রাত। নগর ঘুমালো মাত্রই। সারাদিনের কোলাহলের পর একরাশ নীরবতা।
হাল্কা শীত শীত ভাব, দিনের বেলায় অতটা বোঝা যায় না। খানিক কাচুমুচু হয়ে দুহাত দিয়ে গরম চায়ের কাপ নিয়ে উষ্ণতা নিতে নিতে এদিক ওদিক দেখছে। ফাকা রাস্তা। রাস্তার বিভাজকে একজন প্রায় মধ্যবয়স্ক লোক বসে আছে হাত পা ছড়িয়ে। পোশাকে রুচির ছাপ৷ ঘটনা কি? ছিনতাই এর ভুক্তভোগী নাকি অসুস্থ? বোঝা যাচ্ছে না ঠিক। স্থির হয়ে বসে আছে প্রায় অনেকক্ষন।
হোসেন ধীর পায়ে আগাতে থাকে। লোকটির সামনে এসে দাড়ালো। লোকটা একবার মুখ তুলে তাকিয়ে আবার নামিয়ে নিল।
হোসেন এবার জিজ্ঞেস করে
- আপনার কোনো সমস্যা?
- আমার খুব ক্ষুধা লেগেছে, ভাত খাওয়াতে পারেন?
এমন উত্তর অবশ্য আশা করেনি হোসেন। পরক্ষনেই ভাবল, আশা করাটাই আসলে বোকামি হয়েছে। জীবনটাই যেখানে আশায় বাধিনু ঘর বেদনার বালুচরে সেখানে আশা আর কতক্ষন টেকসই হবে।
- চলুন।
লোকটি কোনো উত্তর না দিয়েই উঠে দাড়ালো, হোসেনের পিছু পিছু হাটা শুরু করল। সারা রাস্তায় আর কোনো কথা নেই।
মতি মিয়ার দোকান সারা রাত ই খোলা থাকে। মতি মিয়ার দোকানে ঢুকতেই মতি মিয়া হুকুম জারি হোলো কর্মচারির দিকে
- ২টা খানা লাগাও।
হোসেন বলল, যান হাত মুখ ধুয়ে আসুন।
লোকটি হাত মুখ ধুয়ে টেবিলে বসে পড়ল। আয়োজন তেমন কিছু নয়। সরিষার তেল মাখা আলু ভর্তা, কালিজিরা ভর্তা, ধনিয়া পাতা আর পাচফোড়নের ডাল, আর একদম গরম ভাত।
লোকটি খাচ্ছে, খুব সুন্দর করে গুছিয়ে, একপাশ থেকে মেখে মেখে, কোন খাবার প্লেটের বাইরে পড়ছেও না। তাড়াহুড়ো নেই। খাবারের মাঝে হোসেন জিজ্ঞেস করল কি নাম আপনার?
- বকুল
আবার কোনো কথা নেই। খাওয়া শেষ করেই বকুল বলল, খুব শান্তি করে খেলাম, নিজেকে খুব সুখী মানূষ এর মত লাগছে।
- তাই?
- হ্যা।
-মানুষ সুখী কিভাবে হয়?
- হুম, এর উত্তর চা খেতে খেতে না হয় দেই?
হোসেন, বকুল কে নিয়ে চায়ের দোকানের দিকে যেতে থাকে, আজ সুখের সংজ্ঞার একটা ক্রসচেক যাবে।
চায়ে চুমুক দিয়েই বকুল বলল,
দেখুন, সুখ আসলে একটা শব্দই কেবল নয়, সুখী হতে সবকিছু লাগে।
- যেমন?
- মনও লাগে, আবার ভালোবাসাও লাগে আবার টাকাও লাগে। ত্যাগও লাগে, আবার স্বার্থও লাগে। সবকিছু লাগে, সব মানে সব। এটা একটা কেবল শব্দের অর্থ না, এটা একটা প্যাকেজ। অনেক জটিল। মানুষ নিজেও জটিল কিন্তু ভাবে তারা খুব সহজ, সব কিছু সহজে নিতে চায়, সহজে ভাবতে চায়, আসলে এভাবে হয় না।
- মানুষ কি সুখী হয়?
- হয়, আবার হয় না।
- কেমন?
- মানুষ না জোড়াতালি দিতে ভালোবাসে, আর ভালোবাসে রিপ্লেসমেন্ট। মানুষ ভাবে, ভালোবাসতে তো পারলাম না টাকা তো দিলাম, তাতেই চলবে। আবার ভাবে, কাছে তো আসতে পারলাম না তাই কিছু ত্যাগ স্বীকার করে দিলাম, এভাবে না একটার বদলে আরেকটা দিয়ে সবসময়ই একটা প্রসেসিং এর মধ্যে দিয়ে চলা শুরু করে দেয়। তাতে আসলে ধোকাই হয়। সুখ আর আসে না জীবনে, আসবেই বা কেন? সুখ তো আর কোনো কিছুর সাথে কম্প্রোমাইজ করে আসে না। তার একটা আলাদা সত্তা আছে। তাকে পেতে আপনাকে তার প্রসেস এর মধ্যে দিয়ে যেতে হবে।
-বকুল, আপনি কি সুখী?
- নাহ, আমি নই।
- কেন? কিছুক্ষন আগেও বলছিলেন, সুখী মানুষের মত লাগছে।
- যখন থেকে সুখ খুঁজতে শুরু করেছি, সারাজীবন নিজেকে সহজ ভাবে মেলে ধরা, সবকিছু সহজ ভাবে নেয়া এই আমার কাছে সুখ খুব জটিল মনে হতে শুরু করে। সুখী হতে হবে এটা ভাববার আগেই আমি আসলে সুখী ছিলাম। খাবার পর সেই অনূভুতিটাই আমার কাজ করছিল কারন আমার কোনো আশা ছিল না। কি খাবো, কি দিয়ে খাবো? আদৌ খাবো কিনা?
জানেন, আপনি যদি ভাবেন আপনাকে ছাড়া আপনার আশে পাশের মানুষ সুখী হতে পারবে না তাহলে আপনি বড্ড অসুখে ভুগছেন। মানুষ মূলত একা। আপনি ছাড়াও দিব্যি চলে যাবে সব। আপনার সুখ আসলে আপনি নিজেই।
কি বুঝলেন? হবেন নাকি সুখী মানুষ?
হোসেন হাসল।
চা খেয়ে বকুল বিদায় নিয়ে চলে গেলো।
মাঝ রাত। ঘুমন্ত শহরে ল্যাম্পপোস্টের আলোতে এক পথে একজন হেটে চলছে। ল্যাম্পের আলোয় সেই মানুষের ছায়া দীর্ঘ হচ্ছে। কুয়াশার মধ্যে দিয়ে হেটে সেই কুয়াশার মধ্যেই হারিয়ে যাচ্ছে একজন সুখী মানুষ।