ষষ্ঠ অধ্যায় / (প্রথম অংশ )
--------ইয়ে তো টুঁটে হুয়ে দিল হ্যায় সাকী,
ম্যয়নে তো টুঁটে হুয়ে শীশা ভী নহী দেখ সেক্তে ….
শীলার ওখান থেকে ফিরে ভালো লাগছিলো না কিছুই । রাতের খাবারের ডাক পরলেও সাড়া দিইনি । মা এসে এসে দু’বার ফিরে গেছেন । বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে থাকা থেকে আমি নড়িনি । শীলার ব্যাপারটিতে আমার যতোটুকু সম্পৃক্ততা তা নিয়ে আমার হয়তো মন খারাপের কিছু থাকার কথা নয় । ওটা একান্তই শীলার ব্যাপার । তবুও মনের কোথাও যেন একটু টান ধরেছে । শীলার মেইলে পাঠানো সব লেখা পড়ে মনে হলো ভদ্রলোক বেশ আপন করে নিয়েছেন শীলাকে, ভালোও বেসে ফেলেছেন খুব । তার কাছে পাঠানো শীলার ছবির মুখখানিও স্কেচ করে পাঠিয়েছেন । লিখেছেন, শীলার ছদ্মনামের সাথে নাকি চোখের অদ্ভুত মিল । ভুমধ্যসাগরের নীল মাখানো দু’টি চোখ তাকে নাকি মোহময় করে রেখেছে । শুধিয়েছেন, “এ চোখ তুমি কোথায় পেলে শীলা ?”
তরুনী বয়েস, সুন্দর মুখশ্রী আর আবেগঘন শে’র বা পংক্তিমালা একজন পুরুষকে ঘায়েল করার জন্যে যথেষ্ট । এই তিন তিনটি মোক্ষম অস্ত্রের একটি যে আমি । যে চোখের অতলে উনি হারিয়ে গেছেন সে চোখ যে আমার । তার কাছে পাঠানো ছবিটি যে আমারই । এইটুকুতেই যে আমাকে পীড়িত হতে হয় আজ, এইটুকুই যে মনের গহীন কোথাও টান ধরানোর জন্যে যথেষ্ট । যার চোখ ভেবে ভেবে ভদ্রলোক তার উদাসী দুপুর, নিদাঘ রাত পার করছেন সে চোখ তো শীলার নয়, অন্য কারো । আমারই । ৭৮নং হাজী লেনের আহমেদুল কবিরের মেয়ে নভেরা কবিরের চোখ ।
শীলাকে যেদিন বলেছিলাম, “শীলা, এতোদিন তো কেবল লালটু আলু আলু মার্কা অল্প বয়েসী ছেলেদের সাথে প্রেম প্রেম খেলেছিস । এবার একজন বেশী বয়সের পুরুষ ধর । দেখবি আলাদা এক মজা । বয়স্ক পুরুষের প্রেম যখন উৎলে ওঠে না, তখন দেখবি তোর দু’কুল ভেসে গেছে । এবার দেখি একা একা তুই কদ্দুর যেতে পারিস সাঁতরে ।”
শীলা হৈ হৈ করে উঠেছিলো - খুব ভালো কথা বলেছিস তো । তাহলে তো বেশী বয়সের পুরুষ ধরতে টোপ হিসেবে সুন্দর একটা মুখ লাগবে । সেটা কোথায় পাবো ? আমার নিজেরটা দিয়ে হবেনা ।
আমি তখন প্রগলভ হয়েছি আরো – “কোত্থাও না পেলে আমারটাই না হয় পাঠিয়ে দে । আর তুই তো জানিসই এতে ধরা পড়ার কোনও ভয় নেই । আমি তো আর থাকছিনা এখানে । খুব শীঘ্রই তো আমি চলে যাচ্ছি ।”
শীলা চেয়ে থাকলো আমার চোখে চোখ রেখে অনেকক্ষন ।
সেদিন কিছু বুঝিনি বা খেয়াল করলেও গায়ে মাখিনি । আজ মনে হচ্ছে সেদিন শীলা কিছু একটা দেখছিলো আমার চোখে ! কি দেখছিলো ! খসে পড় পড় এক নীল আকাশের তারা ! ভুমধ্যসাগরের অতল নীলজলের গোপন কান্না ! আমার চোখের দিকে চেয়ে ও কি পড়তে চাইছিলো বেদনার কোনও ভাষা ? ওর এরকম করে দেখার কোনও অযৌক্তিক কারন নেই মোটেও । দোষ ও নেই ।
সুশান্তর ও ছিলোনা । সুশান্তর সাথে আমার প্রথম যেদিন দেখা সেদিন সুশান্তও তাকিয়েছিলো আমার চোখের দিকে ঠিক শীলার মতো । আজ ভালো না লাগার এই দিনে বুঝতে পারছি, অনেক না বলা কথা লুকানো ছিলো দু’জনারই চোখে । দুই ভিন্ন প্রেক্ষাপটে, দুই ভিন্ন সময়ে । আজ বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে শুয়ে কান্না এলো আমার । আর অনেক অনেকদিন পরে এই আমি কাঁদলাম, নিরবে । নিজের জন্যে । একটি প্রতারনার জন্যে, লজ্জায় । সেদিন যাকে খেলা বলে শীলার সাথে তালে তাল মিলিয়েছিলাম আজ বুঝলাম, সব খেলাই খেলা থাকেনা, সব খেলাই সব সময় খেলা হয়ে ওঠেনা । কোনও কোনও খেলা কারো জীবন মরন হয়ে দাঁড়ায় । আমি জানি আমার এ চোখ একদিন ঘোলা হয়ে আসবে কিন্তু সে চোখ যে কেউ অনন্ত যৌবনা করে রাখবে তার হৃদয়ে সে কথা ভাবিনি । মনের ছবিতে দেখতে পাচ্ছি, ভদ্রলোকটি আমারই চোখে চোখ রেখে ভাবছেন যার কথা বাস্তবে তার কাছে সে আমি নই । অন্য কেউ । অথচ যার মুখখানি ভেবে ভেবে উনি আকুল হয়ে লিখেছেন, “তুমি আমার বেলাশেষের কুড়িয়ে পাওয়া এক নীলমুক্তো । লোকে বলে যে নীলা নাকি কারো সয় কারো সয়না । আমার সইবে তো ?” সে মুখখানি যে আমারই । রক্ত মাংশের নভেরা কবিরের ।
তার প্রশ্নের উত্তর তো আমার জানার কথা নয় , শীলাও জানে কি ?
আসলে আমার এখোন সব কিছু ভুলে যাওয়াই উচিৎ । পচিশ বছর বয়স থেকেই আমার ভুলে যাওয়া উচিৎ ছিলো অনেক কিছুই । সেই বেনী দুলিয়ে স্কুলে যাবার দিনগুলি, বুকের কুঁড়ি মেলার ব্যথাভরা অব্যক্ত শিহরন নিয়ে বৃষ্টিতে ভেজা কদমফুলের মতো আদ্র হয়ে ওঠার দিনগুলি । প্রথম যেদিন শাড়ী ধরলাম তার আবরনে ঢাকা দেহখানির দিকে মুগ্ধ চকিত নয়নের অজস্র চাহনির দিনগুলি । এই সব দিনবদলের ছবিগুলি আমার স্মৃতিপটের শিলায় কেন যে লেপ্টে থাকে ! আমার তো এসব ভুলে যাবার দিন । হায় , যদি সব মুছে ফেলা যেত !
এরকম করে ভাবতে গিয়ে মাথাটা কেমন যেন হালকা হয়ে আসছে , দূর্বল লাগছে আর ম্যাজম্যাজ করছে শরীর । একটা জ্বর জ্বর ভাব পায়ের পাতা থেকে উরু পেরিয়ে মাথায় উঠে আসতে চাইছে । এমোনটা আমার প্রায়ই হয় । সেই পঁচিশ বছর বয়েসের আগে থেকেই ।
কেমন যেন গরম গরম হয়ে থাকতো শরীরটা । হাত-পায়ের গাঁটে গাঁটে যেন বাসা বেধেছে এমোনটা মনে হতো । ব্যথা হতো । পেটেও ব্যথা হতো । দুষ্টুমীতে আর দৌড়-ঝাঁপে সারাদিন কাটতো বলে এমোনটা হচ্ছে ভেবে গায়ে মাখতামনা । মাঝেমোঝে টুকটাক জ্বর-ব্যথার ওষুধ খেয়ে হাপিস করে দিয়েছি শরীরের অস্বস্তি । তখন কে জানতো শরীরে ঘুণপোকা বাসা বাঁধতে লেগেছে ! ঘুণে ধরতে শুরু করেছে অস্থিমজ্জা ।
যেদিন পেট ব্যথায় দারুন কাতর, হাসপাতালে না গিয়ে পারা গেলনা । ডাক্তার রোগ ধরতে পারলেননা বরং ধরা পড়লো সন্দেহজনক কিছু । সে জন্যেই আমার ডাঃ ওয়াদুদ সাহেবের কাছে যাওয়া । সেখানেই সুশান্তকে আমি প্রথম দেখি । সুশান্ত ও আমাকে । সুশান্ত ডাক্তার । ডাঃ ওয়াদুদ সাহেবের সাথে কাজ করে । রোগের ইতিহাস আর রক্তের স্যাম্পল দিতে দিতে তাকে শুধাই – খুব খারাপ কিছু কি ?
উত্তরে নবীন ডাক্তারটি হেসে হেসে বললেন, ‘আগেই ঘাবড়ে যাওয়া ভালো নয় । পরীক্ষাগুলোকে আগে তো শেষ করতে দেবেন । রিপোর্ট আসুক তখন দেখা যাবে । আর রিপোর্ট খারাপ হলেই যে খারাপ তা তো নয় । রোগীর ক্লিনিক্যাল সাইন-সিম্পটমের সাথে মেলাতে হবে, আরো অনেক কিছু দেখতে হবে আমাদের । এগুলো আপনি বুঝবেন না ।‘
‘কেন বুঝবোনা ডাক্তার সাহেব ? বুঝিয়ে বললে বুঝবোনা কেন ?’ অকপটে বলি, আমার যেমন স্বভাব ।
মৃদু হাসে সুশান্ত । ‘ঠিক আছে আপনাকে সব বুঝিয়ে বলা হবে । আজ এ পর্য্যন্তই । আপনি তিনদিন পরে দেখা করবেন । আমার কাছেই চলে আসুন সরাসরি ।’
‘এই যমালয়ে আপনাকে আমি আবার কোথায় খুঁজে পাবো ?’
‘ও.. তাইতো’ বলে একখানা কার্ড ধরিয়ে দেন আমার হাতে সুশান্ত ।
বাবা-মা মুখে দুঃশ্চিন্তা ঝুলিয়ে আর আমি বকবক করতে করতে ঘরে ফিরি । আবার তিনদিন অপেক্ষা !
তিনদিন পরেই শুধু নয় আমাকে এখন নিয়মিত ডাক্তার সূশান্তর কাছে হাজিরা দিতে হয় । ততোদিনে সূশান্ত ডাক্তার সাহেব থেকে কেবল সুশান্ত । সব কিছু পরীক্ষা শেষে ডাঃ ওয়াদুদ সাহেব যেদিন বললেন আমি ক্রনিক মাইলয়েড লিউকেমিয়ার রোগী সেদিন কাছে দাঁড়ানো সুশান্তর চোখে যে দৃষ্টি আমি দেখেছি সেদিন শীলার চোখেও তেমন দৃষ্টি ছিলো । যেদিন আমি শীলাকে বলেছিলাম – “কোত্থাও না পেলে আমারটাই না হয় পাঠিয়ে দে । আর তুই তো জানিসই এতে ধরা পড়ার কোনও ভয় নেই । আমি তো আর থাকছিনা এখানে । খুব শীঘ্রই তো আমি চলে যাচ্ছি ।”
আমি কোথায় যাবো ! কে কোথায় বসে আছে আমার জন্যে ! সবারই কেউ না কেউ একজন থাকে । আমার যে কেউ নেই । এমোন কি সুশান্ত ও । সুশান্ত তো জানে আমার শেষের ঠিকানাটি । দিনের শেষে একজন নভেরা কবিরের জন্যে সে ঠিকানায় বসে থাকার যে কেউ নেই । কল্পনা নামের সিঁথিতে সিঁদুর দেয়া যে মেয়েটি সুশান্তকে জড়িয়ে রেখেছে তার আঁচলে, সেখান থেকে বাড়িয়ে দেয়া সুশান্তর হাত দুখানি শুধু নিটোল বন্ধুত্বের, ভালোলাগার । ভালোবাসার নয় । এ সত্যটি যেমন সুশান্ত জানে তেমনি আমিও । এ নিয়ে আমরা হাসাহাসি করি, খুনসুটি করি । আমি জানি আমাকে হাসিখুসি দেখতে ওর ভালো লাগে । জীবনের বাকী ক’টা দিন যেন আমার নিরানন্দে ভরে না থাকে । হয়তো এটাও এক ধরনের চিকিৎসা ।
ডাক্তার আর রোগী সম্পর্ক নয়, দু’টো সমবয়সী নারী পুরুষের মাঝে এক ব্যথার বন্ধন । যে কৃষ্ণগহ্বরের দিকে আমি ছুটে চলেছি নিরন্তর, সুশান্ত জানে সে পথ কতোটুকু দীর্ঘ । আর তাই সেখানে পৌঁছে যাবার সময়টাকে আসলে সে প্রলম্বিত করতে চাইছে মাত্র ।
শ্বান্তনা দেয় ও আমাকে - তোমার ক্রনিক ষ্টেজ চলছে । ভালো যে শুরুতেই রোগটি ধরা পড়েছে । ঠিকমতো ওষুধ খেয়ে যাও । মনটাকে হাসিখুশি রাখো । দ্বিতীয় ধাঁপ মানে এক্সিলারেটেড ফেজ এ পৌঁছুতে অনেক বছর লাগবে । ভগবান যেন সে ষ্টেজে তোমাকে না নেন ।
চৌকস অনকোলজীষ্ট ডাঃ ওয়াদুদ সাহেব ও একই কথা বলেন ।
(চলবে..... অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন)
শুদ্ধতম পরকীয়া
পঞ্চম অধ্যায়
Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে অক্টোবর, ২০১১ বিকাল ৫:১৪