somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মল্লিকার মেঘ, মেঘেদের মেলাঙ্কোলি (ছোটগল্প)

২৮ শে জুলাই, ২০১৪ বিকাল ৫:৪০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



(বলা যায়, এই গল্পটার একটা প্রিকুয়াল আছে। আগ্রহীরা পড়তে পারেন এখান থেকে । তবে না পড়লেও এই গল্পটা বুঝতে কোন অসুবিধা হবে না। )



আয়নার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নিজেকে আর চিনতে পারে না মল্লিকা । অকস্মাত আয়নায় এ কোন অচেনা অবয়ব? সারাটাদিন ঠোঁটের বামপাশে ভালোমানুষী হাসিটা ঝুলিয়ে রেখে, ‘ভালো আছি’ উপটান মেখে এই এখন সাদামাটা শুন্য রাতে মুখোশের পর মুখোশ, প্লাস্টারের পর প্লাস্টার তুলে দ্যাখে- বিস্বাদ এক বিষাদে ডুবে যাচ্ছে নিরন্তর। কিংবা হয়তো যাচ্ছে না, আজকাল কেন জানি অনুভূতিগুলো খুব ঘোলাটে ঠেকে, গুবলেট পেকে যায় মাঝে মাঝেই, কখন কেমন বোধ হচ্ছে সে ব্যাপারে বোধ থাকে না। মল্লিকা বোঝে- বেশ অনেকগুলো অবান্তর অবাস্তব স্বপ্ন দেখে ফেলেছিল পারিপার্শ্বিক নিয়ে, পারিপার্শ্বিকের মানুষগুলোকে নিয়ে, অট্টালিকাদের ছায়া নিয়ে। তাদের কোনটাই সত্য হয়নি।

টেবিলের বাম পাশে বিছানা, বিছানার বাম পাশে কোলবালিশ, মাথার কাছে বালিশের কোল ঘেষে এলোমেলো কয়েকটা বই, কয়েক ফোঁটা চোখের জলও আছে কোথাও কোথাও, পাশে একটা টেডি বিয়ার-ইশতিয়াকের দেয়া; মুখস্ত প্লেসিং, স্থবির। কি যে অন্যমনস্ক বোধহীনতার ভূত! তাকিয়ে থেকে থেকে কোনকিছুই আর আপন মনে হয় না মল্লিকার। মনে হয়, অন্য কোন মল্লিকার জীবন; সে দর্শকের মত দেখে যাচ্ছে কেবল। এই বিছানা, এই বালিশ, দর্পণের উল্টোপাশের মানুষটা, কোনটাই আসলে সে না, অন্য কেউ, প্রচন্ড অচেনা অবাস্তব দূরের মনে হয় সবকিছু। জানালার ওপারে কিছু অন্ধকার, দূরে কোথাও কয়েকটা কুকুর কাঁদছে।

প্রতিবিম্বে বিস্ময়, হতাশা, এবং এই যে নিজস্বতা হারিয়ে ফেলা বিভ্রম, সব মিলিয়ে কেমন শূন্য শাদা একটা অনুভূতি করোটিতে মেখে এইসব নিঃশব্দ ভূতুড়ে রাতে মল্লিকার মনে হয়- সে একইসাথে ভালো আছে এবং নেই। এবং নিশ্চিত জানে -ইশতিয়াক ভালো আছে, আজহার ভালো নেই।




যেখানেই যাও তুমি, যেখানেই যাও
সঙ্গে যায় আরো একজন;
যদিও অদূরে তবু তার দূরত্ব ভীষণ।

যেকোন অনির্ধারিত নির্জনতম অন্ধকারেও মল্লিকা তার তৃতীয় চোখ দিয়ে দিব্য দ্যাখে-আজহার তাকিয়ে আছে তার দিকে। আজহার তার কথা ভাবছে। আজহারের দৃষ্টি শীতল, পলক পড়ে না সচরাসচর। যখন পড়ে, তখন মনে হয় চোখের পাতাগুলো রাজ্যের ভার বয়ে এসে ক্লান্ত, কোমলভাবে লেপ্টে যায় চোখের সাথে। আজহার নিজেকে ধ্বংস করে আনন্দ পায়, আজহার একই সঙ্গে প্রজাপতিরঙ ফুল এবং ব্লাডশেড নিয়ে স্বপ্ন দ্যাখে। আজহারকে দেখলে মাঝে মাঝে মনে হয়, সে এখনো আশি সালেই পড়ে আছে, একবিংশ শতাব্দীর সাথে মেলালে মনে হয়- যুবকটি নব্বইয়ের মাঝামাঝিতেই মারা গিয়েছিলো, একটা লাশ কেবল টেনে বেড়াচ্ছে।
বিপরীতে ইশতিয়াকের শাদা মনন, সাবলীল জীবন, সিল্কের মত মোলায়েম ভবিষ্যত; ইশতিয়াক স্মুথ। মল্লিকা তার কাছে আজন্ম অধিকার, তার নিজস্ব এসেট। টেবিল থেকে নিজের অজান্তেই খেয়ালবশে মুঠোফোন হাতে তোলার মত করে সে মল্লিকার হাত মুঠোয় পোরে। নিজের হাতগুলোর দিকে তাকিয়ে মল্লিকা তাদের স্বাধীনতা নিয়ে ভাবে, সম্ভবত দ্বৈত নাগরিকত্ব আছে ওদের, কার অধীনে যে কখন থাকে।
মল্লিকা জানে-ব্যক্তি কিংবা ব্যক্তিত্বের পাঞ্জায় ইশতিয়াকের সাথে প্রতিযোগিতায় নামার মত যোগ্যতা আজহারের নেই। তবু মাঝে মাঝে আজহারের ব্যক্তিগত সমুদ্রটার কথা জানতে ইচ্ছে করে, জানতে ইচ্ছে করে হঠাত হঠাত আর্কটিক টার্ন এর মত উড়ে গিয়ে কতটুকু অরণ্য সে ঘুরে এলো।

আয়নার সামনে দাঁড়ালে আজকাল প্রায়ই নিজেকে আর চিনতে পারে না মল্লিকা। তখন তার প্রশ্ন জাগে, সে ইশতিয়াককেই বা কতটুকু চেনে, কতটুকুই বা চেনে আজহারকে।




যন্ত্র শহর, সশব্দ যান, একটা সকাল।
সকাল পেরোলে হলুদ আলো, কয়েকটা কাক, একটা দুপুর।
বিকল বিকেল, ছায়া।
বিমর্ষ সন্ধ্যা, মায়া।
ক্যানাইনে হেমলক সলিটায়ার, ছুটে আসছে কালো জাগুয়ার, একটা রাত।

দিন যায়;
লিপ গ্লসে আটকে পড়ে থাকে দীর্ঘশ্বাস, মল্লিকা একই সাথে ভালো আছে এবং নেই। ইশতিয়াকের ভালোবাসার শেকলে বাঁধা আছে মল্লিকার সময়। আশ্চর্য এই, ইশতিয়াকের সঙ্গ আজকাল তেমন আর ভালো লাগে না। রুটিনের চক্রে ঘুরছে গোলাপ, রক্তজবা, টেডি বিয়ার সব। মাঝে মাঝেই নিজেকে খুব বন্দী মনে হয়, বড়সর একটা খাঁচায় আটকে গ্যাছে আকাশী বাজরিগার। কবিতার বইয়ের পৃষ্ঠা খোলা পড়ে থাকে – “কেউ জানে না আমার কেন এমন হলো।
কেন আমার দিন কাটে না রাত কাটে না...”

সপ্তাহ যায়, মাস যায়, অনেকগুলো ঋতু পেরিয়ে আসে বসন্ত। গাছের ডালে আর শহরের পীচে তুলির আঁচর, বাসন্তী রঙ। সেই বসন্তের কোন এক বিকেলে মল্লিকা একা হেঁটে কোথাও যায়। আজহার আসছে, টের পায়- স্যান্ডেল ঘষে ঘষে আজহার এমনভাবে হাঁটে আজহার যেনো মনে হয় হাতির মত দু’টো পা তুলতে হয় তাকে।
মল্লিকা শুনতে পায় খুব কাছে এসে আজহার খুব নরম করে ডাকে- “এই মল্লিকা!!” মল্লিকা পেছন ফেরে- “আরে আজহার যে, কি খবর ?” আজহার কোন জবাব দেয় না; এমনভাবে তাকিয়ে থাকে যেনো চিনতে পারছে না, সম্মোহিত। আজহারের ঠোঁট একটু কাঁপে, কোন শব্দ বের হয় না। মল্লিকা তাগাদা দেয়- “আরে, কি বলবি বল। চুপ হয়ে গেলি কেন ?”

আজহার আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে অনেকক্ষণ। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে দৃষ্টিটা ওপরের দিকে তাক করলে মল্লিকা দ্যাখে- দীপ্ত, ক্ষীপ্র একটা ভুবনছিল উড়ছে অনির্দিষ্ট উচ্চতায়, নিরাসক্ত, নিস্পৃহ; ডানায় পিছলে যাচ্ছে কয়েকটি রোদের সরলরেখা। পাশে কিছু ছাই মেঘ, মেঘেদের মেলাঙ্কোলি। মল্লিকা অপ্রত্যাশিত হারিয়ে যায় মেঘ ও চিলের দৌড়ের মাঝে।


কিছুক্ষণ পর সম্বিত ফেরে, মনে পড়ে- আয়নার সামনে দাঁড়ালে আজকাল প্রায়ই নিজেকে আর চিনতে পারে না সে। চিনতে পারে না ইশতিয়াক কিংবা আজহার, কাউকেই।

১৩টি মন্তব্য ১৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=বেনারসী রঙে সাজিয়ে দিলাম চায়ের আসর=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫২



©কাজী ফাতেমা ছবি
মনে কি পড়ে সেই স্মৃতিময় সময়, সেই লাজুক লাজুক দিন,
যেদিন তুমি আমি ভেবেছিলাম এ আমাদের সুদিন,
আহা খয়েরী চা রঙা টিপ কপালে, বউ সাজানো ক্ষণ,
এমন রঙবাহারী আসর,সাজিয়েছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিজ্ঞানময় গ্রন্থ!

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪২

একটু আগে জনৈক ব্লগারের একটি পোস্টে কমেন্ট করেছিলাম, কমেন্ট করার পর দেখি বেশ বড় একটি কমেন্ট হয়ে গেছে, তাই ভাবলাম জনস্বার্থে কমেন্ট'টি পোস্ট আকারে শেয়ার করি :-P । তাছাড়া বেশ... ...বাকিটুকু পড়ুন

অস্ট্রেলিয়ার গল্প ২০২৪-৪

লিখেছেন শায়মা, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:৪৫


চলে যাবার দিন ঘনিয়ে আসছিলো। ফুরিয়ে আসছিলো ছুটি। ছোট থেকেই দুদিনের জন্য কোথাও গেলেও ফিরে আসার সময় মানে বিদায় বেলা আমার কাছে বড়ই বেদনাদায়ক। সেদিন চ্যাটসউডের স্ট্রিট ফুড... ...বাকিটুকু পড়ুন

আপনি কি বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, ঋগ্বেদ এর তত্ত্ব বিশ্বাস করেন?

লিখেছেন শেরজা তপন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫২


ব্লগে কেন বারবার কোরআন ও ইসলামকে টেনে আনা হয়? আর এই ধর্ম বিশ্বাসকে নিয়েই তর্ক বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে সবাই? অন্য ধর্ম কেন ব্লগে তেমন আলোচনা হয় না? আমাদের ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ‘অন্তরবাসিনী’ উপন্যাসের নায়িকাকে একদিন দেখতে গেলাম

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:২৫

যে মেয়েকে নিয়ে ‘অন্তরবাসিনী’ উপন্যাসটি লিখেছিলাম, তার নাম ভুলে গেছি। এ গল্প শেষ করার আগে তার নাম মনে পড়বে কিনা জানি না। গল্পের খাতিরে ওর নাম ‘অ’ ধরে নিচ্ছি।

... ...বাকিটুকু পড়ুন

×