somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

যেভাবে হত্যা করা হয় ইন্দিরা গান্ধীকে।

৩১ শে অক্টোবর, ২০২১ সন্ধ্যা ৬:৫৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



৩১শে অক্টোবর সকালে অফিসের জন্য তৈরি হয়েই ব্রেকফাস্ট টেবিলে এসেছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। দুটো পাউরুটি টোস্ট, কিছুটা সিরিয়াল, মুসাম্বির জুস আর ডিম ছিল সেদিনের ব্রেকফাস্টে।
নাস্তার পরেই মেকআপ ম্যান তার মুখে সামান্য পাউডার আর ব্লাশার লাগিয়ে দিয়েছিলেন। তখনই হাজির হন তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডাক্তার কে পি মাথুর।রোজ ওই সময়েই মিসেস গান্ধীকে পরীক্ষা করতে যেতেন তিনি।
ঘড়িতে যখন ন'টা বেজে দশ মিনিট, ইন্দিরা গান্ধী বাইরে বের হলেন। বেশ রোদ ঝলমলে দিনটা।রোদ থেকে প্রধানমন্ত্রীকে আড়াল করতে সেপাই নারায়ণ সিং একটা কালো ছাতা নিয়ে পাশে পাশে হাঁটছিলেন।
কয়েক পা পেছনেই ছিলেন ব্যক্তিগত সচিব আর কে ধাওয়ান আর তারও পেছনে ছিলেন ব্যক্তিগত পরিচারক নাথু রাম।
সকলের পেছনে আসছিলেন ব্যক্তিগত নিরাপত্তা অফিসার, সাব ইন্সপেক্টর রামেশ্বর দয়াল।
বাসভবনের লাগোয়া প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর ছিল আকবর রোডে। দুটি ভবনের মধ্যে যাতায়াতের একটা রাস্তা ছিল।
সেই রাস্তার গেটের সামনে পৌঁছে ইন্দিরা গান্ধী তার সচিব আর কে ধাওয়ানের সঙ্গে কথা বলছিলেন।
হঠাৎই পাশে দাঁড়ানো নিরাপত্তাকর্মী বিয়ন্ত সিং রিভলবার বার করে ইন্দিরা গান্ধীর দিকে গুলি চালায়।
প্রথম গুলিটা পেটে লেগেছিল। ইন্দিরা গান্ধী ডান হাতটা ওপরে তুলেছিলেন গুলি থেকে বাঁচতে। তখন একেবারে পয়েন্ট ব্ল্যাংক রেঞ্জ থেকে বিয়ন্ত সিং আরও দুবার গুলি চালায়। সে-দুটো গুলি তার বুকে আর কোমরে লাগে।
ওই জায়গার ঠিক পাঁচ ফুট দূরে নিজের টমসন অটোমেটিক কার্বাইন নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল আরেক নিরাপত্তা কর্মী সতবন্ত সিং।
ইন্দিরা গান্ধীকে মাটিতে পড়ে যেতে দেখে সতবন্ত বোধহয় কিছুটা ঘাবড়ে গিয়েছিল। সে নির্বাক তাকিয়ে ঘটনা প্রত্যক্ষ করছিল।
তখনই বিয়ন্ত চিৎকার করে সতবন্তকে বলে 'গুলি চালাও।' সতবন্ত সঙ্গে সঙ্গে নিজের কার্বাইন থেকে চেম্বারে থাকা ২৫টা গুলিই ইন্দিরা গান্ধীর শরীরে গেঁথে দিয়েছিল।
বিয়ন্ত সিং প্রথম গুলিটা চালানোর পরে প্রায় ২৫ সেকেন্ড কেটে গিয়েছিল ততক্ষণে।
নিরাপত্তা কর্মীরা ওই সময়টায় কোনও প্রতিক্রিয়া দেখান নি, এতটাই হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন সবাই।
তারপরে সতবন্ত সিং গুলি চালাতে শুরু করতেই একদম পিছনে থাকা নিরাপত্তা অফিসার রামেশ্বর দয়াল দৌড়ে এগিয়ে আসেন।
সতবন্ত তখন একনাগাড়ে গুলি চালিয়ে যাচ্ছেন। মি. দয়ালের উরু আর পায়েও গুলি লাগে। সেখানেই পড়ে যান তিনি।
ইন্দিরা গান্ধীর আশপাশে থাকা অন্য কর্মচারীরা ততক্ষণে একে অন্যকে চিৎকার করে নির্দেশ দিচ্ছেন।
ওদিকে এক নম্বর আকবর রোডের ভবন থেকে পুলিশ অফিসার দিনেশ কুমার ভাট এগিয়ে আসছিলেন শোরগোল শুনে।
বিয়ন্ত সিং আর সতবন্ত সিং তখনই নিজেদের অস্ত্র মাটিতে ফেলে দিয়েছে। বিয়ন্ত বলেছিল, "আমাদের যা করার ছিল, সেটা করেছি। এবার তোমাদের যা করার করো।"
ইন্দিরার আরেক কর্মচারী নারায়ণ সিং সামনে লাফিয়ে পড়ে বিয়ন্ত সিংকে মাটিতে ফেলে দেন।
পাশের গার্ডরুম থেকে বেরিয়ে আসা ভারত- তিব্বত সীমান্ত পুলিশ বা আই টি বি পির কয়েকজন সদস্য দৌড়ে এগিয়ে এসে সতবন্ত সিংকেও ঘিরে ফেলে।
প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে সবসময়ে একটা অ্যাম্বুলেন্স রাখা থাকত । ঘটনাচক্রে সেদিনই অ্যাম্বুলেন্সের চালক কাজে আসেন নি।
ইন্দিরা গান্ধীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা মাখনলাল ফোতেদার চিৎকার করে গাড়ি বার করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন।
মাটিতে পড়ে থাকা ইন্দিরাকে ধরাধরি করে সাদা অ্যাম্বাসেডর গাড়ির পিছনের আসনে রাখেন আর কে ধাওয়ান আর নিরাপত্তা কর্মী দিনেশ ভাট।
সামনের আসনে, ড্রাইভারের পাশে চেপে বসে পড়েন মি. ধাওয়ান আর মি. ফোতেদার।গাড়ি যেই চলতে শুরু করেছে, সোনিয়া গান্ধী খালি পায়ে, ড্রেসিং গাউন পরে 'মাম্মি, মাম্মি' বলে চিৎকার করতে করতে দৌড়ে আসেন।ইন্দিরা গান্ধীকে ওই অবস্থায় দেখে সোনিয়া গান্ধীও গাড়ির পিছনের আসনে চেপে পড়েন। রক্তে ভেসে যাচ্ছিল ইন্দিরা গান্ধীর শরীর। সোনিয়া তার মাথাটা নিজের কোলে তুলে নেন।
খুব জোরে গাড়িটা 'এইমস' বা অল ইন্ডিয়া ইন্সটিটিউট ফর মেডিক্যাল সায়েন্সের দিকে এগোতে থাকে। চার কিলোমিটার রাস্তা কয়েক মিনিটের মধ্যেই পেরিয়ে যায়।সোনিয়া গান্ধীর ড্রেসিং গাউনটা ততক্ষণে ইন্দিরা গান্ধীর রক্তে পুরো ভিজে গেছে।
ওই গাড়িটা 'এইমস'এ ঢুকেছিল ন'টা ৩২ মিনিটে।
জরুরী বিভাগের দরজা খুলে গাড়ি থেকে ইন্দিরা গান্ধীকে নামাতে মিনিট তিনেক সময় লেগেছিল। কিন্তু সেখানে তখন কোনও স্ট্রেচার নেই। কোনওরকমে একটা স্ট্রেচার যোগাড় করা গিয়েছিল।
গাড়ি থেকে তাকে নামানোর সময়ে ওই অবস্থা দেখে সেখানে হাজির ডাক্তাররা ঘাবড়ে গিয়েছিলেন।ফোন করে সিনিয়র কার্ডিয়োলজিস্টদের খবর দেওয়া হয়। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ডাক্তার গুলেরিয়া, ডাক্তার এম এম কাপুর আর ডাক্তার এস বালারাম ওখানে পৌঁছে যান।
ইসিজি করা হয়েছিল, কিন্তু তার নাড়ীর স্পন্দন পাওয়া যাচ্ছিল না। চোখ স্থির হয়ে গিয়েছিল। বোঝাই যাচ্ছিল যে মস্তিষ্কে আঘাত লেগেছে।একজন চিকিৎসক মুখের ভেতর দিয়ে একটা নল ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন যাতে ফুসফুস পর্যন্ত অক্সিজেন পৌঁছাতে পারে। মস্তিষ্কটা চালু রাখা সবথেকে প্রয়োজন ছিল তখন।৮০ ব্যাগ রক্ত দেওয়া হয়েছিল ইন্দিরা গান্ধীকে। শরীরে যে পরিমাণ রক্ত থাকে, এটা ছিল তার প্রায় ৫ গুণ।
ডাক্তার গুলেরিয়া বলছেন, "আমি তো দেখেই বুঝে গিয়েছিলাম যে উনি আর নেই। কিন্তু নিশ্চিত হওয়ার জন্য ইসিজি করতে হয়েছিল। তারপরে আমি ওখানে হাজির স্বাস্থ্যমন্ত্রী শঙ্করানন্দকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, এখন কী করণীয়? ঘোষণা করে দেব আমরা যে উনি মৃত? তিনি না বলেছিলেন। তখন আমরা মিসেস গান্ধীকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাই।"

চিকিৎসকরা 'হার্ট এন্ড লাং মেশিন' লাগিয়েছিলেন ইন্দিরার শরীরে। ধীরে ধীরে তার শরীরে রক্তের তাপমাত্রা ৩৭ ডিগ্রি থেকে কমে ৩১ ডিগ্রি হয়ে গেল।তিনি যে আর নেই, সেটা সকলেই বুঝতে পারছিল, কিন্তু তবুও 'এইমস'এর আটতলার অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তাকে।

চিকিৎসকেরা দেখেছিলেন যে যকৃতের ডানদিকের অংশটা গুলিতে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। বৃহদান্ত্রের বাইরের অংশটা ফুটো হয়ে গেছে। ক্ষতি হয়েছে ক্ষুদ্রান্ত্রেরও।ফুসফুসের একদিকে গুলি লেগেছিল আর পাঁজরের হাড় ভেঙ্গে গিয়েছিল গুলির আঘাতে। তবে হৃৎপিণ্ডতে কোনও ক্ষতি হয় নি।দেহরক্ষীদের গুলিতে ছিন্নভিন্ন হওয়ার প্রায় চার ঘণ্টা পর, দুপুর দুটো ২৩ মিনিটে ইন্দিরা গান্ধীকে মৃত ঘোষণা করা হয়েছিল।কিন্তু সরকারি প্রচারমাধ্যমে সেই ঘোষণা করা হয়েছিল দূরদর্শনের সন্ধ্যা ছয়টার খবরে। সংবাদ উপস্থাপক সালমা সুলতান ইন্দিরা গান্ধীর মারা যাওয়ার খবর প্রচার করেন।
ইন্দিরা গান্ধীর জীবনীকার ইন্দর মালহোত্রা বলছেন, গোয়েন্দা এজেন্সিগুলো আগেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল যে মিসেস গান্ধীর ওপরে এরকম একটা হামলা হতে পারে।তারা সুপারিশ পাঠিয়েছিল যে প্রধানমন্ত্রীর আবাস থেকে সব শিখ নিরাপত্তা-কর্মীদের যেন সরিয়ে নেওয়া হয়।কিন্তু সেই ফাইল যখন ইন্দিরা গান্ধীর টেবিলে পৌঁছায়, তখন ভীষণ রেগে গিয়ে তিনি নোট লিখেছিলেন, "আরন্ট উই সেকুলার?" অর্থাৎ, "আমরা না ধর্মনিরপেক্ষ দেশ?"
এরপরে ঠিক করা হয়েছিল যে একসঙ্গে দু'জন শিখ নিরাপত্তা-কর্মীকে প্রধানমন্ত্রীর কাছাকাছি ডিউটি দেওয়া হবে না।৩১শে অক্টোবর সতবন্ত সিং বলেছিল যে তার পেট খারাপ। তাই তাকে শৌচালয়ের কাছাকাছি যেন ডিউটি দেওয়া হয়।এইভাবেই বিয়ন্ত আর সতবন্ত সিংকে একই জায়গায় ডিউটি দেওয়া হয়েছিল।যার পরিণতিতে স্বর্ণ মন্দিরে সেনা অপারেশন - 'অপারেশন ব্লুস্টার'এর বদলা নিয়েছিল তারা প্রধানমন্ত্রীকে গুলিতে ঝাঁঝরা করে দিয়ে।
১৯৮৪ সালের আজকের এই দিনে নিহত হন ইন্দিরা গান্ধী। বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধুটির জন্য রইল গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।

(সুত্রঃবিবিসি বাংলা, উইকিপিডিয়া ও নেটে প্রাপ্ত বিভিন্ন আর্টিকেল)
২১টি মন্তব্য ২১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×