্ধমূখীগমন আরম্ভ হয়নি। সময় বদলাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু আমরা সেই বদলে যাওয়া সময়ের সাথে একটু রয়েসয়েই তাল মেলাতে পারছি। দ্রুত চলতে গিয়ে পা পিছলে পড়ছি না।
আশির দশকের শেষ থেকেই রেডিওর সাথে আমাদের জীবনের আনন্দ বেদনার কাব্যগুলো ভিন্ন আঙ্গিকে রচিত হতে লাগল। আর নব্বই দশকের জীবনে রেডিও নিয়ে এলো এক অন্যরকমের আবেদন। এই দশকের শুরু থেকেই আমি নিজে ঢুকে পড়েছি ব্যস্ত শিক্ষাজীবনে। সেই ব্যস্ত জীবনের ফাঁকে ফাঁকে একটুখানি বিনোদনের আশায় অপেক্ষা করে থাকতাম বিটিভির রাতের অনুষ্ঠানের দিকে। কিন্তু পড়া থেকে ফুরসত মিললে তবেই তো! মধ্যবিত্তের পরিবারে কোনো এক সন্তান পড়ালেখায় হুট করে সম্ভাবনা দেখাতে শুরু করলে তার আর ফুরসত থাকে কি?
দুপুরে অংক কষার ফাঁকে ফাঁকে ক্যাসেট বাজিয়ে গান শুনতাম। কখনও কখনও ক্যাসেট বন্ধ রেখে শুনতাম রেডিও। রেডিওতে চলত অনুরোধের আসর। সারা দেশ থেকে চিঠি লিখে কত তরুণ তরুণী যে প্রিয় সব সিনেমার গান শুনতে চাওয়ার অনুরোধ জানাত! মাঝে মাঝে হয়ত মাঝবয়সীরাও চিঠি লিখতেন। চারণ করতেন সোনালী অতীতের কোনো মধুময় স্মৃতি। সেই স্মৃতির সুতো হাতে নিয়ে খুঁজে ফিরতেন নিজেদের ফেলে আসা যৌবন।
আমি যে সময়টার কথা বলছি তখন বাংলাদেশের সিনেমাতে নতুন যুগের উঁকিঝুঁকি শুরু হয়ে গেছে। মৌসুমি আর সালমান শাহ তখন হিট জুটি। তাদের ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ সিনেমার দারুণ মেলোডিয়াস গানগুলো তখন আমাদের মুখে মুখে। নাঈম শাবনাজ জুটির কথাও না বললেই নয়। সিনেমাটার নাম ছিল সম্ভবত ‘চাঁদনী’। সেই সিনেমা দিয়েই এই হিট জুটির বাংলাদেশের সিনেমা অঙ্গনে পা রাখা। তারপর একে একে তারা আরও কিছু হিট সিনেমা করেছে যেগুলোর গানগুলো ছিল খুবই জনপ্রিয়। আর সেই সময়ে এই গানগুলো শোনার একমাত্র উপায়ই ছিল এইসব অনুরোধের আসর কিংবা অন্য কোনো গানের অনুষ্ঠান। এসব গান শোনার জন্য অনুরোধের আসর শুরু হলেই তাই আমাদেরও রেডিও অন করা চাইই চাই!
মাঝবয়সীরা হয়ত শুনতেন তাদের ফেলে আসা সময়ের মেলোডিয়াস গান। ববিতা চম্পা কবরী সুচরিতা... এসব গ্ল্যামারাস নায়িকারা তখন বিগতযৌবনা। তবু তাদের স্বর্ণালী সময়ের গানগুলো শুধু যে তাদের কাছেই আকাঙ্ক্ষিত ছিল তা নয় মোটেও। আমরাও সেইসব গান শুনতাম ব্যাকুল আগ্রহ নিয়ে। কী চমৎকার সেইসব গান!
‘ইশারায় শিষ দিয়ে আমাকে ডেকো না...’ অথবা ‘চেনা চেনা লাগে তবু অচেনা...ভালোবাসো যদি কাছে এসো না!’ এই গানগুলোর আবেদন কি কখনও শেষ হওয়ার মতো?
কত কষ্ট করে তখন অনুরোধ পাঠাতে হতো। রেডিওতে দিয়ে দেওয়া অনুষ্ঠানের ঠিকানাতে চিঠি লিখে নিজের নাম ঠিকানা সহ গানের অনুরোধ জানানো। সেইসব অজস্র চিঠির মধ্য থেকে হয়ত গুটিকয়েক ভাগ্যবানের ভাগ্যেই শিকে ছিঁড়ত। আর রেডিওতে নাম প্রচারিত হলে তো ওরে বাবা! সে তো জনে জনে ডেকে শোনানোর মতোই একটা খবর! কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ডাকাডাকি শুরু করার আগেই প্রচার শেষ হয়ে গান শোনানো শুরু হয়ে যেত। কিন্তু তবু কি আর কেউ থেমে থাকত! দুইদিন ধরে হয়ত সেই গল্প চলত। ‘জানিস... কাল না আমার অনুরোধের গানটা শুনাইছে!’
আসলে ঘটনা হলো এই, তখন কার ভাগ্যে শিকে ছিঁড়বে কার ভাগ্যে ছিঁড়বে না এই আশাতে কেউ চিঠি লিখত না। চিঠি লেখার মাঝেই যে একটা আনন্দ ছিল সেই আনন্দ থেকে কেউ আসলে বঞ্চিত হতে চাইত না। আমি নিজেও কিন্তু চিঠি লিখেছি এমন অনুরোধের আসরে। তবে আমার ভাগ্যে শিকে ছেঁড়েনি কখনও!
এ তো গেল গানের অনুষ্ঠানের খবর। এছাড়া রেডিওর আরেকটি অনুষ্ঠানের আমি ভীষণ ভক্ত ছিলাম। অন্যদের কথা জানি না। তবে আমি আর আমার বোন এই অনুষ্ঠানের নিয়মিত শ্রোতা ছিলাম। অনুষ্ঠানটি হচ্ছে ‘সাপ্তাহিক নাটক’।
শুনে নিশ্চয়ই খুব অবাক হয়ে যাচ্ছেন! রেডিওতে নাটক শোনা! সেটা আবার কী এমন মজাদার কিছু!
কেন হবে না মজাদার কিছু? আমরা এখন অডিওস্টোরি শুনছি না? এটাও তো সেরকম অডিওস্টোরির মতোই। বরং তার চেয়েও আকর্ষণীয় কিছু। কারণ এইসব রেডিও নাটকে অভিনয় করতেন দেশের নামীদামী নাট্য অভিনেতারাই। হয়ত তারা এমনিতে থিয়েটার করতেন। কেউ কেউ টিভিতেও চান্স পেতেন। তখন তো আর টিভিতে এত এত চ্যানেল ছিল না! তৈরি হতো না এত অজস্র নাটক। কাজেই এক বিটিভিতে কি আর সবাই চান্স পেতেন? কেউ কেউ ভালো অভিনেতা হওয়া সত্ত্বেও টিভিতে মুখ দেখাতে পারতেন না। তারা বেতার নাটক করে খুশি থাকতেন। আর আমরা খুশি থাকতাম তাদের দারুণ অভিনয়ের নাটক শুনে।
নাটকগুলোর কাহিনী ছিল মানসম্মত। একটা কথা আছে না? কথাটা রবীন্দ্রনাথ বলেছেন ‘শেষের কবিতা’র অমিতের বয়ানে। ‘বিধাতার রাজ্যে ভালো জিনিস কম হয় বলেই তা ভালো। নইলে তা নিজেরই ভিড়ের ঠ্যালায় হয়ে যেত মাঝারি!’
তখন জিনিস কম নির্মিত হতো। তাই ভালো জিনিসের কদর ছিল। আজেবাজে নাটক পাত্তা পেত না। ভালো লেখকদের লেখা নাটক প্রচারিত হতো। ফলে আমরা পরিচিত হতাম ‘সত্যিকারের ভালো’ কিছু জিনিসের সঙ্গে।
এই নাটকগুলো ছিল আমার প্রাণভোমরা। আমি প্রতি সপ্তাহে এই নাটকের জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকতাম। হাতে অন্য কোনো কাজ থাকলেও তা ফেলে রেখে দিতাম শুধুমাত্র মন দিয়ে এই নাটক শোনার আশায়।
রেডিওর সেই একচেটিয়া দিন অনেক আগেই ফুরিয়েছে। এখনও রেডিও কম জনপ্রিয় নয়। কিন্তু আমরা যে বেতারের সঙ্গে পরিচিত ছিলাম তা ছিল অনেক বেশি ঘরোয়া। ঠিক যেন পাশের বাড়ির মেয়েটির নরম কোমল আতিথেয়তা।
মেকি আতিথেয়তার ভিড়ে সেই ঘরোয়া আপ্যায়নটুকুর জন্য এখনো মন কাঁদে... নিরালায়...
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা সেপ্টেম্বর, ২০২৩ রাত ১০:০৭