আমার বাবা মোহামেডানের সমর্থক। আর পুরো বাসা আবাহনীর সমর্থক। আমরা ছোটবেলায় মজা করে ছড়া বলতাম,
'' ইলিশ মাছের তিরিশ টাকা, বোয়াল মাছের দাড়ি
মোহামেডান ভিক্ষা করে আবাহনীর বাড়ি।''
আব্বু মুচকি মুচকি হাসতো। আব্বুর ঘাড়ে চড়ে স্ট্যাডিয়ামে মোহামেডান ও আর আবাহনীর খেলা দেখতে যেতাম। একদিন রাতে খেলা দেখতে গিয়েছি, এমন সময় একটা বড় ইট আবাহনীর গ্যালারী থেকে ঠিক আমার পায়ের কাছে এসে পড়লো। আর আরেকটা ইট আমার পাশের লোকটার মাথা ফাটিয়ে দিল। আমি হাউমাউ করে কান্না জুড়ে দিলাম। আব্বু আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে স্ট্যাডিয়াম থেকে বেড়িয়ে আসলো। এরপর ক্রিকেট দেখতে গেছি ঠিকই কিন্তু আর কোনদিন ফুটবল খেলা দেখতে যাওয়া হয়নি।
খেলার কারনে আমি কয়েকদিন আগে খবর পড়লাম বন্ধুদের মধ্যে ঝগড়া লেগে খুব সম্ভবত বরিশালের একটি গ্রামের এক আরেকজনকে খুন করে ফেলে। যার ফলশ্রুতিতে একটি গ্রামের কয়েকটি বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়। নিঃস্ব হয়ে যায় অনেকগুলো পরিবার।
আইসিসি কোয়ালিফিকেশনে জিতে বিশ্বকাপে যেদিন বাংলাদেশ ক্রিকেট দল নাম লেখায় তখন ভিকারুন নিসা নূন কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী আমি। বাংলাদেশ জেতার পর আমাদের কোন একজন শিক্ষিকা তা মাইকে ঘোষণা করে দিয়েছিলেন। আমরা সব পাগলের মত ক্লাস থেকে বের হয়ে গিয়েছিলাম। খেলার ঘর থেকে জন্য বিভিন্ন ধরনের ঢোল থেকে শুরু করে আরো অনেক বাদ্যযন্ত্র নিয়ে আমাদের স্কুল ও কলেজের মাঠে বাজাতে বাজাতে ছুটতে থাকি। ছুটতে ছুটতে অন্যদের ধাক্কা খেয়ে আমি পড়ে গিয়েছিলাম। ভীড়ের মধ্যে কিছু সহপাঠী আমাকে পায়ে মাড়িয়ে, আমার উপর দিয়ে হেটে গিয়েছিল। অনেক কষ্টে উঠে এক পাশে চলে গিয়েছিলাম, তবু আনন্দে আমার উল্লাস কমেনি এক ফোটাও। বড় ড্রামটা হাতে নিয়ে বাজাতে নিজেই থাকলাম। কি যে আনন্দ হচ্ছিল মনে! আমরা সবাই স্লোগান দিচ্ছিলাম, ''আমার ভাই তোমার ভাই, আকরাম ভাই আকরাম ভাই।'' যদিও সেদিন জানতাম আকরাম খান একজন বিহারী পরিবারের সন্তান। সেদিন বিহারীদের প্রতি আমাদের কারো মধ্যে এক বিন্দু ঘৃণা দেখতে পাইনি যতটা এখন দেখতে পাই। কিছু বন্ধু ছিল এক কাঠি সরস। তারা আমাদের শিখিয়ে দিচ্ছিল, যখন তারা হেটে যাবে আমরা যেন বলি, ঐ দেখ দেখ পাইলটের বউ হেটে যায় আমরা ছিলাম দুষ্টের শিরোমনি লঙ্কার রাজা। বান্ধবীরা হাটা শুরু করলেই চিৎকার শুরু করে বলতে শুরু করেছিলাম, দেখ!! দেখ !!আকরাম ভাবী যায়।
কিন্তু এই খুশীটা বেশিক্ষণ থাকলো না। বাড়ি ফেরার সময় টের পেলাম বিপদটা। ঠিক কলেজের গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলো বখাটে কিছু যুবক। হাতে রঙয়ের বালতি, মেয়েদের গায়ে রং ঢেলে তারা হিরো গিরি করবে। অন্যদের কথা জানি না, আমার কলেজ ড্রেস ছিল একটাই। গায়ে যদি রঙ ঢেলে দেয় তাহলে পরের দিন কলেজে যাওয়া হবে না। কারন , নতুন কলেজ ড্রেস বানানো ছাড়া উপায় নেই। যেসব মেয়েদের গাড়ি ছিল সাথে তারা সেদিন বেঁচে গিয়েছিল। আর আমরা তিন বান্ধবী যারা এক সঙ্গে বাড়ি ফিরছিলাম রিকশা করে তারা পড়লাম বিপদে। কলেজের দাড়োয়ান ঐসব ছেলেদের ধমক ধামক দিয়ে দূরে সরিয়ে দিলেন বটে কিন্তু এরা এমন পাঁজি কিছিমের ছেলে পেলে, সহজে চলে গেল না বরং একটু দূরে গিয়ে অপেক্ষা করতে থাকলো; যেন মেয়েদের গায়ে রঙ না ঢেলে তারা ঘরে ফিরবেই না। আমাদের রিকশা বেইলী রোডে ঢুকতেই ছেলেগুলো দৌড়ে আসতে থাকে আমাদের দিকে। আমার সঙ্গের দুটো বান্ধবীই মহা সুন্দরী। মূল উদ্দেশ্য সুন্দরী দুজনের উপর রঙ ঢালা। আর আমি তাদের দুজনার মধ্যে দেখতে সাধারণ একটি মেয়ে। যাই হোক, বুদ্ধিটা আমার মাথায়ই প্রথম আসলো, রিকশা থেকে দু গজ দূরে একটা পুলিশের ভ্যান দেখে। আমি বান্ধবীদের বললাম, দৌড়া। ওরা আমার পেছনে দৌড় দিল। দৌড়ে দিয়ে গিয়ে আমি পুলিশের গাড়িতে উঠে বসলাম, দেখাদেখি বাকি দুজন। এই ছেলেগুলো আর আমাদের গায়ে রঙ ঢালতে পারলো না। পুলিশের কর্মকর্তা জিজ্ঞ্যেস করলো, কি ব্যাপার আমাদের ভ্যানে কেন? বললাম, প্লীজ স্যার আমাদের একটু সাহায্য করুন, একটু সামনে এগিয়ে দিন, নতুবা আমাদের কলেজ ড্রেস নষ্ট হয়ে যাবে। পুলিশ কর্মকর্তা আমাদের মালিবাগ মোড় পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে বললেন, এবার নামুন; আপনাদের বাড়িতে গিয়ে তো আর দিয়ে আসতে পারবো না; এখান থেকে রিকশা নিয়ে বাড়ি চলে যান। আমরা ভয়ে ভয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম। কিন্তু নিজেদের শেষ রক্ষা করা গেল না। মালিবাগ মোড় দিয়ে ঢুকতেই প্রথমে ছাদের উপর থেকে কয়েক বালতি পানি ঢালা হলো আমাদের গায়ের উপর। আরেকটু এগুতেই আরেক দল বখাটে ছেলে আবুজর গিফারী কলেজের ছাত্ররা যারা মাঝে মাঝে এলাকার ভিতরে পাইপগান নিয়ে ঘুরে বেড়ায় তারা এসে আমাদের তিনজনের রিকশা আটকালো। তারপর কয়েক বালতি রঙ গুলানো পানি দিয়ে আমাদের ভিজিয়ে দিল। আমাদের ভাগ্য বোধহয় একটু ভালই ছিল সেদিন, শুধু শ্লীলতাহানির হাত থেকে বেঁচে গিয়েছিলাম।
এখন ফেসবুকের যুগ। ফেসবুকে যখনই কোন খেলা আসে তখনই বিভিন্ন ধরনের স্ট্যাটাস আপডেট করি আমরা। ক্রিকেট বিশ্বকাপের সময় তো আছেই, বিশেষ করে ফুটবল বিশ্বকাপে আমাদের দেশে আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিলের অনেক সাপোর্টার দেখা যায়। ইদানিং এমনও বলতে শোনা যায়, আওয়ামী লীগাররা আর্জেন্টিনার সমর্থন করে কারণ তা ''A'' অক্ষর আর বিনপি সমর্থকরা ব্রাজিল সমর্থন করে কারন তা ''B'' অক্ষর লিখতে হয়। একজন আরেকজনের মত প্রকাশে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। গত ২০১০ - এর বিশ্বকাপের সময় ফেসবুকে ব্রাজিল সমর্থক এক ছোট ভাই স্ট্যাটাস দিয়েছিল। ছেলেটি বেশ শিক্ষিত পরিবারের ছেলে, আমি শুধু দুষ্টুমি করে বলেছিলাম, হুম ব্রাজিল তো রেফারী নিয়ে খেলে। সে উত্তর দিয়েছিল, আই ডোন্ট ফাক হোয়াট এভার ইউ সে এবাউট ব্রাজিল। আমি রীতিমত স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। ইঞ্জিনিয়ারিং এ গ্রাজুয়েশন করা ছেলে, এখানে এরোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং মাস্টার্স পড়তে এসেছে। এই ছেলের ব্যাবহার এমন হবে কেন? আমি বোবা হয়ে অভিমানে ছেলেটিকে ব্লক করে দিয়েছিলাম।
আবারো বিশ্বকাপ এসেছে, বাংলাদেশের দামাল ফুটবলাররা বিশ্বকাপে হয়তো একদিন ফুটবল খেলবে কিন্তু এই মুহুর্তে তার কোন সম্ভাবনা নেই। স্বাভাবিক ভাবেই বাপ-দাদারা যে দলটির সমর্থন করে ছেলে মেয়েরাও সেই দলেরই সমর্থক। এটা কোন সমস্যা না, সমস্যাটা হয় তখন যখন আরেকটি দলের সমর্থকদের নিজেদের প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতে শুরু করে। তখন তারা প্রতিপক্ষ বা অন্য দলের সমর্থকদের কেউবা দুষ্টুমি করে আর কেউ কেউ এত বেশি উত্তেজিত হয়ে যায় যে, ভয়ঙ্কর ভাষায় আঘাত করতে থাকে। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হচ্ছে এটা যে শুধু খেলার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, তা শুধু নয়। এটি বর্তমানে নিজের সমর্থন করা রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে ধর্ম, ভিন্নমত, ও ভিন্ন পছন্দ সব ক্ষেত্রে গিয়ে ঠেকেছে। ধরুন আপনি লিখলেন ব্রাজিল সুইসাইড গোল দিয়েছে তখন তারা বলবে দেখবোনে আপনের দলটা কি করে? এখানে আমার সমর্থিত দলটা আসতেই পারে না কারন এখানে একটি দলের সেই ভুলের কথা বলা হচ্ছে যার জন্য তাদের নিজেদের মাশুল গুণতে হবে। কিংবা আপনি লিখলেন ডয়েচল্যান্ড আর কোন এক ফেসবুক বন্ধু সমর্থন করে আর্জেন্টিনা। সে তখন গতবার বিশ্বকাপে জার্মানির কাছে ৪ গোলে হেরে যাওয়া আর্জেন্টিনার সেই খেলার কথা মনে করে আপনাকে বলবে হিটলার হিটলার হিটলার। আপনি জার্মানিতে থাকেন। আপনি জানেন, কাউকে হিটলার বলা মানে জার্মানিতে সবচেয়ে জঘন্য গালিটি দেওয়া। সে জানেই না, জার্মানিতে স্বয়ং জার্মানদের কাছে ( কিছু গোপন নাৎসী সমর্থক ছাড়া) কত ঘৃণিত একটি নাম। হিটলার বলার কারনে যে কোন কারো বিরুদ্ধে ইউরোপে মানহানির মামলা করা যায়, শুধু তাই না তাকে জেল পর্যন্ত খাটানো যায়। আপনি তাকে বোঝানোর চেষ্টা করবেন, সে যুক্তি দেখাবে, হিটলার নাকি তার লেখা ''মাইন ক্যাম্পফ'' বইয়ে জার্মানিকে ডয়েচল্যান্ড বলে গেছেন কয়েকবার। সে জানেই না এই পৃথিবীতে বাংলা, ইংরেজী আর উর্দুর বাইরে আরো প্রায় পাঁচ হাজার ভাষা বিদ্যামান। তার মধ্যে ''ডয়েচ'' বা জার্মান ভাষা অন্যতম। আপনি বাংলায় ইংরেজীর অনুকরণে জার্মানি বললেও জার্মানবাসী নিজেদের ''ডয়েচ'' এবং নিজেদের দেশকে ''ডয়েচল্যান্ড'' বলে। আর ডয়েচল্যান্ড নামটি এ্যাডল্ফ হিটলার আবিষ্কার করে দিয়ে যাননি। আর এটা বলাতে আপনাকে সে চূড়ান্ততম গালি দিবে, সামনে থাকলে হয়তো গালি দিয়ে শেষ করতো না, মেরেও বসতো। আর এটাই আমাদের দেশের বেশির ভাগ মানুষের মূল সমস্যা।
আমরা নিজেদের সবচেয়ে সভ্য জাতি হিসেবে পরিচয় দিলেও আচরনে সবচেয়ে অসভ্য/ বর্বর জাতির মতই জ্বলে উঠি। সেটা শুধু খেলা নয় জাতীয়তাবাদ থেকে শুরু করে প্রতিটি ক্ষেত্রে শুরু হয়েছে। আস্তিকরা নাস্তিকদের আগুন লাগিয়ে দিতে চায়, আওয়ামী লীগ / বিএনপি/ জামাত/ আবাহনী / মোহামেডান সবাই সবার বিরুদ্ধে কথা বলছে, একজন মানুষ মারা গেলে সে আনন্দে বিরানী খাওয়ার প্রচলন পর্যন্ত চালু আছে আমাদের দেশে। অথচ জার্মানিতে লাদেন হত্যার খবরে সবচেয়ে খুশী হয়েছিল আমার পাকিস্তানী সহপাঠী। কিন্তু মিষ্টি কিনতে দৌড় দেয়নি, বরং বলেছে আমি আমার পরিবার লাদেন কারনে কতটা ভুক্তভোগী বলে বোঝাতে পারবো না। কিন্তু আমি যদি লাদেনের মৃত্যুর খবরে মিষ্টি খাই তাহলে ঐ মানুষ নামের অমানুষের সঙ্গে পার্থক্যটা থাকলো কোথায়? পাকিস্তানী !! যার সঙ্গে আমার জাতিগত সমস্যা আছে, মনের মধ্যে ঘৃণা আছে, খুব অল্প সময়ে তার কাছ থেকে অনেক বড় একটা শিক্ষা পেলাম। এমনকি জার্মান ক্যান্সেলার এ্যাঙ্গেলা মার্কেল যখন ক্যামেরার সামনে লাদেনের মৃত্যুতে হালকা সস্তির ভঙ্গি প্রকাশ করেছিলেন, তার এই প্রতিক্রিয়া প্রকাশের ভঙ্গির সমালোচনা করতে ছাড়েনি সমগ্র ডয়েচল্যান্ডবাসী।
আমরা নিজেদের অনেক জ্ঞানী, সভ্য, শিক্ষিত জাতি বলে দাবী করি। আর আচরণে সবচেয়ে নিকৃষ্টতম জাতি হিসেবে প্রমাণ দেই। ফেসুবকে নারীদের ভার্চুয়াল ধর্ষণ তো করিই সঙ্গে সময় সুযোগ মত তার ঠিকানা এমন মানুষদের হাতে তুলে দেই যারা হয়তো আমাকে পেলে খুনও করতে পারে। আর তার প্রমাণ আমরা অনেকবারই পেয়েছি এবং ভবিষ্যতেও পাবো। অনেক সুশীল ব্লগার খুনের ফতোয়াবাজ ও হুমকিদাতাদেরকে তাদের সমর্থনও দিয়ে থাকেন বড় গলায়। আমাদের ঘৃণা আর প্রতিহিংসার সংস্কৃতি কবে যে শেষ হবে, কোথায় গিয়ে যে শেষ হবে তা আমি জানি না। শুধু এই টুকু জানি, যেদিন শেষ হবে সেদিন হয়তো পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে প্রতিটি মানুষ আর দেশটির অবস্থা হবে সিরিয়া বা আফগানিস্তানের মতো এবং তা হবে খুব তুচ্ছ আর সামান্য কারনে; আর এই কারনটা হচ্ছে আমাদের অজ্ঞতা।