"আজ আমার ঈদের চাঁদ রাত। কত কথা মনে পড়ে- সব কিছু পরের জন্য রেখে দিয়ে শুরুতেই সকলকে- ঈদ মোবারক"
"আজ ঈদ। মদীনার ঘরে ঘরে আনন্দ। পথে পথে ছেলেমেয়েদের কলরব।. . . ." -এভাবেই পৃথিবীর প্রথম দিনগুলোতে অন্তরে, মননে প্রবেশ করে ঈদ। তখনকার কল্পচোখে দেখতে পেতাম- মদীনার পথে চলছেন মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়াসাল্লাম আর পথের ধারের সেই ইয়াতীম শিশুটিকে কোলে তুলে নিয়ে এলেন নিজ ঘরে। ঈদটা তখনি মনের বিচিত্র ভূমে মহীয়ান হয়ে উঠে, হয়ে উঠে আনন্দ ভাগাভাগির চেতনা-উদ্দিপনায় সমুন্নত আদর্শ প্রতীক। এই তো ছিল ঈদের সাথে প্রথম সাক্ষাত, প্রথম পরিচয়, প্রথম অনুভব।
অন্ততঃ দশ দিন পূর্ব থেকেই গুনগুনাতো ঈদের আগমনী গান; আমাদের শিশু মনে মনে। ইস্, আর ৩ দিন বাকী, আর ২ দিন, আর ১ দিন, আজ চাঁদ রাত। কালী (নারগিস খালা), শফিক্যা (শফিক মামা), ডোক্কা (রফিক), লিঠুইন্যা (লিটন), ইরানী, পাখি মিলিয়ে কারুরই বিয়ে থাকতো না; অথচ মেহেদী বাটার সে কি ধুম। তারপর ঘটা করে বসে পান চিবোনোর মত চিবিয়ে চিবিয়ে দু'হাত ভরে লাগাতাম মেহেদী। এখানে ছেলে মেয়ের প্রভেদ ছিল না কোন। প্রতিযোগিতা ছিল কার হাতে কত বেশী কারুকাজ আর কার হাতের মেহেদীতে কত বেশী রঙ লেগেছে। সে ছিল সকাল বেলার আনন্দ; প্রথম ঘুম থেকে জেগেই তাকাতাম দু'হাতের তালুতে, মোটেই খেয়াল থাকতো না যে, রাতে না ধুয়ে শুয়ে পড়াতে মেহেদী লেগে গায়ের জামাকাপড়, বিছানাপাতি সব মেহেদী লেগে কি দুরবস্থা হয়ে আছে। সবাই ছুটতাম একে অপরকে দেখাতে; সাজ সাজ মেহেদী রাঙা হাত! আহা সেই সব দিন!!
নতুন জামা চলে আসতো দু/একদিন পূর্বেই। শুধু গন্ধ শুঁকতাম আর ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতাম, কারণ গায়ে দেবো তো ঈদের দিন। সকালের গোসলে হতো দলবেঁধে নামা, সাঁতার, ডুবোডুবি আর লম্ফ-জম্ফ শেষে গুরুজনদের তাড়া খেয়েই উঠে আসতাম। নতুন জামা পরিয়ে আতর মাখিয়ে দিতেন আমাদের। সব খানেই সাজ সাজ রব। এবার শুরু হতো আমাদের উপার্জনের পালা। সামনে কাউকে পেলেই হলো, ঠুকো সালাম! তারপর অপেক্ষা- 'কত দেয়'
। গোণাগুণতি পরে, আগে তো দু'পকেট ভর্তি করে নাও। শেষে যখন আর কাউকে পাওয়া যেত না, তখন গুণে দেখতাম যে, ঈদের ফটকা-বাঁশি-চশমা-চিনা বাদাম কিনেও বেশ ক'দিন মজায় কাটানো যাবে। তখন নিজের মাঝে একটা স্বাবলম্বী ভাব এসে যেত। গুরুজনকে- টাকা দেবেন না, বয়েই গেছে আমার
। ঈদের সালাত আদায়ের পর মহা সমারোহে চলতো এক ধাপ কেনা কাটা। এরপর ক'দিন যাবত একটানা এদিকে চলছে বাঁশির 'ভ্যাঁ-ভ্যাঁ' তো ওদিকে ফটকার 'ফটাশ্', তো অন্যদিকে ফটকা ফুটলো কেন সে নিয়ে আরেকজনের কান্নার 'সারগাম'- "এ্যাঁ"-"এ্য্যাঁ"-"এ্য্য্যাঁ" - "এ্য্য্য্যাঁ। সেমাই-পিঠা আর গোশ্তের কথা না হয় নাইবা বললাম, কারণ ওসবের চেয়ে দুনিয়াকে লাল দেখা চশমা আর "দ্রীম" এর জায়গায় "থপ্পাস" শব্দে ফোটা দশ টাকার বন্দুকটাই যে বেশী মজাদার। এভাবে চলতো এই সব মহড়ার আয়োজনে ভাঙ্গচুর না হওয়া পর্যন্ত।
কষ্ট! কষ্টকে উপলব্ধি করতে পারলেও সেদিন কিছুই করার ছিল না। কাউকে দেখার একটা আলাদা চোখ দিয়েছেন আল্লাহ্ আমাকে। তাই দেখতাম অনেকেই আমার দৃষ্টির কাছে বিব্রত বোধ করতেন, অর্থ খুঁজতেন। ঈদের সালাত শেষে যখন ভীড় ঠেলে ঠেলে আমরা মহানন্দে ছুটতাম বাজারের দিকে। তখনি দেখতে পেতাম রাস্তার ধারে দু'হাত পেতে বসে আছে আমার মতই শিশুরা। আমার কষ্টগুলো লুকিয়ে থাকতো তাদেরই অন্তরে অন্তরে। মনে হতো, আমার মতই এক উচ্ছল মন তো তার মাঝেও আছে। আজকের এই আনন্দের দিতে মলিন মুখে হাত পেতে আছে, কেউ যদি দু'এক টাকা দিয়ে যায়...! বিচলন, ব্যাথা আর হৃদয় দুমড়ানো কষ্টগুলোকে ঢেকে রাখতে চাইতাম আনন্দের ছাইপাশ দিয়ে। কখনো নিজের সঞ্চয় থেকেও দু'এক টাকা দিয়ে। কিন্তু ইয়াতীম নজরুলকে দেখলে আনন্দ-বেদনা সব মিলে একাকার হয়ে যেত। 'নজরুল' -আমার ইয়াতীম ভাই, আমার আত্মার এক ব্যথিত স্পন্দন। আল্লাহ্ তাকে পরকালে মহাধনী করুন। আমীন।
[আনন্দ ধরে রাখতে পারলাম না বলে দুঃখিত]
ছবি- নিজের তৈরী।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সন্ধ্যা ৭:০০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



