ব্যস্ততা কেড়ে নিচ্ছে আধুনিক মানুষের সময়। এত বেগ, এত কম আবেগ কম দেখা গেছে এর আগে। হাতে হাতে চলে এসেছে স্মার্ট ফোন, ঘরে ঘরে কম্পিউটারে ইন্টারনেটে কাজ করার সুযোগ। অতি কথন শুনার বা বলার মানসিকতার পরিবর্তন ঘটে গেছে। মানুষ এখন omg দিয়ে oh my god বুঝে নেয়, লোকেরা এখন hru ব্যবহার করে।
কিন্তু থেমে থাকেনি সাহিত্য চর্চা। এখানেও এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। মহাকাব্যের যুগ আর নেই। কবিতায় অতিকথন এখন প্রসংশিত নয়। বৃহৎ পরিসরে পুরো ইতিহাস ঘেটে কল্পনার মাধূর্যতা মাখিয়ে বড় বড় মহাকাব্যিক কাহিনী এখন আর বর্ণিত হতে দেখা যায় না। উপন্যাসের ব্যাপক জনপ্রিয়তা থাকা সত্ত্বেও ছোট গল্প এসেছিল রবীন্দ্র যুগে বরং বলা চলে তার হাত ধরে।
কিন্তু পাঠকের হাতে সময় কম। তারা এখন ছোট গল্প পড়ার অবসর পান না। লেখকরাও কম যান না তারা ছোট গল্পকে আরও ছোট করে নিয়েছে অনুগল্পে। ব্লগ, ফেসবুকে অনুগল্পের ব্যাপক চর্চা করতে দেখা যাচ্ছে। অনেকে এখন অনুগল্প লিখছেন।
আকস্মিক ‘শুরু’ এবং ‘শেষ’ এর দিয়ে কত কিছুই না বলা হয়ে যায়! একটা গল্প? গল্পও কি হয়? হয়ই তো! পরিবর্তনশীল এ পৃথিবীর সাহিত্য জগতেও সময়ের সাথে যুক্ত কিংবা বিযুক্ত হয়েছে নতুন অনেক সাহিত্য-ধারণা। অতি ছোট ক্যানভাসে তীব্র কিংবা আটপৌরে ভাষায় গল্প বলার এই ধরণটি ইদানিং বেশ প্রচলিত। চিরাচরিত সাহিত্য যা গ্রন্থ-ভিত্তিক, সেখানে গল্প বা গল্পের ধরণ মোটামুটি একই আছে। ইন্টারনেট ভিত্তিক সাহিত্য জগতেই মূলত অনুগল্পের এই নতুন ধরণটি যুক্ত হয়েছে।
আধুনিক বাংলা সাহিত্যে অনুগল্পের প্রধানতম লেখক হলেন বনফুল (১৮৯৯-১৯৭৯)। বর্তমান বিশ্বে অনুগল্প লিখে ‘ম্যান অব বুকার’ পুরস্কার পেয়েছেন মার্কিন লেখক লিডিয়া ডেভিস (জ. ১৯৪৭)। ডেভিসের গল্পের দৈর্ঘ্য এক লাইন থেকে শুরু করে দু-তিন পৃষ্ঠা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। তার গল্পকে আদর্শ অনুগল্প বা ফ্লাশফিকশন বলা যায়। ছোটগল্পের পাশাপাশি অনুগল্প লিখে পুলিৎজার পুরস্কার পেয়েছেন আরেক মার্কিন কথাসাহিত্যিক রবার্ট ওলেন বার্টলার (জ. ১৯৪৫)। তবে বার্টলার এবং ডেভিসের অনেক আগে ছোটগল্পের পাশাপাশি অনুগল্প লিখে বিখ্যাত হয়েছেন জাপানের প্রথম নোবেলজয়ী লেখক Yasunari Kawabata (১৮৯৯-১৯৭২)। অনুগল্প লিখেছেন কাফকা, হেমিংওয়ে, আর্থার সি ক্লাক, রে ব্রাডবুরি, নগিব মাহফুজ, ডোলান্ড বার্থলেম, আমব্রুস বিয়ার্স, কেট শপা, শেখবের মতো প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিকরাও।
উল্লেখ্য যে, অনুগল্প সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় হয়েছে আমেরিকায়। সেখানে অনুগল্প এখন ছোটগল্প থেকে কিছুটা সরে এসে সাহিত্যের স্বতন্ত্র বিভাগ (genre) হিসেবে বিবেচিত হতে শুরু হয়েছে।
অনুগল্পে অল্পকথনের ভেতর দিয়ে অনুভবের বিষয়টি উঠিয়ে আনা হয়। প্রখ্যাত ফরাসি কবি বোদলেয়ার (১৮২১-১৮৬৭)-এর মতো অনেক কবি ক্ষুদে গদ্য-কবিতা (prose poetry) লিখেছেন যেগুলোকে অনুগল্প হিসেবে চিহ্নিত করা চলে। অন্যদিকে হালের জনপ্রিয় মার্কিন কবি ও গল্পকার স্টুয়ার্ট ডাইবেক (জ. ১৯৪২)-এর অনেক অনুগল্প গদ্য-কবিতা হিসেবে কবিতার কাগজে প্রকাশিত হয়েছে। এতে বোঝা যায়, কবিতা এবং ছোটগল্প দু’য়ের বৈশিষ্ট্যই অনুগল্পে বিদ্যমাণ।
কবিতার মতো অনুগল্পকে নানামাত্রিক অবস্থান থেকে বিশ্লেষণ করা যায়। একটি কাব্যিক দ্যোতনা বা ভাবমুদ্রা এখানে থাকে। ভাষা হয় ঘন, রূপকাশ্রিত। ফলে মার্কিন কবি ও কথাসাহিত্যিক গ্রেস পালে (১৯২২-২০০৭) বলছেন, ‘অনুগল্প কবিতার মতোই ধীরে পড়া উচিত।’ অন্যদিকে অনুগল্প গল্পের মতোই সমাজ বাস্তবতার কোনো সুপ্ত চেতনাকে ইঙ্গিত করে। চরিত্র থাকে, কথোপকথন (ডায়লগ) থাকে। একটা চমৎকার সমাপ্তিও থাকে। কেবল বলাটা হয় দ্রুত- বিদ্যুৎ চমকের মতন ঝলক দিয়েই শেষ। এক মুহূর্তে বর্ণিত বাস্তবতার এক ঝলক দেখে নেয়া।
অনুগল্পের একটা বড় অংশ লেখা হয়েছে ‘কথারূপক বা ফেবল’ ও ‘উপরূপক বা প্যারাবল’ হিসেবে। মোটাদাগে ফেবলের সঙ্গে প্যারাবলের পার্থক্য হল, ফেবলে সরাসরি হিউম্যান বা মানবচরিত্র থাকে না, কিন্তু প্যারাবলে থাকে। ফেবলের চরিত্ররা হয় জীবজন্তু বা পশুপাখি। এই গল্পের চরিত্ররা হল খরগোশ, নেকড়ে ও প্রতিবেশি অঞ্চলের জীবজন্তুরা। লেখক মানবজগতের কোনো বিশেষ বিষয় বা দিক তুলে আনতে এ ধরনের গল্প লিখে থাকেন। সাধারণত এ ধরনের গল্প শিশুদের জন্য লেখা হয়ে থাকে। তবে বড়দের জন্যও কেউ কেউ ফেবল লিখে থাকেন। সমাজ বা রাষ্ট্রের কিছু বিষয় সমালোচনা করার জন্যে প্রতীকী উপস্থাপনের পথ বেছে নেন। ফেবলের সব সময় একটা নীতিবাক্য বা মোরাল থাকে।
অনুগল্পের সঙ্গে গল্পের মূল পার্থক্যটা হল, গল্প তৈরি হয় কতগুলো মুহূর্ত নিয়ে; এখানে কতগুলো ঘটনা কতগুলো দৃশ্যকে আশ্রয় করে প্রকাশ ঘটে। আর একটি সার্থক অনুগল্পে একটি বিশেষ মুহূর্ত একক দৃশ্যপটের ভেতর দিয়ে উপস্থাপিত হয়। কিছু পরিষ্কার করে বলা হবে না, কেবল একটা ইঙ্গিত দিয়েই ছেড়ে দেয়া হবে।
ব্লগ এর দারুণ কিছু সুবিধাও আছে। যেমন এটি অতি সহজে ব্যবহারযোগ্য এবং বিশ্বের যে কোন স্থান থেকেই সকলের প্রবেশযোগ্য। আরও একটি বিশাল সুবিধা হচ্ছে এটি বিনামূল্য; পাঠক এবং প্রকাশক, উভয়ের জন্য।
সাহিত্যকে বর্তমানে দুই ফরম্যাটে দেখা যায়। প্রচলিত সাহিত্য এবং ই-সাহিত্য। প্রচলিত সাহিত্য হচ্ছে বই ভিত্তিক। আর ই-সাহিত্য হলো ইন্টারনেট ভিত্তিক; মিনি-গল্প, মাইক্রো-গল্প এবং ন্যানো গল্প। ইন্টারনেট ভিত্তিক এই সাহিত্যকে সাধারণত এই ভাবে বিভাজিত হতে দেখা যায়।
মাইক্রোফিকশন বা অনুগল্পের আবির্ভাব মধ্যযুগের গ্রীসে হলেও, এর বিস্তার হয়েছে এই আধুনিক যুগে। ইন্টারনেটের হাত ধরে, ব্লগের মাধ্যমে। আকারে সংক্ষিপ্ত হলেও, সাহিত্য মান যদি অক্ষুণ্ণ রাখা সম্ভব হয়; তাহলে এটি সহজেই পাঠকের কাছে সমাদৃত হয়। বিশ্বজুড়ে উন্মুক্ত সাহিত্য বাজার আর এর সহজলভ্যতার গুণে আজকের সাহিত্যাঙ্গনে অনুগল্পের যথেষ্ট জনপ্রিয়তা! আধুনিক এ জটিল কর্মব্যস্ত জীবনে সাহিত্যের এই দ্রুত-পঠন বিভাগটি খুব সহজেই আজ পাঠকের আপন হয়ে উঠেছে। যদিও ‘সময়’ই সব কিছু নির্ধারণ করে। সাহিত্য জগৎকেও নির্ধারণ করে ‘সময়’। তাই মাইক্রোফিকশন বা অনুগল্পের ভবিষ্যৎ কী হবে তা কেবল ভবিষ্যতের পাঠকই জানে। তবে অদূর ভবিষ্যতে অনুগল্পই যে সাহিত্যাঙ্গনে রাজত্ব করবে না, তাও বা কে বা নিশ্চিত করে বলতে পারে?
ব্লগগুলোতে অনুগল্পের পাঠক বেশি হওয়া স্বাভাবিক। বিশেষ করে কবিরা এই মাধ্যৃমটি বেছে নিতে পারেন এবং পাঠক নন্দিত ও ব্যাপক প্রশংসিত হতে পারেন।
তথ্যসূত্রঃ
বিশ্বসাহিত্যে অনুগল্প
মোজাফ্ফর হোসেন।
অনুগল্প নিয়ে অনুকথা
জান্নাতুল ফেরদৌস নৌজুলা
http://www.galpopath.com/2015/07/blog-post_64.html.
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জানুয়ারি, ২০১৮ সকাল ১১:১৩