পূর্বের তিন অংশের পর-
কথা বলতে বলতে লিখা, পড়তে পড়তে লিখা। কয়দিন আগে ঢাকায় অবস্থান কারী আমার খুব প্রিয় ভাই টিভি ও চলচ্চিত্র শিল্পী জনাব স্বাধীন খসরু তার ফেসবুক ওয়ালে লিখলেন যে, 'আমার পরিচয় : আমি বাংলাদেশি, সিলেটি কিন্তু বাঙালী না'। লেখাটা আমাকে খুব নাড়া দিল। আমি বাংলাদেশে যত নাটক লিখেছি ও পরিচালনা করেছি তার নব্বই ভাগ কাজে আমার প্রিয় স্বাধীন ভাইকে অভিনয়ের সুযোগ দিয়েছি। আমার ভেতর থেকে প্রশ্ন আসলো, কোনো দিলাম। কিন্তু আবার মনে মনে ভাবলাম, স্বাথীন ভাইয়ের মতো একজন সংস্কৃতিকর্মী যে ই্ংল্যান্ডের নাগরিকত্ব থাকা সত্বেও শুধু দেশের টানে, বাংলাদেশের টানে, বাংলা সংস্কৃতির টানে ইংল্যান্ডে অবস্থান না করে, ঢাকায় গিয়ে দুষিত আবহাওয়াতে দেশের হয়ে অভিনয় করে যাচ্ছেন, সে কিনা এমন লিখলো। তখন আমার অনেক কথা মনে পড়ে গেল, আমিও তো ঢাকায় থাকি। কেন অনেকে আমাকে সিলেটি হিসেবে পরিচয় দেয়। কই তারাতো অনেকে অন্য এলাকার লোককে নোয়াখালী বা কুমিল্লা বা বরিশাল বা কুষ্টিয়া বা কোন এলাকার বলে না, তাদেরতো নাম ধরে বা ইজ্জতের সাথে বলে। আমাকে কেন অনেক জায়গায় সিলেটি ভাই শুনতে হয়। আর সেটা যদি উপরস্থ কারো কাছ থেকে শুনতে হয়, বিষয়টা আর ঠাট্রাা পর্যায়ে রয় না। কথার কথা পর্যায়ে থাকে না।
আমার জন্ম সিলেটে, বেড়ে উঠা সিলেটে, পড়া-লেখা সিলেটে, কর্ম জীবন শুরুও করতে চেয়েছিলাম সিলেটে, কিন্তু নাট্য জগতে বা চলচ্চিত্র জগতে আমাকে প্রতিষ্টিত পরিচালক হতে হলে ঢাকাতেই যেতে হবে। গেলামও, মোটামোটি জয় করার চেষ্টায় আছি। আজো একটা প্রডাকশন তৈরী করলে স্ট্রাগল করতে হয় কিন্তু আজ থেকে কয়েক বৎসর আগেও অনেক ছেলে আমার অধিভূক্ত হয়ে কাজ করে গেল, তারা আজ প্রতিষ্টিত, কিন্তু আমি স্ট্রাগল করে যাচ্ছি। কারণ আমি সিলেটি, কোন চ্যানেলের প্রোগ্রাম হেড হোক বা মার্কেটিং হেড হোক বা সিইও হোক, সিলেটিতো খুজেই পাই না। আমি ডিপ্লোমা করা ফিল্ম ডিরেক্টর, ডিপ্লোমা করা স্ক্রিপ্ট রাইটার, কিন্তু আমি পারি না, কিন্তু তারা পারে, তাদের ডিপ্লোমা লাগে না, তারা মেট্রিক পাস না করলেও চলে, আমি অনার্স-মাম্ট্রার্স করেও পারি না। কেন? ২০০২ ও ২০০৩ এ আমি যখন প্রথম চার মাস মেয়াদী মগবাজারের 'ঢাকা ফিল্ম ইন্সটিটিউট'এ ফিল্ম ডিরেক্টর কোর্স করি, আমার পরিচিত কয়েকজন অভিনয় করার জন্য ঢাকা গেল, তারা থিয়েটারও করলো কিন্তু কিছু করতে পারলো না। মাসের পর মাস মেসের বিল ও গাড়ি ভাড়া দিতে দিতে গ্রামে ফিরে গেল। ২০০৬-২০০৭ সালে আরো অনেকের সাথে পরিচয় হলো, কয়েকজনের বাড়ি সিলেটের ছাতকে, ঢাকা থেকে ক্যামেরা ভাড়া করে সিলেটে নিয়ে যায়, ভালো ভালো নায়ক-নায়িকা সিলেটে নিয়ে যায়, নাটক তৈরী করে, কিন্তু কোথাও বিক্রি করতে পারে না। পরে হতাশ হয়ে অন্য পেশায়। আমি আজো লেগে আছি। কাজও করছি, প্রচারও করছি। তবে স্বাধীন ভাই, আপনাকে সালাম, আপনি লড়াই করে যাচ্ছেন, কিন্তু আপনার স্ট্যাটাস দেখে কষ্ট থেকেই এই লেখা লেখতে বাধ্য হলাম।
সে যাই হোক, আমাদের কিন্তু উচিৎ সংযত হওয়া। পূর্বে সিলেট অঞ্চল নিজস্ব সংস্কৃতিতে থাকুক আর নাগরি ভাষায় থাকুক আর আসামের সাথে থাকুক, এখন আমরা রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে বাংলাদেশের সাথে। বাংলাদেশের অন্তর্ভূক্ত। তাই সবার উচিৎ জাতি নিয়ে, গোষ্টি নিয়ে, ভাষা নিয়ে সংযত হয়ে কথা বলা। কারণ এখানে এক গোষ্টি থেকে বাংলাদেশের জন্ম হয়নি। এক ভাষা নিয়েও বাংলাদেশের জন্ম হয় নি। আমার কথায় হয়তো কিছু আসে যাবে না, স্বাধীন ভাইয়ের কথায়ও কিছু আসে যাবে না, কিন্তু বাংলাদেশের জাতীয় পর্যায়ের কারো কথায় অনেক কিছু হয়ে যাবে। যেমন হয়েছিল জিন্নার কথায়। আমরা মানুষ জাতি, পৃথিবীর শ্রেষ্ট জীব। আমাদের উচিৎ ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়।
এবার একটা প্রসঙ্গ না লিখে পারছি না। বাংলাদেশের অনেক মহান ব্যক্তিদের কলাম পড়ে পড়ে বড়ো হয়েছি। তারমধ্যে অন্যতম জনাব আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী। আমি উনাকে অনেক শ্রদ্ধা করি। উনার একজন ভক্তও বলতে পারেন। আমি জানি উনি যুক্তি নিয়ে কথা বলেন। উনার অনেক কথার মধ্যে এই কথাটা মানতে পারলাম না, 'সিলেটিরা লাঙ্গল টু লন্ডন' আর 'সিলেটি ভাষা একটি উপভাষা'। ভাষা আর উপভাষা নিয়ে উপরে মোটামোটি আলোচনা করেছি। আর লাঙ্গল টু লন্ডন প্রসঙ্গে বলতে গেলে। বাংলাদেশের এমন কোন পরিবার নাই যে সে তার পূর্ব পুরুষ লাঙ্গল চাষ করেনি। সেটা নিজে করুক আর কাজের লোক দিয়ে করুক। সে ধান ক্ষেতে চাষ করুক আর বাসার ছাদের উপরে বালতিতে সবজি চাষ করুক। পৃথিবীর আদি থেকেই মানুষ চাষের সাথে সম্পর্কিত। আর সবাইকে কেনো চাষাই বা ভাবা হবে, কই আমিতো লাঙ্গল থেকে উঠে আসিনি, আমার বাবা, আমার দাদা, আমার পিতামহ, কেউতো চাষা ছিল না। আমার দাদা সেই পঞ্চাশের দশকে ইংল্যান্ডে এসেছেন, উনিতো লাঙ্গল টু লন্ডন আসেননি। উনি পাকিস্থান পুলিশেও চাকরিতে গিয়েছিলেন। আর আমিতো পড়া-লেখা করেছি, ব্যবস্থাপনায় অনার্স-মাস্টার্স করেছি, ইলেক্ট্রিকের উপর ডিপ্লোমা করেছি, কম্পিউটার হার্ডওয়্যার, সফটওয়্যার, গ্রাফিক্স, এডিটিং, ফিল্ম ডিরেকশন, স্ক্রিপ্ট রাইটিং এর উপর ডিপ্লোমা করেছি। লন্ডনে এসেও ডিপ্লোমা করেছি। লন্ডনে এসে আমাকে নাটক বানাতে একটু বাঁধার সম্মুখিনও হইনি। সবাই সহযোগিতা করে, কি জানি হয়তো চাষার ছেলেরা সহযোগিতা করে, আর জমিদারের ছেলেরা 'চাচা আপন প্রাণ বাঁচা' বলে। যাই হোক, সিলেট অঞ্চলের লোক ভ্রমণ পিপাসু। পৃথিবীর যে প্রান্তেই যান না কেন, একজন হলেও সিলেটি পাবেন। এর প্রমাণও পেয়েছি। একবার নর্দান সাইপ্রাসে গিয়েছিলাম, আমরা চার বন্ধু অসহায় হয়ে পড়েছিলাম, খুজে পেলাম কয়েকজনকে কিন্তু তারমধ্যে থেকে এক সিলেটি সহযোগিতা করেছেন, উনি বাসায় নিলেন, রাখলেন। কিন্তু বাকিরা বেশিদিন রাখতে দিল না, তাদের বাড়ির ঠিকানা আর নাই বা বললাম। আরেকবার তুর্কিতে ইস্তাম্বুলে গিয়েছিলাম, সেখানেও সিলেটি পেলাম। কেউ ব্যবসা করছে, কেউ বা অন্য কিছু। আমি এক লিখা পড়েছিলাম, যখন বাংলাদেশের নিম্নাঞ্চল চড়াঞ্চলে পরিণত হয়ে বসতি হচ্ছিল, তখন অনেক লোক সিলেট থেকেও গিয়ে বসতি গড়েছে, যারা সিলেটের নিম্নশ্রেণীর ছিল, তারা হয়তো চাষার লেভেলটা চেঞ্জ করতেই নিম্নাঞ্চলের দিকে গিয়েছিল। যেমন বরিশালেও অনেক লোকের পূর্বপুরুষ সিলেট অঞ্চল থেকে পড়ি দিয়েছেন। যাই হোক এ বিষয়ে পড়ে একদিন লিখবো।