somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মুক্তমনা না মু-মনা... আখতারুজ্জামান এর ওয়াল থেকে নেওয়া!

০৯ ই এপ্রিল, ২০১৬ দুপুর ১২:৪৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বিগত অর্ধযুগে ফেসবুককে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে একটি উদভ্রান্ত উটকো প্রজন্ম। এদের বেশিরভাগই মফস্বল থেকে ইন্টার পাশ করে ঢাকায় এসে এরা প্রথমে নিঃসঙ্গ নিস্তরঙ্গ জীবন যাপন করে, পরে ফেসবুকের কল্যাণে ঢাকাস্থ মাস্তিপ্রিয় ছেলেমেয়েদের সাথে গড়ে তোলে মস্ত মহব্বত। এর পরে মফস্বলের নাদান নিরীহ ছেলেটি বা মেয়েটি হয়ে ওঠে বিকট বিপ্লবী এবং চব্বিশ ঘণ্টায় ঘটিয়ে দেয় বাহাত্তরটি বিপ্লব।
এই 'ইন্টার পাশ বিপ্লবী'রা সাধারণত ভর্তিপরীক্ষায় সুবিধে করতে পারে না এবং স্বীকৃত কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়ার সুযোগ পায় না। এই হতাশা ঢাকতে বাপে-খেদানো মায়ে-তাড়ানো এই দলটি ঢাকায় এসে দল পাকায় এবং অন্য হতাশদের সাথে মিশে গিয়ে নিজের হতাশা ভুলে থাকতে চেষ্টা করে। এদের ফেসবুক প্রোফাইলের শিক্ষাগত যোগ্যতার ঘরটি ফাঁকা থাকে অথবা লেখা থাকে 'আমি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় বিশ্বাসী নই, আমি স্বশিক্ষিত' কিংবা 'বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর, সবার আমি ছাত্র'। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া নয়, বিশ্ববিদ্যালয়-এলাকায় কিংবা ছবির হাটে চা খেতে পারাকেই এরা জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন ও বৃহত্তম বীরত্ব বলে মনে করে। ফেসবুক আইডিটিকে বিয়োগ করলে এদের অস্তিত্ব থাকে না।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অভাবকে ধামাচাপা দিতে এরা কয়েক অধ্যায় শরীফ-ছফা-হুমায়ুন আজাদ পড়ে, কয়েক পৃষ্ঠা মার্কস-অ্যাঙ্গেলস-ডারউইন পড়ে, কয়েক ছত্র কাফকা-কামু-পামুক পড়ে এবং তাদের উক্তি দিয়ে প্রোফাইল সাজায়। এই প্রজন্মটির একেকজনের প্রোফাইলে গিয়ে মনে হবে— ওনার এলেম অ্যারিস্টটলের চেয়ে একটু কম, সক্রেটিসের চেয়ে একটু বেশি। শব্দভাণ্ডার সীমিত হওয়ায় সাধারণ বাক্যেও এরা গালি ব্যবহার করে। দেশের জনপ্রিয় ব্যক্তিদেরকে গালি দিয়ে ও ব্যক্তিগত আক্রমণ করে তসলিমা-সিনড্রোমে ভোগা এই প্রজন্মটি পাদপ্রদীপের আলোয় আসতে চায়। অন্তর্জালের জনপ্রিয় কারো সাথে কিছুদিন মিশে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে পরবর্তীতে তাকেই গালাগাল করে দৃষ্টিআকর্ষণ করাটাও এদের আরেক কৌশল। গল্প, কবিতা, ছড়া, প্রবন্ধ বা কোনো মৌলিক সৃষ্টি এদের নেই; আছে কেবলই ব্যক্তিবিদ্বেষ আর ধর্মীয় ব্যাপারে অগোছালো অপলাপ। এরা জানেই না— ফেসবুকে এদের দ্বারা সৃষ্ট অস্থিরতা ও অসভ্যতা চলমান রক্তপাতের পেছনে বহুলাংশে দায়ী। গবেষণামূলক কোনো দীর্ঘ প্রবন্ধ লেখার ক্ষমতা নেই বলে সর্বোচ্চ আট-দশ বাক্যে এরা বিষ উগড়ে দিয়ে থাকে। ধর্মীয় ব্যাপারে লিখিত এদের অসংলগ্ন-অপরিপক্ব পোস্টগুলো রক্তপাতের পথকে ক্রমশ প্রশস্ত করে এবং এসব উক্তির সমষ্টি মাসে একটি করে প্রাণহানিকে ত্বরান্বিত করে।
এরা সাধারণত আট-দশ জন মিলে চলাফেরা করে এবং শুরুর দিকে এদের ঐক্য থাকে ইঁদুরের দাঁতের মতো ধারালো। শুরুতে এরা এককাপ চা তিনজনে, এক শিঙাড়া ছয়জনে, এক বিড়ি নয়জনে ভাগ করে খায়। কয়েক মাসের মধ্যেই এদের ঐক্যের ডিম ফেটে দুর্গন্ধ বেরোয় এবং সেই গন্ধে অন্তর্জাল অস্থির হয়। ধারকর্জ নিয়ে উদ্ভূত উচ্ছৃঙ্খলায় দশজনের দলটি আটজনে পরিণত হয়, ফেসবুকে কে কার চেয়ে বড় মুক্তমনা তারকা হবে— এ সংক্রান্ত সংঘাতে আটজন ছয়জনে পরিণত হয় এবং ঐ ছয়জনের মধ্যকার দুই মেয়ে ও চার ছেলের মধ্যে কে কার প্রেমিক বা প্রেমিকা হবে— এই দ্বন্দ্বে গোটা দলটিরই দাফন ঘটে। দশজন দশভাগে বিভক্ত হওয়ার পর ফেসবুকে দশদিক থেকে শুরু হয় দশমুখী কাদা-ছোড়াছুড়ি, গোপন স্ক্রিন শটের ছড়াছড়ি এবং উচ্চাঙ্গ-মধ্যাঙ্গ-নিম্নাঙ্গের চুল ছেঁড়াছিঁড়ি। ঘাতকরা এদের এই গৃহযুদ্ধ পর্যবেক্ষণ করে এবং কার গর্দান ফেলা নিরাপদ ও সহজ হবে— এই গৃহযুদ্ধ ঘাতকদেরকে সেই সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে।
হতাশ প্রজন্মের অনেকেই কবি হতে চায়; গায়ক-নায়ক, ভাবুক-চাবুক, দার্শনিক-সৈনিক হতে চায়। এরা ধরেই নেয় এসব হতে গেলে মাদক অপরিহার্য। এই ভাবনা থেকে এবং ব্যক্তিগত ব্যর্থতা ঢাকতে এরা পা রাখে মাদকের নারকীয় নর্দমায়। ছবির হাটের পেছনের দিকটা উন্মুক্ত প্রস্রাবখানা, প্রতিদিন সহস্রজনের সহস্র লিটার মূত্র ওখানে জমা হয়। ছবির হাটে এককালে এত গাঁজাসেবন হতো যে, গাঁজার দুর্গন্ধে ঐ সহস্র লিটার মূত্রের দুর্গন্ধ ম্লান হয়ে যেত। এরা কেন যেন ধরেই নেয়— আধুনিক হতে গেলে নর-নারী একত্রে মিলে ধূমপান করতে হবে, কবি হতে গেলে কিংবা চারুকলায় পড়লেই গঞ্জিকা সেবন করতে হবে, কম ঘুমিয়ে বেশি বিপ্লব সাধনের জন্য ইয়াবা গিলতে হবে। এই গোত্রের ছোট-ছোট মেয়েগুলো মনে করে— পুরুষের সমকক্ষ হতে চাইলে অবশ্যই প্রকাশ্যে ধূমপান করতে হবে, পরতে হবে পুং-পোশাক। নরের আধ-খাওয়া বিড়ির পশ্চাৎদেশে মুখ দিয়ে এই দলের নারীরা মনে করে— পুরো বিপ্লবের আদ্ধেকটাই সাধিত হয়ে গেল, নারীর বানিয়ে দেয়া গঞ্জিকা-দণ্ডের ধোঁয়া আকাশে উড়িয়ে এই দলের নরেরা মনে করে— গোটা সৌরজগতেই প্রগতি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল। এদের অনেকে টানা কয়েকদিন স্নান পর্যন্ত করে না, যার ফলে পাশে বসা যায় না দুঃসহ দুর্গন্ধে।
গয়রহে গাঁজায় বুঁদ হয়ে থাকে বলে ও এদের জগৎটা ফেসবুকে সীমিত বলে পথেঘাটেও এরা ফেসবুকের মতো উদ্ধত ভাষায় কথা বলে এবং প্রায়শই জনতার ধোলাইয়ের শিকার হয়, মাদক নিতে গিয়ে গভীর রাতে ঠাঁই হয় থানায়; নিজের গৌরবের কথা ফেসবুকে ফাঁপিয়ে প্রচার করলেও এই গণধোলাইয়ের কথা আড়ালেই থেকে যায়। এই নেশাগ্রস্তরা যখন কোনো আন্দোলনে ঢুকে পড়ে, তখন প্রতিপক্ষ সুযোগ পায় আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার। অনেকে এই প্রজন্মটিকে ডাকে বাছুরবাহিনী বলে।
খুব হতাশ লাগে, যখন দেখি টাকার অভাবে ভাত খেতে না-পাওয়া ছেলেটি বিপ্লবী হওয়ার বাসনায় প্রতিদিন এক ডজন সিগারেট খায়; আচানক আঁতকে উঠি, যখন দেখি ছেলেবন্ধুদের সমকক্ষ হতে গিয়ে সদ্য-কৈশোর-পেরোনো রূপবতী মেয়েটি গাঁজা ফুঁকতে-ফুঁকতে চেহারাটাকে বীভৎস করে ফেলে। আটাশ বছরের জীবনে আটাশ হালি হতাশা ঘিরে রাখলেও আমি কোনোদিন সিগারেটে মুখ দেইনি। এই স্বঘোষিত প্রথাবিরোধীদেরকে ডেকে-ডেকে বলতে ইচ্ছে করে— মাদক মানুষকে সাধক করে না, পরিণত করে জড়পদার্থে; অসুন্দরের মাঝে কবিতা নেই, কবিতার বসত সুন্দর-সুস্থ জীবনে; মুক্তমনার ভেক ধরে ব্যক্তিগত আক্রমণ করে বড় হওয়া যায় না, ঐ ব্যক্তির চেয়ে বড় কিছু করে দেখানোই বড় হওয়ার একমাত্র উপায়; ফেসবুকের ছায়াবন্ধুরা বন্ধু নয়, বাস্তবের কায়াবন্ধুরাই বন্ধু; চের টুপিতে বিপ্লব বাস করে না, নিজের কাজ পরিপূর্ণভাবে পালন করাটাই বৃহত্তম বিপ্লব।
-------- আখতারুজ্জামান আজাদ
https://www.facebook.com/azadinlaw/posts/1142059555825467
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই এপ্রিল, ২০১৬ দুপুর ১২:৫০
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

লবণ্যময়ী হাসি দিয়ে ভাইরাল হওয়া পিয়া জান্নাতুল কে নিয়ে কিছু কথা

লিখেছেন সম্রাট সাদ্দাম, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১:৫৪

ব্যারিস্টার সুমনের পেছনে দাঁড়িয়ে কয়েকদিন আগে মুচকি হাসি দিয়ে রাতারাতি ভাইরাল হয়েছিল শোবিজ অঙ্গনে আলোচিত মুখ পিয়া জান্নাতুল। যিনি একাধারে একজন আইনজীবি, অভিনেত্রী, মডেল ও একজন মা।



মুচকি হাসি ভাইরাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিল্টন সমাদ্দার

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৩:০৬

অবশেষে মিল্টন সমাদ্দারকে গ্রেফতার করেছে ডিবি। এবং প্রেস ব্রিফিংয়ে ডিবি জানিয়েছে সে ছোটবেলা থেকেই বদমাইশ ছিল। নিজের বাপকে পিটিয়েছে, এবং যে ওষুধের দোকানে কাজ করতো, সেখানেই ওষুধ চুরি করে ধরা... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশি নির্মমতা

লিখেছেন এমজেডএফ, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১১



সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে বিক্ষোভের ঝড় বইছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিক্ষোভ দমনের প্রচেষ্টা চালালেও তেমন সফল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ ০১

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×