ষষ্ঠ অধ্যায় / ( শেষ অংশ )
আমার পঁচিশ বছর বয়েসের আগেই যে ঘাতক-ব্যাধি আমাকে আস্তে আস্তে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে, তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে নাম না জানা এক দেশে আমাকে পৌঁছে না দেয়া পর্য্যন্ত সে যে আমাকে জড়িয়ে ধরেই থাকবে, এতো জানা-ই । তারপরেও যে এতোগুলো দিন কেটে গেছে , আমি ভেবে অবাক হই; কি করে ! তাই প্রগলভ হয়েছি আরো, হেসে গেছি আরো আরো । মানুষের দুঃখে কাতর হয়েছি অল্পতেই । নিজের জীবন নিভু নিভু জেনে অন্যের জীবনকে বড় সাধ করে মেলে ধরে সে জীবনের সাথে মিতালী পাতাতে চেয়েছি । নিজের জীবনে যা পাবোনা তা যেন অন্য কারো জীবনে অফুরান হয়ে থাকে তেমন ইচ্ছের ডানা মেলে উড়ে যেতে চেয়েছি ।
লোকে বলে – পাগলী । ঐ যে বললাম, আমার মা আমাকে নিয়ে সারাক্ষন উৎকন্ঠায় থাকেন, সেটা এ কারনেই । মা’কে আমি বুঝতে পারি । কিন্তু বাবাকে আমি বুঝে উঠতে পারিনে । তার মুখের দিকে চেয়ে চেয়ে খুঁজি কোথাও কোনও দুঃখবোধ আছে কিনা । পাইনে । আত্মজা একজন অকালে ঝরে যাবে এমন একটা দুঃসংবাদ জন্মদাতাকে কুরে কুরে খায় নিশ্চয়ই । কে জানে, হয়তো তার হৃদয়ের গহীনে প্রতিদিন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠা সে ক্ষতটি ঢেকে রাখতে কি অপরিসীম সাহসের সাথে তাকে যুদ্ধ করে যেতে হচ্ছে নিরন্তর । মুখে হাসিটুকু ধরে রেখে মৃত্যুর হীমশিতল স্পর্শ যিনি অবলীলায় জয় করে নিতে জানেন তেমন বাবাকেই বা আমি কি বলি !
আর আর.... যে লোকটি শীলাকে অগস্ত্যযাত্রার এক অদেখা যাত্রী ভেবে নিজেকে কাঁদিয়েছেন, প্রার্থনায় রত হয়েছেন স্বভাবের বিরুদ্ধে গিয়ে, দীর্ঘায়ু কামনা করেছেন ঈশ্বরের কাছে ; তাকে কি আমার কিছু বলা উচিৎ ? বলা কি উচিৎ, কাঁদবেননা হে বন্ধু ; যাকে ভেবে যে ছবির দিকে চেয়ে চেয়ে আপনার কাটছে বিমর্ষ দিন সে আপনার শীলা নামের রক্ত মাংশের মানবী নয় ; সে আপনার অদেখা অস্তিত্বহীন আর ক্ষয়িষ্ণু আয়ুর একজন ? বলা কি উচিৎ, সে আমি – নভেরা কবির ? মৃত্যুপথযাত্রী একজন, যার শিয়রে দাঁড়ানো এক যমদুত ? ছুটির ঘন্টাটি বাজলেই আপনার সামনে থাকা ছবিখানি শুধু ছবি হয়েই থেকে যাবে চিরটাকাল ? আমার কি বলা উচিৎ, অনেক মিথ্যাচার হয়েছে আপনার সাথে, আপনার বিশ্বাসের সাথে । আপনার সাথে যে প্রতারনা হয়েছে তাতে যে জড়িয়ে গেছি আমি অজান্তেই । শুরুটা যে আমারই ছিলো ।আমার এ পাপ স্খালন হবে কি ? আমায় কি ক্ষমা করা যায় ?
বড় কঠিন প্রশ্ন । জীবনের আর সব প্রশ্নের সাথে এর মিল নেই । শীলা কি করেছে, কি সব বলেছে নিজের সম্পর্কে, সে তো একান্তই শীলার ব্যক্তিগত ব্যাপার । আসলেই কি ব্যক্তিগত ? নাহ্ আর ভাবতে পারছিনে । মাথাটা ধরে আছে এখনও । গায়ের তাপমাত্রা কি বেড়েছে খানিকটা !
পায়ে পায়ে নীচে নেমে মায়ের কাছে এলাম ।
‘মা, দেখোতো গায়ে জ্বর এলো কিনা ।’
এটুকুতেই উৎকন্ঠিত হয়ে ওঠেন মা । নিভু নিভু মোমের শিখাটি এই নিভে যায় বুঝি ! হাত খানি রাখেন কপালে । আহ কি নরম, শীতল স্পর্শ । যা ভাবতে চাইনে বলে নীচে নিমে এলাম সে ভাবনাই আবার সুড়ুৎ করে মাথায় ঢুকে গেল । চকিতে মনে হলো, আর কতদিন এমোন শীতল স্পর্শ আমাকে ঘিরে থাকবে । ভাবনাগুলোর কি মোটেও কান্ডজ্ঞান নেই ! আর সময় পেলেনা !
কাজের মেয়েটিকে ডাকতে ডাকতে মা ওঠেন – কোথায় যে তোরা থাকিস, ডাকলে পাওয়া যায়না একবারও । জ্বর মাপার থার্মোমিটারটা নিয়ে আয়তো ।
খুব বেশী নয় একশো’র কাছাকাছি । তবুও খারাপ লাগছে বেশ । হয়তো বেশী ভাবছি ।
‘ভাত তো খেলিনা, দু’দুবার ডাকলাম , কি খাবি এখন বল’ । মা ব্যস্ত হয়ে ওঠেন । হম্বিতম্বি করেন কাজের মেয়েটির সাথে । বাসায় লোকজন আমাদের তেমন নেই । সাকুল্যে চারজন আমরা এ বাড়ীতে থাকি । ছোটভাই জাহিদ আর ওর বউ এলে একদিন দু’দিন থেকে যায় । তখন বেশ জমজমাট হয়ে ওঠে ঘরবাড়ী । ওরা গেলে আবার নিরানন্দ । আজো তা ই ।
‘জ্বরটা আজ আবার এলো কেন ? অনেকদিন তো ভালো ছিলি । সুশান্তকে জিজ্ঞেস কর না ।’
মা’য়ের ঐ এক ভরসা । সুশান্ত । ডাক্তার ওয়াদুদকে তো সব সময় পাওয়া যায়না । সুশান্তকে যে আমার বেশ পছন্দ সে কথা মা ভালো বোঝেন । বাবাও । বাবা যেমন আমার কোনও কিছুতেই বাঁধ সাধেন না, এ ব্যপারটিতেও তাই ।
‘কি যে বলোনা মা ! সুশান্তকে ধরে আবার টানছো কেন ? সামান্য জ্বর, কেন এতো উতলা হচ্ছো ?’
‘সন্তানের জন্য মা-বাপের মন যে কেমন করে তা যদি বুঝতি তোরা । মা যেদিন হবি সেদিন....’
কথাটি আটকে থাকে মা’য়ের মুখে । শেষটুকু তার আর বলা হয়ে ওঠেনা । মুখটা ঘুরিয়ে নেন অন্যদিকে কিছু একটা খোঁজার উছিলায় । বুঝতে পারি বেফাঁস কথাটি বলে ফেলে মরমে মরে যাচ্ছেন মা । রক্তে মরনঘাতক বীজ নিয়ে অবিবাহিত যে মেয়ে ঘুরে বেড়ায় তার যে মা হয়ে ওঠা হবেনা কোনওদিন, বেখেয়ালে সে সত্যটুকু দিব্যি ভুলে বসে আছেন । তাই লজ্জা হয়তো বা । সহজ হতে পারলে ভালো হ’তো । পারলাম না । কোথায় যেন আটকে গেল কিছু একটা । আজকের দিনটা বোধহয় আমার জন্যে নয় । বারবার তাল কেটে যাচ্ছে । মানুষের চারপাশে কতো সহস্র জটিলতা ! এই জটিলতা ভেঙ্গে সবসময় কি বের হয়ে আসা যায় !
তবে ভাঙ্গলো, মায়ের হাত থেকে খসে গেল প্লেটটি । ঝনঝন করে রাতের সবে গেড়ে বসা নিরবতাটুকুতে ফাটল ধরলো একটা । বেফাঁস কথা বলে ফেলে হয়তো নার্ভাস হয়ে পড়েছেন মা । আহা, বেচারী !
শব্দ শুনে বাবা বের হয়ে এলেন নিজের রুম থেকে । একবার দেখে নিলেন সবটা । তারপরে হাসিমুখে আমার দিকে, “ কিরে তোর চোখ ছলছল কেন রে ?” তাকিয়ে থাকলেন আমার দিকে একটু ,নজরে এলো থার্মোমিটারটি । “ও… এইটুকু জ্বরেই তুই কাহিল আর আমি তো এই দুদিন আগেই একশো’দুই নিয়ে সারাটা শহর আর অফিস হৈ-হৈ করে এলাম । তোর মা’ও টের পায়নি যে আমার শরীর খারাপ । আর তোর তো জ্বর হবার কথা নয়, নিশ্চয়ই মন খারাপ আর মন খারাপ থেকে জ্বর ।”
বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে রইলাম । কোথাও কোনও দুঃশ্চিন্তার ছায়া নেই । কি অদ্ভুত ! কি সাবলীল ।
“বাবা, কে বলেছে আমার মন খারাপ ? তুমি যে কি মনে করো না আমাকে !”
“পাগলী, এই জ্বরে তোর মুখ-চোখ তো এ রকম হবার কথা নয় । আমি তো তোর বাপ, নাকি ? বল, কে কি বলেছে তোকে । নয়তো নিজে নিজে কিছু উল্টোপাল্টা ভেবে বসে আছিস ।”
তারপরেই হো হো করে তার হাসি ।
এই জন্যেই বলি বাবাকে আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারিনে । আমার মনের কথা ঠিক ঠিক ধরে ফেলেন । অসম্ভব ভাবে নির্লিপ্ত । যে ব্যথার ছবি দেখবো বলে প্রায়-ই তার চোখের দিকে তাকিয়ে আঁতিপাতি করে খুঁজি তার দেখা মেলেনা । মাঝে মাঝে মনে হয়, বাবা কি আমার সাথে সারাটি জীবনই অভিনয় করে যাবেন । এই অভিনয় করা যে কতো কষ্টের আমি জানি ।
শীলা কিন্তু কষ্ট লুকোতে পারেনি । অভিনয় অভিনয় খেলা খেললেও তার ভেতরে কোথায় যেন একটা টোল খেয়ে গেছে । সবাই সবকিছু পারেনা । শীলাও পারেনি । তাই শীলার ভেতরের জঘন্য, কিম্ভুত-কিমাকার শুঁয়োপোকার আড়ালে লুকিয়ে থাকা একটি রঙীন প্রজাপতি মাথা তুলতে চাইছে হয়তো ।
আর সে ঢেউ ছুঁয়ে যাচ্ছে আমাকেও । আমি জানি আমার মনের ভেতরে যে কি ঝড় বইছে এখোন । যদিও এতে আমার কোনও দায় নেই । আমার নিজেকে অপরাধী ভাবার কোনও প্রয়োজন নেই । তারপরেও কেন আমার এমোনটা মনে হচ্ছে ! আমি অসুস্থ্য, স্থির হয়ে থাকা নিশ্চিত নিয়তি জানি বলেই কি আমি ভাবাবেগে ভেসে যাচ্ছি ! জীবনময় হলে কি আমিও আর দশটা মানুষের মতো ফুৎকারে ব্যাপারটি উড়িয়ে দিতাম । মজা পেতাম বেশ । একটা লুকোচুরি খেলার মজা । মানুষ ঠকানোর গল্প করে বেড়ানোর মতো একটা দাম্ভিক কিন্তু রুচিহীন আনন্দ !
আমি কেন আর দশজনার মতো হতে পারছিনা ! আমাদের গার্লসস্কুলের বড়আপা যেদিন অসময়ে মারা গেলেন সবাই মুখেমুখে বললেন, ভালোমানুষ পৃথিবীতে বেশীদিন বাচেঁনা । পৃথিবীটা ভালোমানুষদের জায়গা নয় ।
ছোটখাটো ছিলেন মানুষটি । অবিবাহিত আর নিরামিশ থেকে গেছেন সারাটি জীবন । মুখে একটা হাসি লেগেই থাকতো সারাক্ষন । ঠোট বন্ধ থাকলেও মনে হতো চোখদুটো তার হাসছে । উচ্চস্বরে কোনও কথা তাকে বলতে শুনিনি আমরা কেউই । আমরা হৈহৈ করে সারাস্কুলে তান্ডব লাগিয়ে দিলেও তার রাগ করা মুখ আমরা কখোনও দেখিনি । দেখলেই বলতেন, “কি খুব ফুর্তি করা হচ্ছে ? করো করো, এখনতো তোমাদের ফুর্তি করারই বয়স । কিন্তু দেখো মেয়েরা, ওটা করতে গিয়ে আবার হাতে পায়ে আঘাত-টাঘাত লাগিওনা । আর মজা করতে গিয়ে কারো মনে আঘাত লাগে এমন কথা কক্খোনো বলবেনা, বুঝেছ ?” সন্তান নেই বলেই কি আমাদের সবাইকে সন্তান মনে করে ভালোবাসতে চাইতেন ! তার কি কোনও গোপন দুঃখ ছিলো যা হাসির আড়ালে আড়াল করতে চাইতেন ! কে জানে ! হাসি হাসি মুখখানি ছাপিয়ে যে ব্যক্তিত্ব তার সারা অঙ্গ জুড়ে প্রকট হয়ে থাকতো তার সীমানা ছাড়িয়ে আমাদের যাওয়া হয়নি কখোনও । শুনেছি তার নাকি স্তনের ক্যান্সার ছিলো ।
অকালে মরে যাবো বলেই কি আমিও বড়আপার মতো ভালো হয়ে যাচ্ছি ! নাকি ভালো বলেই তাড়াতাড়ি মরে যাবো! নইলে আমি কেন শীলার বোকামীর বিষয়-আসয়ের সাথে নিজের সম্পৃক্ততা খুঁজতে বসেছি ! কেন নিজেকে অপরাধী অপরাধী মনে হচ্ছে !
অসম্পূর্ণতাকে যা ভরে দিতে পারে তার নামই তো ভালোবাসা ।
আজ সঙ্গত কারনেই নিজ থেকে ভালোবাসার শক্তি বা সাহস আমার নেই - কিন্তু কেউ ভালোবাসলে তা প্রত্যাখান করার নির্লিপ্ততা কখোনো দেখাবো না এ রকম একটা প্রতিশ্রুতির চারাগাছ নিজের ভেতর বপন করতে পেরেছি কি ! উপেক্ষা কি খুবই নির্মম ? এমোন নয় যে এই অভিজ্ঞতা আমার নেই । কিন্তু শীলার কাছে পাঠানো সেই আশ্চর্য্য লোকটির সব মেইল আজ পড়ে নতুন করে বুঝলাম উপেক্ষা কি নির্মম ।
কি সুন্দর করে উনি শীলাকে লিখেছেন “…… এ যেন আমার এক নতুন জন্ম । দিনের উজান বেয়ে বেয়ে সময়ের বলিরেখা যখোন তার দাঁত বসাতে শুরূ করেছে দেহে, তখনি যেন এক সোনার মেয়ের স্পর্শে পাল্টে গেল দিনমানের সব চালচিত্র .............
আমার ভেতর বাইরে যে তুমুল নদী, দিনরাতের পথ বেয়ে ক্লান্ত, মলিন শীর্ণ জলরেখায় রূপ নিচ্ছিলো ধীরেধীরে; ঘুম ভেঙে দেখলাম তা দু’কূল ছাঁপিয়ে বাঁধভাঙা । এক নীল আকাশের ছায়া পড়েছে তাতে ।এক নীলাঞ্জনার কোমল আঁচলের নীচে আমার সব চরাচর যেন গেছে ঢেকে । এই বুঝি শেষ হলো আমার নীল সাগরের পানে ধেঁয়ে চলার তিতীক্ষা ! হে আমার ঈশ্বর , এই বুঝি ছিলো তোর মনে ! কোনদিকে যাবো আমি, কোনখানে ?
……..আর আজ তোমাকে এভাবে দেখার জানালাগুলো তুমি এক এক করে বন্ধ করে দিলে । দিলেই যদি তবে এলে কেন….. ? প্রথমে বললে তুমি দেশের বাইরে যাবে, তাতে যখোন কাজ হলোনা বললে - তুমি ননদকে নিয়ে হাসপাতালে ব্যস্ত, কথা হবেনা কয়েকদিন । তাতেও দেখলে আমি তোমাকে ছেড়ে যাইনি । তখন তুমি নিজেকে মৃত্যুপথযাত্রী বানিয়ে ফেললে । উপেক্ষা যে কি নির্মম, তুমি কি তা জান ! প্রার্থনা করি এরকম কোনও নির্মমতা যেন কোনও দিন তোমাকে না ছোঁয় ……..”
তার অনেক লেখার ভেতরে এইটুকু পড়ে মনে হলো, চেতনার গভীরে যে বোধ জন্ম নেয় অন্ধের মতো, তা যদি চলতে চলতে হঠাৎ করেই উপেক্ষার নিরেট দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসে তবে তার রেখে যাওয়া ভাঙ্গার দাগ যে দগদগে হয়ে থাকে হাযার বছর ধরে ।
আমি তো একটা ভাঙ্গা কাঁচও সইতে পরিনে আর এতো ভেঙ্গে যাওয়া একটা হৃদয় ........
(চলবে..... অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন)
ষষ্ঠ অধ্যায় ( প্রথম অংশ)
Click This Link
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই নভেম্বর, ২০১১ রাত ১০:২০