-ভাড়াটা দেন দেখি?
-কই নামবেন?
বহুদিন পর বাসে উঠলাম, খুব বেশি বাসে চলাচল হয় না। যেখানে যাওয়া দরকার এই পায়ে হেটেই চলে যাওয়া হয়। বাসে উঠে জানালার পাশে বসে রাস্তায় দুই চোখ নিমগ্ন থাকায় ভাড়ার ব্যাপারটা এক প্রকার ভুলেই গিয়েছিল হোসেন। এই ঢাকা শহরে দুরে কোথাও কাজ কর্ম কিছু খুব একটা থাকে না। যদিও থাকে হোসেন হেটেই রওনা দেয়। প্রায় বেকার মানুষ। এলাকার লাইব্রেরিতে ফটোকপির কাজ। মাঝে মাঝে বই বাধাই এর কাজ পরে। সপ্তাহে দুই একবার বাংলাবাজার, নীলক্ষেতে কাজ পরে। হোসেন হেটেই রওনা দেয়। হাটতে খুব ভালো লাগে।গাড়িতে বসলে দৃশ্যপট সাই সাই করে পার হয়ে যায়, হেটে হেটে স্থির ভাবে, শান্তি করে দৃশ্যপট গুলি বোঝা যায়, ইচ্ছে মত থেমে থাকা যায় নিজ পছন্দসই জায়গায়।
কপাল ভাগ্যে জানালার পাশে সিট পড়েছে। হোসেন জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকার চেষ্টা করছে, কিন্তু জানালা গুলি কেমন জানি ছোট, একটা জানালা পুরোটা পাওয়া যায় না। কিছু খোলা আর কিছু জানালার বহুদিনের পুরোনো, ফাটা ময়লা কাচে আটকে যায়। বাস ইতিমধ্যে পূর্ণ হয়ে গেছে মানুষে, মনে হচ্ছে যতগুলো সিট আছে তার থেকে বেশি মানুষ। এক একটা মানুষ যেন এক একটা বাস, যে বাস জীবন নামের রাস্তায় সময় নামের গন্তব্যর উদ্দেশ্য নিয়তির এক একটা স্টেশনে গিয়ে কখনো নামছে আর উঠছে। হরেক রকম মানুষ, হরেক রকম উদ্দেশ্য, হরেক রকম গন্তব্য।
বাস চলছে, কখনো থেমে থেমে, কখনো জোরে, কখনো মাঝপথে দাড়াচ্ছে, কখনো মোড়ে মোড়ে, নিত্য নতুন যাত্রী নিয়ে, কখনো নতুন দিন শুরু করা পুরোনো যাত্রী কখনো পুরোদিন পাড় করে পুরোনো যাত্রী কে পুরোনো গন্তব্যে। কখন চেনা গন্তব্যে পুরোনো যাত্রী কে নামিয়ে কখনো নতুন যাত্রী কে নতুন কোনো গন্তব্যে। এই ওঠা নামা, সিটে বসা, ড্রাইভারের সিগারেট ধরা, গিয়ার বক্স ঠেলে সামনে এগিয়ে যাওয়ার মাঝেই দেনা পাওনা চলছে। যার যার ভাড়া বুঝিয়ে দেয়া নেয়া চলছে, বাম হাতে আংগুলের ফাকে ফাকে সাজানো ক্রমান্নয়ে বড় থেকে ছোট নোট বাহারে, বুক পকেটে কয়েনের সমাহারে, গন্তব্য অনুযায়ী ভাড়া দেয়া নেয়া চলছে।
কেউ কেউ দাড়িয়ে মাথার ওপর হাতল ধরে দাড়িয়ে উদাস মনে আরো দু তিনটি মাথা গলে বাইরের দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবছে, কেউ কেউ নিজের সিটে বসে সামনের সিটের পিছনে মাথা ঝুকিয়ে বসে হয়ত চোখ বুজে আছে, কেউ জানালার পাশে বসে থুতনিতে হাত রেখে কানে হেডফোন গুজে গান শুনছে। সবাই ই কোনো কোনো না কোনো গন্তব্যে যাবে। হোসেন ভাড়া মিটিয়ে দেয় আর ভাবে জীবনের সাথে কি মিল। জীবনের দেনাও শোধ করতে হয়। এই যে বাসে দুজন ছাত্র ছিল, অর্ধেক ভাড়া দিল। কারন তারা ছাত্র, উপার্জনক্ষম হয়ে ওঠে নি তাই। আচ্ছা জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষের কি সব কিছুর দেনা পাওনা চুকাতে হয়? এই যে মানুষ বলে ভালবাসা, আবেগ, সময় এসব অমূল্য, দরদাম হয় না, আচ্ছা সব কি টাকা পয়সা দিয়েই হিসেব হয়? সময়ের বদলে সময়, অথবা আবেগের বদলে আবেগ দেয়া কি এক ধরনের দেনা পাওনা মেটানো নয়? নাহ, কি সব ভাবছে, বড্ড এলোমেলো লাগে।
নেমে যেতে হবে সামনেই, গন্তব্য চলে এসেছে।
বাস থেকে হোসেন নেমে যায়, পুরোনো মানুষ, পুরোনো গন্তব্যে। নামিয়ে দিয়ে বাস চলে যায়। সময় জীবনকে, জীবন পথে হয়ত এভাবেই নামিয়ে দিয়ে চলে যায়, তার আরো যাত্রী আছে।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০ দুপুর ১২:৩৫