পাঁচতলা বিল্ডিং এ বিশ পরিবার থাকি। টানা দুই মাস লকডাউনের কারণে এই সময়ে কদাচ ব্যাতিরেকে কারো মুখ কেউ দেখেনি। ঈদ উপলক্ষে অন্য ফ্লাটের লোকজনের সাথে দেখা হবে তাই ঈদের বিকেলে নিরাপদ দুরত্ব বজায় রেখে ছাদে ঈদ পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।
ঈদের দিন বিকেলে বউ বললো, আমি ছাদে যাচ্ছি তুমি তাড়াতাড়ি আসো। তাড়াহুড়া করে ছাদে গিয়ে দেখি চারিদিকে অপরিচিত লোকজন। আশ্চর্য লাগলো,এই দুই মাসে প্রচুর নতুন ভাড়াটিয়া এসেছে,অনেককেই চিনতে পারছিনা।
একটা চেয়ারে শ্বেত শুভ্র চুল আর লম্বা সাদা দাড়ির এক মুরব্বি বসে ছিলেন। চেহারায় শেষ বয়সের রবীন্দ্রনাথের মতো প্রশান্তি। আমি গিয়ে সালাম দিলাম,
-- জেইয়া (জেঠা) আসসামুআলাইকুম, নতুন ভাড়া আসছেন বুঝি?
এই সাধারণ প্রশ্নেই জেইয়া গরম চোখে আমার দিকে তাকালেন।
-- লিটন ভাই, আপনি মাঝে মাঝে একটু বেশি ফাজলামো করে ফেলেন।
আমি থতমত খেয়ে গেলাম। ভালো করে লক্ষ্য করে দেখি আরে এ-তো চারতলার রফিক ভাই। কিন্তু বয়স হটাৎ করে বিশ বছর বাড়লো কেমনে? ব্যাটা তাইলে এতোদিন কলপ টলপ দিয়ে ইয়াং ভাব নিয়ে ঘুরতো? এখনতো দেখি শরীরের কোন লোমই কালো নাই।
একটু খোঁচা দিয়ে বললাম,
স্যরি রফিক ভাই আমার দাদাজানের ঠিক এইরকম সাদা দাড়ি ছিল, তাই ভুল হয়ে গেছে।
রফিক ভাই গম্ভীর চোখে তাকাচ্ছে। ব্যাটা রাগ করছে মনে হয়। উনি আবার মালিকের কেমন জানি শালা,আমার পানির লাইন টাইননি আবার বন্ধ করে দেয়। পরিস্থিতি খারাপ দেখে ওখান থেকে কেটে পড়লাম।
আমার বউরে খুঁজতে গিয়ে দেখি একটা কাজের বুয়া আসছে। বেশ চকচকে একটা শাড়ি পরা, নিশ্চয়ই ঈদে কোন ভাবি উপহার দিয়েছে তাকে।
ডেকে বললাম, এই খালা আমরা তিন তলায় থাকি, আমার স্ত্রীকে একটু ডেকে দাও তো।
কাজের বুয়া হটাৎ করে দাঁড়িয়ে পড়লো, কড়া চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, আমাকে দেখলে কি কাজের বুয়ার মতো লাগে?
গলা শুনে চমকে গেলাম। ভালো করে তাকিয়ে দেখি, পাঁচ তলার ভাবি। মুখে মেকআপ নাই। সেই ফর্সা সুন্দর মুখের বদলে এক আদিবাসী রমনীর তামাটে মুখ বসানো এখন। উনাকে দেখে কে বলবে উনি সেই ভাবি যাকে দেখলে আমি ভাবতাম, হায় খোদা আমার বউরে এই রকম সুন্দর করে দাও। ভাগ্য ভালো দোয়া কবুল হয় নাই, সত্যি, খোদা যা জানে আমরা তা জানি না। লকডাউন কত লক যে খুলে দিচ্ছে। তবে উনার মেক আপ ম্যানের প্রতি শ্রদ্ধা বেড়ে গেল আমার, আদিবাসী রমণীকে বলিউড নায়িকা করার আশ্চর্য ক্ষমতা তার।
ছাদের এদিক ওদিক বউকে খুজছি, তিন তলার ভাবি এগিয়ে এলো। চমৎকার হাসিখুশি মহিলা, এই লকডাউনেও চেহারা বদলায়নি। আমাকে দেখে হটাৎ গম্ভীর হয়ে গেল। হাজার টাকার তিনটা নোট আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
-- এই ভাই যাও তো মিস্টি আর দই নিয়ে আসো দৌড় দিয়ে। আমি একটু ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলাম। আমি একটু ইতস্তত করছি দেখে ভাবী ধমক দিলো,
-কি ব্যাপার ভ্যাবলার মতো দাড়ায় আছো কেন? সামনের মোড়েই দোকান, যাও, এক দৌড়ে যাবা এক দৌড়ে আসবা।
আমি যন্ত্রের মতো নামলাম, তিনতলায় নেমে ভাবলাম বৌ আসছে কিনা দেখি। নিজের ঘরে ঢুকে দম নিচ্ছি কিছুক্ষণ পর বউ বাইরে থেকে ঢুকলো।
কই, তুমি রেডি হও নাই এখনো? তাড়াতাড়ি কর। লুংগী খুলে পায়জামা পাঞ্জাবি পর। ছাদে চল তাড়াতাড়ি, ছাদে চোর আসছে,বিশাল হুলুস্থুল কান্ড!
--ক্বি? চোর?
--হু। আরে তিনতলার ভাবির তিন হাজার টাকা চুরি করেছে।
আমি ঢোক গিললাম, কেমনে?
-- আর বইলো না, ভাবীর কাছ থেকে মিস্টি দই কেনার কথা বলে টাকা নিয়ে ভাগছে।
--ভাবী টাকা দিলো কেন?
বউ মাথা নাড়লো, ভাবিরে বলছে সে নাকি নতুন দারোয়ান। ভাবি বললো দেখাও যায় নাকি সেইরকম, ময়লা লুংগী আর ছেড়া গেঞ্জি পরা, উষ্কখুষ্ক চুল দাড়ি চিমসে চেহারার চোর। এইদিকে নতুন দারোয়ান হাজির, সে গাট্টাগোট্টা লোক।
আমি বলতে চাইলাম পুরাই মিথ্যা, আমি মোটেই নিজেরে দারোয়ান বলি নাই, মহিলা জোর করে টাকা দিছে।
কিন্ত ঘরের আয়নায় নিজের চেহারা দেখে চুপ করে গেলাম। হায়রে লকডাউন, চেহারা আর কন্ট্রোলে নাই।বউরে ক্যাম্নে বলি আমিই সে যাকে ভাবি দারোয়ান ভাবছে,আর ছাদেই বা কেম্নে যাই? তিন তলার ভাবি যদি চোরকে সনাক্ত করে ফেলে?
(সংগৃহিত /সম্পাদিত লেখাটি ২০২১ সালে ফেসবুকে প্রকাশিত)
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা জুলাই, ২০২৩ রাত ৯:৫৪