পঞ্চম অধ্যায় / (প্রথম অংশ)
“… আমি একদিনও না দেখিলাম তারে
আমার বাড়ীর পাশে আরশী নগর
এক পড়শী বসত করে ।”
ঘুম ভাঙতেই দেখি আকাশটা ঝিম মেরে আছে । কাল রাতের আকাশের ছিচকাঁদুনে ভাবের রেশটুকু কাটেনি এখোনো । একটু যেন শীত শীত লাগছে । জানালার বাইরে মরা রোদের আভাস একটু পাওয়া যায় কি যায়না ! যেন ঢুকবে কি ঢুকবে না এমোনটা ভাবছে । এরই মাঝে একটা চড়ুই এসে বসেছে জানালার সামনের কামিনী ফুলগাছটার ভেতরের একটি ডালে । ভিজে গেছে, ডানা ঝাপটে জল ঝড়াতে গিয়ে রোমগুলো খাড়া খাড়া হয়ে আছে । পাখিটার ঝড়ো অবস্থা দেখে মায়া হলো । ওর জোড়টা কই ! এক শালিক দেখলে নাকি দুঃখ আসে । একটি চড়ুই দেখলে কি হয় !
পাশ ফিরে সামিয়ার দিকে তাকালাম, দেখি অকাতরে ঘুমুচ্ছে । আহা বেচারা । বাবার আদর মেলেনা সব সময় । বাবা কাছে থাকেনা সপ্তাহের বেশী দিন । শোয়েব কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়র । ভালো মাইনের চাকুরে । হপ্তা শেষের ছুটিতে যখোন আসে তখোন যেটুকু আদর পায় মেয়েটি সেটুকুই তার জমার খাতায় তলানীতে পড়ে থাকে । বাকীটুকু পোষাতে হয় আমাকেই । মেয়েটি আমাদের দু’জনারই চেহারা পেয়েছে । আমাদের প্রথম সন্তান । গোড়ার দিকে আমাদের দু’জনার ভাব ভালোবাসা ছিলো বলেই হয়তো । সে ভালোবাসা এখোন দুরত্বের কারনে কতোটা মজবুত আছে মাঝেমাঝে ভাবি ।
শিক্ষিত, সুপুরুষ শোয়েবের ঘর করতে এসে প্রথম প্রথম পাখির মতো উড়ে উড়ে গেছি । শ্বাশুড়ী আর দুই ননদ দেবরের সংসার । ছেলে কাছে থেকেও যেন প্রবাসী । আর দশটা সংসারের নিয়ম মতো তাই সংসার চালানোর দায়িত্বটা এসে পড়েছে । নিজের মতো করে সাজিয়েছি সব । ব্যবধানটা বেড়েছে সেখান থেকেই । আমার শিক্ষা সেটাকে একটা সীমার মধ্যে আটকে দিয়েছে । তবু তাই ই খানিকটা ডালপালা ছড়িয়ে পৌছে যায় যেন হাযার মাইল পেরিয়ে । শোয়েবের সাথে এ নিয়ে আমার তেমন কথা হয়না । তবু বুঝতে পারি সুরের তাল যেন খানিকটা ঢীমে হয়েছে । একা একা এ ভার বয়ে চলা মাঝে মাঝে বড় কঠিন মনে হয় ।
বিছানা ছেড়ে বাথরুমের দিকে যেতে যেতে হিসেব করলাম, শোয়েবের আসতে আরো দু’দিন বাকী । বেশ কিছু কাজের কথা আছে ওর সাথে । শ্বাশুড়ী ডায়াবেটিসের রোগী । ননদ যূথী আর দেবর পলাশের কলেজ, লেখাপড়া নিয়ে কথা বলতে হবে । কথা বলতে হবে শোয়েবের হাজী লেনের এই পৈত্রিক বাড়ীটি নিয়েও । যতো ঝামেলার কাজ । সবাইকে সামলে, এতো দিক দেখেশুনে রাখতে মাঝে মাঝে একাকী হয়ে পড়ি । একা একা মনে হয় নিজেকে । নভেরা ছিলো বলে বাঁচোয়া । আমি যখোন আইবিএ থেকে মাষ্টার্স করে একটি বিদেশী টেলিকমিয়্যুনিকেশান প্রতিষ্ঠানে চাকরী করি তখোনই নভেরার বাবা আমার সাথে শোয়েবের বিয়ের প্রস্তাবটি আনেন । নভেরাদের বাসার কাছেই বাসা । সেই সুবাদেই আজো নভেরা আমার প্রতিবেশী । আমার বাবা বেঁচে নেই । কেবল আমার মা বড় ভাইয়ের সাথে রাজশাহীতে আছেন এখোন । আত্মীয়রা যে যার মতোন, ধারে কাছে নেই । তাই এই শহরে আমি বড় একা । স্বামী নামের লোকটি অনেকটা থেকেও নেই যেন । শুরুর দিকের জোয়ারের কলধ্বনী এখোন মনে হয় দুরাগত । নদীতে একবার স্রোত থেমে গেলে নদী মরে যেতে চায় কান্নায় । ক্ষীন হয়ে আসে তার ধারা । মজা নদীতে ধীরে ধীরে জন্ম নেয় শৈবালের দল । পাঁক ধরে, যেন ছানি পড়ে গেছে জলে ।
দরজায় খটখট শব্দ । কেউ ডাকছে হয়তো । শ্বাশুড়ী ! ননদ যুথী ! কে ? মরুক গে । আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলে চিরূনী ছোঁয়াতে গিয়ে হঠাৎ চোখ গেল আয়নার চোখে । বেশ ফোলা ফোলা মনে হলো । রাতে কি ঘুম ভালো হয়নি ! নাকি খুব বেশী ঘুমিয়েছি ! ঘুমের কোনও সমস্যার কথা এ মূহুর্তে মনে পড়লোনা । তাহলে কি কোনও স্বপ্নের ভেতর কেঁদেছি !
না, স্বপ্নের ভেতর নয় আর একজনের কান্না শুনেছি কাল সন্ধ্যের আগে আগে । কাল রাতের বৃষ্টির মতো শব্দ ছিলো তার ।
যাকে তাড়াতে চাইছি কেন যে বারে বারে সে ই সবকিছু ঠেলেঠুলে মনের দরজা খুলে উঁকি মারে ! এ খেলাটি নিষিদ্ধ বলেই কি ! নিষিদ্ধতার একটা আলাদা রোমাঞ্চ আছে হয়তো । কিন্তু আমার তো সে রকম লাগছেনা , কেমন যেন কষ্টের মতো একটা সুখী ঝরনা তিরতির করে বয়ে গেছে, যাচ্ছে আমার শিরায় শিরায় । কান পাতলেই তার কুলুকুলু কুহকী ধ্বনি শুনতে পাবো বোধহয় । অনেক তীব্র ভালোলাগার চোরকাটাগুলি আমারই অজান্তে একটি একটি করে আমার শাড়ীর আঁচলে ফুটে গেছে যেন । তা বাছতে গেলেই কোথায় যেন স্মৃতির তারে ঘা লাগছে । প্রথম ভালোবাসা হারিয়ে যাওয়ার মতো । মনে পড়ে যাচ্ছে, পৃথিবীর কোনও এক নিভৃত কোনে শুধু একজোড়া চোখ আমার প্রতীক্ষাতেই জেগে আছে । যে আমার কেউ নয় অথচ আমার ভালোমন্দ সকলি ভেবে ভেবে যার সারাদিনমান কাটছে । উৎকন্ঠার সে চোখ যেন আমাকে ঘিরে আছে অনুক্ষন । যে চোখ তৈরী করেছি আমি নিজে ।
কুসুম কোমল লজ্জার একটা অস্বস্তি জড়িয়ে ধরতে চাইলেও আমার যে ভালো লাগেনা, একথা কি করে বলি ! নিজেকে এই একটিমাত্র ক্ষেত্রেই সৌভাগ্যবতী মনে হয় ।
উপায় ছিলোনা । সে দু’চোখেই আমি কাল জল ঝড়িয়েছি । কাল দুপুরে “ হোয়্যার আর য়্যু ?” তার এরকম একটা মেসেজ পেয়ে মনে হলো ঘাতক তীরটি ছোঁড়ার এই ই সময় । দেরী করে ফেললে আমার নিজেকেই কষ্ট দেয়া হবে । সময় লম্বা হলে আমার কষ্টই বাড়বে শুধু । আমি এই খেলার তীব্র পাঁকে আরো গভীর ভাবে গেঁথে যাবো । বাঁশের ঝাড় বাড়তে দিতে নেই । বাড়তে দিলে তাতে অনেক বাঁশী হয়তেো বাজবে কিন্তু অন্ধকার করে দেবে চারদিক ।
মেসেজ করলাম, “ আমাকে এতো ভালো বেসোনা । আমি এখানে দু’দিনের অতিথি।”
পরক্ষনেই তার মেসেজ, ‘ঠিক করে বলো তো কি বলতে চাচ্ছো তুমি ?’ উত্তর দেয়ার আগেই আমার মোবাইল বেজে উঠলো । দেখি সে ।
এই প্রথম নিয়ম ভাঙ্গলো তার, কন্ঠে উৎকন্ঠা, বললো – “আমি একটা মিটিঙয়ে ছিলাম মধ্য থেকে উঠে এসেছি । তুমি জানো কি কথা তুমি বলেছো ? তোমার কথার মানে কি ?” ।
গলা তার কাঁপছে স্পষ্ট বুঝতে পারছি
বললাম, মনটাকে শক্ত করো । আমি মেইল করে জানাচ্ছি সব ।
মেইল করলাম “….. তুমি আমাকে এতো ভালো বেসোনা । আমি এখানে দু’দিনের অতিথি । তুমি মনটাকে শক্ত করো, আমি “সিএমএল” এর রোগী । ইন্টারনেটে দেখে নিও এ রোগটি কি । বেঁচে থাকবো কতোদিন জানিনা । সবাইকে ছেড়ে চলে যাওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র । আমাকে ভুলে যেতে চেষ্টা করো ।”
এতোবড়ো এক মিথ্যে লিখতে আমার হাত কাঁপলোনা একটুও । মানুষ বলে – স্ত্রী চরিত্রম দেবঃ ন জানন্তিঃ” । ভুল বলে কি খুব ! আমি তাকে দেখছিনে কিন্তু দিব্যচোখে দেখতে পাচ্ছি সে ‘থ’ হয়ে তার স্ক্রীনটির দিকে তাকিয়ে আছে । চোখমুখে তার আঁধার ঘনিয়ে আসছে একটু একটু করে । গলার কাছে কি যেন একটা উঠছে নামছে । কান্না ! জবাই করা পশুর মতো শব্দহীন এক ছটফটে কান্না ।
যাকগে, আমার কি !
(চলবে..... অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন)
শুদ্ধতম পরকীয়া
চতুর্থ অধ্যায়
Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে সেপ্টেম্বর, ২০১১ দুপুর ১:৫১