চতুর্থ অধ্যায় / (শেষ অংশ)
পরেরদিন সকালে অফিসে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম রোজকার মতো । দু’টো মৃদু মৃদু ধ্বনি ভেসে এলো আমার মুঠোফোন থেকে । যা ভাবছিলাম তাই । এ সময়টাতে একমাত্র শীলা ছাড়া আর আমাকে এসএমএস করার কেউ নেই । শীলা ই । শীলার এসএমএস । লিখেছে, “দ্য বিউটি অব লাইফ ডাজন্ট ডিপেন্ড অন হাউ হ্যাপী য়্যু আর…. বাট হাউ হ্যাপী আদারস ক্যান বি …. বিকজ অব য়্যু .. গুড মর্নিং” ।
শীলার এমোন কথার কি অর্থ করবো আমি ? আমার জন্যেই সে কি সত্যিকারের সুখী ভাবতে শুরু করেছে নিজেকে ? নইলে একথা লিখলো কেন সে ! যে মেয়ে আমাকে বলতে পারে “তোমাকে ছেড়ে আমি কি করে যাই বলো” সে মেয়ে তো এমোনটা লিখতেই পারে ! আমি যে আরো গভীর ভাবে বাঁধা পড়ে গেলাম ওর কাছে । এটাকে কি আমার “পরকীয়া” অর্থেই পরকীয়া ভাবা উচিৎ নাকি আরো গভীর কোনও ভালোবাসার অতল আহ্বান !
সমুদ্রের অতলে আলোহীন নীল জলের ভেতর সাতরঙা প্রবালের যে দ্যুতি খেলা করে যায় সোনালী মাছেদের গা’য়ে; তেমনি কায়াহীন এক ভালোবাসা আমাকে ছুঁয়ে দিয়ে গেল যেন । আমি যেন শীলা নামের এক অদৃশ্য মেয়ের হৃদয়ের গভীর গোপনে মুখ ডুবিয়ে খুঁজে পেলাম এক দিঘী তৃষ্ণার জল । শীলার মানবী শরীর, তার কায়া ছাড়িয়ে এক অশরীরি শীলা যেন উঠে এলো আমার কাছে । এ অনুভব আমার জপের মালাটি হয়ে থাকুক । আমার সব ।
অফিসে যেন উড়ে এলাম । বড় ইচ্ছে হলো, ওর সাথে কথা বলি । আমি কখনও ওকে আগ বাড়িয়ে ফোন করিনি যদি ওকে কোনও বিব্রতকর অবস্থায় ফেলি কিম্বা ওর সাংসারিক কাজের ব্যাঘাত ঘটিয়ে ওকে অন্যমনষ্ক করে তুলি এই চিন্তা থেকে । আজও এটা ভেবে বিরত থাকতে হলো । এ এক অন্যরকম ভালোবাসা । তীব্র অথচ মধুর সংযম ভালোবাসাকে গাঢ় রসেই সিক্ত করে , ব্যতিব্যস্ত করে তরল করে ফেলেনা । হাতে কাজ ছিলো বেশ, কাজের মধ্যেই ডুব দিতে হলো । এর মধ্যেই শীলার ফোন, “অফিসে পৌঁছেছ, ব্যস্ত ?”
ভেসে গেলাম । কাব্যিক হয়ে উঠতে ইচ্ছে হলো, বললাম – “যব রাত আঁয়ে তো নিদ আঁয়ে / যব নিদ আঁয়ে তো খাঁব আঁয়ে / যব খাঁব আঁয়ে তো তুম আঁয়ে / আওর যব তুম আঁয়ে তো নাহ নিদ আঁয়ে, নাহ খাঁব আঁয়ে ।।
“তুমি কবি হয়ে উঠলে যে” শীলার গলায় আহ্লাদী আমেজ ।
“কি করবো বলো ? এই যে তুমি এলে, কাজ থাকুক একদিকে পড়ে, পৃথিবী অন্যদিকে । কবি হয়ে ওঠা তো এখোন শুধু আমাকেই মানায় ।”
“তুমি তো আমাকে পাগল করে দেবে……” শীলার কন্ঠে ভেজা বসন্ত খেলা করে যায় ।
কথা হয় অনেকক্ষন । কবিতা থেকে ওর ঘর-গৃহস্থালীতে কথাকে নিয়ে যাই সন্তর্পনে । যাতে শীলা, একজন পরস্ত্রী-একজন মা , না ভেবে বসে নিষিদ্ধ এক খেলায় মেতে আছে সে । এ বোধ থেকে তাকে ফেরাতে চাই আমি, অসীম ভালোবাসায় । আমি জানি, আমার ভালোবাসায় কোনও অশুচি নেই, নিষেধের গন্ধ নেই, প্রচলিত পরকীয়ার শরীর নেই । প্লেটনিক ভালোবাসার মতো তার অবয়ব । কঠিন বটে কিন্তু একেবারেই অসম্ভব নয় । তাই স্বাভাবিক বন্ধুর মতো তার ঘর-সংসারের কথা জিজ্ঞেস করি । কি রান্না করছে সে এখোন, জিজ্ঞেস করি তাও । হাসিতে ভেঙে ভেঙে কথারা এগোয় । পৃথিবীর সব ভালোবাসা উজার করে আমরা দু’জন অন্যরকম এক খেলায় মেতে উঠি ।
শেষমেশ হাল ছাড়ে শীলা – “তুমি কি আমাকে কোনও কাজ করতে দেবেনা, সোনা ? আমার কি তোমার প্রশ্নের জবাব দেয়া ছাড়া আর কোনও কাজ নেই ?” প্রশ্রয়ী শাসন ওর গলায় ঝরে পড়ে বৃষ্টির শব্দের মতো ।
হিমাদ্রী শিখরে সূর্য্যের আলো লেগে যেমন বরফ গলে গলে পড়ে , আমার ভেতর এক কিশোর হৃদয়ও তেমনি করে গলে গিয়ে আদ্র হতে থাকে । কানে বাজে শীলার কথাটিই – “আমার কি আর কোনও কাজ নেই ?” যেন জন্ম-জন্মান্তরের অধিকার নিয়ে আমার চপলতাকে দুষ্টু শাসন করা তার । এ পাওয়াকে আমি কোথায় রাখি !
লাঞ্চ সেরে শীলার সাথে সকালে বলা কথাগুলোর কথা ভাবতে ভাবতে মুঠোফোনের অডিওতে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনছিলাম চোখ বুজে । এমোন সময় পি পি করে শব্দ তুলে মুঠোফোনের গান বন্ধ হয়ে গেল । কারো এসএমএস । এই এক ঝামেলা, জিপি অফার অথবা সরকারী মেসেজ , দিন নাই ক্ষন নাই – গভট ইনফর্মেশান… বা জিপি অফার । গানের বাটনে হাত লাগাতে গিয়েই থমকে গেলাম । শীলার মেসেজ । হঠাৎ আবারো শীলা । পড়লাম । শীলার প্রতিটি মেসেজই যেমন হৃদয়ে উন্মাতাল ঝড় তোলে এটিও তাই । এবার ঝড় নয়, তান্ডব –
“ ম্যায়নে হাওয়া কো এক মেসেজ দিয়া / উও হাওয়া ঝুমতি হুয়ি বাদল কি পাস গ্যায়ী / আউর মেরা মেসেজ বাদল কো দে দিয়া / আউর ও বরসনে লাগা / গিরনে ওয়ালী হর বুন্দ সে আওয়াজ আঁয়ি “আই মিস য়্যু” ।।”
আমি এখোন কি করি ! “আই মিস য়্যু” এই কথাটি যেন কাল বোশেখীর তান্ডবের মতো আমার নাজুক হৃদয়খানাকে দুমড়ে মুচড়ে দিয়ে গেল । আমার প্রচন্ড ইচ্ছে হলো শীলাকে একবার দুচোখ ভরে দেখি । হায় যদি দেখতে পেতাম ! শুধু লিখলাম, “ তোমার মতোন এই এতোটুকু এক মেয়ে এতো শক্তি কোথায় পেলে ?” উত্তর এসেছিলো ঝটপট, “ সে আমার প্রেম ” ।
আজ ইচ্ছে করেই দেরীতে বাসায় ফিরলাম । ফুল্লরা একবার শুধু জানতে চাইলো দেরীর কারন । পথের গাড়ী-ঘোড়ার জ্যামের কথা বলে এড়াতে চাইলাম । “সে তো প্রতিদিনই থাকে” - ফুল্লরার গলায় কি একটু অবিশ্বাসের ছোঁয়া ! ফুল্লরাও কি আমাকে মিস করছে ? ওর জন্যে বুকের ভেতর থেকে উঠে আসতে চাইলো একরাশ মমতা-ভালোবাসা । যে ভালোবাসার স্রোতে আমি ভেসে যাচ্ছি তেমন ভালোবাসার স্রোতে ফুল্লরাকেও ভাসিয়ে নিতে ইচ্ছে করলো । বিশুদ্ধ ভালোবাসার স্পর্শ তো এমনি করে ভালোবাসতেই শেখায় । আদর করে কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেলাম ফুল্লরার তীর্যক দৃষ্টির দিকে চোখ পড়তেই । ভেতরের ধেঁয়ে আসা ভালোবাসা যেন একটা দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে থেমে গেল ।
“এককাপ চা দেবে ?” ফুল্লরার দিকে তাকাই । ফুল্লরা মেয়েকে ডাকে, তোর বাবাকে এককাপ চা করে দে তো । জিনিয়া খুব ব্যস্তসমস্ত হয়ে দৌড়ে এলো ।
“বাবা, আর একটু পরেই তো খেতে বসবে, এখোন চা খাওয়ার দরকার কি ? আমি এখোন ব্যস্ত বাবা । তুমি একটু নিজে নিজে করে খাওনা ।” আদুরে ঢঙে বলতে বলতে জিনিয়া নিজ ঘরের দরজার ওপারে । চা খাওয়া একটা অজুহাত মাত্র । ইচ্ছে ছিলো ফুল্লরাকে নিয়ে একটু বসি, ছেলেমেয়েরা থাকলে আরো ভালো । কতো কিছু যে সবাইকে বলতে ইচ্ছে করে ! দেশের কথা, রাজনীতির কথা, নিজের কথা, অফিসের, বাইরের, ঘরের কথা । সারা বিশ্বে কোথায় কি ঘটেছে তার কথা, মানুষের কথা, কবিতার কথা, সবুজ গা-গ্রামের কথা । ফুল্লরার ভরা যৌবনে, ছেলেমেয়েরা যখোন ছোটো ছোটো ছিলো কত কথাই তো একজোটে বসে করেছি আমরা । ওপানটি বাইস্কোপ এর মতো বাপ-ছেলেমেয়ে পরপর কোমড় জড়িয়ে টেবিল চেয়ার এর চারদিকে ঘুরে ঘুরে গান গেয়েছি – আজ জোৎস্নারাতে সবাই গেছে বনে..... । খুব কি বুড়িয়ে গেছি আমরা এখোন ! অতি বাস্তবতা কি আমাদের ভেতরের নরম মোমের মতো কোমল নান্দনিকতাকে চটের দেয়ালের ওপারে ঠেলে সরিয়ে দিয়েছে ? যেখান থেকে ফাঁক-ফোকড় দিয়ে পিছনের দিনগুলির ছবি ছেঁড়া ছেঁড়া, অস্পষ্ট দেখা যায় ?
গল্পের মতো দিনগুলো ফুরিয়ে গেলো এতো তাড়াতাড়ি ? কি দোষে আমরা নত হয়ে আছি প্রাত্যহিকতার কাছে ?
দিনের রং মুছে গেলে সব পাখি ঘরে আসে । শূন্য একটি নীড় যেন অপেক্ষায় থাকে কারো । একটি গল্পের জন্যে কিশোরী রাত তরুনী হতে থাকে ধীরে ধীরে । আকাশের আঙ্গিনা থেকে নেমে আসে এক “আর্টেমিস” আলোর দেবী । অন্ধকারের মাঝেও যে রাত্রিবাসে নীল সবুজের আলো জ্বেলে বসে থাকে । যার দেখার চোখ আছে শুধু সে ই দেখতে পায় ।
এমোন একটি মরমী সন্ধ্যার জন্যে আর কতো অপেক্ষা মানুষের !
(চলবে..... অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন)
চতুর্থ অধ্যায় / (প্রথম অংশ)
Click This Link
চতুর্থ অধ্যায় / (দ্বিতীয় অংশ)
Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে সেপ্টেম্বর, ২০১১ দুপুর ১২:৫৭