somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ জায়গীর

০১ লা নভেম্বর, ২০১৮ রাত ৩:০৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

প্রিয় বন্ধুরা, যেহেতু আমি গল্পটি আমার মত করে লিখেছি। তবে প্রকাশের আগে গল্পটি আপনাদের চোখ দিয়ে দেখতে চাই। অনুগ্রহ করে একটু সময় বের করে পড়ে আপনাদের গুরুত্বপূর্ণ মতামত জানালে কৃতজ্ঞ হব।

জায়গীর

সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছিল। রাস্তাটা যথারীতি ক্লান্ত। গোসাইহাট হাইস্কুলের পেছনের রাস্তায় নেমে হাবিবের মনে হয় গ্রামটি আর আগের মত নেই। রোদে পুড়ে যাওয়া কঙ্কালসার মানুষগুলোর অবস্থা ফিরে হয়েছে পুরোদস্তুর আধুনিক। শহরের প্রলেপ পরিয়ে তারা সনাতন গ্রামটাকে অলকৃত করেছে। কোথাও ছিটেফোটা জীর্ণতার চিহ্নমাত্র নেই। এত বছরের ব্যবধানে জায়গাটা আগের মত আর থাকবেনা একথা সত্য তবে এতটা যে বদলে যাবে সেটাও ভাবতে পারেনি সে। স্কুলটা নদীর ধারে একচিলতে মাঠের কোণে এতিম শিশুটির মত দাঁড়িয়ে ছিল। জোয়ারের সময় চোরা ফাটল দিয়ে ভুলভুল করে জল উঠে ছাপিয়ে যেত মাঠ। টিনের চালাটা বাতাসে দোল খেয়ে ঝনঝন করে উঠত আর বেড়ার ফাঁক দিয়ে প্রকা- আকাশটা মাঝে মাঝে তার সাজশয্যা, মান-অভিমান দেখাতে ভুল করত না। স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী ছিল মাংসহীন একেকটা জীব। যেন বাতাসের সাথে টলতে টলতে পড়ে যায়। একদিন এই স্কুলমাঠে হাবিব ফুটবল খেলা শেষ হলে নদীর ঘোলাজলে গোসল করে কাঁচা রাস্তার পথ ধরে যেত জায়গির বাড়ি । সে সময়টা এখন বহু অতীত। অথচ, গরিব পল্লীর এই রাস্তায় কত বছর সে হেঁটেহেঁটে কাটিয়েছে। কত বিকেল সে নদীর পাশে বসে ওপারের নদী লাগোয়া বাড়ির মানুষের গোসল করা দেখেছে। কত নৌকা পাল তুলে চোখের সামনে দিয়ে চলে গেছে সেসবের অনেক কিছুই এখন আর মনে নেই। সন্ধ্যায় ভেঁপু বাজিয়ে ঢাকাগামী লঞ্চ এসে ভিড়ত এখানকার ঘাটে। দূর-দূরান্তের মানুষ এই ঘাট দিয়ে ঢাকার লঞ্চে উঠেছে। আপনজনের বিদায়বেলা পরমাত্মীয়েরা কীরকম ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদত আর ধোয়া ওঠা লঞ্চের চিমনির দিকে তাকিয়ে থাকত নির্বিকারভাবে। হাবিব একটা পান দোকানে ঢুকে লোকটিকে বলল, হালাদার বাড়ি চেনেন চাচামিয়া?
শীর্ণকায়, অকালবৃদ্ধ লোকটি কেটলিটা চুলোয় রেখে তাকাল হাবিবের দিকে। কিছুটা বিচলিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, আপনে কেডা বাবা? হাবিবের বিস্তারিত পরিচয় দেওয়ার সময় নেই। লোকটির আঙ্গুল উঁচিয়ে দেখানো সংকীর্ণ পথ ধরে সোজা হাঁটতে থাকে সে। নারকেল সুপারির বাগান পেছনে ফেলে পুরনো উঁচু পুকুরপাড় হয়ে সিরাজ হালাদার বাড়ির নাগাল পায়।
বাড়ির চেহারাও ঠিক আগের মত নেই। পাশাপাশি চারটি ঘরের উঠোনে যে বড়ই গাছটি ছিল সেখানে এখন টিনসেট দালান। গোবরজলে লেপা উঠোনটা চকচক করছে। মাটি দিয়ে উঁচু করা উঠানের চত্তরে সবুজ মাঝারি মেহগিনি গাছের পাতা দুলছে নিরিবিলি হাওয়ায়। ঘরগুলোর জানালার ফাঁক গলে বিদ্যুতের যে আলোর ঝলক উঁকি দিচ্ছে তাতে কোনো ভাবেই উল্লেখ করা যায় না এই বাড়ির মানুষ প্রায় দুদশক আগে এতটা দরিদ্র ছিল। হাবিব উঠানের দক্ষিণ দিকের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, সিরাজ চাচা বাড়ি আছেন নি?
দরজা খুলে ভেতর থেকে এক বৃদ্ধ আসে বারন্দায়। মাথায় পাকা চুল, থুতনিতে কয়েকগাছি দাড়ি হালকা বাতাসে দুলছে। টলতে টেলতে সে উঠানে নামার চেষ্টা করে হোচট খেয়ে কিছুক্ষণ সিঁড়ির থাম আঁকড়ে ধরে দাঁড়ায়। তার হাটার ভঙ্গি দেখে মনে হয় না সে শক্ত সামর্থ্য আছে। লোকটির পা ছুঁয়ে সালাম করে হাবিব বলে, আমারে চিনছেন নি চাচামিয়া? আমি হাবিব, আপনেগো হাবু। হঠাৎ লোকটির কোথায় যেন বাঁধ ভাঙা জোয়ারের মত জল উঠল ছাপিয়ে। যেন আবেগ এসে খুলে দিল ভালোবাসার দুয়ার। লোকটির ঠোঁটদুটো বাঁকা হয়, ঝুলে পড়া ভ্রুর নিচে ম্রিয়মান চোখদুটি আনন্দে চকচক করে ওঠে। হাবিবকে জড়িয়ে ধরে সিরাজ হালাদারের মনে হয় হাজার বছরের খালি বুক মুহূর্তে ভরাট হয়ে গেছে। তখন পাশের ঘরের শিশু আর মহিলাদের কণ্ঠস্বরে আসন্ন সন্ধার রহস্য ও স্তব্ধতা ভেঙে যায়। পুরো বাড়ির জুড়ে মৌন একটা আলোড়ন।
সিরাজ হালাদারের বউ জাকিয়া বেগমকে দেখে হাবিবের যেন বুক ভেঙে যায়। কি সোনার পুতুলের মত শ্রী ছিল তার। অথচ মুখের দিকে তাকানো যায় না মোটে। ঘোমটার আড়াল থেকে কয়েকগাছি সাদা চুল উঁকি দিচ্ছে তার। শরীরটা আগের মত আর পাতলা গড়নে নেই। ভরাট মাংসে মুখের বসন্তের দাগ মিলিয়ে গেছে কোথায়! গায়ের রং হয়েছে পোড়া চুলার মাটি। আঠার বছরের পুরনো মুখখানি হাবিবের চোখের সামনে ঝুলে আছে অথচ, সেই মুখের সাথে এই মুখ কোনো ভাবেই মেলাতে পারে না। হাবিবের এ বাড়িতে আসার প্রথম দিনের কথা মনে পড়ে যায়।
বাড়ির নিত্য অভাবের মাঝেও ছেলেটাকে লেখাপড়া শেখাতে পশারিবুনিয়া গ্রামের আবদুল মোতালেবের মেঝছেলে হাবিবকে তিন গ্রামের পরে জায়গীরে আসতে হয়। চেনা গ্রামটিকে পর করে যখন সে আচেনা গ্রামের পথে রওয়ানা হল, পথের ধারে দাঁড়িয়ে অঝরে কেঁদেছিলেন মা। ছেঁড়া পাড়ের মোটা শাড়ির আঁচল ছিল মায়ের মাথার ওপর। কী মায়াময় জীবন! সাময়িক সময়ের জন্য নিজের জন্মস্থান ত্যাগ করাও বড় কষ্টের। হাবিব বাড়ির পথের বাঁক পেরিয়ে রাস্তায় ওঠার আগে শেষবারের মত ফিরে তাকায় পেছনের দিকে সবুজ গাছ-পালার আড়ালে কলাপাতার বেড়ার ভেতর নিজেদের ঘরের দিকে। তিন তিনটে রেইট্রি গাছ আর চোখের আড়াল হতে চলেছে কাঠের ছোট্ট বাড়িটা। হাবিব প্রতিজ্ঞা করেছিল, সে একদিন পড়াশোনা শেষ করে বড় সাহেব হবে। চাকুরিতে প্রথম বেতন পেয়ে মায়ের জন্য কিনবে নতুন শাড়ী।
চাকুরি সে ঠিক পেয়েছিল কিন্তু মা তখন পরাপরে। যে বছর গোসাইহাটের পাট চুকিয়ে ঢাকায় পাড়ি জমাল, পথে পথে কপাল ঠুকেছে অন্ন সংস্থানের জন্য। কিন্তু শহর-নগরের মানুষের হৃদয়ে অতটা রহম নেই। পরিচিত, নতুন পরিচিত কোন মানুষের কাছে সে সাহায্য চায়নি? কিন্তু ইট-পাথরের শহরে অত সহজে মানুষ প্রশ্রয় পায় না। শেষে কিশোরগঞ্জের এক সাহেবের আন্তরিক চেষ্টায় আর বাবার জমি বন্ধকের টাকায় সে হয়েছে সরকারি অফিসের কেরানি। টাকা সে যথেষ্ট কামিয়েছে, তাতে গ্রামের দারিদ্র্যক্লিষ্ট বাড়িটির চেহারা ফেরাতে বেগ পোহাতে হয় না। বাবা-মা এমন সুখ দেখে যেতে পারেনি বলে একটা ব্যাথা তার মনের ভেতর কুড়ে কুড়ে খায়।
গোসাইহাট হাইস্কুলে ভর্তি হয়ে যেদিন সে হালাদার বাড়ি প্রথম পা রেখেছিল, চারিদিকে ছিল জীর্ণতার ছায়া। পাশাপাশি চারটি ঘর, দীর্ঘ উঠান। বাড়ির দক্ষিনের চৌচালা ঘরটি ছিল সিরাজ হালাদারের। সংসারে বুড়োবুড়ি কেউ নেই। একমাত্র ছেলে সবুর এবং স্ত্রী জাকিয়া বেগমকে নিয়ে সুখের সংসার তার। টু ক্লাসে পড়া ছাত্রটিকে পড়ানোর জন্য হাবিবকে রাখা হয়েছিল মাস্টার হিসেবে। যেদিন জাকিয়া বেগমকে সে প্রথম দেখেছিল সেই মানুষটি এখন কোথায়! পাতলা ঋজু দেহটিতে একফোটা মেদ ছিলনা কোথাও। কী নির্মল হাসি ছিল তার! সরে যাওয়া আঁচলটা মাথায় তুলে দিয়ে অনাবশ্যক নীরবতা ভেঙে বলেছিল, কেমন আছ বাবা?
সবুরকে পড়ানো হাবিবের জন্য ছিল উছিলা মাত্র। জাকিয়া বেগম দ্বিতীয় দিন সকালে হাবিবের পাতে ছোট চিংড়ির চচ্চড়ি দিয়ে বলল, আইজ হইতে তুমি মোর আরেকটা পোয়া। অন্যমত বুইজ্য না বাপু। নিজের ঘরের মতই থাইক্য।
বাড়ির দক্ষিণ দিকে বিরাট বিল। গলাডোবা জলে ভেসে আছে কিশরী ধানখেত। সরু বারান্দায় হু হু করে শরতের হাওয়া আসে দীর্ঘ বিল থেকে । জাকিয়া বেগম হাবিবের হাতে কইয়া জাল তুলে দিয়ে বলল, তোমার চাচায় ক্ষেতে আছে, যাও জাল পাতার জাগাডা চিন্যা আও। মাথা নাড়ে হাবিব। বিলের মাঝে ধানক্ষেতের আড়ালে কোমড় সমান জলে পাততে হবে জাল। বিকেলে পাওয়া যাবে কই, তারা বাইন, বায়লা ও অন্যান্য মাছ। হাবিব জায়গীর মালিকের ভাত খেয়েছে। কাজে না করার উপায় কী!
প্রয়োজনে কখনো মানুষ পরকে আপন করে। সংসারে বড় কিছু পেতে হলে ছোটছোট অনেক কিছু বিসর্জন দিতে হয় । জীবন থেকে চিরন্তন এই সত্যটি শিখে নিয়েছে হাবিব। কখনো কষ্ট হলে, সামান্য কথায় আঘাত পেলে টু শব্দটি করে না। সংসারে পড়াশোনা করে মানুষ হওয়ার খায়েশের চেয়ে খিদের জ্বালা বড় একথা চিরন্তন সত্য। রাগে একবার মনে হয়, সবকিছু ছেড়েছুড়ে বাড়ি চলে যায়। কিন্তু বারোমাসের অভাবের সংসারে পেটে দুবেলা ভাত পড়ে না তার। জায়গীর বাড়ির ফরমায়েশি কাজ না করে পড়াশোনা করার আর উপায় নেই ।
সিরাজ হালাদারের ঘরের সামনে হাটের বাছারির মত হেলে আছে গোয়াল ঘর। সকালে দুটি হাড় বের হওয়া জীর্ণ, শান্ত গোরু সেখানে জাবর কাটে। বেলা বাড়লে মাঠে যাওয়ার জন্য কেমন অসহায়ের মত হাম্বা হাম্বা ডাকে। হাবিব জানালার ফাঁক দিয়ে গোরুদুটিকে দেখে আর ভাবে, বোবা ধন, খিদের জ্বালায় কেমন হাম্বাহাম্বা করছে। সে সোৎসাহে গোরুদুটোকে মাঠে নেয়।
মাঠ তো নয়, বিরাট বিলের মাঝে সামান্য উঁচু জায়গাটুকু ঘাসের অরণ্য। সেখান থেকে আরেকটু দূরে গোসাইহাট বাজারের বাছারিঘর দেখা যায়। মাথাটা উঁচু করে তাকালে দূরে বহূদূরে একটা ছোট্ট গ্রাম চোখে পড়ে। হাবিবের মনে হয় ওই গ্রামের ওপারে, ওইতো আরেকটু দূরে আড়াল হয়ে আছে যে গ্রামটা ওখানেই তার জন্মভূমি। সে বাতাসে শুনতে পায় পশারিবুনিয়া গ্রামের গোরুর ডাক, কুকুরের ঘেউঘেউ, পুকুরের কাছে হাঁসের প্যাঁকপ্যাক। মা সজল চোখে তাকিয়ে আছে গোসাইহাট বরাবর। হাবিবের চোখে জল আসে।
প্রচণ্ড শীতে যখন অনন্যোপায় না হলে মানুষ সাধারণত বাইরে বের হয় না তখন সিরাজ হালাদারের সঙ্গে হাবিব হাইস্কুলের পেছন দিয়ে নদীর ধারে যায়। ধানের কুড়া মুঠি করে নদীর জলে চড়া ফেকে। রাত বাড়লে ঝাকি জাল দিয়ে মাছ ধরে। যখন আকাশে পাতলা কুয়াসার ফাঁক দিয়ে চাঁদ উঁকি দেয় তখন খেজুর গাছ থেকে রস নামিয়ে বাড়িতে নিয়ে আসে। সংসারের কোনো কর্তব্যই তার বাদ থাকে না।
হালাদার বাড়ি এসে হাবিব তার জীবনকে উল্টেপাল্টে দেখেছে। যে বয়সে তার বন্ধু-বান্ধব নিয়ে হৈচৈ করে কাটিয়ে দেওয়ার কথা সেখানে সে নিজের সংসার ছেড়ে অন্য গ্রামের অনাত্মীয়ের সংসারের ভাড় গ্রহণ করেছে। কিন্তু আপন বললেই কি সবকিছু অত সহজে আপন হয়?
সে হয় না। যখন সিরাজ হালাদারের বাড়িতে আত্মীয়-স্বজন আসে তখন হাবিবের এই সংসার থেকে অধিকার ছুটে যায়। সিরাজ হালাদার এবং জাকিয়া বেগম তাকে আপন ছেলের মত দেখলেও আত্মীয়রা তার দিকে কেমন অসহায়ের মত তাকায়। তাদের দৃষ্টির বক্তব্য এমন, আহা! কোন গ্রামের ছেলে এমন ভাতের অভাবে এ বাড়িতে এসেছে। এ বাড়ির আশ্রয় পেয়ে ছেলেটি স্কুলে যায়। গরিব ছেলেটির বাড়িতে না জানি কী নিদারুণ অভাব। সে কারণে আত্মীয়-স্বজনের উপস্থিতির কয়েকদিন হাবিব নিজের সত্যটা খুব উপলব্ধি করে। তখন পড়াশোনা করে সাহেব হবার সংকল্প কোথায় যেন মিলিয়ে যায়।
সিরাজ হালাদারের সঙ্গে পাশের ঘরের পরিবারটির সাথে বনিবনা ছিল না অনেক দিন আগে থেকেই। বাঙালি সমাজে কার ভালো কে দেখতে পারে! প্রতিবেশির সুখের খবরে আরেকজন প্রতিবেশির চক্ষুশূলের ইতিহাস বহু দিনের। সে কারণে পাশের ঘরের মন্তাজ হালাদার বেশ চটেই উঠল। তার উঠান পার হয়ে দক্ষিণ ঘরের মানুষ যাতায়াত করে এটা সহজে সে মেনে নিতে পারে না। এছাড়াও দুপরিবারের মধ্যে রয়েছে জমিজমা ভাগাভাগি নিয়ে দীর্ঘ দিনের দন্তাজ। সাকালে উঠে সূর্যের দিকে মুখ করে দুপরিবার পরস্পরের অনিবার্য ধ্বংশ কামনা করে। দুপুরে এক পরিবারের বউ অন্য পরিবারকে শুনিয়ে শুনিয়ে গালাগাল দেয়। ঝগড়া হলে একে অপরের মরণ কামনা করতেও ছাড়ে না। আশ্বিন মাসের প্রথম সপ্তাহে দুপরিবারের উঠানের মাঝে সীমানার আড়াল পড়ল। কাফলার গচা দিয়ে দেয় সীমানার বেড়া। সেসময় উভয় পরিবার ছিল মহা বিরক্ত।
হাবিবকে অকারণে যে মার খেতে হবে এটা ছিল তার ধারণার অতীত। কিন্তু মার সে খেল বেদম ভাবে। মন্তাজ হালাদার সামনের খোলা বারান্দায় বসে ছিল একা। কোলা থেকে মাছের খালুই নিয়ে ফিরছিল হাবিব। ছোট ছোট কুটিল চোখে হাবিবের দিকে তাকিয়ে মন্তাজ হালাদার বলল, এই দিকে আয় তো বাপু, দেহি, তর খালুইতে কী?
এই কয়ডা ভেদি আর বাইন মাছ পাইছি চাচমেয়া, হাবিব বলল। ম্যাসের কাঠি নিভে গেলে যেমন ধোয়া উড়ে যায় তেমনি পিটপিটে চোখ থেকে যেন ধোয়া বের হতে লাগল মন্তাজ হালাদারের। হাবিবকে কাছে ডেকে বলে, খালপাড়ে জাল পাতি আর হুদা আতে বাড়তে আই। একটাও মাছ পাইনা। পেরতেকদিন মোর জালের মাছ চুরি হরো রে চোরার পো চোরা। আইজ তোরে ইচ্ছা মত সোঞ্জামু।
মন্তাজ হালাদার হাবিবকে মারল খ্বু। কয়েকটা চর ধাপ্পর দিয়ে তার জ্বালা মেটে না। শেষে ঘরের পেছনের দরজার লাট নিয়ে কয়েকটা বাড়ি দেয়। মারটা হাবিবের শরীরে বিশেষ লাগেনি, যতটা লেগেছে অপমান আর গ্লানি। শেষে পরের বাড়ি জায়গীর এসে মার খেতেও হল, এই ছিল তার কপালে! মারের এক পর্যায়ে মন্তাজের দুই মেয়ে শায়লা ও লায়লা দরজার সামনে এসে বাবার অসভ্য কীর্তি চেয়ে দেখেছিল। একেতো কম বয়স, তার ওপর নারীহৃদয়। হাবিবের জন্য দুবোনের মায়া হল খুব। কিন্তু গোঁয়ার বাবার সামনে কথা বলার মত সাহস তাদের নেই। শেষে শায়লা ঘটনাস্থল থেকে ঘরের ভেতর চলে যায়। কিন্তু মেয়েদুটোর সামনে চোরের অপবাদ দিয়ে যে মারটা খেল তাতে লজ্জায় আর বাঁচেনা হাবিব। তার শরীরের জ্বালা কোথায় যেন মিলিয়ে গেল কিন্তু মনের জ্বালায় ভেতরটা ফেটে যায়। আশেপাশের ঘরগুলো থেকে ছেলেমেয়েরা শোরগোল শুনে দেখতে আসে। জানালার পাল্লা খুলে রহস্যভরা চোখে তাকিয়ে থাকে অন্য ঘরের মহিলারা। আলকুনের মা ঝাড়–টা হাতে নিয়ে অনেক্ষণ ঝুঁকে থাকে এই দিকে। শেষে বিড়বিড় করে বলতে বলতে চলে যায়, তোর ধর্মে কুলাইবে না রে মোন্তাজ।
সিরাজ হলাদার বিষয়টি নিয়ে সালিশ বসানোর সিদ্ধান্ত নিল কিন্তু হাবিবের ঘোর আপত্তিতে আর হল না। সে বলল, মাইরের ব্যাতা ভোলন যায় চাচা তয় চেয়ারম্যান মেম্বারের সামনে বিনা দোষে মাইর খাওয়ার শরম আরো ব্যাতার। ওসবে কাম নাই চাচা। মুই মাইন্যা নিছি।
তারপর আকাশে মেঘ আসে, রোদ উঠে ব্যপ্ত হয় চরাচরে। আবার অভিমান করে সেই রোদ কালো মেঘের আড়ালে লুকোয়। প্রায় একমাস পর অসময়ে ঝড় ওঠে। আর সেই রাতে ভবের মায়া সাঙ্গ করে মন্তাজ হালাদার। হাবিব বাঁশ কাটল, কবরের মাটি তুলল যেন কিছুই হয়নি কখনো। মৃত্যুর মত সত্য যখন সামনে আসে তখন আর কিছু কি মনে থাকে ওসব? থাকে না। হাবিবেরও নেই। শুধু গোসলের পরে কাপনের আড়ালে সর্বশেষ মন্তাজের মুখটা যখন বের করেছিল আপনজনদের দেখানোর জন্য তখন হাবিবের মনে হয়েছিল ওই মুখটা মনের বিষবাষ্পে পুড়ে হয়েছে ছারখার। মন্তাজের পিটপিটে চোখ বুজে আছে সেখানে হিংসার ধোয়া নেই; আছে অনন্তলোকের পথের দিকে দৃষ্টি। এত ব্যাথা দিয়েছিল মন্তাজ তবুও প্রতিবেশির বিয়োগ ব্যথায় কয়েকফোটা জল গাল বেয়ে নামে হাবিবের। এই জল তার ভেতরের মানুষের আর্তি, মানবতার জন্য ব্যথার দলক।
কয়েকদিন আগে মার খেয়ে হাবিবের মন বিষন্ন ছিল। বাড়িতে একটা মৃত্যু সেই বিষাদের ওপর কালি লেপে আরো ভাড়ী করে তুলল। হাবিবের কিছুতেই মন ভালো লাগে না। কিছুদিন সে বাড়িতে গিয়ে বাবা-মায়ের সঙ্গে কাটিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেয় কিন্তু সন্ধ্যায় তার শরীরটা কেঁপে কেঁপে উঠে। মন তার ভীষণ রকমের বিষাক্ত সেইসঙ্গে শরীররটা ম্যাজম্যাজ করে ব্যাথায়। হাবিব অসাড় হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল। জ্বর উঠল খুব। জাকিয়া বেগমকে সে ডেকে বলল, চাচিআম্মা, একটা খ্যাতা দেন দিহি, কেমন শীতশীত লাগে। জাকিয়া বেগম হাবিবের মাথায় হাত দিয়ে বুঝল অবস্থা সুবিধার নয়। গ্রাম্য নারী হলেও তার অভিজ্ঞতার একটা শিক্ষা আছে। সে হাবিবকে খুব যতœ করল ছেলের মত। নিজের হাতে জোড় করে ভাত খাইয়ে বিছানায় শোয়ায়। বিকেলে চৌকির একপাশে বালিশের নিচে কলাপাতা দিয়ে হাবিবের মাথায় জল ঢালে। একেকবার হাবিবের মুখের ওপর স্পর্শ করে জলে ভেজানো হাত। হাবিব সেই স্পর্শে মায়ের হাতের মমতার অনুভব করে। সন্ধ্যায় হাবিবের জ্বর খুব বাড়লে সিরাজ হালাদার খুব চিন্তায় পড়ে। রাতে হাবিবের চোখ পিটপিট করে কিন্তু একটুও তাকায় না। সিরাজ হালাদার ফার্মেসিতে গিয়ে ওষুধ নিয়ে আসে আর সারারাত মায়ের মত শিয়রে বসে থাকে জাকিয়া বেগম। সেইরাতে জাকিয়া বেগমের সঙ্গে হাবিবকে আর দুটি কিশোরী হাত সেবা করেছিল। যদিও যথেষ্ট আনাড়ি ছিল সেবার হাত তবে চেষ্টার এতটুকু কমতি ছিল না। মন্তাজ হালাদারের মৃত্যুতে বাড়িতে কঠিন নীরবতা নেমে আসে। কিছু দিনের জন্য সকলের কাছে মৃত্যুর সত্যটা স্পষ্ট হয়। পাশাপাশি দুটি পরিবার বিবাদ ভুলে পরস্পরের ঘরে যাতায়াত শুরু করে। মন্তাজ হালাদারের মেয়ে লায়লা পুকুর থেকে কলসি ভরে জল এনে দেয়। জাকিয়া বেগম হাবিবের মাথায় সেই জল ঢালে।
হাবিব দিন কয়েক বাদে ঢ্যাঙা, রোগা হয়ে উঠে দাঁড়ায়। মুখটা হয়েছে তার বিবর্ণ। যেন মৃত্যুর গ্রাস থেকে অনেক ঝড় ভেঙে সে এইমাত্র ফেরত এসছে। যখন প্রলাপজ্বরে বেঘোর হয়ে ছিল, তখন অজ্ঞাতে, গোপনে পাতার আড়াল হওয়া কুঁড়ির মতন কেমন করে যেন ফুটে উঠেছিল লায়লার কালো মুখ। কখনো তার পুরুষ্টু হাত পড়েছিল হাবিবের বুকের ওপর। কখনো তার খোলা চুল মুখের ওপর দিয়ে চিকন সাপের মতন শীতল হয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছিল। রূপের খুব একটা বালাই নেই মেয়েটির। সরু, ছোট ছোট চোখ। নাকমুখ যেন কুড়ুলে কেটে এবড়োথেবড়োভাবে গড়া। চওড়া কাঁধ, খাটো গড়ন। মোটাসোটা মেয়েটি সবসময় একটা খাটো জামা পরে থাকে। মুখে শিশুর ভাব থাকলেও যৌবনের যথেষ্ট উপস্থিতি শরীরে। হাবিবের কাছে এলে মেয়েটির কত রকম নিজেকে লুকোনোর প্রাণান্ত চেষ্টা। থান কাপড়ে বানানো সস্তা জামাটি হাঁটুর কাছে টানে আর ফিনফিনে পাতলা ওড়ানাটি বারবার বুকের ওপর ঠিকঠাক করে।
তারপর দুজনের মধ্যে দূরত্ব কমতে থাকে ধীরেধীরে। দিন-দুপুরে লায়লার এ ঘরে আসায় কেউ বারণ করে না। অপরিণত বয়সের কারণে হয়ত কেউ কাউকে বলতে পারেনি নিজেদের ইচ্ছার কথা। তবে একটা মায়া, একটা টান তৈরি হয় দুজনার মধ্যে।
একদিন দুপুরে ঘরে ছিলনা জাকিয়া বেগম। সিরাজ হালাদার গেছে মাঠে। কী এক দিবসের কারণে স্কুল ছিল বন্ধ। লায়লা এই ঘরে বারান্দায় এসে দেখে হাবিব একা জানালার ধারে বসে খুব চিন্তায় মগ্ন। কোথায় হারিয়ে গেছে কে জানে! লায়লা হাবিবের মাথায় খোঁচা মেরে বলে, বউর কতা ভাবচেন নি মাস্টার সাপ? কথাটা শুনে হাবিব বলল, পরের বাড়ি খাইয়া দাইয়া যে লেহাপড়া করে, হের বউ অয় কেডা? অমন ঠেহা ক্যার?
লায়লা কথাটার উত্তর যেন আর মুখে দিতে পারে না। সে ঘরে উঠে হাবিবের সামনে জানালার পাশে দাঁড়ায়। যেন নিস্তব্ধ লাগে সবকিছু। জানালার ফাঁক গলে বাইরের ফিঁকে আলো পড়েছে কাঁচা মাটির খাটালে। কেমন যেন রক্তের উচ্ছ্বাসে, অদ্ভুত নেশায় মেতে ওঠল দুজন। মনে হল একসঙ্গে বাঁধা পড়েছে দুজনার ভাগ্য। শুধু একবার চুমুর মাদকতা থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে লায়লা হাবিবকে লজ্জায় মরে মরে জিজ্ঞাসা করে, মাস্টার, এহন কী অইবে? তোমাগো বাড়ি নেবা মোরে?
হাবিব হু বলে মাথা নাড়ে। এই হু শব্দটির বৈশিষ্ট্য, ব্যপকতা লায়লার জানা নেই । সে শুধু জানে অদ্ভুত অপরিচিত স্পর্শে রঙিন হয়ে এল পৃথিবী। কেমন উদাস উদাস লাগে তার। তখন জানালার ফাঁক দিয়ে কার যেন ছায়া পড়ল ঘরে। সামান্য চাপানো ছিল দরজাটা, সেখানে ঠকঠক শব্দ হয়। হাবিব জানালায় উঁকি দিয়ে দেখে লায়লার মা কেমন পাথরের মত দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। মুখে রা শব্দটি নেই। সে ঘরের ভেতর ঢুকে লায়লাকে চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে নিয়ে যায় নিজের ঘরে। যাবার সময় সামান্য টু শব্দটি পর্যন্ত করল না। ঘরে গিয়ে হাবিবকে শুনিয়ে লায়লাকে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করে, ভাতার লাগবে তোর ছেরি? বাপ তো মইর্যাষ বাঁইচ্যা গেছে। এহন মোর যত জ্বালা।
যৌবনের প্রারম্ভে হাবিব এক কিশোরী শরীরের তাজা ঘ্রাণ পেয়ে সামান্য সময়ের জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিল। নেশার ঘোরে তার কখনো মনে হয়নি পাড়াগাঁয়ের অশিক্ষিত মেয়েটির গায়ের রং কালো। চাষার ছেলে হয়ে, অন্যের বাড়িতে জায়গীর থেকে সে কখনো নিজেকে ভবিষ্যতের সাহেব ছাড়া অন্য কিছু ভাবেনি। শহর, নগরের কোনো দালান-কোঠায় সে ভবিষ্যত ঠিকানা রচনা করবে। লায়লাকে প্রশ্রয় দিয়ে পঁচা শামুকে পা কাটার মত অদূরদর্শী নয় সে।
কিন্তু আজ, এত বছর পরে লায়লার সেই মুখটা-ই প্রথম দেখতে ইচ্ছা করে হাবিবের। প্রদীপের শিখায় যে ঘরটা একদিন আধো আলোয় নিভু নিভু করত সেই ঘর আজ কারেন্টের আলোয় ভেসে যাচ্ছে। হাবিব শান্ত চোখে বাড়ির সমস্ত মানুষের দিকে তাকিয়ে কুশল জিজ্ঞাসা করে। কিন্তু দৃষ্টিতে একটি মানুষের জন্য কতশত প্রশ্ন, কত আকূলতা তার। লায়লার কথা কারো কাছে জানতে খুব সংকোচ হয়।
জাকিয়া বেগম আঁচলটা মুখে চেপে দাঁড়িয়ে আছে সামান্য দূরে। লায়লার মা একটা লাঠিতে ভড় করে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকায় হাবিবের মুখের দিকে। একেতো শহুরে জৌলুস তার মুখে, পোষাক পরিচ্ছদে সাহেবের ভাব স্পষ্ট। গ্রামের ঘর-দুয়ারের চেহারা হয়ত ফিরেছে কিন্তু হাবিবের মুখের দিকে তাকিয়ে কেউ সহজ হতে পারে না। যে বছর জাকিয়া বেগমের একমাত্র ছেলেটি হঠাৎ মারা যায় হাবিব আসবে আসবে বলে আর আসা হয়নি। একমাত্র ছেলেটিকে হারিয়ে কতটা অসহায় হয়ে পড়েছে পরিবারটি তা মুখের দিকে তাকালেই বোঝা যায়।
এ বাড়িতে যারা বউ হয়ে নতুন এসেছে হয়ত তারা কখনো শুনে থাকবে হাবিবের গল্প কিন্তু আজ তাকে দেখে কে বিশ্বাস করবে একদিন সে এবাড়ির পুকুরে মাছ ধরত! কে বিশ্বাস করবে সে একদিন মাঠে গোরু চড়িয়ে, বিলে ঘাস কেটে, কখনো হাল-চাষ করে হাতিনার চকিতে ঘুমাত। সিরাজ হালাদারের পাদুটো পট্টি জড়ানো। সেই অনেক বছর আগে কেমন এক ঘা হয়েছিল আঙুলের ফাঁকে। গিদগিদ করত জায়গাটা। ওষুদপত্তর যখন ফেল মারল তখন চউট্টার ছোরাপ ফকির দিয়েছিল এক পথ্য। আট সের দুধের সাথে এক ফালা বিষকচু জ্বাল দিয়ে বানাত এক ছিরাপ। খেয়ে কিছুদিন ভালো থাকত আবার সেই ঘা। কবে সেই পায়ের আঙুল সিরাজ হালাদার হারিয়েছে হাবিবের জানা নেই।
হাবিব মনে মনে ঠিক করে রেখেছিল, অনেক বছর পর চাচীর হাতের রান্না সে আয়েস করে খাবে। সে যেখানে ঘুমিয়ে থাকত সেখানটায় একরাতের জন্য শুয়ে কাটাবে। আর পরিচিত মানুষগুলোকে একেক করে বলবে, কেমন কন তো দিহি? আমি তো হাবু আমনেগো।
কিন্তু শাড়ীর আঁচলে আড়াল করা জাকিয়া বেগমের মুখের কোথাও সেই আপন ভাবটা নেই। একবারও তার চোখের দিকে চেয়ে মনে হয় না এই মানুষটা মায়ের মত আঁচল দিয়ে একদিন মুখ মুছিয়ে দিয়েছিল। তারই পাশে বসিয়ে নিজের রাঁধা সালুন দিয়ে জোড় করে খাওয়াত ভাত। সামান্য এদিক ওদিক হলে শাসন করত ঠিক মায়ের মতন। আঠার বছর আগের এক সন্ধ্যার মত মাদুর পেতে কাঁচা মাটির খাটালে বসে খাওয়া তো দূরে থাক, হাবিবের কাছ মনে হয় কেমন একটা ভ্যাপসা গন্ধে ভুরভুর করছে ঘরটা। এতটুকু বসে থাকারও উপায় নেই। যেখানে সে ঘুমাত তার থেকে কত উন্নত খাট, তোষক, বিছানা কিন্তু কোথাও যেন সেই সময়ের উৎসব আর খুঁজে পায় না। ঘরটা আগের মত নেই, ভেতরেও যেতে ইচ্ছে করছে না। শুধু জাকিয়া বেগমকে ব্যাগ খুলে হাবিব একটি শাড়ী বের করে দেয়। জাকিয়া বেগম হাতে তুলে শাড়িটা আর নেয়নি, অগত্যা হাবিবকে বিছানায়ই রাখতে হল।
ঘরের ভেতরে কাপ পিরিচের শব্দ, সেই সাথে শাড়ীর খসখসানি আর চুড়ির টুংটাং। শব্দটা কেমন যেন চেনা লাগে হাবিবের। ভেতর থেকে চলে আসে নাশতা, চা-বিস্কিট। গ্রাম্য পিঠার তালিকায় ভারাক্রান্ত টেবিল। কিন্তু সেসব আর মুখে যায় না হাবিবের। যেখানে একরাত থাকার পরিকল্পনা করে সে এসেছিল বহু বছরের ব্যবধানে পরিচিত মুখগুলো অপরিচিত দেখে অস্থির লাগে তার। শেষে সে উঠেই পড়ল। কিন্তু তবুও লায়লার মুখটা না দেখলে কিছু অপূর্ণতা থেকে যায়।
সবাইকে বলে কয়ে হাবিব উঠানে নামে। মুখেমুখে তাকে কেউ যেতে দেবে না, সকাল হলেই খেয়েদেয়ে যেতে পারে কিন্তু কারো মুখের আপ্যায়নের সাথে আন্তরিকতার ছায়টুকু সে খুঁজে পায় না। এত বছর পর সে যে দেনাটা শোধ করতে এসেছে কী উপায়ে সিরাজ হালাদারের হাতে সেই টাকাটা গুঁজে দেয় সেটা ভাবে সে। বহু বছর আগে ফেরত দেবার কথা বলে এসএসসি পরীক্ষার ফরম ফিলাপের টাকাটা সে ধার হিসেবে নিয়েছিল কিন্তু সময় সূযোগের অভাবে ফেরত আর দিতে পারেনি। আজ টাকাটা ফেরত দিতে সে এ বাড়িতে এসেছে।
উঠানের আলোটা জ্বেলে দিলে বাড়ির সকলের মুখ আরেকবার দেখল সে। অনেকগুলো মুখের ভীড়ে আরেকটি কালো মুখ একঝলক তার চোখের সামনে থেকে আড়াল করে নিল। মানুষের বৃত্ত ভেঙে সে দাঁড়াল আরেকজন মহিলার আড়ালে। এমন অনায়াস ভঙ্গি তার কাঁধের ওপর ছড়িয়ে থাকা চুলগুলো এতটুকু নড়ে না। ওই মুখটা হাবিবের খুব পরিচিত, খুব চেনা। কিন্তু দ্বিতীয়বার ওই মুখের দিকে হাবিব আর ফিরে তাকাতে সাহস পায় না।

























সর্বশেষ এডিট : ০১ লা নভেম্বর, ২০১৮ রাত ৩:২৬
২টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে...

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:০৯

ছিঁচকাঁদুনে ছেলে আর চোখ মোছানো মেয়ে,
পড়তো তারা প্লে গ্রুপে এক প্রিপারেটরি স্কুলে।
রোজ সকালে মা তাদের বিছানা থেকে তুলে,
টেনে টুনে রেডি করাতেন মহা হুলস্থূলে।

মেয়ের মুখে থাকতো হাসি, ছেলের চোখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অহমিকা পাগলা

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১৪


এক আবেগ অনুভূতি আর
উপলব্ধির গন্ধ নিলো না
কি পাষাণ ধর্মলয় মানুষ;
আশপাশ কবর দেখে না
কি মাটির প্রণয় ভাবে না-
এই হলো বাস্তবতা আর
আবেগ, তাই না শুধু বাতাস
গায়ে লাগে না, মন জুড়ায় না;
বলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

হার জিত চ্যাপ্টার ৩০

লিখেছেন স্প্যানকড, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩




তোমার হুটহাট
চলে আসার অপেক্ষায় থাকি
কি যে এক ছটফটানি
তোমার ফিরে আসা
যেন প্রিয় কারো সনে
কোথাও ঘুরতে যাবার মতো আনন্দ
বারবার ঘড়ি দেখা
বারবার অস্থির হতে হতে
ঘুম ছুটে... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবনাস্ত

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৪৪



ভোরবেলা তুমি নিশ্চুপ হয়ে গেলে একদম,
তোমার বাম হাত আমার গলায় পেঁচিয়ে নেই,
ভাবলাম,তুমি অতিনিদ্রায় আচ্ছন্ন ,
কিন্তু এমন তো কখনো হয়নি
তুমি বরফ জমা নিথর হয়ে আছ ,
আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে দেশে সকাল শুরু হয় দুর্ঘটনার খবর দেখে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:১১

প্রতি মিনিটে দুর্ঘটনার খবর দেখে অভ্যস্ত। প্রতিনিয়ত বন্যা জলোচ্ছ্বাস আসে না, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার খবর আসে। আগে খুব ভোরে হকার এসে বাসায় পত্রিকা দিয়ে যেত। বর্তমানেও প্রচলিত আছে তবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×