মায়া যখন রহিমার পেটে, তখন কাজের খোঁজে শহরে যায় সবুজ মিয়া । অনেক স্বপ্ন লালন করে শহরে যায় সে—ছোট মেয়ের জন্য ভালো ভালো জামা কিনবে, ভালো খাবার খাওয়াবে, সুন্দর সুন্দর খেলনা কিনে দিবে । কিন্তু শহরে গিয়ে অতিরিক্ত পরিশ্রমের ফলে সে অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং একসময় মৃত্যুকে বরণ করতে হয় ।
মায়া জন্মানোর তিনদিন আগে তার নিথর দেহটি গ্রামে আসে । দেহটি নিথর হলেও বুকে জমানো স্বপ্নগুলো ছিল তাজা । সবুজ মিয়া তার কামাই করা টাকা দিয়ে মায়ার জন্য অনেক কিছু কিনে ব্যাগ ভরিয়েছে ।
মায়ার জন্ম হল । তাকে সবুজ মিয়ার কেনা খুব সুন্দর লাল একটি তোয়ালে দিয়ে জড়ানো হল । মায়ার মা নির্বাক চেয়ে থাকে মায়ার দিকে । তার মনে আজ খুশি নেই, স্বামী হারানোর বেদনায় সে স্তব্ধ ।
গ্রামের মাতবর মফিজ শেখ । রহিমা যখন ক্লাস ফাইভে তখন মফিজ শেখ কলেজের ছাত্র । সে রহিমাকে ভালোবাসার প্রস্তাব দিয়েছিল । রহিমা রাজি হয়নি । তখন থেকেই মফিজ শেখ মায়াকে রাস্তায় পেলেই উত্ত্যক্ত করতো ।আর এই কারণে রহিমার পড়াশোনার গন্ডিটা ক্লাস ফাইভেই আটকে যায় ।
বাপমরা মেয়ের বিয়ে দিয়ে দায়মুক্ত হোন রহিমার মা ।
কিন্তু সেই মফিজ শেখ আজও তার পিছু ছাড়েনি ।
সবুজ মিয়া মারা যাবার পর থেকেই সে রহিমাকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠায় । রহিমার উত্তর যখন কোনভাবেই না থেকে হ্যাঁ হয় না তখন মফিজ শেখ হুমকি দেওয়া শুরু করে ।
এক পর্যায়ে রহিমা বাধ্য হয় তাকে বিয়ে করতে রাজী হয় ।
বিয়ের পর ছায়া আর মায়াকে অমানুষিক নির্যাতন শুরু করে মফিজ শেখ । রহিমা কিছুই বলতে পারে না । তার মেয়েরা যে দুইবেলা খেতে পারছে, এটাই তার কাছে অনেক ।
সেই সকাল থেকে শুরু হয় ছায়া আর মায়ার সংগ্রাম । সংসারের সব কাজ তাদেকেই করতে হয় ।
রহিমাও দিনদিন কেমন যেনো হয়ে যাচ্ছে । তাদের আর আগের মত ভালোবাসে না । সব কথাতেই শুধু মফিজ শেখের পক্ষ নেয় ।
রহিমা আর মফিজ শেখের একটি ছেলে হয়েছে । রহিমা তার ছেলে নিয়ে থাকে সারাক্ষণ । আর সংসারের সব কাজ করে ছায়া আর মায়া । আর কাজে যদি একটু ভুল হয়, তাহলে খাবার বন্ধ করে দেয় ।
দিন দুই আগের কথা ।
মায়ার হাত থেকে পড়ে একটি চা খাওয়ার কাপ ভেঙে যায় । সঙ্গে সঙ্গে মফিজ শেখ এসে মায়ার চুলের বেণি ধরে বেধম মার মারে আর বলে, "এই শুয়োরের বাচ্চা দুইটা যদি একটা কাজও ঠিকমত করে । তোর দুইবেলার খাওয়ন বন্ধ । ঐ রহিমা ওক খাওন দিবি না ।"
সেদিন রহিমা সত্যি সত্যিই মায়াকে খেতে দেয়নি । ছায়া তার পাতের পুরো খাবার মায়াকে তুলে খাইয়েছে ।
ছেলে হওয়ার পর থেকে রহিমা পরিবর্তিন আরও ভয়ানক রুপ নেয় । ছায়া আর মায়াকে যেনো সে চেনেই না ।
আগে ছায়া আর মায়ার জন্য একটা ছোট বিছানা ছিল । কিন্তু ছেলে হওয়ার পর থেকে তাদের মেঝেতে শুতে হয় ।
দুপুর বেলা ।
রহিমা গোসল করতে পুকুরে যাবে ।
"ঐ ছায়া, কি রে কই গেলি ?"
"এই তো মা এখানে ।"
"কই থাকিস সারাদিন, খুঁজেই পাওয়া যায় না । শোন আমি নাইতে গেলাম,বাবুকে দেখিস । ও যেনো না কাঁদে ।"
ছায়া বাবুর দোলনার পাশে বসে আছে । বাবু ঘুমাচ্ছে আর ছায়া দোলনায় দোল দিচ্ছে । দোলনার প্রতিটি দোলে ছায়া যেনো তার অতীতে ফিরে যেতে লাগল ।
তার বাবার কথা মনে পড়ছে । কাজ থেকে ফিরে এসে ছায়া ছায়া বলে ঘর মাথায় করত সবুজ মিয়া । আর তার ঘর্মাক্ত শরীরে লাফিয়ে পড়ত ছায়া । বাবা-মেয়ে সারাদিনের সব কথা একে অন্যকে বলত । বলতে বলতে একসময় ঘুমের দেশে চলে যেত সে । শহর থেকে সবুজ মিয়া ছায়ার জন্য খুব সুন্দর একটা থ্রি-পিস কিনেছিল । সেইটাই আজ পর্যন্ত তার কাছে নতুন । এরপর আর কোন কাপড় তার পড়া হয়নি ।
বাবুর কান্নায় ঘোর ভেঙ্গে যায় ছায়ায় । বাবুর ঘুম ভেঙে গেছে । সে প্রচন্ড জোরে শব্দ করে কাঁদছে ।ছায়া বাবুকে কোলে নিয়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করে । কিন্তু বাবুর কান্না কোনমতেই থামানো যাচ্ছে না ।
নাওয়া শেষে ঘরে ফেরে রহিমা । এসেই বাবুর কান্না শুনে তার মেজাজ গরম হয়ে যায় । বাবুকে কোলে নিয়ে অনেক কষ্টে ঘুম পাড়িয়ে দেয় ।
তারপর ছায়ার ঘাড় ধরে বেধড়ক মারধর করে । ছায়াকে মারা শেষ মায়া মায়া বলে চিৎকার করতে থাকে ।
সব কাজ শেষ করে মায়া উঠানে বসে চুল বাঁধছিল । চুলে চিরুনি জড়িয়ে দৌঁড়ে আসে মায়া । মায়াকে দেখেই চিল্লাতে শুরু করে, "নবাবজাদির বেটি, সারাদিন খালি সাজগোজ, তাই না ? ঘরদোর যে এখনও বাসি, সে খেয়াল আছে ?"
কথাটি শেষ না হতেই মায়ার পিঠে দুম দুম করে কিল বসিয়ে দেয় রহিমা ।
ছায়া আর মায়া বাড়ির পেছনের আম গাছের নিচে বসে কাঁদছে ।
"বুবুনি দেখছো মা আর আগের মত নেই । আমাদের আর ভালোই বাসে না । খালি মারে । বুবুনি, আমি আর এদের সাথে থাকবো না । কি হল বুবুনি, কথা বল না কেনো ?"
কথা শেষ না হতেই হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে মায়া ।
ছায়া নিরবে চোখের পানি ফেলছে । তার দৃষ্টি ঘোলা হয়ে আসছে । ঘোলা দৃষ্টির অন্তরালে সে গভীর চিন্তায় নিমগ্ন । সে আর এখানে থাকতে চায় না ।
হঠাৎ করে চোখ মুছে রাগের সুরে মায়াকে বলে ওঠে, "আজ রাতে ঘুমাবি না । আজি আমরা চলে যাবো ।"
ছায়ার কাছে এরকম কথা শুনে মায়া হতভম্ব হয়ে যায় । সে এরকম কথা আশাই করে নি । মায়া একনজরে ছায়ার দিকে তাকিয়ে আছে । আর ছায়া আমগাছের ভাঙা ডাল দিয়ে মাটিতে কি যেনো আঁকিবুঁকি করছে । তাকে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে !
রাত ১১টা ।
চারিদিক শুনশান । মাঝে মাঝে দু একটা নিশাচরের পাখা ঝাপটানোর শব্দ সেই নিরবতা ভাঙছে ।
হঠাৎ ছায়া-মায়ার ঘর থেকে হ্যারিকেন জ্বলে ওঠে । সেই আলোয় ওরা রেলস্টেশন পর্যন্ত চলে আসে ।
এরপর হ্যারিকেনের বাকী তেলটুকু বোতলে ঢেলে হ্যারিকেনটিকে রেলস্টেশনের পাশের জঙ্গলে ছুঁড়ে ফেলে ।
প্রথম ট্রেন আসবে ভোরে । তার আগে কোন ট্রেন নেই । রেলস্টেশনের এক কোণে ঘুমিয়ে নেয় তারা ।
কুলিদের চেঁচামেচিতে ঘুম ভেঙ্গে যায় তাদের । ট্রেন চলে এসেছে ।ছায়া মায়াকে ডেকে তোলে । ক্ষুধার জ্বালায় মায়া কাতরাচ্ছে । স্টেশনের একটা টিউবওয়েল থেকে পানি খেয়েই ট্রেনে উঠে পড়ে ।
তাদের গন্তব্য অজানা । হয়তো অসীমে ।ছায়ার মুখে বিষন্নতার ছাপ । মায়া ক্ষিদার জ্বালায় কাতরাতে কাতরাতে ঘুমিয়ে পড়েছে ।
হঠাৎই এক দমকা হাওয়া ছায়ার চুল উড়িয়ে দেয় । ছায়া আনমনে হয়ে জানালা দিয়ে দৃষ্টি ছুঁড়ে দেয় অসীমে । তারা আজ ক্ষুধার জ্বালায় বন্দী কিন্তু আপনজনদের দেওয়া কষ্ট থেকে মুক্ত..............
________মোঃ মেহেদী হাসান গালিব