somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ছোটগল্প- কাকতালীয়

১৪ ই নভেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:৩১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



(আমার লেখা ছোটগল্প 'কাকতালীয়' অনেকেই পড়েছেন। এইবারের বইমেলায় একটা গল্পগ্রন্থের পাণ্ডুলিপি তৈরি করেছি। তাতে নতুন কিছু গল্পের সাথে এই পুরনো গল্পটাকেও রেখেছি। বলা যায়, গল্পগ্রন্থের বিষয়বস্তুর আলোকে এই গল্পটাকে অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক মনে হয়েছে আমার কাছে।
নিজের প্রিয় বান্ধবীকে স্বামীর সাথে আলাপ করিয়ে দেওয়ার পরে কীভাবে একটি মেয়ের জীবনে গোপনে অমানিশা নেমে আসে সেটাই গল্পের প্রতিপাদ্য।
ফেসবুক জুড়ে সাকিয়া হকের গল্প ঘুরে বেড়াচ্ছে। না চাইলেও চোখ চলে যায়। পড়তে হয় কী হয়েছে তার সঙ্গে।
পরকীয়া এই সমাজের সবচেয়ে বড় দুষ্টক্ষত।
পরকীয়া এই সময়ে খুব বেশি প্রাসঙ্গিক।

গল্পটি একবারেই পোস্ট করলাম। কেউ চাইলে পড়তে পারেন।)

******
কাকতালীয়ই বটে!

কাকতালীয় নয় কি? সেদিন নীলার ওরকম করে আমার সাথে দেখা করা, তারপর আমার ড্রেসটা দেখে ওর অমন উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করা! আমিও বা কী মনে করে সেই ড্রেসটা ওকে পরিয়ে দিলাম! তারপর দুজনে মিলে একসাথে সাব্বিরের লাঞ্চের আমন্ত্রণে রওয়ানা দেওয়া... আর তারপর পথিমধ্যে... নীলার ওরকম নিথর হয়ে পড়ে যাওয়া...

বুঝতে পারছেন না নিশ্চয়ই? আচ্ছা বেশ! তাহলে গোড়া থেকেই খুলে বলি। এই পর্যন্ত পুলিশের কাছে কতবারই তো বললাম! আপনাদের কাছে আরেকবার খুলে বলা কী আর এমন বেশি কিছু! অবশ্য পুলিশের কাছে এত এতাল বেতাল গল্প করিনি। কিন্তু আপনাদের কাছে বলতে শুরু করলে কত কী বলে ফেলব কে জানে! তবু শুনুন মন দিয়ে। ঘটনাটা শোনা দরকার।


সাব্বিরের সাথে সম্পর্কটা বেশ দীর্ঘদিন ধরেই শুকনো পাতার মতো মচমচ করছিল। এটাকে জল হাওয়া খাইয়ে একটু তরতাজা করা খুব জরুরি হয়ে পড়েছিল। আমাদের দিনের মধ্যে কতটুকু সময়ের জন্য দেখা হতো তা বুঝি গুণে গুণে বলতে পারব।
সাব্বির... আমার হ্যান্ডসাম স্বামী। যেকোনো মেয়েরই পরম আরাধ্য মনের মানুষ হতে পারার সবটুকু যোগ্যতাই ওর মধ্যে ছিল। অথচ বিয়ের পর থেকেই আমাদের দাম্পত্যটা ঠিক যেন জমে উঠতে পারছিল না। সমস্যাটা যে কোথায় বুঝতে পারতাম না। আমার অতি সংসারী মন নাকি সাব্বিরের নিরেট ঔদাসীন্য... কাকে দায়ী করব জানি না!

সেই সকাল সাড়ে সাতটার মধ্যেই পাটপাট ইস্ত্রি করা রুচিশীল শার্ট প্যান্ট আর অত্যন্ত মানানসই একটা টাই পরে ফিটবাবুটি সেজে সাব্বির বেরিয়ে যায়। আমি সাড়ে ছয়টার মধ্যে উঠে ওর জন্য ব্রেকফাস্ট বানাই। টোস্ট ওমলেট জুস আর ব্ল্যাক কফি। মাঝে মাঝে ওমলেটের বদলে স্ক্র্যামল্ড এগ বানিয়ে দিই। এটা আমি খুব ভালো করে বানাতে পারি না। শুধু সাব্বির আগ্রহ করে খায় বলেই বানাতে চেষ্টা করি।
সাব্বির রুদ্ধশ্বাসে ব্রেকফাস্ট সারে। এত দ্রুত মানুষ খায় কীভাবে আমি বুঝতে পারি না। সেই তো প্রতিদিন সাড়ে সাতটাতেই বের হয়ে যায়! তবু এত ঝটপট করে খায় যে মনে হয়, আজ বুঝি তার এক আধ ঘণ্টা আগে বেরুতে হবে। আমি কতদিন বলেছি, ‘একটু আস্তে খাও না! ঘোড়ায় কি জিন পরিয়ে রেখেছ?’

সাব্বির উত্তর দেয় না। এমনিতে সে খুব কম কথা বলে। খাওয়ার সময় তো আরও কথা বলে না। আমি তার সামনে বসে চুপচাপ খেয়ে যাই। অমলেটে লবণ থাকা সত্ত্বেও বারবার লবণ ছিটাতে থাকি, টোস্টে শব্দ করে কামড় বসাই। কুড়মুড়ে শব্দে অসহ্য নৈশব্দটাকে ভেঙে খানখান করে দিতে চাই।


আমাদের বাচ্চাকাচ্চা নেই। বাচ্চাকাচ্চার কলকাকলি আমার বেশ ভালোই লাগে। চাকরিবাকরি করি না, করতেও চাই না। বাসায় বসে বাচ্চাকাচ্চা পেলেপুষে বড় করব এই ইচ্ছা আমার মধ্যে ষোলআনাই ছিল। অপেক্ষা করছিলাম কবে আমরা দুই থেকে তিন হবো!
কিন্তু সাব্বিরের দিক থেকে কোনো সদিচ্ছাই দেখতে পেলাম না। তার সেফটি সে ঠিকমতোই বজায় রাখছিল। বিয়ের তৃতীয় এ্যানিভার্সারির দিন সাব্বির আমাকে সোজাসাপ্টাই জানিয়ে দিলো, সে এখনই বাচ্চাকাচ্চা নিতে চাচ্ছে না। কারণ কেরিয়ারের এই সময়টাতে বাচ্চার দায়িত্ব ঘাড়ে নিলে সে নিজের কাজে ঠিকমত ফোকাস করতে পারবে না। কলিগরা সামনে এগিয়ে যাবে। সে পিছনে পড়ে থাকবে।
আমি অবাক হয়ে বলেছিলাম, ‘বাচ্চার দায়িত্ব কি তুমি একা ঘাড়ে নিবা নাকি? আমারও তো একটা ঘাড় আছে, তাই না?’
সাব্বির নির্বিকার মুখে বলেছিল, ‘তা আছে নিশ্চয়ই। কিন্তু বাচ্চাকে সবরকম সাপোর্ট দেওয়ার জন্য তো টাকা লাগবে! এখনই যদি এই দায়িত্ব আমাকে নিতে হয়, তাহলে আমার কেরিয়ার আর কখনোই দাঁড়াতে পারবে না!’
সাব্বিরের যুক্তিগুলো আমার কাছে যতই অযৌক্তিক লাগুক, বেশি কথা খরচ করে লাভ নেই। কারণ সাব্বির যা বলার বলে দিয়েছে। তার কথা হচ্ছে পিস্তলের গুলির মতো, মেপে মেপে খরচ করে।

দুজনের ইচ্ছা অনিচ্ছাতে এত ঘোরতর অমিল থাকার পরেও আমরা একসময় মানিয়ে গুছিয়ে চলতে আরম্ভ করলাম। সাব্বির আমার পছন্দে বাগড়া দেয় না। আমিও খুঁজে খুঁজে ওর খুঁত বের করতে যাই না। দুজনের কাছে দুজনের প্রত্যাশার আকাশচুম্বী চূড়াটাকে আমরা খুব সযত্নে কেটেছেটে রাখতে শিখলাম।
আর তার ফলাফলটা হলো দারুণ। আমি বহুদিন পরে আমার কৈশোরের অপূর্ণ নেশার পেছনে সময় দিতে আরম্ভ করলাম। আঁকাআঁকিতে ভালোই ছিলাম একসময়। কিন্তু আর সব কিছুর মতোই এটাকেও একসময় পাশ কাটিয়ে সরে এসেছিলাম। আজ এতদিন পরে অখণ্ড অবসর পেয়ে ভাবলাম, এখন আবার না হয় শুরু করা যাক! আর কিছু না হলেও সময়টা দিব্বি কেটে যাবে।


বন্ধুবান্ধবদের সাথে দেখাসাক্ষাতটা একেবারে কমিয়ে দিয়েছিলাম। এই সুযোগে সেটিও আবার শুরু হয়ে গেল। আমার স্কুলের বন্ধুরা নিজেদের মধ্যে গেট টুগেদার করত। একেকবার একেকজনের বাসায় ওয়ান ডিশ পার্টির আয়োজন করত। আমাকে ওরা সবসময়ই ডাকাডাকি করে আসছিল। কিন্তু এসব গেট টুগেদারে যেতে আমারই তেমন একটা ভালো লাগত না। তাই ওদের আমন্ত্রণ সবসময়ই ফিরিয়ে দিতাম।
ঠোঁটকাটা লিজা ফোন দিয়ে প্রায়ই বলত, ‘কীরে বান্ধবী, হ্যাণ্ডসাম বর বুঝি বউকে বগলদাবা করে নিয়েই অফিসে যায়? নাকি সবসময় চোখে চোখে রাখে? বেশ তো! তুই না এলি, আমরা যাই তোর বাসায়। নাকি বরকে বান্ধবীরা দেখে ফেলুক সেটা চাস না … অ্যাঁ! ঠিক করে বল!’

এতসব টানাহেঁচড়াতে আমি আর না বলতে পারিনি। এক মনোরম সন্ধ্যায় ওদেরকে আমার বাসায় আমন্ত্রণ দিয়ে ফেললাম। ওয়ান ডিশ পার্টি ছিল না। আমিই সারাদিন ধরে অনেক কষ্ট করে প্রচুর আয়োজন করলাম। তারপরও আমার বান্ধবীরা প্রত্যেকেই আসার সময় একটা করে ডিশ রান্না করে নিয়ে এসেছিল।

বান্ধবীদের কাছ থেকে এতদিন দূরে দূরে থাকার পরেও নতুন করে জমে উঠতে সময় লাগল না। স্কুলের বন্ধু বলে কথা! এদের জন্য মনের দুয়ারটা সবসময়ই খোলা থাকে হয়ত। আমার সাজিয়ে রাখা ঘরদোর দেখে ওদের উচ্ছ্বাস ফুরাতে চায় না।
‘এত সুন্দর টিপটপ সবকিছু! এলোমেলো করে ফেলার মানুষকে ডেকে আনছিস না কেন? ব্যস্ত বর বাবাজি সময় পাচ্ছে না বুঝি?’
আমি মৃদু হাসি। মুখে কিছু বলি না। হাসির অর্থটাকে যে যেভাবে পারে ব্যাখ্যা করে নিক।

নীলা এসেছিল ওদের সঙ্গেই। ঘরের এক কোনায় সীমাহীন কুণ্ঠা আর অস্বস্তি নিয়ে বসে থাকা নীলাকে চিনতে খুব কষ্ট হচ্ছিল আমার। সেই উচ্ছল হাসির আলো ছড়ানো মেয়েটাকে এমন ম্রিয়মাণ লাগছে কেন? স্কুলে থাকতে আমার সবচেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠতা ছিল নীলার সঙ্গেই। স্কুলজীবনের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বান্ধবীর সাথে এই এতগুলো বছরেও কেন যোগাযোগ করিনি, সেটা একটা প্রশ্নই বটে!
হিলহিলে গড়নের আমার সেই সুহাসিনী বান্ধবীটি দেখতে এখনো আগের মতোই আছে। কাজলকালো চোখদুটোতে মলিনতা জড়ো হয়েছে। তবু এখনো তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। সৃষ্টিকর্তা ভারী পক্ষপাতিত্ব করে ওর দুই চোখে জন্মকাজল পরিয়ে দিয়েছে।
লম্বা চুলগুলো সেই স্কুলজীবনের মতোই এক বেণিতে বন্দি। এই লম্বা বেণী ধরে কতদিন টান মেরে বলেছি, ‘তুই কথা না শুনলে তোর বরও এভাবে টান মারবে বুঝলি?’
এখনো হাসলে গালে সেই মিষ্টি টোলটা পড়ে। এই টোল দেখে যে কতদিন কত বখাটে আমাদের দুজনের রিক্সার পিছু নিয়েছে। দুজন সবসময় একসঙ্গে পড়তে যেতাম। আমিও দেখতে একেবারে এলেবেলে ছিলাম না মোটেও। কিন্তু নীলার মধ্যে যে একটা ‘অন্যরকম’ অপ্রতিরোধ্য ব্যাপার ছিল এটা সেই বয়সেও বুঝতে পেরেছিলাম।

নীলা পাল্টায়নি বটে, কিন্তু ওর সেই ভূবনভোলানো হাসি কোথায় যেন নিজস্ব সীমারেখা মেপে নিয়েছে। কথায় কথায় জানতে পারলাম অনেক কিছু। এতজনের হৃদয়হরিনী যার সাথে গাঁটছড়া বেধেছিল, সে তাকে সুখ দেয়নি। নানারকম নেশা করত। মদ জুয়া মেয়েমানুষ। কথায় কথায় নাকি গায়ে হাত দিতেও কসুর করতো না। সবকিছু শুনে খুব দুঃখ হলো। পুরনো সেই হৃদ্যতাটা ফিরে আসতেও সময় লাগল না। অন্য সবার আড়ালে নিজেদের মতো করেই আমরা আমাদের সেই পুরনো গাঢ় বন্ধুত্বটাকে পুনর্জীবিত করে তুললাম।

নীলা ঘনঘন আমার বাসায় আসত। আমিও হুটহাট ওর সঙ্গে দেখা করতে চলে যেতাম। আমি ওর বাসায় গেলে নীলা সংকোচে একেবারে গুটিসুটি মেরে যেত। নিজের পছন্দে বিয়ে করেছিল বলে ওর মা-বাবা নীলাকে আর মেনে নেয়নি। ছোটখাট একটা চাকরি করত। সেটা দিয়েই কোনওরকমে বেঁচেবর্তে আছে। স্কুলের বন্ধুদের সাথে যোগাযোগটা ছিল বলেই হয়ত বেঁচে গিয়েছিল একরকম। বন্ধুরা জোরজবরদস্তি করে এসব গেট টুগেদারে নিয়ে আসত। অথচ স্কুলজীবনের প্রিয় বান্ধবী হয়েও আমি এতদিন নীলার কোনো খোঁজখবর রাখিনি দেখে অপরাধবোধে মরে যেতাম।

সেই অপরাধবোধ থেকে মুক্তিলাভের আশায় আমি আরও বেশি বেশি নীলার প্রতি মনোযোগী হলাম। ওকে প্রায়ই বাসায় দাওয়াত দিতে লাগলাম। দুজন মিলে একসঙ্গে নানারকম আইটেম রান্না করতাম। রাতে খাবার টেবিলে এতরকম বৈচিত্র্য দেখে সাব্বির বিস্মিত গলায় বলত, ‘এত কিছু তুমি রান্না করেছ? ইউটিউবে রান্নাবান্নার কোর্স করছ নাকি?’
আমি হেসে বলতাম, ‘না না কোর্স ফোর্স কিছু না! আমার রন্ধনপটিয়সী পুরনো বন্ধুকে ফিরে পেয়েছি। এসব বেশিরভাগ রান্নাই ওর করা!’
‘তাই নাকি? ভালোই তো!’
সাব্বির যথারীতি একটা ‘ও’ বলেই মুখে কুলুপ এঁটে নিত। এতরকম খাবার দেখেও নিজের রসনাকে কখনো বেপরোয়া হতে দিত না। সাব্বিরের মতো কাউকেই আমি নিজের ওপরে এত প্রখর নিয়ন্ত্রণ রাখতে দেখিনি কখনো। আচ্ছা হঠাৎ কখনো সখনোও কি ওর একটু বেসামাল হয়ে যেতে ইচ্ছে করে না?

ভাবলাম একদিন নীলাকে সাব্বিরের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই। আমার এত ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে ওর সঙ্গে আলাপ করাবো না, তা কী করে হয়?
কিন্তু নীলাকে বলতেই একেবারে মিইয়ে গেল। আঁতকে উঠে বলল, ‘এ্যাই না না... প্লিজ না! সাব্বির ভাইয়ের সঙ্গে আগে দেখা হয়নি। প্রথম দেখা হওয়ার পরে যদি আমার ম্যারিটাল স্ট্যাটাসের ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করে! তুই সবকিছু বলে দিসনি তো আবার?’
‘যদি বলেও দিতাম, সাব্বিরের একেবারে বয়েই গেছে তোর মারিটাল স্ট্যাটাসের আপডেট জানার! তুই ওকে চিনিস না তাই এসব বলছিস! দেখে বড়জোর বলতে পারে... ওহ আচ্ছা আপনিই তাহলে নীলা! মজার মজার রান্নাগুলো তাহলে আপনিই করেন?... ব্যস! এটুকুই! খুব বেশি যদি কথা বলে তাহলে বড়জোর বলতে পারে, আপনার বান্ধবীকে একটু রান্নাবান্না শিখিয়ে দিয়েন তো!’
নীলা তবুও গাঁইগুই করতেই থাকে। শেষমেশ একেবারে অব্যর্থ তীর ছোঁড়ে। ‘এ্যাই সুপ্তি, শোন। আমার তো ভালো কোনো জামাকাপড় নাই। আমাকে দেখতে নিশ্চয়ই ক্ষ্যাত ক্ষ্যাত লাগে একেবারে! এভাবে কি কারও সামনে গিয়ে দাঁড়াতে ইচ্ছে করে বল?’


আমি আর কিছু বলতে পারি না। নীলার এই সেন্টিমেন্টের জায়গাটাতে আমি একেবারেই চুপ মেরে যাই। আর কেউ না জানলেও আমি তো জানি, নীলা একসময় কী প্রচণ্ড স্টাইলিশ একটা মেয়ে ছিল! সুন্দর সুন্দর জামাকাপড় ওর একটা প্যাশনের মতো ছিল। সে ছিল ধনাঢ্য বাবার সন্তান। একেক দিন একেকটা জামা পরে বের হতো। আমি তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতাম। নিটোল সুন্দর নীলাকে দেখে আমার চোখ সরতে চাইত না।

আজ ধনী বাবার আশ্রয় থেকে বের হয়ে কত দীনহীন অবস্থার মধ্যেই না পড়েছে বেচারি! সুন্দর পোশাক পরিহিত সেই নীলাকে মনে মনে কল্পনা করে আমিও একটু কেমন জানি অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম। তাই তো! আমার অপরূপা স্নিগ্ধ সেই বান্ধবী আজ জীবনের এ কোন বাঁকে এসে দাঁড়িয়েছে! ওর পক্ষে তো এতটা বিপর্যয় এত সহজে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়!

কিছু একটা তাড়না বোধ করলাম ভেতর থেকে। অনেকটা জোর খাটিয়েই নীলাকে নিয়ে এলাম দামী সুপারমলে। আমি নিজে চাকরিবাকরি কিছু না করলেও ততদিনে সফল কর্পোরেট স্বামীর দাক্ষিণ্যে কেনাকাটা ভালোই করি। দেশীয় দামী ব্রান্ডের কাপড় ছাড়া কোনোকিছুই গায়ে উঠাই না।
নীলাকে সেইরকমই একটা দোকানে ঢুকিয়ে বললাম, ‘ইচ্ছেমতন শপিং কর! দাম নিয়ে ঘাবড়াবি না। যার সাথে আলাপ করিয়ে দিব, ধরে নে এসব সবকিছুই তার তরফ থেকে উপহার। আপত্তি করলে এই থাকলি তুই, এই থাকলাম আমি। মাঝখানে এঁকে দিলাম সীমারেখা। জীবনেও আর কখনো তোর ছায়া মাড়াব না।

এত বড় কসম দেওয়ার পরে নীলা একেবারে চুপ মেরে গেল। কিছুক্ষণ হতবুদ্ধির মতো দাঁড়িয়ে থাকার পরে নিরুপায় হয়ে শেষমেশ শপিংয়েই মন দিলো।
দীর্ঘদিন পরে মন ভরে পছন্দের জামাকাপড় কিনতে পেরে নীলার মুখ খুশিতে ডগমগ করছিল। আনন্দ ফুটে বেরুচ্ছিল তার সর্বাংগ দিয়ে। ওর এই আনন্দ দেখে আমিও আত্মতৃপ্তিতে ভেসে যাচ্ছিলাম। সুন্দর পোশাকে আবৃত হতে চাওয়া মেয়েটি কতদিন পরে সাধ মিটিয়ে পোশাক কিনল! আজ নিশ্চয়ই ওর একটা স্পেশাল দিন!

কিন্তু সম্ভবত সেই দিনটি আমাদের দুজনের জন্যই স্পেশাল ছিল। কারণ... সেই দিনটি না এলে আজ হয়ত আমাকেও এই কাহিনীটা শোনাতে বসতে হতো না।

আগেই বলেছি নীলা প্রায়ই আমার বাসায় আসত। আমি ওর বাসায় গেলে নীলার মুখেচোখে যে গ্লানি আর লজ্জা ফুটে উঠত, সেটা এড়াতে আমিই ওকে এটা সেটা বলে নানাভাবে আমার বাসায় নিয়ে আসতাম।
প্রচুর কথা বলত নীলা। বহুদিন পরে বুঝি ওর মনের আগলটাকে কেউ হ্যাঁচকা টানে খুলে দিয়েছিল। সেই খোলা আগল দিয়ে হুড়হুড় করে আলো হাওয়া ঢুকত। মুক্ত হাওয়ায় সে প্রাণভরে শ্বাস নিত।

তারপর আসি সেদিনের কথায়। সাব্বিরের সাথে ওকে আলাপ করিয়ে দেওয়ার জন্য সেদিন রাতটা নীলাকে আমার বাসায় থেকে যেতে বললাম। সাব্বিরকে কথাটা আগেই জানিয়েছিলাম। সে সম্মতি জানিয়ে অল্প কথায় নিজের দায়িত্ব সেরে নিয়েছে। বলেছে, ‘বন্ধুকে এক দিন রেখে দিবা, এটা তো ভালো কথা! আমার আপত্তি থাকবে কেন?’
আমার ইচ্ছে ছিল সেদিন আমরা ডিনার করে কোথাও ঘুরতে যাব। আমার বাসার পাশেই যমুনা ফিউচার পার্ক। বিয়ের একেবারে প্রথমদিকে সাব্বির মাঝে মাঝে আমাকে সিনেমা দেখাতে নিয়ে যেত। আজ একবার আমার প্রিয় বন্ধুর সৌজন্যে কি নিয়ে যাবে না? তবু মনে মনে ঠিক করলাম, সাব্বির নিজে থেকে না বললে আমিও আগ বাড়িয়ে কিছু বলতে যাব না। আমার সম্মানের চেয়েও আমার বন্ধুর সম্মান আমার কাছে বড়।


যা ভেবেছিলাম তাই হলো!
জানি না, সাব্বিরের মতো রসকষহীন একজন মানুষের সাথে বিধাতা কেন আমার গাঁটছড়া বেঁধে দিলো! মাঝে মাঝে হাঁপিয়ে উঠতাম ওর অদ্ভুত সব ঔদাসীন্যে। নীলাকে দেখে শুকনো একটা হাসি দিয়ে শুধু বলল, ‘আপনি ভালো আছেন? সুপ্তির মুখে আপনার কথা শুনেছি!’
নীলা আরেকটু কুণ্ঠিত হলো। সেই কুণ্ঠা সাব্বিরের নিরাসক্ততায় নাকি নিজের মেপে রাখা সামর্থ্যের দৈন্যতায়.. আমি সেটা বলতে পারব না। বন্ধুর সেই কুণ্ঠিত অপমানিত মুখের দিকে তাকিয়ে আমি মনে মনে নিজেকে আর নিজের ভাগ্যকে ধিক্কার দিলাম।


তবুও বহমান দিনগুলোতে সান্ত্বনার মলম মাখিয়ে সেগুলোকে যথাসম্ভব ক্ষতমুক্ত করে তুলছিলাম।
নীলার সাথে আমার বন্ধুত্বে ভাটা পড়ল না, তবু অদ্ভুত একটা দূরত্বও আমি ঠিকই টের পাচ্ছিলাম। নীলা আর আগের মতো ডাকলেই যখন তখন চলে আসে না। বাইরে কোথাও যাওয়ার প্রস্তাব দিলেও গড়িমসি করে। একেকদিন একেকটা অজুহাত দেখায়। আমি বুঝতে পেরেছিলাম, সাব্বিরের শীতল ঔদাসীন্য ওকে ভেতরে ভেতরে থমকে দিয়েছিল। আমি মনে মনে সাব্বিরের থেকে আরও অনেকখানি দূরে সরে গেলাম। এতদিন পরে প্রিয়বন্ধুকে পেয়েও তাকে নিজের ভুলেই হারিয়ে ফেললাম!

অথচ এত কিছু সত্ত্বেও সাব্বিরের মধ্যে কোনো ভাবান্তর দেখতে পেলাম না! সে যেন আপন ভুবনেই মেতে ছিল। প্রতিদিন সকালে ফুরফুরে মেজাজে অফিসে বের হয়। যত দিন যাচ্ছে, তার স্ফূর্তি আর চেহারাতে যেন নতুন জেল্লা ফুটে বেরুচ্ছে। একদিন জিজ্ঞেস না করে পারলাম না, ‘অফিসে খুব ভালো সময় কাটছে বুঝি? এত খুশি খুশি থাকছ ইদানিং!’
সাব্বিরের মুখে হাসির ঝিলিক। আমি নিজের চোখদুটোকেই একবার ভালো করে কচলে নিই। ভুল দেখলাম না তো! রসকষহীন মানুষটা আজকাল বেশ হাসতেও শিখেছে দেখছি!

দেখতে দেখতে কয়েক মাস চলে গেল। আমি আবার সেই পুরনো নিঃসঙ্গতায় ডুবে গেছি। আঁকাআঁকির সঙ্গে নতুন করে সখ্য গড়তে পারিনি। হয়ত কিছু জিনিস যখন জীবন থেকে বিদায় নেয়, তখন একেবারেই নেয়। আমি যেটাকে একদিন অবহেলাভরে দূরে সরিয়ে দিয়েছি, সেটা যে কখন আমার হাতের মুঠো গলে পালিয়ে গেছে তা জানতেও পারিনি।
নীলাকে আজকাল আর একদমই পাই না। ফোন দিলেই তড়িঘড়ি কথা শেষ করতে চায়। বুঝতে পারলাম, হয়ত ওর কাছেও আমার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে।

এর মাঝে আচমকা অপ্রত্যাশিতভাবেই আমি সাব্বিরের নতুন করে মনোযোগ কাড়তে সক্ষম হলাম। অবশ্য নতুন করে কথাটা বলা কি ঠিক হচ্ছে কী না বুঝতে পারছি না। আমি কবেই বা সাব্বিরের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলাম! তবে জানি না কেন, ইদানিং সে আমাকে যথেষ্ট সময় দিতে শুরু করেছে। একদিন বেশ আবেগঘন ভাষায় সে তার জীবনের দীর্ঘ কিছু বাক্য উপহার দিলো আমাকে।
‘সুপ্তি, আমি বুঝতে পারছি… তুমি আজকাল অনেক বেশি মনমরা হয়ে থাকো। আমার হয়ত তোমার প্রতি আরেকটু মনোযোগী হওয়া উচিত!’
আমি অপাঙ্গে তাকিয়ে দেখলাম সাব্বিরকে। মনে মনে মেলাতে চেষ্টা করছিলাম, ঠিক মানুষটাকেই দেখছি তো? হ্যাঁ... এ তো দেখি সেই সাব্বিরই! আমার স্বামী। যার নামের সঙ্গে প্রায় চারবছর আগের কোনো এক বসন্তদিনে ভুল করে আমার নামটি জুড়ে গিয়েছিল। আমি সাব্বিরের দিকে তাকিয়ে কৌতুক করে বললাম, ‘তা কীভাবে আমার প্রতি মনোযোগ বাড়াতে চাও?’

সাব্বির ঘনদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো। আমি রীতিমত অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম। সে গভীর চোখে আমাকে দেখতে দেখতে বলল, ‘চলো একদিন আমরা একসঙ্গে বাইরে কোথাও লাঞ্চ করি।’
আমি এবার সজোরে বিষম খেলাম। যা শুনলাম ভুল শুনলাম না তো? থতমত খেয়ে তাকালাম সাব্বিরের দিকে। ওর চোখের দৃষ্টি দেখে অবশ্য নিশ্চিত হলাম, আমি মোটেও ভুল কিছু শুনিনি!


অনেকক্ষণ ধরে হাবিজাবি বকরবকর করলাম। গল্পের ইতিটুকু তো শুরুতেই বলে দিয়েছি। এবারে সেটাকে আরেকবার ঝালাই করে নিই আপনাদের কাছে। হয়ত এতক্ষণের এত দীর্ঘ বকবকানিতে সেই ক্লাইম্যাক্সের কথা ভুলেই গেছেন আপনারা!

সেদিন বেশ অনেকদিন পরেই নীলা হুট করে বাসায় এলো। আমার ড্রেসটা দেখে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করছিল নীলা।
‘ইস! কী দারুণ রে জামাটা! কোথা থেকে কিনেছিস?’
‘জানি না। আমি কিনিনি। সাব্বির কিনে এনেছে আমার জন্য!’
‘ওমা! কী ভালো রুচি সাব্বির ভাইয়ের! ইস এই ড্রেসটাতে তোকে কী যে দারুণ দেখাবে!’
আমি তাকিয়ে তাকিয়ে নীলার উচ্ছ্বাস দেখছিলাম। সুন্দর জামাকাপড়ের প্রতি মেয়েটার প্রচণ্ড ভালবাসা এখনও আগের মতোই আছে!

ও হ্যাঁ, নীলাকে কিন্তু মিথ্যে কথা বলিনি। সাব্বির সত্যিই আগের চেয়ে অনেক বেশি মনোযোগ বাড়িয়ে দিয়েছে আমার প্রতি। নীলার হাতে ধরা এই আনারকলি ড্রেসটা সেদিন ওই তো নিয়ে এসেছিল! ডিপ মেরুনের ওপরে সোনালী সুতার কাজ করা জামাটা সত্যিই ভীষণ অন্যরকম। চোখদুটো রীতিমত আটকে যায় ড্রেসটার ওপরে। কিছুতেই আর সরানো যায় না। আমি ড্রেস পেয়ে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘হঠাৎ ড্রেস কেন?’
‘আনলাম! আনতে পারি না? ভুলে গেছ, আগামী শনিবার আমাদের বিয়ের চতুর্থ বার্ষিকী? ঐ দিন আমরা বাইরে লাঞ্চ করব। তুমি এই ড্রেসটা পরে আসবে!’
বিবাহবার্ষিকী! আচ্ছা তাই নাকি? এটাও তাহলে মনে রাখার মতো বিষয় ছিল? বিস্ময়ের ঘোর যেন কিছুতেই কাটছে চাইছে না আমার!

নীলার উচ্ছ্বাস দেখতে দেখতে হঠাৎ মুখ ফসকেই বলে বসলাম, ‘তুই পরবি ড্রেসটা? তোকে দারুণ মানাবে!’
নীলার মুখে আলো ছায়া দোলা দিলো। এক নিমেষে খুশিতে উদ্বেল হয়েই সাথে সাথে খুশিটাকে সংযত করে নিয়ে বলল, ‘আমি! না না! এটা সাব্বির ভাই তোকে গিফট করেছে। আমি কেন পরব?’
‘পর না! আমার চেয়েও তোকেই বেশি মানাবে! চল আজ তোকে একটা জায়গায় নিয়ে যাব।’
‘কোথায়?’
‘আরে আগে চলই না! এত প্রশ্ন করলে চলে?’


তারপরের অংশটুকু বেশ সংক্ষিপ্ত।
নীলাকে নিয়েই সেদিন সাব্বিরের লাঞ্চের দাওয়াত রক্ষা করতে যাচ্ছিলাম। নীলাকে পরিয়েছি মেরুন সোনালীর সেই অদ্ভুত সুন্দর আনারকলিটা, যেটা সাব্বির বিশেষভাবে শুধু ‘আমার’ জন্যই এনেছিল! আমি পরেছি দুধসাদা রঙের সিল্কের একটি টু পিস। সঙ্গে মাল্টিকালারের তসর ফুলকারি ওড়না। আমি আড়চোখে বারবার নীলাকে দেখছিলাম। কী সুন্দর লাগছে মেয়েটাকে! কী দারুণ মোহময়ী... অপরূপা অপ্সরা আমার বান্ধবীটি! এমন অসাধারণ সুন্দর পোশাকে তো ওকেই মানায়!

হঠাৎ ভীষণ জোরে শব্দ হলো। দুম! দুম! দুইবার! বন্দুকের শব্দ কি? কে গুলি চালাল? কোথা থেকে কেন? ঐ...ঐ তো... গুলি করেই মোটরসাইকেলে করে দুটি ছেলে হাওয়া হয়ে গেল। চোখের পলকেই!
আমি হতবুদ্ধি হয়ে নীলাকে কিছু বলতে গিয়েই দেখি... এ কী! নীলার সারা শরীর রক্তে ভেসে যাচ্ছে! সারা শরীর দুমড়ে মুচড়ে কংক্রিটের রাস্তায় নীলা পড়ে আছে। ওর মেরুন রঙ্গা আনারকলিতে লাল রঙের রক্ত অদ্ভুত আলপনা তৈরি করছে। মুহূর্তের মধ্যেই বারবার সেই আলপনার নকশা পাল্টে যাচ্ছে। অদ্ভুত অন্যরকম একটা দৃশ্য। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মতো সেদিকে তাকিয়ে থাকলাম।

আমি বিস্ময়ভরা আকুলতায় নীলাকে দেখছি। রাস্তায় একটু একটু করে লোক জড়ো হচ্ছে। আমার ড্রাইভার সবে গাড়ির দরজা খুলে দিয়েছিল আমাদের জন্য। সেও তখন ছুটে এসে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে আছে।
আমি চিন্তা করতে পারছি না। আমি কি জ্ঞান হারাবো?
এই মুহূর্তে কি আমার জ্ঞান হারানোটাই সবচেয়ে ভালো হবে?
আপনাদের মতামত কী বলুন দেখি!

নীলাটা সবসময়ই সুন্দরের প্রতি আকৃষ্ট ছিল। সুন্দর জামাকাপড়, সুন্দর ঘরবাড়ি, সুন্দর মানুষ... শুনেছিলাম ওর বরটাও নাকি বেশ সুন্দরই ছিল দেখতে। সুন্দর মাকাল ফল!
এত বেশি সুন্দরের প্রতি আকাঙ্ক্ষাই কি তবে কাল হলো? আমার ছোটবেলার প্রিয় বান্ধবী কি এই সুন্দরের কাছেই নিজেকে বিকিয়ে দিলো?

আমি সবকিছু জানতে পেরে গিয়েছিলাম। যদিও আগেই আন্দাজ করেছিলাম। নিজের ওপরে প্রখর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারা আমার হ্যাণ্ডসাম স্বামীটিও পা ফসকে ফেলেছিল। এমনটাই ধারণা করেছিলাম আমি। আর সেই ধারণা আমার ভুল হয়নি। সেটা নিশ্চিত হয়েছি পরে।
আমি জানতাম, সাব্বির আমাকে কখনোই ভালোবাসত না। আমার প্রতি ওর ওরকম ভীষণ নিস্পৃহতা আসলে একটা আড়াল ছিল মাত্র। নিজের মা-বাবার সিদ্ধান্তে সে আমাকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছিল। ভালবাসতে পারেনি। ভালোবাসার গোলাপ কি সব গাছে ফোটে?
নীলার টোলপরা হাসিমুখ দেখে সাব্বিরও গলে গিয়েছিল। ওর মতো শক্তমুখো মানুষও ঐ ডাইনির রূপে বিভোর হয়েছিল। আর নীলা! সে তো সুন্দরের কাছেই নিজেকে আজন্ম বিকিয়ে দিয়ে বসে আছে! আমার সুন্দর ঘরবাড়ি সুন্দর স্বামী... এসব যে ওর চাই!
আমাদের বন্ধুত্বটাও যে বড্ড সুন্দর ছিলরে নীলা! সেটাকে দেখতে পেলি না কেন বল দেখি?

আর সেই মেরুন রঙ্গা আনারকলি! বেচারা আনারকলি যদি জানত, বলি হওয়ার জন্যই তাকে পাঁঠা বানানো হয়েছিল! কে তাকে ধারণ করবে এটা তো তার ঠিক করে দেওয়ার ক্ষমতা ছিল না! তাই সেই ক্ষমতা আমিই হাতে নিয়েছিলাম।
সাব্বিরের মতো চৌকষ একজন মানুষের কাছ থেকে আরেকটু বুদ্ধিদীপ্ত কিছু আশা করেছিলাম আমি। এত গড়পড়তা ছক কষে আমাকে সরিয়ে দিতে চাওয়াটা খুব বড় বোকামি হয়ে গিয়েছিল। চার বছরেও যে আমাকে একটা গোলাপ কখনো উপহার দেয়নি, সে কী না দিয়ে বসল আস্ত একটা আনারকলি!

এরপরের অংশটুকু তো বুঝতেই পারছেন!
আমি এক আবেগঘন বার্তা পাঠালাম আমার প্রিয় বন্ধুকে। ওদের দুজনের আবেগঘন মেসেজগুলো যে ফাঁকতালে কিছু কিছু আমিও পড়ে ফেলেছি, এটা আর খুলেমেলে ব্যাখ্যা করতে গেলাম না। আপনারা তো নিশ্চয়ই সেটা ভালোভাবেই বুঝতে পেরে গেছেন!
বন্ধুকে লিখলাম, ‘আজ প্লিজ একবার আয়। তোকে কতদিন দেখি না! আমার শরীরটা খুব খারাপ থাকে প্রায়ই। হয়ত আর বাঁচব না বেশিদিন। একবার আয়। দুই বন্ধুতে মিলে একটু প্রাণভরে গল্প করি!’
আবেগের ডোজে কাজ হলো। বন্ধু চলে এলো। তার চোখ আটকে গেল... ঐ... সেই সুন্দরেই!
হায়রে সুন্দরের পূজারিণী! ঐ সুন্দরই তো তোকে শেষ করে ফেলল!

সাব্বির আমাকে অক্ষত দেখে সৃষ্টিকর্তাকে খুব করে ধন্যবাদ জানালো, আর নিষ্পলক চোখে নীলার দিকে তাকিয়ে থেকে মনে মনে হয়ত মেলাতে চেষ্টা করল, ওর অত সাধ করে কেনা আনারকলি ওখানে গেল কেমন করে!


শুনলেন তো গল্পটা। এখন আপনারাই বলেন দেখি আমি কি পুলিশকে এতকিছু খুলেমেলে বলেছি? সাব্বিরকেই কি খুলে বলেছি আনারকলি ঐখানে কীভাবে গেল! নীলাই বা সেদিনই আমার সঙ্গে দেখা করলো কেন?

ভাবছেন কি, আমি সত্যি কথাটা বলে দিব? বলব যে নীলাকে আমিই ডেকে এনেছি? আনারকলিও আমিই একরকম জোর করে ওকে পরিয়েছি? কারণ ঐ আনারকলিই যে আমার তুরুপের তাস!

না না কক্ষনো না!
এই যে এত এত কাকতালীয় যোগাযোগ সেদিন এক সাথে জুড়ে গেল, এটা কেন আপনারা দেখতে পাচ্ছেন না বলুন দেখি?

আমি তো পুলিশকে বলেই দিয়েছি, পুরোটাই কাকতালীয়! অন্য কিছুই নয়!

(প্রকাশকাল- ১৬ই জানুয়ারি’ ২০২৩)




সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই নভেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:৩২
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দ্যা এডামেন্ট আনকম্প্রোমাইজিং লিডার : বেগম খালেদা জিয়া

লিখেছেন ডি এম শফিক তাসলিম, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:০৪

১৯৪৫ সালে জন্ম নেয়া এই ভদ্রমহিলা অন্য দশজন নারীর মতই সংসার নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, বিয়ে করেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের অন্যতম সুশাসক শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান কে! ১৯৭১সালে এ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

×