শান্তি প্রতিষ্ঠার নামে এক অশান্তির নাম যুদ্ধ। এই যুদ্ধ জ্বালাও,পোড়াও,আর ধ্বংসের তাণ্ডব লীলার সাথে অকালে নিভিয়ে দেয় অনেক জীবন প্রদীপ। এই সমাধি ক্ষেত্রে ঢুকার প্রায় প্রথম ভাগেই চোখে পড়ে এক তরুণ যোদ্ধার সমাধি. R.P Law নামের ব্রিটিশ রয়্যাল কোরের এই সদস্যের মৃত্যু কালে বয়স হয়েছিল মাত্র ১৯ বছর।আরেকজনের ২১, আরেকজনের ২৩। এরকম নানা বয়সী, নানা দেশী, নানা ধর্মের ৭৩৭ জন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত সৈন্য চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন এখানে।
১৯৩৯ সাল। বিশ্বজুড়ে দেখা দিয়েছে অশান্তির ছায়া। চারদিকে শুরু হয়েছে বিশ্বযুদ্ধের দামামা। দিন নেই, রাত নেই, বোমার গুড়ুম গুড়ুম আওয়াজ। অস্ত্রের গর্জন আর ছোপ ছোপ রক্তে শান্তিকামী মানুষের মনে আতঙ্ক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এ সর্বগ্রাসী মরণছোবল ভারতীয় উপমহাদেশের যেসব জায়গায় লেগেছিল, তার মধ্যে অন্যতম কুমিল্লা। ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আজও টিকে আছে বিংশ শতাব্দীর চল্লিশের দশকের সেই যুদ্ধের আগুন দগ্ধ দিনের স্মৃতিময় একটি স্থান।
বলছিলাম কুমিল্লা ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রি বা কমনওয়েলথ রণ সমাধি ক্ষেত্রের কথা। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের ও ময়নামতি সাহেবের বাজারের মাঝামাঝি কুমিল্লা-সিলেট সড়কের বাম পাশে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নিয়ে সাড়ে চার একর পাহাড়ি ভূমি জুড়ে বাংলাদেশে অবস্থিত দ্বিতীয় এ কমনওয়েলথ সমাধি ক্ষেত্র।অপর কমনওয়েলথ সমাধি রয়েছে চট্টগ্রাম শহরের বাদশা মিয়া চৌধুরী রোডে। যাতে ৭শ' ৫৫ জন সৈনিকের সমাধি রয়েছে।
সমাধি ক্ষেত্রটির প্রবেশমুখে একটি তোরণ ঘর আছে। এই ঘরের ভিতরের দেয়ালে সমাধি ক্ষেত্রের ইতিহাস ও বিবরণ ইংরেজি ও বাংলায় লিপিবদ্ধ করে একটি ফলক লাগানো হয়েছে। ভিতরে সরাসরি সামনে প্রশস্ত পথ, যার দুই পাশে সারি সারি কবর ফলক। সৈন্যদের ধর্ম অনুযায়ী তাদের কবর ফলকে নাম, মৃত্যু তারিখ, পদবির পাশাপাশি ধর্মীয় প্রতীক লক্ষ করা যায়-যেমন খ্রিস্টানদের কবর ফলকে ক্রুশ, মুসলমানদের কবর ফলকে আরবি লেখা (যেমন: হুয়াল গাফুর) উল্লেখযোগ্য।
প্রশস্থ পথ ধরে সোজা সম্মুখে রয়েছে সিঁড়ি দেয়া বেদি, তার উপরে শোভা পাচ্ছে খ্রিস্ট ধর্মীয় পবিত্র প্রতীক ক্রুশ।
বেদির দুপাশে রয়েছে আরো দুটি তোরণ ঘর। এসকল তোরণ ঘর দিয়ে সমাধিক্ষেত্রের পিছন দিকের অংশে যাওয়া যায়। সেখানেও রয়েছে আরো বহু কবর ফলক।
প্রতি দুটি কবর ফলকের মাঝখানে একটি করে ফুলগাছ শোভা পাচ্ছে। এছাড়া পুরো সমাধিক্ষেত্রেই রয়েছে প্রচুর গাছ। সমাধিক্ষেত্রের সম্মুখ অংশের প্রশস্ত পথের পাশেই ব্যতিক্রমী একটি কবর রয়েছে, যেখানে একসাথে ২৩টি কবর ফলক দিয়ে একটা স্থানকে ঘিরে রাখা হয়েছে। এই স্থানটি ছিল মূলত ২৩ জন বিমান সৈনিকের একটি গণকবর, যেখানে লেখা রয়েছে:
These plaques bear the names of twenty three Air men whose remains lie here in one grave
দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধে ১৯৪১ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত বার্মায় সংঘটিত যুদ্ধে প্রাণ হারান ৪৫ হাজার কমনওয়েলথ সৈনিক।তাদের স্মৃতি রক্ষার্থে মিয়ানমার, আসাম এবং বাংলাদেশের ৯টি রণ সমাধি ক্ষেত্র তৈরি করা হয়েছিল। যার একটি ময়নামতি ওয়ার সেমিট্রি। এখানে শায়িত আছেন নিহত ৭শ' ৩৭ জন সৈনিক। এর মধ্যে ২৪ জন জাপানি যুদ্ধবন্দি এবং ১ জন বেসামরিক ব্যক্তি বাদে বাকি সবাই কমনওয়েলথ সৈনিক। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধে নিহত এবং যুদ্ধে আহত হয়ে পরে মারা যাওয়া সাধারণ সৈনিক থেকে ব্রিগেডিয়ার পদ মর্যাদাধারীকে এখানে সমাহিত করা হয়েছে।
যুদ্ধের পর বিভিন্ন স্থানের বিভিন্ন সমাধি থেকে কিছু লাশ স্থানান্তর করেও এখানে সমাহিত করা হয়। বাহিনী অনুযায়ী এখানে ৩ জন নাবিক, ৫৬৭ জন সৈনিক এবং ১৬৬ জন বৈমানিক রয়েছেন। যুদ্ধে নিহতরা হলেন যুক্তরাজ্যের ৩৫৭ জন, কানাডার ১২ জন, অস্ট্রেলিয়ার ১২ জন, নিউজিল্যান্ডের চারজন, দক্ষিণ আফ্রিকার একজন, অবিভক্ত ভারতের ১৭৮, জিম্বাবুয়ের তিনজন, পূর্ব আফ্রিকার ৫৬, পশ্চিম আফ্রিকার ৮৬ জন, মিয়ানমারের একজন, বেলজিয়ামের একজন, পোল্যান্ডের একজন ও জাপানের ২৪ জন।
এখানে মোট সমাধির সংখ্যা ছিল ৭৩৮টি। ১৯৬২ সালে এ সমাধিস্থল থেকে একজন সৈনিকের আত্মীয় স্বজন তার দেহাবশেষ যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে যান। বর্তমানে এ সমাধি সংখ্যা ৭৩৭টি। এরমধ্যে ১৪জন সৈনিকের পরিচয় পাওয়া যায়নি। ১৯৪৩/৪৪ সালে আর্মি গ্যারিসন ইঞ্জিনিয়ারগণ এ সমাধি ক্ষেত্রটি তৈরী করেন।
সমাধির পাহাড়ের প্রথম ধাপে রয়েছে ইউরোপিয়ানদের কবর। উপরের ধাপে রয়েছে এ উপমহাদেশের যোদ্ধাদের কবর। সমাধিগুলো সারিবদ্ধভাবে সাজানো রয়েছে। ১৪টি বাদে প্রত্যেক সমাধিতে লেখা আছে নিহত সৈনিকের নাম, বয়স, পদবী, নিহত হবার তারিখ ও ঠিকানা।
কুমিল্লার ময়নামতি সমাধিক্ষেত্র এবং চট্টগ্রামের সমাধি ক্ষেত্র এ দুটির সার্বিক তদারকি করছে কমনওয়েলথ গ্রেভস কমিশন। এর প্রধান কার্যালয় লন্ডনে। কমনওয়েলথ ভুক্ত দেশ সমূহের অনুদানে চলে এ সংস্থাটি। কুমিল্লার ময়নামতি সমাধি ক্ষেত্রটিতে গ্রেভস কমিশনের নিয়োগ করা ১ জন কেয়ারটেকার ও ৫ জন গার্ডেনার রক্ষণাবেক্ষণের কাজে নিয়োজিত আছে।
ঈদের দুদিন ছাড়া বছরের প্রতিদিনই সকাল ৭টা থেকে দুপুর ১২টা এবং দুপুর ১টা হতে বিকেল ৫টা পর্যন্ত এ যুদ্ধ সমাধিস্থল সর্ব সাধারণের জন্য উম্মুক্ত থাকে। একটি নোটিশ বোর্ডে - 'প্রেম পিরিতি করতে যাওয়া কাপলদের সমাধি ক্ষেত্রে প্রবেশ নিষেধ।' জাতীয় কিছু লিখা দেখলাম।
এ সমাধি ক্ষেত্র দেখতে প্রতিদিন দেশ-বিদেশের শত শত দর্শনার্থী ভিড় করে। প্রতিবছরের ৫ নভেম্বর কমনওয়েলথ ভুক্ত দেশের রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনাররা এই সিমেট্রিতে উপস্থিত হয়ে নিজ নিজ দেশের পক্ষে স্মৃতিফলকে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করেন। এবং প্রায় সকল ধর্মের ধর্মযাজকদের দিয়ে এই দিনে নিহতদের স্মরণে প্রার্থনার আয়োজন করা হয়।
পুনশ্চঃ শেষ ছবিটি দেখে কমনওয়েলথ রণ সমাধিক্ষেত্র থেকে উঠে আসা কোন সৈনিক ভেবে আবার 'আমিন' লিখে ফেলবেন না। ইনি আসলে একজন পর্যটক।
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জানুয়ারি, ২০১৯ সকাল ১১:৪৯