
তুমি যাবে ভাই
যাবে মোর সাথে
আমাদের ছোট গাঁয়,
গাছের ছায়ায় লতায় পাতায়
উদাসী বনের বায়.........
অনেক অনেক কাল ধরে শোনা এই কবিতার অমন আবেগীয় অনুভূতির মূর্চ্ছনা দিয়ে লেখাটি শুরু করতে পারলে ভালো হতো । ভালো হতো বলছি এ কারনে যে, এই অনুভূতিটা আজ যে জনে জনে মরে গেছে সেটা যদি না হতো।
সেই গাঁ-গ্রাম আর নেই । গাঁয়ের সেই অমায়িক - আত্মীয়র মতো মানুষও নেই । উদাসী বায়ে লতায় পাতায় আর জড়িয়ে নেই মানুষের সেই মায়া-মমতা, আত্মীয়তার বন্ধন । মানুষ এখন এক সর্বনাশা দৌড়ের মাঠে ঘাম ঝরায় । দৌড়ে সবাইকে পিছে ফেলে এগিয়ে যাবার তাড়নায় পরিপাশ বেমালুম ভুলে গেছে মানুষ । জনমানুষের এই স্বার্থপরতার নিঠুর থাবার নীচে যে মানুষের সম্পর্কের অনেক ছিঁটেফোঁটাই বেঁচেবর্তে নেই, এ লেখা তাকেই স্মরণ করে ।
বেঁচে থাকার অসম দৌঁড়ে যে মানুষ নামের আত্মীয়গুলো অনাত্মীয় হয়ে কোথায় ভেসে যায় ক্রমে ক্রমে, তারই যেটুকু ছবি বিশদ হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এখানে ওখানে , তাই-ই বলে যায় “জীবন যেখানে যেমন” ! এ জীবন ঘাস ফড়িংয়ের নয়, কীটের । এ জীবন দিগন্তজোড়া মাঠের মিষ্টি গন্ধ নয় , এ জীবন নর্দমার পূঁতিগন্ধে ভরা । অনেকেই হয়তো এসবের খোঁজও রাখেন না । সর্বগ্রাসী সময়ের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গিয়ে এসবের কোনও কিছুই হয়তো আমাদের মনে দাগও কাটেনা
আর দাগ কাটেনা বলেই, যে কজন মানুষ সর্বগ্রাসী সময়ের এই অভিঘাত সয়েও এখনও ---
“ঘরে যারা যাবার তারা
কখন গেছে ঘর পানে ,
ঘরেও নহে পারেও নহে
যে জন আছে মাঝখানে
সন্ধ্যাবেলায় কে ডেকে নেয় তারে..”
গানটির কথামালায় নিরবে কেঁদে ওঠেন, লেখাটি তাদেরই জন্যে ।
১ - এক নিঃসঙ্গ যাত্রা --------------------
কেহ নাই কিছু নাই ,
কিছু রয় সংগোপনে -
শুধু নিঃসঙ্গতা সঙ্গী আমার,
এ ধরনীতলে এক নতুনের
অসহায় আগমনে
ওঠেনা উলুধ্বনী আর .....
.



এক পুরাতন নিঃস্ব পৃথিবীতে কী নিঃসঙ্গ অভিযাত্রা এক নতুন অভিযাত্রীর । যেখানে স্বপ্ন-অলস যত ছায়ারা একে একে সকলি অদৃশ্য , সেখানেই চরণ দু’টি তার প্রথম ছাপ রেখে যায় । জন্মের পরে চোখ খুলতেই এক ক্লেদাক্ত ধরণীর ছবি আঁকা হয়ে যায় তাই তার বুকে ! এ থেকে তার নিস্কৃতি নেই । এতোটুকু ঘেরাটোপে ভালোবাসার, মায়া মমতার অনুভূতিহীন একটি প্রানী বেড়ে ওঠে ধীরে ধীরে । আর তার “মানুষ” নামটি হারিয়ে যায় নর্দমার স্রোতে ..................
২ – তবুও জীবন বয়ে যায় ...
যেখানে মানুষ আর থাকেনা মানুষ
তারই মাঝে তবু উতলায় অবিরাম
স্নেহ - ভালোবাসা যার নাম,
মানুষের কাছে প্রতিদিন অবহেলা শেষে
ফুরায় এ জনম এমন-ই দুঃখের হাসি হেসে ......



মোর গেহখানি রহিয়াছে ভরি, ..... (জসিম উদ্দিন )

স্নেহ – মায়া – মমতা – ভালোবাসা বস্তির দম আটকে আসা বাতাসে বাতাসেও ভাসে । এর রূপ আলাদা । এর সাথে জড়িয়ে থাকে যে এক অসহায় দায়িত্ববোধের দায় ! আকাশ ছোঁয়া অট্টালিকার আলোকিত জানালার ফাঁক গলে এর গন্ধ কখনই আপনার অন্দর মহলে ঢোকেনা । আর ঢুকলেও সে গন্ধের স্বরূপ আপনার মস্তিষ্কের কোনও তন্ত্রীতে আঘাত করেনা । শুধু জীবন বয়ে চলে তার পথ ধরে, একাকী ....
৩. পথের পাশে নাম না জানা ফুল ----------
পথকলি মেয়েটির পাজরের হাড়
জীর্ণ হাতে তুলে ধরা বিবর্ণ গোলাপ
আমার গাড়ীর জানালায় ছবি হয়ে থাকে ।
কোন ছবি চাও তুমি ?
আমি যে শুধু পথের ফুল চিনি
রাস্তার পাদানীতে ফুটে থাকা
হলুদ জবা, ঘেঁটু ফুল
রঙহীন সাদাসাদা কামিনী-বকুল ।
ওরা হাসে, কাঁদে, খেলে
ধীরে ধীরে ফোঁটে, যেমন তোমার ফুল, বাগানের ।







আমারই দায় ।
কেউ কি এখন বাড়িয়ে দেবে হাত
এই আমায় ?
যে পথকলিদের ফুঁটে থাকার কথা ঘরের সাজানো বাগানে, তারা আজ ধুলোয় লুটায় , বর্ণহীন - গন্ধবিহীন। এরা রাস্তার পাদানীতে ফুটে থাকা হলুদ জবা, ঘেঁটু ফুল । রঙহীন সাদাসাদা কামিনী-বকুল ।
এরই নাম জীবন ! এখানে নেই পরিচর্যা, নেই যতন , নেই বুকে টেনে নেয়ার কোনও হাত ! ক্ষুধার রাজ্য যেখানে গদ্যময় সেখানে কোনও ভাবাবেগ নিয়ে কেউ থামেনা এখানে , হুশশশশ করে চলে যায় বিত্ত-বৈভবের পথে । শুধু পথকলিদের ভাগ্যের গাড়ি থেমে থাকে আগোচরে ! তবুও ফুলগন্ধের বিনিময়ে নগ্ন ক্ষুধার তেতো স্বাদের তেষ্টা মেটায় তারা জীবনের ধুলোমলিন পথে ...........................
৪ - দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইলোনা ................
এ রকমই ভাগ্য আমার, জন্ম থেকেই কন্ঠলগ্ন
হয়ে আছে। সেই যেদিন থেকে আমার ঈশ্বর
ছুঁড়ে ফেলেছিলেন নীচের পৃথিবীতে একটা মানুষের ছেলে
একটা সীল ঠুকে দিয়েছিলেন কপালে
একটা লাইন লিখে দিয়েছিলেন -
দুর্ভাগ্য আছে তোর বরাতে।

দু'মুঠো অন্নের লাগি
আমি যে এখন কর্মে বিভোর.....




যে রৌদ্রকরোজ্বল সকাল সারা দিনের কথা বলে যায় .......... আমাদের চারিধারের এই সকাল কি সে কথা বলে ? সে সকাল যে নিঠুর দারিদ্রের মেঘময় অন্ধকার । সে মেঘ কেটে রোদের দেখা মিলবে কি ? রাষ্ট্র-সমাজের অবহেলা , কর্ম-সংস্থানের অনুপস্থিতি, অর্থনৈতিক বৈসাম্যের সকল কলা-কুশলতার যাতাকল যে পিষে মারে আমাদের চক্ষু উন্মীলনের আগেই ! এই বিষবাষ্পে শ্বাস টেনে টেনে খুঁইয়ে ফেলি শিশুকাল , আমাদের কৈশোর , আমাদের যাবতীয় দিন । এ নিষ্টুরতা আমাকে করেনা মহান , দানেনা খ্রীষ্টের সম্মান !
৫ - গড়ে যাই সভ্যতা , এক শরীর ঘামে .......
ভ্রুনের মতো কী জটিল দ্রুততায়
পাল্টে যেতে থাকে চেনা শহর,
গড়ে যাই সভ্যতা জীবনেরে ভাঙি,
পড়ে থাকে শুধু আমার দুঃখের প্রহর .................





৬ - এক নিষ্ঠুর পৃথিবীতে.....
দিলেনা কিছুই হে মানুষের ঈশ্বর !
শুধু দিও ম্লানমুখে একটু হাসি অবিনশ্বর,
যে আনন্দ-সুখ লুকানো হৃদয় গহীনে
তারে রেখ কিছুক্ষন, এই অপাপবিদ্ধ জীবনে .......

এইটুকু হাসি নিয়ে তবুও জীবন হোক ধন্য ......

তবুও তোমায় দিলাম ভুবনডাঙার হাসি ...

পৃথিবীর সব বৈভব জড়ো করে
কে কিনিতে পারে তারে ?

তবে কি জন্মেই আজন্ম পাপ ?
কেন ঘিরে থাকে জীবনের সব সন্তাপ,
শুধু হাসি কেন রয় অমল-ধবল-অমলিন ?
তবুও জীবন থেমে থাকেনা , বয়ে চলে নিরবধি । দুঃখ-সুখ , কান্না-হাসি, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির চক্রবুহ্য ঘিরে রাখে আমাদের চারিধার । যেমন ঘিরে থাকে স্বপ্নও আমাদের ...........
জড় নই, মৃত নই, নই অন্ধকারের খনিজ,
আমি তো জীবন্ত প্রাণ, আমি এক অঙ্কুরিত বীজ;
মাটিতে লালিত ভীরু, শুধু আজ আকাশের ডাকে
মেলেছি সন্দিগ্ধ চোখ, স্বপ্ন ঘিরে রয়েছে আমাকে। - সুকান্ত ভট্টাচার্য
ছবি – ইন্টারনেট থেকে ।
[ প্রতিটি ছবির জন্যে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করছি তাঁদেরই যারা ছবিগুলোর প্রকৃত দাবীদার ।
আর স্বনামধন্য যে সব কবি-লেখকের দু’একটি চরন তুলে এনেছি, কৃতজ্ঞতা স্বীকার করছি সেই মহাগুনীজনদের ও ।
এদের সকলের কাছেই ঋনী হয়ে রইলুম ।]
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই অক্টোবর, ২০১৬ সকাল ১০:০৬

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




