সপ্তম অধ্যায় / ( প্রথম অংশ )
“আলাম হ্যাঁয় সব হী ইয়ার,
কহী ইয়ার নহ্ পায়া …..”
[দুনিয়া বন্ধুতে ভর্তি, কিন্তু কোথাও বন্ধু পাওয়া গেলনা …]
ঝগড়াটা এড়ানো গেলোনা কিছুতেই । সময়টা উশৃঙ্খল হয়ে গেল । ফুল্লরাকে আমার বুঝে ওঠা বেশ কঠিন হয়ে যাচ্ছে দিনদিন ।
‘এই বয়সে সারারাত কম্প্যুটারে কি করো বসে বসে ।’ রাত দশটা বাজতে না বাজতেই এই ছিলো ফুল্লরার দিক থেকে প্রথম দমকা হাওয়া ।
সামলে নিয়ে বললাম, ‘দেখতেই তো পাচ্ছো লিখছি’ ।
‘লিখছো না চ্যাট করছো ? কি লিখছো শুনি…’ হাওয়ার গর্জন একটু বাড়লো মনে হয় ।
‘লিখছি । তুমি জানোনা আমি কি লিখি ? গল্প লিখি, কবিতা লিখি, প্রবন্ধ লিখি । যখোন যেটা ভালো লাগে । এখোন সরো তো একটু, যা ভাবছিলাম দিলে তো এলোমেলো করে ! আর আমার জন্যে কোন মেয়ে বসে আছে এই রাত্তিরে চ্যাট করার জন্যে ? মেয়েদের আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই ?’ বোকাবোকা হাসিতে মুখটাকে ভাসিয়ে তুলতে চেষ্টা করি ।
‘লিখছো ? তো কাকে লিখছো ?’
ঠা-ঠা পড়ার শব্দের মতো হেসে উঠি, ‘যা..ব..বাবা… কাকে লিখতে যাবো আবার ? গল্প,কবিতা কি কেউ বিশেষ কারো জন্যে লেখে ? কি যে বোকা হয়ে যাচ্ছো দিনদিন তুমি !’
‘লিখে কি হবে ? কোন পত্রিকায় ছাপা হবে ? কে পড়বে ?’ ফুল্লরার কন্ঠের বাতাস এখোন ঘুরপাঁক খেঁতে শুরু করেছে । তিন তিনটে প্রশ্ন এক সাথে ।
লেখকের যোগ্যতা নিয়ে টান দিলে খুব খারাপ কিম্বা ছোট-নগন্য একজন লেখকেরও আত্মসম্মানে লাগে । ফুল্লরা কি ইচ্ছেকৃত ভাবেই আমাকে রাগাতে চাইছে ! যথাসম্ভব হালকা করতে চাইলাম পরিবেশ- ‘ ছাপা হলে তো দেখতেই পাবে । আর ছাপা না হলে বিছানার নীচে রেখে দেবো, মরনের সময় কবরে দিয়ে দেবে ।’
‘ইয়ার্কি ? তুমি কি আমাকে একেবারেই বোকা ভাবছো ? তোমার হালচাল তো দেখছি ক’দিন ধরে …’ ওর গলা চড়লো, ঝড়ের টান ।
‘ডিষ্টার্ব করোনাতো, যাও এখোন’ একটু ঝাজ মিশলো কি মিশলোনা আমার গলায় ।
‘ ও..,.আমি তোমায় ডিষ্টার্ব করি এ্যা..? আর ঐ যে সেদিন রাত দু’টোর সময় অল্প বয়েসী সুন্দরী একটা মেয়ের ছবি দেখলাম, দেখলাম তার সাথে তোমাকে চ্যাট করতে সেটা কিচ্ছুনা ?’ ফুল্লরার চোখে যেন বিদ্যুত খেলে যায় । এতো জোড়ে ও কথা বলে উঠলো যে, যে কোনও সময় ছেলেমেয়েরা চলে আসতে পারে ।
এটা সুনামীর পূর্বাভাস । ঠেকাতে প্রস্তুত হই যে কোনও ছলে –‘ ও… সেদিনের ঘটনা ? সে চ্যাপ্টার তো সেদিনেই ক্লোজড ।’ যেন এ ধরনের ঘটনা অতি মামুলী সাধারন কিছু । নিত্যদিন অফিসে আসা যাওয়ার মতো অনুল্লেখ্য ঘটনা ।
ছেলেমেয়েরা দৌড়ে এলো ।
‘বাবা তোমাদের হচ্ছেটা কি শুনি । প্রায়ই দেখছি তোমরা একজন আর একজনের সাথে লাগছো…. এটা তো আমাদের ভাল্লাগছেনা ।’ কম কথা বলার ছেলে জিশান এবারে আগেই মুখ খোলে ।
‘দ্যাখ, এই বুড়ো বয়েসে তোর বাপের ভীমরতি ধরেছে ……’
ফুল্লরার কথা কেড়ে নিয়ে আমার ন্যাওটা মেয়েটি আমাকে উদ্ধারে নামে - ‘মা তুমি যাওতো । দেখি বাবা কি করে ।’
ঝড়ের দিক বদল হয় বেডরুমের দিকে । হাঁপ ছাড়লেও শংকা যায়না । এখোন মেয়ের জেরার মুখে পড়তে হবে । হয়তো ছেলেরও । কথা ঘুরাই –‘শোন তোর মাযের বয়স হচ্ছে, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে তাই । আমাকে কম্প্যু্টারে বসতে দেখলেই তার মেজাজ গরম……’
‘আর কথা নয় বাবা, একদম চুপ’ মেয়ে স্নেহের শাসন করে আমাকে, ‘বয়স তো তোমারও হচ্ছে না কি ? কেন খামোখা লাগতে যাও তার সাথে ?’
মায়ের সাথে ছেলেও উধাও । জিনিয়ার পালা এবার । গেলেই বাঁচি কিন্তু বলতে পারছিনা যেতে । এক নজর চোখ বুলায় জিনিয়া আমার স্ক্রীনে , ভ্রুটা কোঁচকায় খানিকটা তারপরেই হেসে ওঠে, ‘ও তুমি গল্প লিখছো । লেখো তো অনেক কিছুই কিন্তু ছাপা হতে তো দেখিনা ।”
‘ভালো লাগে তাই লিখি, সময়ও মন্দ কাটেনা । আর ছাপা না হলে তোর মাকে বলেছি কবরে দিয়ে দিতে । তুই ও দিতে পারিস ।’
‘তুমি কি যে বলোনা বাবা !’ বলেই জিনিয়া চলে যাবার জন্যে ঘুরতেই বলি ‘এক গ্লাস ঠান্ডা পানি দিয়ে যাস তো ।’
আমি লিখছি । এই উপন্যাসিকাটিই লিখতেই বসেছি আমি । রাতের বেলা ছাড়া সময় হয়না ।একটু একটু করে লিখি । একটা বই যেন আমি উৎসর্গ করি শীলার নামে, এই ছিলো একদিন শীলার আবদার । লিখছি আবদারের কারনে নয় । এটাও নয় যে শীলাকে আমি ঘৃনা করতে বসেছি । বরং উল্টোটা, প্রচন্ড ভালোবাসি বলেই শীলার সাথে আমার সব কথাগুলোকে গেঁথে গেঁথে একটা সৌধ গড়তে চাইছি । আমার ভালোবাসার অধরা মিনার ।
নিপুন ভাবে আমার স্মৃতির উঠোনে তার ছড়ানো ছিটানো ভালোবাসার মাঝখানে গিয়ে দাঁড়াতে ইচ্ছে হচ্ছে । তার হাতের , তার গায়ের ক্ষীনতম কিছু সুরভী- কিছু গন্ধ হয়তো পাওয়া যেতে পারে এই আশায় । সংসারের দীর্ঘতম পথের শুরুতে যে অনুক্ত আর অনুচ্চারিত ভালোলাগাটুকু থাকে যা কখোনই সামনে এসে দাঁড়ায় না তেমন করে, তা যেন কালপরিক্রমায় একসময় খুব অপরিচিত হয়ে ওঠে । সংসারের যাতাকলে তা কেমন যেন অচেনা হয়ে যায় । অনাঘ্রাত থেকে যায় । সে চিরাচরিত সত্যটুকু ভেঙ্গে ,সেই অনাঘ্রাত প্রবাসী সময়টুকুতে যে আমার সঙ্গী হয়, স্বপনচারিনী হয় তাকে ভুলি কি করে ! কি করে ভুলে যাওয়া যায় তারই সাথে সুখ-স্বস্তির কিছু একটা সময় কেটেছিলো আমার !
ক’দিনের সেই সম্বলটুকু নিয়েই আমি হয়তো কাটিয়ে দিতে চাই বাকী সময়টুকু । এই সংসারের প্রেমহীন হাযার বছরের চেয়েও সে ক’টা ভালোবাসার দিন অনেক অমূল্য যে । আমি যে তাকে আগলে রাখতে চাই ।
আমি নামের একটা মানুষের ভেতর লুকিয়ে থাকা আর একটা মানুষ যেন আমার ভেতর থেকে বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছে । একটা খোলা হাওয়ায় । অন্ধকারে সে মানুষটার হয়তো হাঁপ ধরে গেছে । আমি তো শীলাকে লিখেছিলাম – “আমার এই নাজুক হৃদয়টাকে বড় সাবধানে হাতে নিও গো…” ! শীলা তা ঠুনকো আঘাতে ভেঙ্গে ফেলেছে ।
ফুল্লরার এসব জানার কথা নয় । জানেনা কেউ-ই । আমিই কি জানতাম আমাকে এরকম একটা লেখা লিখতে হবে ! নিয়তি তো আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে নিয়েছে, সেই যেদিন শীলাতে আমি নিমগ্ন হয়েছি । এ থেকে যে আমার পরিত্রান নেই । শীলাও লিখেছিলো তাই । একটি গানের চরনে – “ যিধার তুম যাওঁগে, মেরী ইয়াদ আয়েঁগে; কভী নগ্মা বন্কে – কভী বন্কে আঁসু ...”।
শীলা কি জানতো, কি নিষ্টুরতম সত্য কথাটিই সে সেদিন আমাকে ভালোবেসে উপহার দিয়েছিলো ! অশ্রু ছাড়া আমার যে আর কিছুই সম্বল নেই যেদিকেই রাখি চোখ । মেসেজটি পাঠানোর আগে তার সাথে আমার কথা হয়েছিলো অনেকক্ষন । আমরা যেন দু’টি স্কুল পালানো ছেলেমেয়ের মতো কৈশোরের দিনগুলিতে ফিরে গেছি । কি নির্মল আর স্বচ্ছন্দ ছিলো কথারা সেদিন ।
আর সে রাতেই তার পাঠানো আর একটি মেসেজে ছিলো যেন চৈত্রের হাহাকার – “ ইয়ে শাম ইত্নি তানহা কিঁউ হোতি হ্যাঁয় ! কিস্মত সে আপনে শিকায়্যাৎ কিঁউ হোতি হ্যাঁয় ! আজীব খেল্ খেলতি হ্যাঁয় ইয়ে কিস্মত ভী । জিন্হে হম্ পা নহী সেক্তে উন্হী সে মোহাব্বত কিঁউ হোতি হ্যাঁয় !”
সেদিন আকাশে চাঁদ ছিলোনা । কৃষ্ণপক্ষের রাত ছিলো । শীলার মনের গহীন কোনে যে হাহাকার জমে উঠছিলো তাকে ঢেকে দিতেই কি আকাশ সেদিন অন্ধকার করে রেখেছিলো বিশ্ব চরাচর ! কেউ যেন দেখতে না পায় ! হয়তো ! শীলা যে এতো আবেগময়ী স্বয়ং বিধাতাও কি তা জানেন ! যদি জানতেন তবে সেদিনগুলোতে শীলাকে সংযত হতে বলা তার উচিৎ ছিলো । তার উন্মাতাল ভালোবাসার অসংযমী ঝড় উড়িয়ে নিয়ে গেছে যে আমার আজন্ম লালিত নিঃশ্বাস । বুক জুড়ে তাই কঠিন সুখের এক কষ্ট । দুঃখের মতো নীল তার রঙ । আমি জানি, মনের মাধুরী মেশানো সে রঙে । তার শরীরে মহূয়ার গন্ধ, মাতাল করা । সে তো এক দক্ষিনে বাতাস ! ধেঁয়ে এসেছে কার টানে, উত্তরে ? বাতাসকে তো শুধু অনুভবই করা যায় , ছোঁয়া যায়না, ধরা যায়না । আমিও শীলাকে ধরতে পারিনি ।
প্রখর সূর্য্যময় আকাশের দিকে চেয়ে থেকে থেকে দিনের পর দিন ঈশ্বরকে খুঁজে বেড়ানো “দ্য ম্যাগাস” বইটির সেই অন্ধ হয়ে যাওয়া লোকটির মতো আমারও এখোন চীৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে – “ ওহ্ গড ; হোয়্যার আর য়্যু ?”
জিনিয়ার এনে দেয়া পানিটুকু গ্লাসেই পড়ে থাকে । ছোঁয়া হয়না । আমার তো আসলে পানির তেষ্টা পায়নি তবুও মেয়ের কাছে ঘটনাটিকে স্বাভাবিক করতে গিয়ে এরকম তেষ্টার ছলনা করতে হয় । জীবনভর কতো ছলনাই যে করে যেতে হয় মানুষকে ! ঢের দিন বেঁচে থেকে দেখেছি পৃথিবী ভরা আলো, অথচ সে আলোতে রোশনাই নেই, ছলনায় মিয়ম্রান । অনেক রাত্রিদিন ক্ষয় করে ফেলে জেনেছি মানুষের মন বড়ই অগম্য । আজকে লিখতে বসে একথাই আমার বার বার মনে হ’লো ।
মানুষের মন নিয়ে কারবার করতে সবাই পারেনা । শিল্পি, কবি – সাহিত্যিকেরা পারে । আমি আটপৌরে লিখিয়ে, কবি নই । শীলার প্রতি দিনের পাঠানো মেসেজগুলিই হয়তো কবি কবি করে তুলতে চেয়েছে আমাকে । তাই আমি কাব্য করেই গেছি শীলার সাথে । লিখেছিলামও তাই – ‘তোমার শরীরের ভাষা না বুঝে আমি তোমার সাথে কাব্য করতে গেছি । দেহময় শরীরের চেয়ে একটি কাব্যময় শরীর যে কতো সুন্দর , কতো নান্দনিক তুমি যদি জানতে ! হোকনা তা কায়াহীন-ছোঁয়াহীন দু’টি শরীরী টান । ভালোবাসাময় সেক্স একটি শিল্প, একটি আর্ট । মনের ইজেলে রাখা বিভিন্ন রংয়ে রাঙিয়ে আমি সেই নান্দনিক এক শরীরী টানের তুলিই বোলাতে চেয়েছিলাম তোমার দেহজ ক্যানভাসে । তুমি বুঝতে চাইলেনা । তুমি শুধু নিতে চাইলে, অনুভব করতে চাইলেনা ! যেনতেন একটা ছবিই চাইলে শুধু । তাই কি সরে যেতে ছলনায় জড়ালে নিজেকে !’
এসব কথা যখন আমি শীলাকে লিখি তখন উড়ে যাবার অপেক্ষায় শীলা । ততক্ষনে মুঠোফোনে তার দেখা মেলা লম্বিত হচ্ছে দিন দিন । মেসেজে ছুটির ঘন্টা - ‘আই উইল ওয়ক উইদ য়্যু ইন এভরী ষ্টেপ অব লাইফ বাট প্রমিজ য়্যু উইল হাইড ইয়োর উইংস এভরীটাইম উই ওয়ক ট্যুগ্যাদার কজ ওয়র্ল্ড শ্যুডন্ট নো মাই ফ্রেন্ড ইজ এ্যান এ্যাঞ্জেল …..’ ।
আমাকে নিয়ে শীলা নয়, বরং শীলাকে নিয়েই আমি হাটছি একা একা । দেবতা বলে নয়, কেবল রক্তমাংশের মানুষ বলেই শীলা আমাকে লুকিয়ে ফেলতে পেরেছে লোকচক্ষুর আড়ালে । এমোনকি নিজেরও । সংসারে এমোন করে কিছু একান্ত জিনিষ থাকে যাকে লুকিয়ে রাখতে হয় । খুব গোপন কোনও কুলুঙ্গিতে তুলে রাখতে হয় । আমাকে প্রমিজ করতে হয়নি যে নিজের ডানাটি লুকিয়ে রাখবো আমি । আমি তো দেবতা নই তাই নিজের ডানাদু’টি লুকোতে পারিনি । ডানাদু’টি কেবল ঝটপট ঝটপট করে গেছে আর আমি তার যন্ত্রনার ছবিটি এঁকে চলেছি নিরন্তর । একটু একটু করে .................
(চলবে..... অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন)
ষষ্ঠ অধ্যায় ( শেষ অংশ)
Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই নভেম্বর, ২০১১ রাত ৯:৪৮