খালেক সাহেব একজন রিটায়ার্ড ব্যাংকার। বয়স ৬০। গতকালও উনার বয়স ৫৯ ছিল। আজই ষাটের কোঠায় পা রাখলেন তিনি। একটামাত্রই মেয়ে তাঁর, রিমি। মেয়েতো নয়, যেন সাক্ষাত মা। অনেক আদরের। আর আদরের হবেই বা না কেন? পরপর দুটো বাচ্চার জন্মোত্তর মৃত্যুর পরে মসজিদে/মাজারে অনেক কেঁদেকেটে, অনেক দান-সদকার বিনিময়ে এই মেয়েটাকে বাঁচিয়েছেন তিনি। তাছাড়া বাবার একমাত্র সন্তান বলে কথা!
আজ খালেক সাহেবের জন্মদিন। আগেই বলেছি, ষাটের কোঠায় পা দিলেন খালেক সাহেব। দেখতে দেখতে কিভাবে এতগুলো বছর পার করে ফেললেন! সময়গুলো কতো তাড়াতাড়ি কেটে যায়! আজ মনে হচ্ছে যেন কোন টাইম মেশিনে চড়ে ষাট বছরের যাত্রা ষাট মিনিটে সেরে এলেন মাত্র!!
মেয়েটাও কিভাবে যেন হুট করে বড় হয়ে গেছে! এইতো যেন সেদিন, পাশের বাসার নটখটে প্রতিবেশীটার বাসায় বউ আর আট মাসের রিমিকে নিয়ে ঘুরতে গেলেন। হঠাত্ বউয়ের কোলে মেয়েটার পেটের ভেতর থেকে খুব পরিচিত সূক্ষ্ম একটা আওয়াজ!:p বুঝতে বাকি রইল না কি ঘটতে চলেছে। যে খটখটে প্রতিবেশী! এখানে বাচ্চাটা হাগু করে দিলেই বাধবে লঙ্কাকান্ড। সাথে সাথে নিচে হাত পেতে দিলেন এবং মেয়েটার সমস্ত ইয়ে (!) উনার দুইহাত কোষ বানানো ভাসমান হাওয়াই কমোডের মধ্যে...!
ভাবতেই উনার হাসি আসতে লাগল। আর আজ এই মেয়েটা কতোবড়। হাঃহাঃ সময় কতো তাড়াতাড়ি চলে যায়।
মেয়েটার বুদ্ধি হবার পর থেকেই খালেক সাহেবের প্রতিটি জন্মদিনে কিছু না কিছু একটা সারপ্রাইজ দিয়েই আসছে। কখনোই ভোলেনা। হয়তো খুব দামী বা উল্লেখ করার মতো কিছু না। কিন্তু একমাত্র মেয়ের আয়োজন বলে কথা।
এইতো, গত জন্মদিনে রাত ১২ টা ০১ মিনিটে উনার ফোনে একটা এসএমএস। রিমির!! "বাবা ফেবুতে যাও।" কি আবার হল? এত রাতে ফেবুতে কি? মেয়ে বলেছে বলে কথা! ফেবুতে গিয়েতো উনি ভীষণ আবেগাপ্লুত! মেয়ে বাবার জন্মদিনে বাবাকে উইশ করে এবং বাবার সাথের অনেক অতীতস্মৃতিচারণ করে বাবা-মেয়ের একটা সেলফি আপ করে স্ট্যাটাস দিয়েছে! আবেগে চোখের কোনের তরল রুখে রাখতে পারলেন না খালেক সাহেব।
কিন্তু কমেন্টবক্স চেক করে বিপুল আক্রোশে ফেটে পড়েছিলেন তিনি। কতগুলো ছেলে 'হ্যাপি বার্থডে ড্যুড / শুভ জন্মদিন বাডি / লং লিভ আংকেল টম' ইত্যাদি লিখে উইশ করেছে।
এই নতুন 'হ্যালো বাডি-হেই ড্যুড' জেনারেশনটার প্রতি অনেক অভিযোগ-অনীহা খালেক সাহেবের। বাবার বয়সী মানুষকে কিভাবে বাডি/ড্যুড বলে সম্বোধন করে? কি হয়ে আজকালকার জেনারেশনের? একটু আদব কায়দা করে চললে কি এমন ক্ষতি হয়? আমাদের সময়তো বাবা-কাকাদের রাস্তায় দেখলেও ছুঁট লাগাতাম পালিয়ে বাঁচতে; কথা বলা পর্যন্ত দুরে থাক। কই, আমার রিমি মা-টাতো এমন না? খুব শ্রদ্ধা করে মুরুব্বিদের। অনেক সংস্কারি আর আচারঞ্জানসম্পন্না। আত্মীয় স্বজনদের মাঝে কতো সুনাম মেয়েটার। ভাবতেই বুকখানা চওড়া হয়ে ওঠে।
যাক... আজকেও মেয়েটা রাত ১২ টায় ফেবুতে স্ট্যাটাস দিয়েছে বাবাকে নিয়ে। তবে আজ বাডি-ড্যূড ফলোয়ারগুলোকে এভয়েড করার জন্য শুধু 'শেয়ার উইথ ফ্রেন্ডস' দিয়ে স্ট্যাটাস দিয়েছে। বেশ হয়েছে! একদম উচিতকর্ম।
আমার মেয়ে বলে কথা! আমার মতো হবেনা তো কার মতো হবে?
এদিকে আবার মেয়েটার বিয়ের চিন্তায় ঘুম হারাম খালেক সাহেবের। আর দুই/এক বছরের মধ্যেই বিয়ে দিয়ে দিবেন মেয়েটাকে। তবে ভাবতেই বুকটা ভারী হয়ে ওঠে। এত আদরের মেয়েটাকে ছেড়ে থাকবেন কি করে? তবুও, বিয়েতো দিতেই হবে। প্রকৃতির নিয়ম। দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন খালেক সাহেব।
ভালো রীতি-সংস্কারসম্পন্ন ছেলে দেখে বিয়ে দেবেন তিনি মেয়েকে। একটু ব্যাকডেটেড হলেও আদব কায়দা থাকা চাই। হয়তো বিয়ে করতেই চাইবেনা মেয়েটা। বাপকে ছেড়ে থাকতে পারবেতো? নাহ্। বুকে পাষাণ বেঁধে হলেও........ এসব ভাবতে ভাবতেই ঘুম এসে যায় তাঁর।
সকালে ঘুম থেকে অনেকটা জোরজবরদস্তি করেই ঘুম থেকে উঠিয়ে দিলেন স্ত্রী রাহেলা বানু। “কি হল আবার? এত সকাল সকাল কি?” “আরে রিমি বলেছে তোমার জন্য নাকি কি একটা সারপ্রাইজ আছে। বাইরে বেরুনোর সময় বলে গেছে তাড়াতাড়ি উঠিয়ে দিতে।” জবাবে তাঁর স্ত্রী।
সারপ্রাইজের কথা ভাবতেই আনন্দে বাকবাকুম করে ওঠে খালেক সাহেবের মন। ইচ্ছে করছে নাচতে শুরু করে। কিন্তু নাহ্, এই বয়সে এসব একদম হাস্যকর। কি ভাববে বউ অথবা কাজের বুয়াটা দেখে ফেললে? ওরা না থাকলে একবার চেষ্টা করে দেখা যেত।
থাক, এই প্ল্যান রিজেক্টেড।
এসব বাজে চিন্তা বাদ উঠে বাথরুমে গিয়ে লম্বা একটা শাওয়ার নিলেন। তারপর নতুন জামাকাপড় পরে রেডি হয়ে নিলেন। মনটা অনেক শান্ত লাগছে এখন। ডাইনিংয়ে খাবার এলেও খেলেন না। গিয়ে সোফায় বসে পড়লেন। মেয়ে আসলে খাবেন।
অপেক্ষার পালা এখন। আচ্ছা অপেক্ষা জিনিসটা এত বিরক্তিকর হয় কেন? সৃষ্টিকর্তা যতোটা না সুন্দর করে এই পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন; ততোটাই কুশ্রী কিছু জিনিসও রেখেছেন। এসব ভাবছেন সোফায় বসে বসে।
হঠাত্ বেজে উঠল কলিংবেল। লাফ দিয়ে সোফা থেকে উঠে বসলেন। নতুন পাঞ্জাবীটা টেনেটুনে ভাঁজ সোজা করে নিলেন। ইতোমধ্যে স্ত্রী দরজা খুলে মেয়েকে আসতে দিলেন ভিতরে।
ওমা!
মেয়েতো নয়, যেন সাক্ষ্যাত্ ডানাকাটা একটা পরী! শাড়ি পরেছে, খোপায় ফুল গুঁজে রেখেছে। হতবিহ্বল হয়ে চেয়ে রইলেন খালেক সাহেব। এ যেন তাঁর মা স্বয়ং স্বর্গ থেকে নেমে এসেছেন।
ঘোর কাটতেই মাথায় একটা চিন্তা চলকে উঠল! কই সারপ্রাইজ? কি যেন সারপ্রাইজ দেবে বলেছিল না? নাকি রাহেলা ভুল শুনেছে? এই বুড়া হলে আজকাল যা হয় আর কি!
হঠাত্ মেয়েটা এসে ঝুঁকে বাবার পা স্পর্শ করে সালাম করল। বাবাকে জড়িয়ে ধরে 'লাভ ইউ বাবা' বলল। খুশিতে খালেক সাহেব তখন কল্পনাচক্ষে দুনিয়া ছেড়ে তারার দেশে রওয়ানা হলেন।
এবার মেয়ে “চলো বাবা, তোমার জন্য সারপ্রাইজ আছে” বলেই তাঁর চোখ দুটো দুই হাত দিয়ে চেপে ধরল। তিনিও উঠে মেয়ের সাথে সাথে হাঁটতে শুরু করলেন। খানিকটা উত্তেজিত। মেয়ে তখনও বলে চলেছে,“উঁহুহ চোখ খোলা যাবেনা। একটু ধৈর্য্য ধরো......” তারপর, দরজার কাছে পৌঁছে গেলেন। এক হাত দিয়ে চোখ দুটো আড়াল করে আরেক হাতে দরজার হাতলটা ধরে মেয়েটা এক মুহুর্তের জন্য কি যেন ভাবল। তারপর লক খুলে হাতলটা নিচে নামিয়ে আস্তে আস্তে অনেকটা হরর মুভিগুলোর মতো স্লো মোশনে দরজাটা খুলতে লাগল।
পুরো দরজাটা খুলে যেতেই মেয়েটা এক লাফে বাইয়ে চলে এল এবং বালিকা তাহার বাবাকে বলিল,“সারপ্রাইজ! তোমার জামাই ইয়ো ইয়ো কিডস!”
বালক হস্তদ্বয় প্রসারিত করিয়া অনেকটা চ্যাগানোর ভঙ্গি করিয়া বলিয়া উঠিল,“ইয়ো বাপস, ইয়ো ইয়ো।” (মনে হয় শ্বশুর মশাইকে ইয়ো ইয়ো কায়দায় সালাম জানাইল)
বালিকা বলিল,“বাবা ও দারুণ না?”
খালেক সাহেব জবাব দেওয়ার আগেই জবাবহীন হইয়া পড়িল। মনে হইল উনার পদতলের মাটি থরথর করিয়া কাঁপিতেছে। ঠাস করিয়া পশ্চাত্ অভিমুখে গমনারম্ভের সহিত হার্ট এটাক খাইলেন জীবনে প্রথমতমবারের মতো।
অতঃপর জ্ঞান ফিরিবার পর নিজেকে হসপিটালের বেডে আবিস্কার করিলেন। এবং সাথে সাথেই বালক আসিয়া বলে,“হেইইই, ওয়েলকাম ব্যাক বাপস। চলেল একটা সেলফি তুলি।”
এই কথা শুনিবামাত্র খালেক সাহেবের মনে হইল এইবার তাহার বেড কাঁপিতেছে থত্থর করিয়া। এবং আবারও কোমাগমণপূর্বক বেডঅভিমূখে যাত্র আরম্ভ করিলেন।
খানিক পর পূণরায় জ্ঞান ফিরিল খালেক সাহেবের। তবে এইবার খুব বুদ্ধির পরিচয় দিলেন তিনি। ঝিম মারিয়া চক্ষু মুদিয়া পড়ি রহিলেন। ভাবখানা এমন, যেন উনি এখনও ধরাধামে অবতীর্ন হইতে পারেন নাই।
ঝিম মারিয়া পড়িয়া না থাকিয়া কোন উপায় আছে? অলরেডি দুইবার হার্ট এটাক খাইয়া ফেলিয়াছেন। এইবার যে তাহার শেষবার! এখন চক্ষু মেলিয়া ওই ইয়ো ইয়োর মুখদর্শন হইবামাত্র মৃত্যুর মুখে ঢলিয়া পড়িবেন খালেক সাহেব, দ্যা এক্স ব্যাংকার। আর কয় মিনিট যা বেশি বাঁচিয়া থাকিতে পারেন, তাহাই লাভ।
মড়া হইয়া পড়িয়া রহিলেন নিখুঁত অভিনয়ের মাধ্যমে, আর মনে মনে গাহিতে লাগিলেন, 'মরিতে চাহি না আমি সুন্দর এ ভুবনে.......'