somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

।।চিকিৎসক- রোগী: একটি জটিল মনঃস্তত্ব ।।

০৭ ই মে, ২০১১ রাত ৯:২৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

চিকিৎসক- রোগী: একটি জটিল মনঃস্তত্ব ।। (পর্ব – ২ ।। শেষ পর্ব)
ইদানীং ব্লগে ডাক্তারদের বা চিকিৎসকদের নিয়ে কিছু কথা উঠেছে । কথা শুধু এখানেই নয়, হচ্ছে তামাম দেশ জুড়ে । আজই শুধু নয় হচ্ছে অনেক দিন ধরেই । একজন ডাক্তার এখোন আর “ঈশ্বর” নন, “কসাই” হয়েছেন । কেন ?
এই “কেন”র উত্তর কেউই খুঁজে দেখেন নি হয়তো তেমন করে । যদি দেখতেন তবে চিত্রটি অন্যরকম হতে পারতো । সাদামাটা চোখে যা দেখা যায় না তাকে দেখতে হয় গভীর দৃষ্টি নিক্ষেপে । নতুবা ভুল থেকে যেতে পারে কোথাও না কোথাও । আমরা অনেকেই শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে দেশের বর্তমান চিকিৎসার হাল নিয়ে শংকিত । খুবই সঙ্গত শংকা । কিন্তু বিদগ্ধজন মাত্রই জানতে চাইবেন, অবস্থাটি এমোন কেন ? তাদের উদ্দেশ্যেই আমার আজকের লেখা ।
আপনার সুচিন্তিত মতামত এবং তার প্রয়োগ কিন্তু সামগ্রিক ভাবে স্বাস্থ্য খাতের এই হতাশ চিত্রটিকে বদলে দিতে পারে ।


(দ্বিতীয় পর্ব এবং শেষ)এখানেও আছে অর্থনৈতিক অবস্থার ভূমিকা। যারা চিকিৎসকের “ফি” আর ল্যাব টেষ্টের খরচ যুগিয়ে চিকিৎসা চালিয়ে যেতে পারেন তাদের দু’টি রাস্তা খোলা থাকে। এক, রোগী ভালো হলে ( যেটি রোগের ধরনের কারনেও হতে পারে যা আপনা আপনি ভালো হয়ে যায় সময়ের ব্যবধানে অথবা চিকিৎসকের বিচক্ষনতার কারনেও হতে পারে ) চিকিৎসকের সুনাম করেন। দ্বিতীয়টি, রোগী ভালো না হলে চিকিৎসকের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করা। দেশের সব চিকিৎসকদের কশাই আখ্যা দিয়ে বিদেশে পাড়ি জমানো।
এই দ্বিতীয়টি বেশী বেশী পরিমানে ঘটছে বলে সারা দেশের চিকিৎসক সমাজের উপর একটি অনাস্থা (যার সবটাই আসলে চিকিৎসকদের প্রাপ্য নয়) তৈরী হয়ে গিয়েছে জনগনের ভিতরে। আর যারা টাকার অভাবে চিকিৎসা চালিয়ে যেতে পারেন না তাদের ভেতরে অন্যরকম মানসিকতা জন্ম নেয়। তারা অন্যদের মধ্যে ভুল ধারনা ছড়ায় এই বলে যে, এদেশের ডাক্তাররা মোটেও চিকিৎসা জানেনা। এই এত্তোগুলি টাকা খরচ করলাম আমার রোগীকে ভালো করতে পারলো না। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা আসল সত্যটি ( অর্থনৈতিক অক্ষমতার কথাটি ) প্রকাশ করেন না। এটা স্বাভাবিক, মানুষ নিজের অক্ষমতা বা দোষ স্বীকার করতে চায়না কিছুতেই। কিন্তু ক্ষতি যা হবার তা হয়ে যায় এবং তা ডালপালা ছড়ায়।
এর বিপরীতে আবার কিছু রোগী আছেন যারা আবার ল্যাবরেটরী টেষ্ট না দিলে ডাক্তারের উপর আস্থা রাখতে পারেন না। তাদের ধারণা , ল্যাবরেটরী টেষ্ট করা ছাড়া ডাক্তারসাহেব সঠিক রোগ নির্ণয় করবেন কি ভাবে ? অথচ অনেক রোগ আছে যাদের ক্লিনিকাল সাইন সিম্পটম দেখেই বোঝা যায় ল্যাবরেটরী টেষ্টের প্রয়োজন পরেনা। এজাতীয় রোগীদের বোঝানো বা তাদের আস্থা অর্জন করা বেশ কঠিন।
সকল রোগীদের আস্থা অর্জন চিকিৎসকদের জন্যে তার পেশার একটি অংশ। ডাক্তারদের একটি হাদিসের বই আছে “হাচিনসন’স ক্লিনিকাল প্রাকটিস অব মেডিসিন”। তাতে একজন চিকিৎসক কি কি ভাবে রোগ নির্ণয় করবেন এবং রোগীকে ‘হ্যান্ডল’ করবেন তার বিশদ বর্ননা আছে। মোটামুটি ভাবে তা এরকম - রোগীর নিজ মুখে তার নিজস্ব ভাষায় রোগের সকল বর্ণনা শোনা, রোগটির ইতিহাস জেনে নেয়া, অন্য কোন রোগের পূর্ব ইতিহাসের খোঁজ নেয়া, রোগীর পেশা সম্পর্কে ধারণা নেয়া, রোগীর পারিবারিক ইতিহাস নেয়া, রোগীর সাথের লোকজনের কাছ থেকে রোগীর দেয়া বর্ণনার সত্য-অসত্য যাচাই করে নেয়া; যা কিছু এতোক্ষন শোনা হলো প্রশ্ন করে তা যাচাই করার সাথে সাথে শারীরিক লক্ষনগুলো দেখা এবং বিশদ শারীরিক পরীক্ষা করা, রোগীর পেশা এবং সামাজিক আচার আচরনের সাথে এইগুলোর সম্পর্ক নির্ণয় করা, সব মিলিয়ে সন্দেহভাজন রোগগুলির একটি তালিকা করা,এবার ল্যাবরেটরী টেষ্ট এবং অন্যান্য পরীক্ষা নিরীক্ষা করে সন্দেহভাজন রোগগুলির মধ্যে থেকে সঠিক রোগটি নির্ণয় করা, রোগীকে তার রোগটি এবং তার গতিপ্রকৃতি সর্ম্পকে পূর্ণাঙ্গ ধারনা দেয়া, এই ক্ষেত্রে রোগীর করনীয় কি তা রোগীকে বুঝিয়ে বলা, রোগটি নির্মূল করতে বা তাৎক্ষনিক ভাবে সারিয়ে তুলতে ব্যবস্থাপত্র দেয়া, রোগীকে আশ্বস্ত করা, রোগ পরবর্তী রোগীর পূনর্বাসনের ব্যবস্থা বলে দেয়া ইত্যাদি।
সত্যিকার চিকিৎসার খাতিরে ও রোগীর আস্থা অর্জনে এই প্রক্রিয়াগুলোর ভেতর দিয়ে অবশ্যই একজন চিকিৎসককে যেতে হবে। দুঃখের বিষয় এই যে, এখানে চিকিৎসকদের ঘাটতি বা গ্যাপ রয়েছে প্রচুর। আর এই গ্যাপটি দিন দিন বাড়ছেই বেশ কিছু কারনেই। এই গ্যাপটুকুর কারনেই বাজারে প্রচলিত ধারণাটি এই- “আমাদের দেশের ডাক্তাররা একদম কশাই, কথা শুনতেই চায়না। অথচ বিদেশের ডাক্তাররা কতো আন্তরিক, কি মধুর তাদের ব্যবহার। এদের কথা শুনলে রোগ আগেই অর্ধেক ভালো হয়ে যায়। কি সুন্দর ভাবে সব বুঝিয়ে বলে।” এক্ষেত্রে দায়ী একমাত্র চিকিৎসকরা নিজেরাই। কারণ একজন চিকিৎসককে অবশ্যই রোগীর কথা রোগীর নিজের ভাষাতেই শুনতে হবে তা সে যতোক্ষন ধরেই তা বলুক না কেন। তারপরে চিকিৎসক রোগীর কথার সত্যাসত্য যাচাই করবেন বিভিন্ন আঙ্গিকে, তাকে শারীরিক ভাবে পরীক্ষা করবেন এবং সম্ভাব্য রোগটি নির্ণয় করবেন। চুড়ান্ত নিস্পত্তির ক্ষেত্রে চিকিৎসককে পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। তারপরেই হবে চুড়ান্ত রোগ নির্ণয় বা ফাইনাল ডায়াগনোসিস। এরপরে চিকিৎসা বা ট্রিটমেন্ট এবং আনুষাঙ্গিক।
এই প্রক্রিয়াটুকুতে আমাদের দেশের চিকিৎসকরা কেন যেতে পারেন না ?
এর কারণ নানাবিধ। নৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অবক্ষয়; সত্যিকার শিক্ষার অভাব; ধৈর্যের অভাব; আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার প্রতিযোগিতার সংস্কৃতি ইত্যাদি। চিকিৎসক সমাজ এটাকে স্বীকার করুক আর নাই করুক, বাস্তবতা হলো এই। এসবই কিন্তু দীর্ঘকালের অব্যবস্থাপনার ফল। একক ভাবে কেউ দায়ী নয় হয়তো। প্রত্যেকে প্রত্যেক কে অনৈতিক হতে সাহায্য করেছে বা বাধ্য করেছে নিজের অজান্তেই।
আমাদের দেশের বড় বড় ডাক্তার, প্রচলিত অর্থে যাদের চেম্বারে একশো দেড়শো কিম্বা তারও বেশী রোগীর লাইন পড়ে থাকে সেখানের চিত্র কি , কেনই বা চিত্রটি আপনি যে ভাবে দেখছেন সে রকম ? কিন্তু চিত্রটি তৈরী হওয়ার পেছনে আছে আমার আগে বলা সূত্রটি - রোগে শোকে শ্রেষ্ঠ চিকিৎসকের শরনাপন্ন হওয়া উচিৎ। শ্রেষ্ঠ চিকিৎসক কারা ? এখানে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোর প্রফেসর শ্রেনীর চিকিৎসকবৃন্দ এক নম্বরে আছেন। এরপর শ্রেণী ভেদ অনুযায়ী। জ্ঞানে এবং একাডেমিক শিক্ষায় এরা প্রথম শ্রেণীর সন্দেহ নেই। কিন্তু একজন “চিকিৎসক” হওয়া ভিন্ন জিনিষ। আমার সমগোত্রীয়রা একথা শুনে হয়তো আমাকে মারতেই আসবেন। তাদের জন্যে বলছি, আগে উল্লেখিত “হাচিনসন’স” বইটির কথা মনে করুন। সেখানে আপনি নিশ্চয়ই পড়েছেন, কি ভাবে একজন চিকিৎসককে এগুতে হবে ? আসলে সে ভাবে আমাদের চিকিৎসক সমাজ এগুচ্ছেন কি ? হাতে গোনা কিছু সম্মানিত , বিরল চিকিৎসক ছাড়া বাকী সবার চেম্বার একবার ঘুরে আসুন। এক মাস থেকে দুই মাস আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে রোগী দেখানোর সিরিয়াল পেতে। ততোক্ষন কি রোগটি বসে থাকবে ? প্রতিদিন একশো’র বেশী রোগী দেখা এখন স্ট্যাটাস সিম্বল চিকিৎসকদের জন্যে। এবার ভাবুন, আসলেই এখানে একজন জ্ঞানী চিকিৎসকের পারদর্শীতা দেখানোর কি আছে ? তিনি প্রতিটি রোগী দেখার জন্যে সময় পাচ্ছেন সর্ব্বোচ্য মাত্র ৩ থেকে ৪ মিনিট। এ সময়টুকুতে রোগীর কি শোনা বা দেখা সম্ভব ? কিছুই না। তাহলে এই চিকিৎসকের চেম্বারে ভীড় কেন ? এই ভীড়ে নতুন মুখ আর পুরানো মুখের ছবি দেখলেই উত্তরটি আপনি জেনে যাবেন। এই প্রসঙ্গে বাস্তব উদাহরন দিতে চাই চিত্রটি বোঝার জন্যে যা বাহুল্য হবেনা। বর্তমানে আমি “জিপি” হিসাবে প্রাকটিস্ করে থাকি। “প্রায়ই” বলা যাবেনা, মাঝে মাঝে কিছু রোগী আসেন কথা বলার জন্যে। এরা একটা প্রেসক্রিপশন এগিয়ে দেন, ডাক্তারসাহেব এটা একটু দেখেন। নেড়ে চেড়ে দেখি। কোনও বড় (?) ডাক্তারসাহেবের প্রেসক্রিপশন। বলি, দেখলাম এখন কি করবো ? রোগীর ভাষ্য- পাচঁ’শ টাকা ভিজিটের ডাক্তার দেখালাম, হাযার হাযার টাকা পরীক্ষায় খরচ করলাম। অনেক ঔষধ খেলাম অথচ আমার রোগ তো ভালো হলোনা। আপনি বলেন আমার কি হয়েছে। বলি, আপনার ডাক্তারসাহেবের কাছে জিজ্ঞেস করেন নাই আপনার কি হয়েছে ? রাগ, ক্ষোভ আর একটা অসহায় মুখে রোগী বলে, ডাক্তারসাহেবের সাথে তো কথাই বলা যায় না। ডাক্তারসাহেবের কথা শোনার সময় কই ? রোগীর যে ভীড়। সেই বিকেল তিনটা থেকে বসে সিরিয়াল আসতে আসতে রাত্র নয়টা। প্রথমে এ্যাসিস্টান্ট আমার অসুবিধার কথা একটা কাগজে লিখলো। ডাক্তার ....... বাচ্চা আমার কিছুই শুনলোনা, এ্যাসিস্টান্ট কি কি বললো আর ......... পুতে এত্তোগুলো পরীক্ষার কথা লিখে দিলো। চারদিন পরে আবার রিপোর্ট নিয়ে গেলাম। বললো কিছু হয় নাই। ঔষধ লিখে দিলো আর দুই’শ টাকা রেখে দিলো। ডাক্তার সাহেব এবার আপনিই এটা (প্রেসক্রিপশন) দেখে বলেন আমার কি হয়েছে। বলি, আপনার কি হয়েছে সেটা কি আমার বলার কথা। আমার মতামত শুনতে হলে তো আমার প্রাপ্য ফি আপনাকে দিতে হবে।
রোগী - আপনার কয় টাকা ভিজিট ?
ফি এর পরিমানটা বলি। এর পরের কথোপকথন বেশ মজার।
রোগী : ভিজিট ছাড়া বলতে পারবেননা ?
আমি ঃ আমি কেন ভিজিট ছাড়া বিনা পয়সায় আপনাকে পরামর্শ দিতে যাবো ?
রোগী ঃ তা হলে আপনি কি মানুষ না ? ডাক্তার হয়েছেন কোনও দয়া মায়া নেই? ডাক্তার হয়েছেন তো মানুষের উপকার করার জন্যে।
আমি ঃ (মুচ্কি হেসে) আপনাদের কি ধারণা, আমরা ফেরেস্তা ? আমাদের ভাত খেতে হয়না ? আপনার বড় ডাক্তার সাহেব ও তো মানুষ ছিলো। এই বললেন হাযার হাযার টাকা খরচ করেছেন, কিছূই লাভ হয় নাই। এখন আমাকে আমার ভিজিটের সামান্য কয়টা টাকা দিতে পারবেন না ? আচ্ছা ঠিক আছে, কত আছে ?
রোগী ঃ টাকা থাকলে তো বড় ডাক্তারের কাছেই যেতাম। টাকা নেই বলেই তো আপনার কাছে আসা। সরকার আপনাদের কতো টাকা খরচ করে ডাক্তার বানিয়েছে মানুষের সেবার জন্যে। আপনারা .... ইত্যাদি ইত্যাদি।
পাঠক, এই হলো অধিকাংশ চিকিৎসক ও রোগীদের মধ্যে আরেক ধরনের সম্পর্কের ধ্যান ধারণার চিত্র। আমাদের শিক্ষা, অর্থনৈতিক অবস্থা, জ্ঞান-বুদ্ধি ও সর্বোপরি বিবেচনার দৈন্যতা রোগীকে একজন চিকিৎসকের বিপক্ষে দাঁড় করিয়ে দেয়ার অনুঘটক। এটি যখন দেশের ব্যাষ্টিক পরিধিতে চিত্রিত হয় তখন দেখা যায় চিকিৎসক ও রোগী পরস্পরের অনাস্থা আর অবিশ্বাসের পাত্র হিসাবে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেছেন।
চিকিৎসকদের প্রতি রোগীদের সবচেয়ে বড় অভিযোগ; চিকিৎসকরা রোগীদের কথা শোনার সময় পান না, কেবল ফি এর দিকেই তাদের নজর। ভালো করে দেখেন না বলেই ভুল ডায়াগনোসিস হয়। বিদেশে গেলেই আমাদের ডাক্তারদের অজস্র ভুলগুলো ধরা পরে। এবং এখানকার খরচের তুলনায় অর্ধেকেই আসা যাওয়া আর পুরো চিকিৎসা হয়ে যায়। বিদেশে চিকিৎসা সুযোগ গ্রহণকারী অধিকাংশেরই আক্ষেপ আর ক্ষোভ এ ভাবেই প্রকাশিত হয় - “আমাদের দেশের ডাক্তাররা আমার রোগীকে প্রায় মেরেই ফেলেছিল”।
তাহলে প্রশ্ন , আমাদের চিকিৎসকেরা কি আসলেই অযোগ্য ? আমরা এই অভিযোগগুলোর সত্যি-মিথ্যা একটু খতিয়ে দেখি।
ডাক্তাররা রোগীদের কথা শোনার সময় পান না, কথাটি (ব্যতিক্রম বাদে) একেবারেই ঠিক। পাবেন কি ভাবে? যিনি রোজ পঞ্চাশের উর্দ্ধে রোগী দেখেন তার পক্ষে কোনও রোগীকেই সর্ব্বোচ্য পাঁচ মিনিটের বেশী সময় দেয়া সম্ভব নয়। এই যে এতো রোগী দেখা এবং সময় দিতে না পারা, এটি কি ইচ্ছাকৃত না অনিচ্ছাকৃত ? অনেকের হয়তো এ ব্যাপারটিতে ভিন্ন ভিন্ন ধারণা বা মত থাকতে পারে , আমি আমার ধারণাটি বলছি - এটি উভয় পক্ষের দায়িত্ব পালনের দীর্ঘকালিন নেগলিজেন্সির একটি সামগ্রিক ফল।
রোগী, যারা ডাক্তারকে তিনশত থেকে পাঁচশত টাকা “ফি” বা “ভিজিট” দিয়ে চিকিৎসা পরামর্শ নেন তাদের অধিকাংশই যে কোনও কারনেই হোক তার রোগের বর্ননা এবং রোগের “কি” ও “কেন” সম্পর্কে ডাক্তারকে কোন প্রশ্নই করেন না। মুখ বুজে চলে আসেন। আবার কেউ কেউ প্রশ্ন করে হয়তো ডাক্তারের মুখ ঝামটাই শুনতে পান, আপনি ডাক্তার না আমি ডাক্তার ? যদি বেশী বোঝেন তো নিজের চিকিৎসা নিজে করলেই পারেন। সুতরাং এই জাতীয় ধমক খাওয়া রোগী পরবর্তীতে অন্য কোনও ডাক্তারকে নিজের রোগ সম্পর্কে জানতে চেয়ে প্রশ্ন করা থেকে বিরত থাকেন। এবং এদের এই অভিজ্ঞতা থেকে শিখে অন্যরাও একই আচরন করেন। এভাবেই ডাক্তার নিজ দায়িত্বের একটি গুরুত্বপূর্ন অংশ, রোগীকে আশ্বস্ত করে বিশ্বাস উৎপাদন বা “কনফিডেন্স” অর্জন করা থেকে দুরে থাকার একটি অভ্যাস তৈরী করে ফেলেন। ফলে ডাক্তার ও রোগীর মধ্যে একটা অলিখিত দুরত্ব তৈরী হয়েই থাকে সব সময়। আবার এটাও সত্য- ডাক্তার সাহেবই বা সময় দেবেন কোথা থেকে! অসংখ্য রোগী তার দরজায় হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন প্রতিদিন। তার উপরে রোগীরা নিজেরাও প্রতিযোগীতা করেন কে কার আগে ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকবেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ডাক্তারের চেম্বার এটেন্ড্যান্টকে ম্যানেজ করে আগে আগে ভিতরে ঢুকতে হয়। এমন কি রোগী ও তাদের সাথের লোকেরা অন্য রোগী চেম্বারে ঢোকার দু’তিন মিনিটের মাথাতেই অধৈর্য্য হয়ে যান এবং হয় ডাক্তারের চেম্বারের কড়া নেড়ে জানান দেন তাড়াতাড়ি করার জন্যে নতুবা তেমন সুযোগ না থাকলে এটেন্ড্যান্টকে রাগতঃ স্বরে বলে বসেন- কতক্ষন লাগে ডাক্তার সাহেবের রোগী দেখতে ? ডাক্তার সাহেবকে বলেন তাড়াতাড়ি করতে ,আরো রোগী আছে। সেই দুপুর থেকে দাঁড়িয়ে আছি। ইত্যাদি .....।
এটি গেল রোগীদের দিক থেকে সচেতনতার অভাবের দিকটি। এবারে ডাক্তার সাহেবের দিক থেকে দেখা যাক্ - যদি ডাক্তার সাহেব এটা চিন্তা করেন যে, একশত রোগী ইন্টু পাচঁশত টাকা। এক্ষেত্রে আর্থিক লাভ তো আমারই। আমি কেন রোগীকে ইথিকস্ বুঝিয়ে নিজের পায়ে কুড়াল মারতে যাই। যতো বড় রোগীর লাইন ততোই আমার সুনাম এবং কড়ি। সুতরাং ডাক্তারের চেম্বারে লাইন লেগে থাকলেও কার্যত একজন মানুষরূপী ডাক্তারের সংস্কারপন্থী হওয়ার সুযোগ নেই। কারণ সমাজ ‘অর্থ’ চেনে ‘মনুষ্যত্ব’ কে নয়।
এখন যে কারণই থাকুক না কেন এই যে সময় দিতে না পারা, এতে রোগীর রোগ নির্ণয়ে ভুল হওয়ার বা অবহেলার সুযোগ থেকেই যায়। এটা নিশ্চয়ই কোন চিকিৎসক অস্বীকার করবেন না। অথচ দেখুন, আমাদের এসিস্ট্যান্ট প্রফেসর বা তার উর্দ্ধের পদবীধারী চিকিৎসকবৃন্দ কিন্তু পৃথিবীর আর দশটা দেশের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতোই হয়তো একই ডিগ্রী নিয়েছেন। জ্ঞানের পরিধিতে সমান সমান। কিন্তু প্রয়োগের ক্ষেত্রে এসে পিছিয়ে পড়ছি আমরা। এর পেছনের কারণগুলোর অনেকটা আগেই বলা হয়েছে। কিন্তু এই সামগ্রিক চিত্রটির জন্যেই বিদেশে আমাদের চিকিৎসকদের এবং চিকিৎসা ব্যবস্থার সুনাম নেই। অথচ মজার ব্যাপার, আমাদের দেশের কতিপয় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক কিন্তু বিদেশের কিছু কিছু নামীদামি হাসপাতালেরও চিকিৎসক। এঁরা দেশে এবং বিদেশে দু’জায়গাতেই প্রাকটিস্ করেন। এঁদের যদি যোগ্যতা নাই ই থাকে তবে তাঁরা বিদেশের হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ হিসাবে টিকে আছেন কি ভাবে ?
এই যে সময় দিতে না পারা এর কারনেও কিন্তু ‘ডিফারেন্সিয়াল ডায়াগনোসিস’ এর লিস্ট বড় হতে থাকে। আর তার সাথে পাল্লা দিয়ে বড় হতে থাকে ডায়াগনোস্টিক ল্যাবরেটরী টেষ্ট এর তালিকা। এখানে ডায়াগনোস্টিক সেন্টারগুলোর ভূমিকাও প্রশ্নাতীত নয়। ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা এই সেন্টারগুলি ডায়াগনোস্টিক টেষ্ট এর বিপরীতে টেষ্ট প্রদানকারী চিকিৎসককে ‘কমিশন’ দিয়ে থাকেন। এই কমিশনের হার ৩০% থেকে ক্ষেত্র বিশেষে ৫০% পর্যন্ত হয়ে থাকে। এখানে এই কমিশনের হাতছানি একজন চিকিৎসককে অসৎ হওয়ার পথে ঠেলে দেয়ার জন্যে যথেষ্ট। এখন আমরা যদি এভাবে হিসাব করি - একটি বুকের এক্সরে করতে লাগে ১২০ টাকার মতো। যিনি এই এক্সরে করতে উপদেশ দিয়েছেন তিনি এর থেকে কমিশন বাবদ পাবেন নুন্যতম ৩০ টাকা। তাহলে আসলে ৯০ টাকাতেই ঐ এক্সরেটি করা সম্ভব ছিল। রোগীর আর্থিক সাশ্রয় হতো। প্রাকটিক্যালী তা কিন্তু হচ্ছেনা। চিকিৎসকের কমিশন ধরে নিয়েই ডায়াগনোস্টিক সেন্টারগুলো বিভিন্ন টেষ্টের ‘চার্জ’ বা ‘ফি’ ধার্য করে থাকে। ডায়াগনোস্টিক সেন্টারগুলোর তেল চক্চকে চেহারা দেখলেই বুঝতে পারা যায় এখানে লাভের পরিমান কতো। আর এগুলোতে উপচে পড়া রোগীদের ভীড় দেখলেই বুঝতে পারা যায় কি পরিমান অর্থ অনৈতিক ভাবে ঢুকে যাচ্ছে চিকিৎসকদের পকেটে। আর ল্যাবরেটরী টেষ্টের ফলাফলের যথার্থতা বা তার উপর নির্ভরতা কতোখানি রাখা যায় তা সংগতভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ। রোগীদের একটি কমন অভিযোগ, কমিশনের লোভে ডাক্তাররা অযথা টেস্ট করতে দেন যা আদৌ রোগীর প্রয়োজন নেই। সামগ্রিক অবস্থা কিন্তু রোগীদের অভিযোগের সপক্ষেই অঙ্গুলি নির্দেশ করে। এবং এই অভিযোগটি যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সত্য তা একজন চিকিৎসকই মাত্র বোঝার ক্ষমতা রাখেন। একজন চিকিৎসককে অবশ্যই আমাদের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর একজন রোগীর অর্থনৈতিক সামর্থ্যটি মাথায় রেখে প্রয়োজনীয় নূন্যতম ডায়াগনোস্টিক টেষ্ট দিতে হবে। একজন চিকিৎসকের এটি একটি নৈতিক এবং মানবিক দায়িত্ব। চিকিৎসক যখন রোগীর পেশা, সামাজিক আচার আচরন,খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদির সাথে তার রোগের সম্পর্ক নির্ণয় করে তার করনীয়টি কি তা বলে দেবেন, তখন রোগী চিকিৎসকের উপর ভরসা করতে শুরু করবেন। এতে করে খুব অল্প ডায়াগনোস্টিক টেষ্ট এর মাধ্যমে রোগটি নির্ণয় সহজ হবে এবং রোগী চিকিৎসককে বিশ্বাস করতে শুরু করবেন, সব মিলিয়ে চিকিৎসকের উপর রোগীর কনফিডেন্স্ বাড়বে।

চিকিৎসক এবং রোগীর মধ্যেকার এই জটিল মনঃস্তত্ব যা গড়ে উঠেছে উভয়পক্ষের অবহেলা আর একপক্ষের ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি থেকে, সামাজিক এবং নৈতিক স্খলন থেকে, রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনা এবং জনগনের মৌলিক অধিকার রক্ষার প্রতি বিভিন্ন সময়কালের সরকারগুলোর অনীহা থেকে, রাজনৈতিক শক্তির ছত্রছায়ায় সুবিধা লোটার মানসিকতা থেকে; যা সমগ্র স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে কলুষিত করে চিকিৎসক এবং রোগীকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে পরস্পরের প্রতিপক্ষ হিসেবে তা থেকে উত্তরন ঘটাবে কে এবং কবে ?


সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই মে, ২০১১ রাত ৯:২৮
১০টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ডালাসবাসীর নিউ ইয়র্ক ভ্রমণ

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:৪৪

গত পাঁচ ছয় বছর ধরেই নানান কারণে প্রতিবছর আমার নিউইয়র্ক যাওয়া হয়। বিশ্ব অর্থনীতির রাজধানী, ব্রডওয়ে থিয়েটারের রাজধানী ইত্যাদি নানান পরিচয় থাকলেও আমার কাছে নিউইয়র্ককে আমার মত করেই ভাল ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×