somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ করণ্ডিকা

১৯ শে নভেম্বর, ২০১৭ রাত ১:৫৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



বড় মেয়ে পারুলের জন্মের পর অনিল মাস্টার মনে মনে ঠাকুরের কাছে মুখাগ্নি করার জন্য ছেলে চেয়েছিলেন। ঠাকুর তার আশা পুরণ করেননি। আরেকটি ফুটফুটে মেয়ে জন্ম দিয়ে পারুর মা আতুড় ঘরেই মারা যায়। অনিল মাস্টার মা হারা মিষ্টি মেয়েটির নাম রাখলেন কারু।

কারুর ষোল বছর বয়সে প্রতিবেশীরা প্রথম জানতে পারে তার আসল নাম কর-িকা। অপরিচিত দুর্বোধ্য নামটির অর্থ কেউ খুঁজে বের করতে না পেরে কারুর কাছেই নামের অর্থ জানতে চায় কিন্তু গাঁয়ের মেয়েটির কাছে 'কর-িকা' শব্দটির মতো দুর্বোধ্য রহস্যময় আর কিছু নেই। মা মরা মেয়েটিকে অনিল মাস্টার অতি স্নেহের প্রগাঢ়তা বুঝাতে টিনের ছাউনির ঘরটির সামনে চৌকোনা নেমপ্লেটে 'কর-িকা' নামটি আর্ট করে লিখিয়ে লটকে দিলেন। পাড়া প্রতিবেশীর কৌতুহলী মন রহস্যময় নামটির অর্থ খুঁজে ক্লান্ত হয়ে শেষে সবাই চুপ হয়ে যায়।
পারুর বিয়ে দিয়ে অনিল মাস্টার স্নেহের কারুকে নিয়ে বসবাস করে। যখন বর্ষার দিনে টিনের চালের ফুটো ভেদ করে জং ধরা টিনের লাল আস্তরণ বৃষ্টির জলে মিশে টুপ করে কাঁচা খাটালে পড়ে কারু সেখানে গামলা পাতে। গামলায় জমানো পানি খেজুর রসের মতো লাল হওয়ায় কারু জলের দিকে বিস্ময় ভরা চোখে চেয়ে থাকে। জল কি করে লাল হল মা থাকলে তার কাছে জানতে চাওয়া যেত কিন্তু সে এখন অদৃশ্যের ঠিকানায়।

মাঘের হাড় কাঁপানো শীতে অনিল মাস্টার কাবু হয়ে পড়ে। চট আর কাপড়ে তৈরী পুরণো পুরু কাঁথা কারু বাবার শরীরে জড়িয়ে দেয়। অনভিজ্ঞ কিশোরী বাবাকে কি করে একটু শান্তি দিতে পারে সে চিন্তায় ব্যাকুল হয়ে মাটির মালসায় তুষের আগুন ধরিয়ে বাবাকে পোহাতে দেয়। টিনের বেড়ার ছিদ্রগুলি নিপূণতার সাথে কাপড় দিয়ে ঢাকে। বাইরের হিম বাতাস বাবার কাছে আর আসতে পারেনা।
সকালের সোনা ঝরা রোদে পিঠ দিয়ে অনিল মাস্টার তিনমাথা এক করে ভাবে। বেলা বাড়ার সাথে কারু বাবার জন্য গোসলের গরম পানি নিয়ে আসে। অনিল মাস্টার মেয়ের মাথায় আদরের হাত বুলিয়ে পাশে বসায়। কারু বাবার মুখের দিকে চেয়ে অপিরিচিত একটা ছায়া দেখে। গা ঝাড়া দেওয়া ভয়ে একটা হীম শরীর বেয়ে ধমনীতে গড়ায়। মনে হয় চিরচেনা বাবার মুখটা বরাবরের মতো নয়। মুমূর্ষূ মৃত্যুযাত্রীর মুখের উপর যেভাবে একটি ফ্যাকাশে ছায়া পড়ে মুখটা অচেনা মনে হয়, অনিল মাস্টারের মুখটা দেখতে সেরকমই লাগে। কারু বাবার কোল ঘেষে ছোট স্বরে জানতে চায়, --শইলডা কেমন লাগে বাবু?

অনিল মাস্টার পরম স্নেহে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,- মারে, সোমায়তো বেশী নাই। কোন সোমায় তোর মায় স্বর্গে ডাইক্যা নেয় কইতে পারিনা। তোর বিয়াডা দেতে পারলে এট্টু শান্তি পাইতাম।

কারু বাবার ঘোলাটে চোখের দিকে নিস্পলক চেয়ে থাকে। সে চুপ করে বাবার শুষ্ক আর নির্বাক মুখে তাকিয়ে শিশুর ছায়া দেখতে পায়। এ রূপে বাবাকে আর কখনো দেখেছে কিনা মনে পড়েনা। মায়ের স্নেহ সে পায়নি কিন্তু বাবার আদরে তার মনের সবকূল ছাপিয়ে গেছে। তখন অনিল মাস্টার পরম স্নেহে কারুর মাথাটা বুকের সাথে চেপে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে।

বিয়ের কথাটি শোনার পর কারুর মাঝে এক অদ্ভূত পরিবর্তণ দেখা যায়। আগের মতো আর হাসির ফোয়ারা ছুটিয়ে প্রতিবেশী চাচীর মেজাজ খারাপ করেনা। সংসারের কাজে সে পুরো মন দিয়েছে। বাবাকে একজন মায়ের ভূমিকায় শিশুর মতো যতœ করে। সন্ধ্যায় পড়ার টেবিলে বসে বইয়ের পৃষ্ঠায় কালো অক্ষরগুলি তার কাছে অপরিচিত এবং দুর্বোধ্য লাগে। বইয়ের দিকে তাকিয়ে নিজের ভবিষ্যত কল্পনা করে। কল্পনায় সে কখনো মা হয়ে পরম মমতায় শিশুর মতো বাবাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। জগতে বাবা ছাড়া তার আপন কেউ নেই। কলেজে সে প্রায় অনিয়মিতই হয়ে গেল।

অবস্থা বেগতিক দেখে কারু বড়দিদি পারুকে খবর দিল। পারু বাপের বাড়ি এসে বাবার মুখটা দেখে খুব কাঁদল। আবেগ ভালোবাসার অনুভূতিটা কান্নায় কিছুটা হালকা হলে পারুর হাত ধরে অনিল মাস্টার কারুর বিয়ের কথা তোলে। চিতায় ওঠার আগে সে মেয়েটির গতি দেখে যেতে চায়। পারু বাবাকে আশ্বস্ত করল। অনিল মাস্টার কিছুটা আশ্বাস পেয়ে ক্লান্তিতে চোখ বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়ল।

একদিন কুয়াশাচ্ছন্ন সন্ধ্যায় পারুর বর পিসতুতভাই সঞ্জয়কে নিয়ে শ্বশুড় বাড়ী আসে। ছেলের ঝালকাঠীর ফরিয়া পট্টি পাইকেরী মুদিখানার মোকাম আছে। বয়স একটু বেশী, মুখে বয়সের রেখা দেখা যায়। মুদিখানার মালিক হওয়ায় পয়সার কাছে বয়স চাপা পরে ব্যবসায়ী নামটা সামনে চলে আসে। জামাইবাবু শালীর জন্য উপযুক্ত পাত্র নির্বাচন করতে ভুল করেনি। ক'দিন পর বিয়ে হলে শালী নিজেই পাত্রের পয়সার জৌলুস দেখে সূখ অনুমান করতে পারবে। কারু চা নাস্তার ট্রে হাতে নিয়ে হাতিনায় এসে জড়োসরো হয়ে কাঠের চেয়ারে বসে।

মেয়ে তাদের পছন্দ হলো খুব। পাত্র ধ্যানমগ্ন হয়ে কারুর মুখের দিকে চেয়েই রইল। বাম গালের নিচে কারুর তিলটি তাকে খুব আকৃষ্ট করেছে। দাঁড়িয়ে, হাঁটিয়ে দেখানোর সময় কারুর মুখের দিকে চেয়ে পাত্র নতুন আরেকটি ভালোলাগা খুঁজে পেল। ভার মুখটি একটু উজ্জ্বল করে তাকালে গালের মাঝখানে টোল পরে কয়েকটি রেখাঙ্কিত হয়। এই সুন্দর টোলটা সচরাচার মেয়েদের মুখে দেখা যায় না। তাই পাত্র আড়ালে ডেকে কারুর জামাইবাবুকে আবেগ উৎসাহে পছন্দ হয়েছে বলে জানায়। ফাল্গুণ মাসের কোনো এক লগ্নে বিয়ের সানাই বাজবে বলে আশ্বস্ত করে পাত্রপক্ষ বিদায় নেয়।

ফাল্গুণের প্রথম দিকের এক দুপুরে চেয়ারম্যানের ছোট ছেলে কারুদের ঘরের সামনে দিয়ে কোথাও হেঁটে যাচ্ছিল। উঠাণের পাশে বেড়ির মতো উচু জায়গাটিতে ফুল গাছ থেকে ফুল ছেঁড়ে। নাকে সুবাস নিয়ে নিঃশ্বাস বন্ধ করে যখন চোখ খোলে তখন গোসল সেরে কারু চোখের সামনে হেঁটে যাচ্ছিল। সে চুলে গামছা মুড়িয়ে, হাতে বালতি নিয়ে উঠানের শেষ মাথায় যাচ্ছে। সেখানে দড়ির উপর স্যালোয়ার কামিজ মেলে দিয়ে ঘরে যাবে। চেয়ারম্যানের ছেলে দেখল দিনে দুপুরে ভরা পুর্ণিমার বড় চাঁদটা চোখের সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছে। বন্ধু বুটকুর কাছে মেয়েটির পরিচয় জানতে চায়। বুটকু একগাল হেসে বলে,- ওর নাম কারু। অনিল মাস্টারের ছোড মাইয়া।
সে’দিনের পর থেকে চেয়ারম্যানের ছেলে কারুর পিছে লাগল। সময়ে অসময়ে ছুতা দিয়ে কারুদের ঘরে এসে অনিল মাস্টারের সাথে গল্প জুড়ে দেয়। চেয়ারম্যানের রিলিফের চাল, গম বস্তায় বস্তায় কারুদের ঘরে আসে। স্লিপের দরকার হয়না। কারু তখন খুব রকম বেকায়দায় পড়ে।

ফাল্গুনের এক দুপুরে বাতাসে জানালার পাশে অনিল মাস্টার নিরবে ঘুমায়। কারু তখন রান্না ঘরে ছিল। চেয়ারম্যানের ছেলে দুপুরের নির্জনে কারুদের উঠনে এসে এদিক উদিক উঁকি দেয়। অনিল মাস্টারকে ঘুম থেকে জাগিয়ে ফলের জুস খাওয়ায়। রোগগ্রস্থ্য অনিল মাস্টার জুস পেয়ে খুশি না অখুশি বোঝা যায়না তবে পাঁচ মিনিটের মাথায় সে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। জুসের ভিতর চেয়ারম্যানের ছেলে যে ওষুধ মিশিয়েছিল সেটা কাজ করতে পাঁচ মিনিটের বেশী সময় লাগেনি।

দুপুরের গরমে কারু রান্নার কাজ শেষ করে হাড়িতে লুচমি দিচ্ছিল। চেয়ারম্যানের ছেলে কারুর সামনে গিয়ে সালুনের হাড়িতে হাত ডুবায়। ঝোলের উপর ডুবে থাকা আলুর টুকরা মুখে পুড়ে কারুর হাতটা চেপে ধরে। বুকের কাছে টেনে এনে শুষ্ক গোলাপী ঠোঁটে চুমু খেয়ে বলে,- তরে মুই বিয়া করমু কারু। ব্যপারটি দেখে কারু অস্বস্তিেেত পড়ে। বাবু বাবু বলে কয়েকবার ডেকে অনিল মাস্টারের যখন রা’শব্দটি শোনেনা তখন বুকের ভিতর ধক করে ওঠে। দুপুরের নির্জনতায় প্রতিবেশী সবাই ঘরের ভিতর খাবারের অপেক্ষায় ব্যস্ত। চেয়ারম্যানের ছেলে সূযোগটি হাতছাড়া করল না। কারুকে রান্না ঘরের ছেঁড়া মাদুরে শোয়ায়। চিৎকার করতে গেলে মুখ চেপে ধরে বিষ্ফোরিত চোখে শাসায়। শেষে কারু নিস্তেজ হয়ে পড়ল। ধস্তাধস্তিতে জামার কিছু অংশ ছিঁড়ে গেল। চেয়ারম্যানের ছেলের বহূদিনের মনের ইচ্ছা পুরণ হলো।
ঘটনার পর কারু চিন্তায় ভেঙ্গে পড়ে। জোড়াজুড়িতে শরীরের ব্যাথাটা ভীষণ রকম টের পেল। কোমড়ের নিচের পুরুষালী স্পর্শের অনুভূতি ভুলতে পারেনা। কয়েকদিন কারু কাজকর্ম ছেড়ে বিছানায় পড়ে রইল।

বিয়ের দিন ঘনিয়ে আসায় কারুর মনে আরেকটি বেদনা সজাগ হয়। মনে মনে ভাবে, দিন দুপুরে আমার লুকোনো শরীর যে ছেলেটি চেয়ে দেখল, আমার শরীরকে ছিন্নভিন্ন করে সব লজ্জা উন্মুক্ত করে দিল। তাকে ছাড়া এই নোংরা শরীরটা আর কাকে দেখানো যায়! কিন্তু এ কথা চেয়ারম্যানের ছেলেকে বলার উপায় নেই, কারণ সেদিনের পর চেয়ারম্যানের ছেলের আর দেখা নেই। বুটকুকে রাস্তায় পেয়ে একদিন কারু খুব অনুরোধ করল। চেয়ারম্যানের ছেলে তার সাথে যেন একবার দেখা করে। বুটকু আরেকটি নতুন খবর কারুকে জানায়। সেদিন বিকেলে চেয়াম্যানের ছেলে পুলিশের কাছে ধরা পড়ে। গোডাউনের চাল সরানোর দায়ে এখন সে জেল হাজতে। ঘটনা শুনে কারু বুঝতে পারে উপায় আর তার কাছে কিছু নেই। মুদিখানার মোকামওয়ালাকেই বিয়ে করতে হবে।

ফাল্গুণের মাঝামাঝি রাতের আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ যেদিন পূর্ণতা ছড়িয়েছিল সেদিন চেয়ারম্যানের ছেলে ছাড়া পেয়ে কারুর সাথে দেখা করতে আসে। একবার তার মনে হয়েছিল অনিল মাস্টারের সাথে দেখা করে। কিন্তু সেদিন নির্জন দুপুরে যে ঘটনা সে ঘটিয়েছে তা মনে পড়তেই মনের মাঝে লজ্জা, ভয় চেপে বসে। শেষে ঘরের পিছনদিক দিয়ে জানালার পাশে গিয়ে কারুকে ফিসফিসিয়ে ডাকে। কারু তখন জীবনের চরম দুর্ঘটনা মুছে ফেলে নীরবে ঘুমায়। বারবার ফিসফিসানিতে কারুর ঘুম ভাঙ্গল। জানালা খুলে তাকিয়ে দেখে বাড়ির পেছনের বাশঁঝাড়ের কাছে জোছনার বৃষ্টি হচ্ছে। সেখানে দাঁড়ানো অস্পষ্ট মানুষটিকে কারু চেনে।

কারু সোদিন বাইরে বের হয়নি। গভীর রাতের চাঁদোয়া আলোয় বাঁশ বাগানের ছায়াটা দেখে কারুর মনে হলো চেয়ারম্যানের ছেলে আরেকবার সূযোগ নিতে এসেছে। যুবতী মনে যে ভ্রান্ত ধারণাটা জন্মে ছিল তা মুহূর্তে উবে যায়। জানালাটা সে বন্ধ করে দিল। ভয়ে গলাটা শুকিয়ে এলে উঠে জল খেয়ে বাবার কাছে যায়। অনিল মাস্টার ঘুম থেকে জেগে মেয়ের চুপসে যাওয়া মুখ দেখে বিচলিত হয়ে পড়ে। কারু কিছু বলতে পারেনা। একে সে সম্মান হারিয়েছে তা আবার মুসলমানের ছেলের থেকে। বাবুকে জানালে নির্ঘাত কষ্ট পেয়ে কি করে কে জানে! বিষয়টি কারু চেপেই গেল। চেয়ারম্যানের ছেলে আর স্থির থাকল না। কারু খট করে জানালা বন্ধ করায় রাগে সে গজগজ করে। দরজায় নক করার শব্দ পেয়ে কারু দম আটকে দাঁড়িয়ে থাকে। ক্লান্তি অবসাদ, টেনশনের পীড়ন তাকে বিপর্যস্ত করে তোলে। চেপে বসা দুঃসহ মস্তিষ্কপীড়নে ঘেমে স্নান করে। তখনি কয়েকটি লাথির আঘাতে সামনের দরজা খুলে যায়। কারু আড়ষ্ঠ পায়ে বাবার কাছে গিয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসে। চেয়ারম্যানের ছেলে তখন হুংকার দিয়ে শাসায়।

- হ্যারে কারু, এত দেমাগ কিল্লাইগ্যা? দেমাগতো হেইদিন ভাইঙ্গা দেলাম। আমার তোরে লাগবে। অনিল মাস্টার ভাংগা চশমাটা চোখে পরে একবার কারুর মুখের দিকে চেয়ে আবার চেয়ারম্যানের ছেলের দিকে তাকায়। কারু ভাবে বিষয় যা হয়েছে সেটা বাবুকে বুঝতে দেয়া যাবেনা। চেয়ারম্যানের ছেলে আরো চড়াও হলো। উঠাণে দাঁড়ানো বুটবুকে ঘরের ভিতর আসতে বলল। অনিল মাস্টারকে বলল,- কারুরে লইয়া গেলাম, অওে মুই বিয়া হরমু।

কারুর চিৎকারে প্রতিবেশীদের ঘুম ভাঙ্গল। দু'চারজন করে কারুদের ঘরের পাশে ভীড় করল। অনিল মাস্টার চশমাটা খুলে শুয়ে পড়ে। তখন মাঝ রাত পেরিয়ে চাঁদের আলো ঝিমিয়ে পড়েছে। অনিল মাস্টার শরীরে খিচ দিয়ে দুটো উপরমুখী টান দিল। তারপর পুরোপুরি স্তব্ধ।
সকাল হতেই বাতাসে চাউর হয়ে গেল রাতের ঘটনা। ঘটনার ডালপালা ছড়িয়ে আরো অনেক কিছু। চেয়ারম্যানের ছেলে কারুর ইজ্জত মেরেছে। শোকে অনিল মাস্টার স্বর্গে গেছে। হিন্দুরা ছ্যা ছ্যা করে জাতের কলঙ্ক দিল। মুসলমানরা কারুকে মুহূর্তেই চরিত্রহীনা বলতে ছাড়েনা। সেদিন নির্জন দুপুরের ঘটনাটা কারুর মনের ভিতর আছাড় খেয়ে মরে। বাবা আর নড়েনা দেখে জোড়ে চিৎকার দিয়ে লাশের উপর লুটিয়ে পড়ল।

চেয়ারম্যানের ছেলেকে তারপর আর গ্রামে দেখা যায় না। পুলিশ এল। অনিল মাস্টারকে শ্মশানে নেয়া হলো। পাারু ও কারু দু বোন মিলে উঠাণে আছাড় খেতে থাকল।

পুলিশ দু'চার দিন চেয়ারম্যানের বাড়ি গিয়ে তার ছেলেকে খুঁজে চলে আসে। আসামী পলাতক বলে রিপোর্ট লিখে ক্ষান্ত হয়। একদল তরুণ কারুর পক্ষে দু’চারদিন রাস্তায়, চায়ের দোকানের আড্ডায় বয়ান দিল। ফেইজবুকের পাতায় স্ট্যাটাস দিয়ে লাইক কুড়ালো, তারপর সবাই চুপচাপ।

কারুদের বাড়ি চেয়ারম্যানের ছেলের আসা যাওয়া অনেকেরই চোখে পড়ত। এখন সবার মুখে মুখে একই কথা। অনিল মাস্টার অপকর্ম দেখে সইতে পারেনি। অধর্ম তাকে ধাক্কা দিয়েছে তাই দুইটানে স্বর্গে চলে গেছে।

বিয়ে আর হলোনা কারুর। সে বড়বোন পারুর সাথে তার শ্বশুড় বাড়ী যায়। কারুকে নিয়ে পারু একরকম বিপদেই পড়ল। তার শ্বশুড়বাড়ীর মানুষ কারুকে তাদের বাড়ি আর রাখতে চায় না। ঘটনা যা হয়েছে তাতে সমাজে মুখ দেখানো দায়। মুসলমানের ছেলের সাথে কারুর প্রেম। এ মেয়ে এ বাড়ি রাখলে জাত ধর্ম সব যাবে। পারুর চাপ দেখে কারু খুব চিন্তায় পড়ল। কোথায় যাবে কি করবে ভেবে পায়না। শেষে একদিন বিকেলে পারুকে কিছু না বলেই হাঁটা শুরু করল।

একা মেয়েমানুষ তার উপর যুবতী কোথায় যাবে কারু। শিবপুর হাট পার হতেই সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। সে কোথায় যাবে, কার কাছে যাবে ঠিক করতে পারেনা। সন্ধ্যার একটু পরেই খালের ধারের রাস্তায় ঝিমধরা নির্জনতা নামে। গাছ-গাছালিতে ঘেরা সরু রাস্তার পথ ধরে যেতে হবে শহর বাসস্ট্যান্ড। তারপর কোথায় গন্তব্য জানা নেই। কারু আর সাহস করতে পারেনা। আধাঘন্টা পথ হাঁটলেই বাপের ভিটা। শেষে সেখানেই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল।

কারু উঠানে গিয়ে দেখল, কর-িকা লেখা সাইন এখন বেড়ার সাথে নেই। কে কখন কি করেছে কে জানে! শিকল খুলে ঘরে ঢুকে দেখে অনিল মাস্টারের খাটে দুটি বিড়াল গা ছেড়ে ঘুমায়। কারুর অস্তিত্ব টের পেয়ে মিউ মিউ করে ডাকে। কারু বিছানা ঝেড়ে মুছে হাতিনায় ঘুমাল। কখনো ঘুমে কখনো সজাগ রাতটা পার করে ভয়ে ভয়ে। পরদিন বেলা বাড়লে তার ঘুম ভাঙ্গে। দুপুরের আগে দড়জা খুলে দেখে পুরো উঠান মলমুত্রে একাকার।

কারু এবার একা জীবন শুরু করল। প্রতিবেশীরা দেখে দূর থেকে মুখ বাঁকিয়ে চলে যায়। ভালোমন্দ খবর নিতে কেউ কাছে আসেনা। আবার মুখরোচক কাহিনীতে গ্রামে ছড়িয়ে যায় কারুর নতুন গল্প। চেয়ারম্যানের ছেলে মাঝ রাতে কারুর কাছে আসে।
একা কারুর টিনের বেড়ায় মাঝরাতে দুষ্টু ছেলেরা ঢিল ছোড়ে। জং ধরা টিন ভেঙ্গে সে ঢিল মাটির কলসে লেগে ভেঙ্গে যায়। ভেতরের পুরাণ চাল ছড়িয়ে পরে খাটালে। সকাল হলে কারু চাল কুড়িয়ে, বেছে হাপিয়ে ওঠে।

পনের দিন কারুর এভাবেই কাটে। সকালে তুলসির গায়ে জল ঢালে। দুপুরে দুলাইন জানা গীতার পদ আওড়ায়। রাতে কাঁথার বিছানায় এ পাশ ওপাশ করে কাটায়।

একদিন অমবস্যার মতো ঘোর আঁধার রাতে কারু জানালার পাশে ফিসফিসানি টের পেল। আবার সেই পরিচিত কন্ঠ। উৎকন্ঠায় পাগলের মতো অবস্থা। শূন্য বৃত্তের মাঝে দেহ আছড়ায়। ফিসফিসিয়ে সেই ঘৃণিত কন্ঠ তার নাম ধরে ডাকে কারু,- ও কারু? কারু বুঝতে পারল। চেয়ারম্যানের ছেলে কোথা থেকে মৃত্যুর মতো আঁধার মাথায় নিয়ে এসেছে কে জানে!

তখন কারুর সব মনে পড়ে। সেই প্রথম দিনের কথা। গাঁজার গন্ধে ভরা মুখটা কিরকম ঘষেছিল কারুর গালে। হিংস্র জানোয়ারের মতো মুখ চেপে ঝাপিয়ে পড়েছিল দেহে। কিভাবে অনাভ্রু করেছিল পবিত্র দেহটি। দু’বাহূ দিয়ে চেপে ধরেছিল সজোড়ে। তারপর অনিল মাস্টারের ভয়ার্ত চোখের করুণ চাহনি। দুই টানে কি করে মরে গেল সেই দৃশ্য।

কারু সামনের দরজা খুলে দেয়। চেয়ারম্যানের ছেলে ঘরে আসে। আঁধারে কেউ কারো মুখ দেখতে পায় না। চেয়াম্যানের ছেলে ফিসফিসিয়ে বলে,- ল কারু ঢাকা যাই। তরে বিয়া হরমুআনে।

তারপর সে আরো কাছে ঘেষে। কারুকে টেনে নেয় নিজের আয়ত্বে। দ্বিধাহীন শুয়ে পড়ে জীর্ণ কাঁথার বিছানায়। তখন চুপচাপ কারু। অহেতুক ছেঁকে-ধরা ভযগুলো সরে যেতে থাকে। বড় বড় নিশ্বাসে বুক ওঠানামা করে আর ঢোক গেলে। তখন দূর থেকে ভেসে আসে মহাজাগতিক ধ্বনি। পালকের মতো হালকা হতে থাকে ভয়ের ভাড়ী অনুভূতিগুলো। কারু তখন ডান হাতটা ছড়িয়ে রাখে একটু দূরে নিজের আয়ত্বে।

চেয়ারম্যানের ছেলে নেশায় ঢলে পড়ে। তার ফুলে ওঠা পুরুষাঙ্গে রক্তের স্রোত নামে। প্রস্তুত করে নিজেকে আরেকটি আদিম অসভ্য আয়োজনে। চুপচাপ কারু নড়ে ওঠে। বামহাতে মুঠো করে ধরে ফাঁপানো ধর্ষকের শিশ্ন। ডান হাতের ব্লেড দিয়ে জোড়ে জোড়ে পোছায়। ধর্ষকের রক্তে ভিজে যায় পুরণো কাঁথা বালিস। একটি চিৎকার আঁধার ভেদ করে ছড়িয়ে পড়ে গ্রামে। হয়ত আরো দূরে।

পুলিস আবার আসে। কারুর হাতে হাতকড়া পরে। গিজগিজে মানুষের দিকে চেয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে কারু। দেখে মনে হয় সে কিছু করেই নি। পুলিশ তাকে যাবার জন্য তাড়া দেয়। কারু তখন চেয়ে দেখে কর-িকা লেখা ফলকটি অযত্নে আছে তুলশি গাছের আড়ালে। সে ফলকটি হাতে নিয়ে পুলিশের সাথে হাঁটে। ফুলহীন ঝুড়ির মতো কর-িকা নাম ফলকের ঘরটি মানুষহীন ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। গ্রামের মানুষ তখন রা'শব্দটি করেনা।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে নভেম্বর, ২০১৭ রাত ১:৫৮
৬টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

রম্য: টিপ

লিখেছেন গিয়াস উদ্দিন লিটন, ১৫ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৫




ক্লাস থ্রীয়ে পড়ার সময় জীবনের প্রথম ক্লাস টু'এর এক রমনিকে টিপ দিয়েছিলাম। সলজ্জ হেসে সেই রমনি আমার টিপ গ্রহণ করলেও পরে তার সখীগণের প্ররোচনায় টিপ দেওয়ার কথা হেড স্যারকে জানিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বৈশাখে ইলিশ

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৫ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৪০



এবার বেশ আশ্চর্য ঘটনা ঘটেছে । বৈশাখ কে সামনে রেখে ইলিশের কথা মনে রাখিনি । একদিক দিয়ে ভাল হয়েছে যে ইলিশকে কিঞ্চিত হলেও ভুলতে পেরেছি । ইলিশ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার প্রিয় কাকুর দেশে (ছবি ব্লগ) :#gt

লিখেছেন জুন, ১৫ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৩



অনেক অনেক দিন পর ব্লগ লিখতে বসলাম। গতকাল আমার প্রিয় কাকুর দেশে এসে পৌছালাম। এখন আছি নিউইয়র্কে। এরপরের গন্তব্য ন্যাশভিল তারপর টরেন্টো তারপর সাস্কাচুয়ান, তারপর ইনশাআল্লাহ ঢাকা। এত লম্বা... ...বাকিটুকু পড়ুন

যেরত

লিখেছেন রাসেল রুশো, ১৫ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:০৬

এবারও তো হবে ইদ তোমাদের ছাড়া
অথচ আমার কানে বাজছে না নসিহত
কীভাবে কোন পথে গেলে নমাজ হবে পরিপাটি
কোন পায়ে বের হলে ফেরেশতা করবে সালাম
আমার নামতার খাতায় লিখে রেখেছি পুরোনো তালিম
দেখে দেখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসরায়েল

লিখেছেন সাইফুলসাইফসাই, ১৬ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৪৮

ইসরায়েল
সাইফুল ইসলাম সাঈফ

এ মাকে হত্যা করেছে ইসরায়েল
এ বাবাকে হত্যা করেছে ইসরায়েল
নিরীহ শিশুদের হত্যা করেছে ইসরায়েল
এই বৃ্দ্ধ-বৃদ্ধাদের হত্যা করেছে ইসরায়েল
এ ভাইক হত্যা করেছে ইসরায়েল
এ বোনকে হত্যা করেছে ইসরায়েল
তারা মানুষ, এরাও মানুষ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×