এসেছি অষ্ট্রেলিয়া দেশটি দেখতে। ভাই-বোনেরাও দেশটি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখানোর জন্যে পাগল। তাই এখান থেকে ওখানে এতো এতো ঘুরতে হয়েছে যে খেই হারিয়ে ফেলতে হচ্ছে এখন লিখতে গিয়ে। বেড়াতে গিয়ে ডায়েরীতে বৃত্তান্ত লিখে রাখা আমার ধাঁতে পোষায় না। তাই কোন ছবিটা যে কোন জায়গার, কোনটাই বা আগে আর কোনটাই বা পরে, সেটা বুঝে উঠতেই হিমসিম খাচ্ছি। চেষ্টা করছি বেড়ানোর ধারাবাহিকতা যেন ঠিক থাকে, তবে কতোখানি সফল হতে পারবো সন্দেহ থেকেই গেলো!!!!
তো রাতে বাসায় ফিরে তিন ভাইবোন মিলে পরের দিনের ঘোরার জায়গা ঠিক করে ফেললো। ব্লু- মাউণ্টেইন দেখতে যেতে হবে। সেখানে নাকি তিন পাহাড় কন্যারও দেখাও মিলবে। অসংখ্য পর্যটকের ভিড়ে ওখানটা নাকি গমগম করে! আর চাই কি!!!! চললুম সেখানেই ----
ছবি – ১) ব্লু- মাউণ্টেইনের তিন কন্যা…….
দিনের বেলা “জেমিসন ভ্যালী” নামের এই উপত্যকাটি আর তার ভেতরে থাকা পাহাড়গুলোকে নীলরংয়ের দেখায় বলে এর নামকরণ করা হয়েছে “ব্লু- মাউণ্টেইন”। আমরা যখন সেখানে পৌছেছি তখন ঝকঝকে রোদে ঝলসে যাচ্ছিলো উপত্যকাটি। তাই এর নীল রং বেশ খানিকটা ধুঁয়েমুছে গেছে তখন। তবুও সেই নীলের খানিকটা চোখে পড়ছিলো। হয়তো দিনের বেলা সূর্যের আলোর আপতনের সাথে পাহাড়গুলির অবস্থান এমনটাই যে পাহাড় আর উপত্যকাটিকে নীলাভ বলে মনে হয়।
ছবি – ২) অনেক উঁচু থেকে নীলাভ ব্লু- মাউণ্টেইন আর জেমিসন ভ্যালী....
পর্যটকদের জন্যে বিভিন্ন এ্যাঙ্গল থেকে তিন কন্যাকে দেখার জন্যে কয়েকস্তরে দীর্ঘ ওয়াকওয়ের যে বিন্যাস তা মুগ্ধ করার মতো। রয়েছে ফুলের বাগানও। আর উপরের ছবি দু’টোতে যে তিনটি স্তম্ভের মতো পাহাড় চুঁড়ো দেখা যাচ্ছে ওরাই নাকি “ থ্রী সিস্টারস” , খাস বাংলায় “তিন কন্যা”। শুরুতে নাকি এখানে ঐ রকম দশটি চুঁড়ো ছিলো, এখন সময়ের চক্রে তাদের সাতটি ক্ষয় হয়ে তিনটিতে এসে ঠেকেছে! সত্তর বছর আগে ইংল্যান্ডের রানী এলিজাবেথ যেমন করে এই দৃশ্য দেখেছিলেন তেমনি করে আমরাও মুগ্ধ হয়ে তা দেখছিলুম।
ছবি –৩) আমাদের মতো রানী এলিজাবেথও যে এই ব্লু- মাউণ্টেইন দেখতে এসেছিলেন তার প্রমান.......
আমরা যে এলাকাতে এসেছি এই নীল পাহাড় দেখতে, সেই এলাকার নাম হলো “ কাতুম্বা”। সাথে থাকা ছোটভাই দু’জন বললো, এখানে যখন এসেই গেছি তখন এর “সিনিক ওয়র্ল্ড” স্পটটি দেখে গেলে এতোদূর আসার পয়সা উশুল হতে পারে! তো চলো সেখানে, সিনিক ওয়র্ল্ড বলে কথা!
ছবি –৪) সিনিক ওয়র্ল্ড এর মূল অফিস ঘর।
বেশ মকশো করে এর স্থাপনাটি গড়ে তোলা হয়েছে। অফিস ঘরের ভেতরে টিকিট কাটার কাউন্টার। আমরা বেশ কয়েকটি রাইডের টিকিট কাটলুম। কাউন্টারের লোকেরা আমাদের কব্জিতে রাইডের ব্যান্ড বেঁধে দিলো। প্রতিটি রাইডের গেটে এসব স্ক্যান করে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে। যদ্দুর মনে পড়ে, প্রচুর ভীড় ঠেলে প্রথমেই গেলুম কেবলকার রাইডে। বিশালাকারে মুখব্যাদান করে থাকা একটা গিরিখাতের ( প্রায় ২০০/২৫০ মিটার গভীর) উপর দিয়ে পেট মোটা কেবলকারে চড়ে ওপার যাওয়া আবার ফিরে আসা।
ছবি –৫) মুখব্যাদান করে রাখা গিরিখাতের উপরে কেবলকার থেকে নীচের গহ্বর আর ঝরনা…….
ওপারে গিয়ে আমাদের নেমে যেতে হলো বাঁধানো একটি পথ ধরে । তাহলে এই গিরিখাত পেরিয়ে মূল কেবলকার ষ্টেশনে আবার ফিরবো কি করে !!!! নিশ্চয়ই উপায় একটা আছেই! বাঁধানো পথ ধরে একপাঁক ঘুরে যেখানে নেমে যেতে হয়েছিলো সেখানটাতেই আবার ফিরে এলুম। দেখি একটি কেবল কার সবে এসে পৌঁছে গেছে। বুঝলুম, ঐ বাঁধানো পথ পাড়ি দিয়ে আমাদের এখানে আসতে যে সময় নেবে ঠিক সেই সময়ের মধ্যেই আর একদল পর্যটক নিয়ে কেবলকার এসে যাবে, এমন চমৎকার ভাবে সব অর্গানাইজড। একদলকে নামিয়ে দিচ্ছে আর একদল যারা আগে এসেছিলেন তাদেরকে নিয়ে ফেরৎ যাচ্ছে।
মাঝখানে একটি স্কাইওয়ে রাইডে চড়ে আর একবার ঘুরে আসা গেলো আর একটি গিরিখাতের উপর দিয়ে, যেটা নীচ থেকে অনেক উঁচু আর একটি পাহাড়ে গিয়ে ঠেকেছে।
ছবি - ৬) গিরিখাতের উপর দিয়ে স্কাইওয়ে রাইড…….
ছবি - ৭) হেই উঁচুতে উঠছি…….
শেষ রাইডটি ছিলো গা শিরশির করার মতো। ৫২ ডিগ্রী খাড়া একটি পথে ট্রেন ভ্রমন । এই পথের মাঝখানে প্রায় ১০০/১৫০ মিটার টানেল পথে ঝপ করে উঁচু থেকে একদম খাড়া নীচে পড়তে হয় । এখানে ঢোকার মুখে লেখা দেখেছি – “ দ্য ষ্টীপেষ্ট রেলওয়ে ইন দ্য ওয়র্ল্ড”।
ছবি - ৮) ষ্টীপ রাইডের ট্রেন ও ষ্টেশন।
ছবি -৯) খাড়া রেলপথ। একদম মাথায় উঠে ঝপ করে নীচে পড়া…..
ছবি -১০) রেলপথের ট্রেনের কামরা থেকে………
ভয়ে মুখ শুকিয়ে আসছিলো। খাড়া পথে যখন নামছিলো, মনে হয়েছে এই বুঝি গোত্তা খেলো নিচের পাথুরে মাটিতে! মনে পড়ছিলো ছোট্টকালের পড়া ছড়ার লাইন –
“রেলগাড়ী ঝমাঝম
পা পিছলে আলুর দম!!!!!!”
এখানে – “গোত্তা খেয়ে আলুর দম” টা-ই যুৎসই মনে হয়েছিলো তখন!
সিনিক ওয়র্ল্ড দেখতে গিয়ে এই রাইডটাই ছিলো সবচেয়ে ভয়ঙ্কর আর মনে রাখার মতো।
সেদিনের মতো হাট ভেঙে ঘরে ফেরা হলো রাতে। পরের দিন যেতে হবে ‘গোল্ডকোষ্ট” । একদম ছোট্ট ভাইটি যেখানে থাকে। ভাইটি এসেছে আমাদেরকে নিতেই। সকালে ঘুম থেকে উঠেই তার সাথে যাত্রার আয়োজন। সিডনী থেকে গোল্ডকোষ্ট ।
ছবি -১১) বিকেলের কিছুটা ঝাঁঝালো রোদ গায়ে মেখে গোল্ডকোষ্ট এয়ারপোর্টে নামা………….
উড়াল পথে প্রায় ৭’শ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে কুইন্সল্যান্ড প্রদেশের গোল্ডকোষ্ট শহরে পা রাখা গেলো।
সেদিন বিশ্রাম নিয়ে পরের দিন বিকেলে একপাঁক ঘুরে আসা হলো Currumbin Beach থেকে । কুরামবিন বীচ গোল্ডকোষ্ট শহরের দক্ষিন প্রান্তে। প্রিষ্টাইন স্যান্ড, স্বচ্ছ জল আর শান্ত পরিবেশের নৈসর্গিক সুন্দরতা নিয়ে পড়ে থাকা এই বীচটি যে কারো চোখের মুগ্ধতা কাড়বেই! কেড়েছে আমারও………
ছবি -১২) কুরামবিন সৈকতে…………
ছবি -১৩ মাথা উঁচিয়ে থাকা কুরামবিন সৈকতের বিশালদেহী পাথুরে বোল্ডার…….
বিকেলের আলো ফুরিয়ে আসতেই বিশাল বালিয়াড়ী প্রান্তর পেড়িয়ে আবার ঘরে ফেরা।
রাতে ঠিক হলো, পরের দিন যাবো ব্রিজবেন শহরে। গোল্ডকোষ্ট থেকে ব্রিজবেন প্রায় ৮০ কিলোমিটার পথ। সমস্ত পথ জুড়ে একটা সুন্দরতা আছে । যেতে লাগলো ঘন্টা খানেকের ওপর।
ছবি -১৪ ব্রিজবেনের পথে……
ছবি -১৫ ঐ দেখা যায় ব্রিজবেন!!!!!!!
বেরিয়েছিলুম নীল আকাশে মেঘের ভেলা নিয়ে। যেতে যেতে আকাশ বেশ মেঘলা হয়ে এলো। অবশ্য আকাশের মন মরা ভাব থাকলোনা বেশিক্ষন।
ছোট ভাইকে জিজ্ঞেস করলুম – কোথায় যাবো আমরা? বললো – এখানকার একটি দেখার মতো জায়গা, মাউন্ট কুট-থা পর্বতের চূড়োয়। সমস্ত ব্রিজবেন শহরটাকে এখান থেকে দেখা যায়।
সারাটা শহর না চষে একবারে সব শহরটা দেখাই তো ভালো! তো চলো সেখানে..।
ছবি -১৬ মাউন্ট কুট-থা’র চূড়োয় প্রবেশ পথের মুখে……..
ছবি -১৭ কুট-থা পর্বতের চুড়ো থেকে নীচে ছবির মতো ব্রিজবেন শহর…….
এখান থেকে এই পর্বতের ঢাল ধরে অনেকগুলো ট্রেইল আছে পর্যটকদের ঘুরে আসার জন্যে। গিন্নীর হাটু ব্যথার কারনে সে সাহস আর করা হয়নি! পর্বতের চূড়োর বিশাল ভিজিটর’স এলাকায় ঘুরে ঘুরে আর ছবি তুলেই সময়টা পার করেছি।
ছবি -১৮ কুট-থা পর্বতের চূড়োয় বিশাল ভিজিটর’স এলাকার একাংশ……
ছবি -১৯ ছবি তুলে তুলে ক্লান্ত, গিন্নী আর ভাই-বৌ……
এতোক্ষন ছবিগুলো গুছিয়ে পোস্টে যোগ করতে গিয়ে আমিও ক্লান্ত। তাই……..
( চলবে ………. )
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জুলাই, ২০২৪ রাত ১১:৩৯